খান সেনারা হঠাৎ একদিন হামিদপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। আমি কোন উপায় না দেখে অতি চতুরতার সাথে শরীরে কাদামাটি মেখে নিজের জমিতে চাষ করতে যাই। সেখান থেকে একজন খান সেনা আমাকে আক্রমণ করে। তখন আমি হাত থেকে গরু তাড়ানোর লাঠি মাটিতে ফেলে দু হাত তুলে খান সেনার কাছে আত্নসমর্পণ করি। অতঃপর খান সেনা আমার গ্রামের নাম, মুক্তিবাহিনী এবং নিজে মুক্তি কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন উর্দুতে জিজ্ঞাসা করে। জিজ্ঞাসা করার পর আমি উর্দুতে সমস্ত কথা তাকে বুঝিয়ে দেই। কিন্তু খান সেনা অবিশ্বাস করে এবং আমাকে মুক্তি ধারনা করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। এরপর আমি মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ভাল করে পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত উর্দুতে ও বাংলাতে বলি। তারপর আমি আল্লাহর নিকট পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তানের সৈন্যদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। তখন খান সেনারা গুলি না করে আমার বাড়ীর ভিতর নিয়ে আসে। অতঃপর স্ত্রী পুত্র আছে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। স্ত্রীকে ডেকে আনে। ঐ সময় আমার ঘরের ভিতর একজন পাঞ্জাবী সৈন্য ডেকে নেয়। ঠিক ঐ সুযোগে ঐ খানটি আমার স্ত্রীর ৫ ভরী সোনার দুইটি বালা বাক্স খুলে নেয়। এরপর তারা ছেলের নাম জিজ্ঞাসা করে। তখন আমি পিস্তল ও জান্টার পর পর দুই ছেলের নাম বলি। তখন পিস্তলের কথা শুনে তারা পজিশন নেয় । আমি তাহা উর্দুতে বুঝিয়ে দেই। কারণ পিস্তল ও জান্টার আমার ছেলেদ্বয়ের ডাকনাম ছিল। এত বলা সত্ত্বেও খান সেনারা আমাকে ভারতের দালাল বলে বিবেচনা করে। আমি মুসলমান কিনা তা দেখার জন্য আমার লুঙ্গী খুলতে বলে। একজন বেলুচী সৈন্য তা নিষেধ করে। ঐ বেলুচী সৈন্যটি আমাকে বারবার সাহায্য করে আসছে। আমি তখন বলি যে, আপনি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেন। তবুও আমি নিজের ইজ্জত দেখাব না। আরও বলি যে, আমি যদি প্রকৃত মুক্তি হয়ে থাকি, তাহলে আপনাদের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চলুন। তিনিই বিচার করবেন। অতঃপর আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে এসে কিছু সময় পর দেখতে পাই যে হাত বেঁধে একটি ছেলেকে রাস্তার উপর নিয়ে আসছে। বিগ্রেডিয়ারের নির্দেশ মোতাবেক তাকে লাথি মেরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পরপর কয়েকবার বুট জুতার লাথি মেরে তাকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলে। এরপর আমাকে গুলি করার নির্দেশ দেয়। তখন আমি বলি খান সাহেব মৃত্যুর আগে আমি কয়েকটি কথা বলব, তখন আমাকে বলার জন্য সময় দেয়। অতঃপর আমি চতুরতার সাথে পাকিস্তানী জাতিয় সঙ্গীত গাই এবং পাকিস্তানী ফৌজ ও পাকিস্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করি। এরপর বিগ্রেডিয়ার আমার লেখাপড়া কতটুকু জানতে চায় আমি আরও চতুরতার সহিত বলি যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ব্রিগেডিয়ার বলে যে, তা হলে তুমি এত ভালো উর্দু কেমন করে শিখলে? জবাবে আমি বলি যে, ভাষা আন্দোলনের সময় উর্দু ভাষার উপর যখন জোর দেওয়া হয়েছিল, সেই সময় আমি উর্দু ভাষা শিক্ষা করেছি। বার বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর ব্রিগেডিয়ার পুণরায় গুলির হুকুম দেয়। তখন আমি কোন উপায় না দেখে বলি যে, খান সেনা আপনার মত আমারও একজন পাক ফৌজের ক্যাপ্টেন আছে। যার নাম কুদরতে খোদা (বাবলু)। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধে তিনি কুদরতে খোদা খেতাব পেয়েছেন। এই কথা শুনে তিনি ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করেন। এরপর সেখান থেকে সঠিক খবর নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেওয়ার পর খান সেনাদের সাহায্য করার কথা, পাকিস্তানের হেফাজতের কথা এবং মুক্তিদের খোঁজ খবর দেওয়ার কথা বলে। এরপর আমি বাড়ী চলে যাই।
এর কিছু দিন পর খান সেনারা নাড়ুয়া মালা হাটে জনসাধারণ নিয়ে মিটিং এর জন্য নাড়ুয়া মালা হাটে চলে যায়। মিলিটারির কথা শুনে হাটের লোকজন দৌড়ে চলে যায়। আমি একটি গ্রেনেড নিয়ে জঙ্গলের ভিতর শুয়ে পড়ি খানসেনারা সেখান থেকে আমাকে দ্বিতীয়বার ধরে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি কেন জঙ্গলের ভিতর। নিশ্চয়ই তুমি মুক্তিফৌজ এই বলে আমাকে গাড়ীতে তুলে পুনরায় হাটে নিয়ে আসে। হাটের ভিতর ব্রিগেডিয়ার জনসাধারণের মধ্যে ভাষণ দিলেন এই বলে যে, তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমারা আমাদের সাহায্য কর, মুক্তিফৌজের খোঁজ খবর দাও এবং ভারতের দালাল ধরে দাও ইত্যাদি বিষয়। এরপর আমি ব্রিগেডিয়ারের অনুমতি নিয়ে ঐ সমস্ত কথাগুলি পুনরায় বলি। আমি আরও বলি যে পাক ফৌজ কেন আমাদের মা বোনের ইজ্জত ধ্বংস করছে? তারা আমাদের হেফাজতের জন্য এসেছে। আমাদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে আমাদের উপর গুলি করা আল্লাহপাক বরদাস্ত করবে না। মুসলমানদের ধর্ম কি তাই? একজন নিরীহ লোককে হত্যা করা এটা বিধর্মীয় কাজ ইত্যাদি ভাষণ দেই। এই ভাষণ শুনে ব্রিগেডিয়ার আমাকে ডেকে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। ঘরের ভিতর নিয়ে জোর করে ৫০ টি টাকা বকশিস দিয়ে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করায় যে, আগামী কাল আমি যেন তাদের ক্যাম্পে দেখা করি। পরের দিন সেই মোতাবেক তার কথা ও ধর্ম রক্ষার্থে ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করি। তখন ব্রিগেডিয়ার বলে যে, তোমাকে ১০০০ (এক হাজার) করে টাকা দিতে ইচ্ছুক এবং সমস্ত বগুড়া জেলার রাজাকারের কমান্ডার বানিয়ে দিতে চাই, তুমি কি ইচ্ছুক? তখন আমি বলি যে, স্যার আমি রাজাকার হতে চাই না। এরপর আমাকে অনেকগুলি ৫০০ (পাঁচশত) টাকার নোট দেখায় এবং বলে যে, তুমি যদি রাজাকার কমান্ডার হও তাহলে তোমাকে বহু টাকা দেওয়া হবে। আমি সমস্ত কিছু অস্বীকার করে কোন রকমে বাড়ী চলে আসি। রমজান মাসে আমি নাড়ুয়া মালা হাট থেকে আসছিলাম। তখন দেখতে পেলাম একজন খানসেনা একটি লোকের নিকট থেকে জোর করে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। লোকটি তখন আমার কাছে ঐ কথা বলে দেয়। তখন আমি প্রতিবাদ করলে আমার পকেটে যত টাকা ছিল খানসেনা তা কেড়ে নেয়। গাবতলী বাজারের ভিতর এসে একখানা চাকু সংগ্রহ করি। অতঃপর বাজারের ভিতর খান সেনাকে রাইফেলসহ জড়িয়ে ধরি। অতঃপর আমি লোকজন ডাকলাম খান সেনাকে চাকু মারতে। কিন্তু কেউই আমাকে সাহায্য করতে আসল না। ১০ মিঃ আমাদের এ লড়াই চলে আমিও সুযোগ পাইনা চাকু মারতে। অতঃপর খান সেনাটি তার টাকা এবং তার সাথে আরও বিশটি (২০) টাকা দেয়। আমি খান সেনাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে প্রাণ বাঁচাই। এই রকম ভাবে আমি তিনবার খান সেনাদের হাতে নির্যাতিত হই। প্রত্যেক বারই আমি সাহস ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে রেহাই পাই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আজাদুর রহমান মণ্ডল
গ্রাম- হামিদপুর
থানা- গাবতলী
জেলা- বগুড়া
ইং ২৪/৯/৭৩