প্রবল গুলি ও গোলাবর্ষনের ভেতর দিয়ে বর্বর পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক সহকারে বগুড়ায় প্রবেশ করে। শুরু হলো নরপিশাচদের ‘বাঙালী চোষা’ বিহারী বেঈমান সহযোগে শহরের বুকে তান্ডব নৃত্য। লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুন, তৎসহ ধর্মীয় স্থান কলুষিত ও বিধ্বস্ত করায় মত্ত হয় তারা।
২৫ শে এপ্রিল রবিবার হঠাৎ করেই গ্রামের বাসা হতে গুলি ও ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনে বুঝতে দেরী হয়েছিলো না যে, পাকবাহিনী বগুড়া হতে বড় রাস্তা ধরে এদিকে এগিয়ে আসছে (সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়ার দিকে)। কিছুক্ষন পর দক্ষিন-পূর্ব কোণ হতে কালো ধোয়ার কুন্ডলী আকাশে উথিত হতে দেখা গেল। অনেকে বললেন কুমারেরা হাঁড়ি পোড়াচ্ছে। কিন্তু সব ধারনার অবসান হল তখনই, যখন শুধু এক জায়গাতে নয়, সমস্ত পশ্চিম দিক হতে ধোঁয়া আর আগুনের লাল আভা দেখা যেতে লাগল। যতই আধাঁর নামছিল আগুনের লেলিহান শিখা ততই প্রকট হয়ে ফুটে উঠছিল চোখের সামনে। আগুনের সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল উল্লাপাড়ার দিক হতে।
পরের দিন শুনলাম চাঁদাইকোনার প্রত্যক্ষদর্শীর এক বিবরণ। তারা লোকজন ডেকে এনে লুট করিয়েছে বাজার এলাকা। অনেক স্বেচ্ছায় এসেছে লুট করার লোভে। লুট করার সময় তারা ছবি তুলেছে। লুটপাট হয়ে গেলে আগুন ধরানোর পালা। আগুনও দিয়েছে লোকজনের সহায়তায়। আগুন ধরানোর সময় তারা ছবি তুলেছে। আর সব কাজ হাসিল করার পর বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবর্ষণ করে জনসাধারণকে করা হয়েছে হত্যা। এরকম আরও ঘটনা। খাওয়ানোর নাম করে ডেকে এনে লাইন করে গরীব গ্রামবাসী নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
পরের দিন শুরু হলো সিরাজগঞ্জে ঐ একই দৃশ্যের অবতারণা। ৩-৪ দিন ধরে চলে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, খুন ইত্যাদি। বাসার এত কাছে ঐ সব হচ্ছিল যে, ছাই এসে পড়ছিল বাসার মধ্যে। গ্রামের ও আশেপাশের অনেক লোক শহরে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। এর সংগে সংগে গ্রামে গ্রামে ডাকাতি, লুটতরাজ, রাহাজানি প্রকটভাবে দেখা দেয়। দিনে মিলিটারীর ভয়, রাত্রে ডাকাতের ভয় সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে। দিনে গ্রামছাড়া আর রাত্রে পাটের ক্ষেত – এভাবে প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে। দৌড়ানোর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়েছে।
একদিন শুনলাম মিলিটারী আসছে। তবুও থাকলাম বাসায়। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, কাছের এক হাট হতে আগুন আর ধোয়া। অনেকে পালিয়ে যেতে লাগল।গ্রামের কিছু দূর দিয়ে উঁচু মাটির রাস্তা। দাঁড়িয়ে ছিলাম মিলিটারীদেরকে দেখবার জন্য। দেখলামও, আমার কাছে ছোট একটা দূরবীন ছিল। তাই স্পষ্ট দেখলাম, একে একে ৭৯ জন সৈন্য পার হয়ে গেল। আমের সময় গাছে কাঁচা আম ছিল। তাই তারা খেতে খেতে চলছে। কি তাদের উল্লাস, এতটুকু অনুশোচনা নেই মনে তাদের এই ধ্বংসলীলার জন্য।
অবশেষে নানান কারনে সে গ্রাম আমাদের ছাড়তে হলো ২৬ শে মে বুধবার। নৌকায় চললাম উল্লাপাড়ার অভিমুখে। দুপুর ২ টার দিকে বুধগাছা নামক গ্রামে আশ্রয় নিলাম। যে বাড়ীতে ছিলাম সে বাড়ীর এক ছেলে সৈন্য বিভাগে কাজ করত। শুনলাম সে ছুটি নিয়ে এসেছিল। মার্চের পর পাক বাহিনীর পক্ষ হতে কাজে যোগ দেবার জন্য আবেদন আসে। কিন্তু বর্বর বাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে বাংলা মাকে উদ্ধার করার জন্য সে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে নি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দিয়েছিল।
ঐ বাড়ির ধারেই রাস্তা (বগুড়া- উল্লাপাড়া) । সাহস করে বসলাম এক গাছের ধারে। কিছুক্ষনের মধ্যে মোটরের শব্দ পেলাম। বুঝতে দেরী হলো না মিলিটারীদের গাড়ী আসছে। দেখলাম এক এক করে নয়খানা গাড়ী পার হয়ে গেল। কোন গাড়ীতে শুধু দু-একটা পেট্রোলের ড্রাম। আবার কোন গাড়ীতে মিলিটারী ও গোলাগুলির বাক্স। হাটের দিন দু’একজন করে পাকা আম,কলা এসব নিয়ে যেত হাটে। ওরা জোর করে কেড়ে নিত, আম কলা ইত্যাদি, পয়সা চাইলে মারার ভয় দেখাত।
পরের দিন ২৭ শে মে দুপুরের পর আর এক গ্রামে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, যুবক ছেলেদের জোর করে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। ভয় পেলাম শুনে। এ গ্রামে আসার পথে কিছুক্ষণ বড় রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটলাম খুব ভোরের দিকে। দেখলাম জ্বালিয়ে দেওয়া বহু বাড়ি। রাস্তা থেকে নেমে আধ মাইলের মত হেঁটে এসে বর্বরেরা পুড়িয়ে দিয়েছে বহু গ্রাম। রাস্তায় শুনলাম বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়ার কাহিনী। প্রথমে তারা নাকি কি একটা তরল পদার্থ ‘স্প্রে’ করত। তারপর একটা সাদা কাঠির মত জিনিসে আগুন ধরিয়ে ফিকে মারত ঘরের মধ্যে। আগুন ধরে যেত সমস্ত ঘরে। খেয়াল-খুশী মত দু-একটা বাড়ীও তারা বাদ দিয়েছে। মনে হয় খেলেছে তারা, আগুন আগুন খেলা।
যে গ্রামে আমরা থাকতাম, তার আশপাশের গ্রাম হতে ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে উল্লাপাড়া বাজারে খালের মধ্যে বুকজলে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। ট্রেনে করে যাতে মিলিটারীরা না আসতে পারে সে জন্য গ্রামের লোকজন লাইন তুলে ফেলেছে। ফলে তাদেরকে হারাতে হয়েছে ঘরবাড়ী।
মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মাঝে মধ্যেই রেল লাইন, ব্রীজ উড়িয়ে দিত। একদিন মোহনপুরের কাছে এক গ্রামে, রাত্রিবেলা দু’জন দালালকে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মেরে ফেলে। পরের দিন পাক সৈন্যরা সে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
২৬ শে জুন শনিবার আমি ও একজন লোক বগুড়া বাড়ী দেখবার জন্য রওনা হই। একটা বাস রাজশাহীর ও একটা বাস বগুড়ার ছিল। বাসে একটা পাঠান ব্যক্তি বাসের সমস্ত পয়সা নিত। কণ্ডাক্টরের হাতে লাগান ছিল শান্তি কমিটির লাল ব্যাজ। পথে মিলিটারীর যাতায়াত চোখে পড়ল।
১-৪৫ মিঃ বগুড়ার পুলিশ লাইনে গাড়ী সার্চ করবার জন্য থামান হয়। অনেকের সঙ্গে আমাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি। দেখলাম, পুলিশেরা রাইফেলের বাঁট (দুইজন) উপর দিকে ও নল নিচের দিকে দিয়ে পাহারা দিচ্ছে। ‘বগুড়া কারিগরি মহাবিদ্যালয়কে তারা ঘাঁটি বানিয়েছিল। শহরে ১৮% জন জনসাধারণ তখন এসেছে। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তার দু পাশের দোকান, বাড়ীঘর পোড়ানো। যারা বাইরে থেকে শহরে আসে, তখনই কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে তারা চলে যায়। বগুড়া জেলা স্কুল ও হয়েছিল তাদের ঘাঁটি। ঐ স্কুলের হোষ্টেলে বারান্দায় ব্যাটারী চার্জ দেওয়া হতো। ষ্টেশনে কোন বাঙ্গালীকে যেতে দেওয়া হতো না।
বগুড়া পিটি স্কুলের কাছে নামলাম ২-১০ মিঃ। নেমে হেঁটে বাড়ীর দিকে আসছি। বাড়ীঘড় পোড়া। রাস্তা জনমানবশূন্য। প্রায় ১ মাইল রাস্তার মধ্যে মাত্র ৪ জন লোকের সঙ্গে দেখা হয়। রাস্তা চলতে ভয় ভয় হচ্ছিল। যেখানে একদিন ছিল উৎফুল্ল প্রানের স্পন্দন, আজ সেখানে শুধু পোড়া মাটির স্তূপ। দেখে কান্না এসে যাচ্ছিল। বাড়ীর কাছে আসলাম, একই অবস্থা আমাদের বাড়ীর ও তবে সম্পূর্ণ নয়। কেননা জামায়াতে ইসলামীর এক লোক বেদখল করার জন্য বর্বরদের কাছে অনুরোধ জানালে তারা সম্পূর্ন বাড়ী ধ্বংস করেনি। প্রতিটি মন্দির ধর্মীয় স্থান তারা হয় ধ্বংস, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি একটুর জন্য প্রাণে রক্ষা পাই বিহারীদের হাত হতে, এক মুসলমান ভাইয়ের সহায়তায়। প্রাণ নিয়ে ফিরি ঐ গ্রামে।
কিছুদিন পর দালালদের ভয়ে ও নানান কারনে কোন গ্রামেই থাকা সম্ভপর না হওয়ার জন্য ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভারত অভিমুখে নৌকায় রওয়ানা হই। মাঝে মধ্যেই সিরাজগঞ্জ, পাবনার দিক হতে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসত।
৩রা সেপ্টেম্বর নৌকা থেকে দেখলাম কাজীপুর এলাকার অগ্নিসংযোগের দৃশ্য। ৪ দিন পর মানকর চরে (আসাম) পৌঁছাই যমুনা পথে।
স্বাক্ষর/-
শ্যামল রায়
মালতী নগর, থানা- সদর
জেলা-বগুড়া
১৬.৯.৭৩