You dont have javascript enabled! Please enable it! 1968 | প্রথম সরকারী প্রেসে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিলনা। আগরতলা মামলা। কামাল হোসেন - সংগ্রামের নোটবুক

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে আহমেদ ফজলুর রহমান সর্বপ্রথম আইনজীবির সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তাতে তিনি আমার নাম করেন। ১৯৬৭ এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ১৯৬৮ এর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে আমি জেলখানায় তার সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি জানালেন যে গ্রেফতারের পরপরই  তাকে ঢাকায় বনানীস্থ নতুন আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কয়েকদিন ধরে তাকে সেখানে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তার মাধ্যমে একটি ষড়যন্ত্র মামলায় কয়েকজনকে জড়াতে চেয়েছিলেন। যতই এসব আটকের ঘটনা ঘটছিল, উত্তেজনা ততই বাড়ছিল। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের আইনজীবীরাও গ্রেফতারের সম্ভাবনায় ছিলেন। ফজলুর রহমানের জন্য একটি হাবিয়াস করপাস (আদালতে বন্দী প্রদর্শন) আবেদন দাখিল করা হলো।

একই দিনে ব্যারিস্টার কে জেড আলম আমার কাছে এলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের পক্ষে একটি আবেদন জমা দেওয়ার জন্য। তাকে বলা হয়েছিল যে প্রত্যেক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা আইনজীবী কাজ করার জন্য। কারণ একই আইনজীবী সকলের পক্ষে লড়লে অভিযুক্ত ব্যক্তিগনের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ প্রতীয়মান হয় যা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলার ক্ষেত্রে পরিহার করা উচিৎ। পরে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের মামলাটি ইশতিয়াক আহমেদ পরিচালনা করেন। রুহুল কুদ্দুসের শ্যালক কামালউদ্দীন হোসাইন রুহুল কুদ্দুসের মামলার ভার নেন। যখন পিটিশনটি উচ্চ আদালতে গেল তখন সরকারী উকিলেরা এসে বললেন যে এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। জানুয়ারীর প্রথম দিকে প্রকাশিত প্রথম সরকারী প্রেসে অভিযুক্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল না। প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম বার আসে জানুয়ারীর ২০ তারিখে প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক প্রেস রিলিজে।

পরবর্তী ৫ মাস অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পুরো মামলাটি রেখে দেওয়া হলো। অভিযুক্তদের অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া হল না। এদেরকে জেল থেকে মিলিটারি জিম্মায় পাঠানো হয়েছিল। বিচার কার্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পরিচালনার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারী করা হলো। সেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট এর বিচারক এস এ রহমান, এবং হাই কোর্টের দুজন বাঙালি বিচারক এম আর খান এবং মাকসুমুল হাকিম। একেবারে শুরু থেকেই বুঝা যাচ্ছিল যে মামলাটি রাজনৈতিক। মামলাটির প্রধান প্রমাণ ছিল কয়েকজনের সাক্ষ্য যাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ছিল এবং বিচারের সময় এরা ‘বিরূপ’ স্বাক্ষীতে পরিণত হচ্ছিলেন।

বিচার শুরু হবার কিছুদিন পর টম উইলিয়ামস কিউসি এমপি নামের একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারকে লন্ডনস্থ বাঙালিরা ঢাকায় পাঠালেন বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর দলে যোগ দেবার জন্য। সালাম খানের নেতৃত্বে পুরো দলটি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক করা হল যে টম উইলিয়ামস দু’একদিনের মধ্যে বিচারকার্যের ক্রস পরীক্ষণ করবেন এবং এরপর তিনি হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করবেন। আমি উইলিয়ামসের সাথে রিট প্রস্তুতিতে লেগে গেলাম এবং একটি খসড়া প্রস্তুত করা হলো। পিটিশনটি উইলিয়ামস পরিচালনা করলেন এবং হাইকোর্ট একটি রুল জারী করলেন। অবশ্য উচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিলেন না। ঐ সময়টায় উইলিয়ামস অভিযোগ করলেন যে তাঁকে পুলিশ এবং গোয়েন্দা লোক দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আইয়ুবের নজরদারীতে রাখা হয়েছে। তার গাড়ি অনুসরণ করা হচ্ছিলো এবং সবচেয়ে খারাপ ঘটনার মধ্যে ছিল তার ঘরে অনুপ্রবেশ করে লাগেজ এবং কাগজ পত্র তছনছ করা। সপ্তাহখানেক কাটানোর পর তাকে আয়কর পরিশোধের নোটিশও দেওয়া হয়েছিল আর ভীষণ রকমের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। টম উইলিয়ামসের ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া উচিত বলে সবাই ঐক্যমত্য প্রকাশ করলেন। তার আগমন এবং মামলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্য মিটে গিয়েছিল। টাইমস (লন্ডন) এর নতুন প্রতিনিধি পিটার হাজেলহার্স্ট এই মামলা এবং টম উইলিয়ামসের ভোগান্তির ওপর সিরিজ রিপোর্ট করে এতে সাহায্য করেছিলেন।

মামলার অগ্রগতি এবং বিচারকার্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জনগণের কাছে প্রবল আগ্রহের বিষয় ছিল। আইয়ুব খান যদি ভেবে থাকেন যে এই মামলা শেখ মুজিবের জন্য অমর্যাদাকর হবে তবে ফল হয়েছিল ঠিক উল্টো। বাঙালির অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে শেখ মুজিব অত্যাচারিত হচ্ছেন বলে তিনি আরো সহানুভূতি পেতে লাগলেন। বাঙালির দুর্দশা ব্যাপক প্রচারও পেয়েছিল এবং এতে তাদের বঞ্চনার বোধও তীব্র হচ্ছিল।

  • Dr Kamal Hossen Interview, 1974