বঙ্গবন্ধুর পার্সনাল এইড হাজী গােলাম মােরশেদের সাক্ষাৎকার
হাজী গােলাম মােরশেদ। নামটি আমি প্রথম শুনি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার সাথে থেকে যান। ঐ কালাে রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও ৩২ নং রােডের বাসগৃহ হতে কারাবন্দি হন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকাধীন মােরশেদ সাহেবের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি মুক্তি লাভ করেন ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১। ওনার উদ্যোগে ও অনুরােধে, ভারতীয় সেনার বঙ্গবন্ধুর গৃহবন্দি পরিবারকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রােডের বাড়ি থেকে মুক্ত করে, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। কিশাের বয়স হতে রাজনীতির সাথে জড়িত হাজী গােলাম মােরশেদের জীবন বর্ণাঢ্য ঘটনামালায় ভরপুর। বরেণ্য ও শক্তিধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন; সাক্ষী হয়েছেন এমন সব ঘটনাবলির যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভবিষ্যতের সত্যান্বেষী-বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচয়িতাদের ইতিহাসকে আলােকিত করতে পারে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছ থেকে ওনার নাম ও ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে, পরদিন ওনাকে ফোন করি। উনি সাথে সাথেই ওনার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। পুত্রবধূ প্রিয়াংকার ভিডিও ক্যামেরাটি নিয়ে ওনার ঢাকার আসাদগেটের বাড়িতে যখন পৌছি তখন বিকেল তিনটা। পেরিয়ে গিয়েছে। উনি খাটের ওপর আধশােয়া অবস্থায় স্ত্রী, কন্যা, জামাতা ও পরিবারবর্গ পরিবৃত অবস্থায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি উপভােগ করছিলেন। আমাকে সাদরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, যেন বহুদিনের চেনা। এক নিমিষে আপন করে নেওয়ার মতাে গুণাবলি সমৃদ্ধ এই অশীতিপর মানুষটির অভিব্যক্তি ও আচরণে তারুণ্যর উদ্দীপনা স্পষ্ট। রসিকতা করেন স্বাচ্ছন্দ্যে। রসালাপে যে কোনাে আলােচনাকে করে তােলেন প্রাণবন্ত।
স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। কালের গর্ভে নিমজ্জিত ইতিহাসকে বর্ণনা করেন এমনভাবে, যেন মাত্র সেদিনের ঘটনা। সত্য বলেন নির্দ্বিধায়, কোনােরকম রাখ ঢাক ছাড়াই। ভিডিওতে ধারণকৃত ওনার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষ তুলে ধরা হলাে : আসসালামু আলাইকুম। চাচা আপনার পুরাে নামটি বলবেন? আমার নাম মহম্মদ গােলাম মােরশেদ। আমাকে হাজী মােরশেদ নামেই সবাই চেনে। চাচা আপনি যদি একটু শুরু করেন সেই সময়ের ঘটনা থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলছিলেন যে রাত সাড়ে দশটার দিকে উনি এবং ড. কামাল হােসেন, ২৫ মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলেন। যেয়ে দেখলেন যে ডাইনিং টেবিলে বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনি বসা। ওখান থেকে আপনি কি স্মৃতিচারণ করবেন ? যখন আমীর-উল আসল, তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাবার চেষ্টাই সে করল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন যে তিনি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছেন আগেই। তার আগেই উনি বলে দিয়েছেন, “If they don’t get me, they will massacre all the people and destroy the city.” Wala RCA হয়েছে যে এটা তার ও আমার জীবনের শেষ রাত্রি। স্বাধীনতার Key লগ্ন যাকে বলে। লগ্ন শুরু হলাে। বঙ্গবন্ধু আমাকে অনেক দিন আগে একটা নির্দেশ দিয়েছিলেন যখন কোনাে ডিসিশন নিয়ে ফেলব, তুমি কখনাে আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করবার চেষ্টা করবে না। তার আগে তিনি বলেছেন, “তুমি আমার সবচেয়ে কাছে থাক, তার ফলে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারি।’ ২৫ মার্চ রাতে তাহলে আমি সকাল থেকে বলি।
প্রতিদিন সকালে আমি চলে আসতাম। সারাদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকতাম। অনেক রাত হলে চলে যেতাম। এটা আমার রুটিন ছিল। আপনার বাসা কোথায় ছিল? কাকরাইলে বাসা ছিল। আমার একটা গাড়ি ছিল ঢাকা গ, ওয়ান। ঐ গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু আমার সাথে যেতেন। বঙ্গবন্ধু প্রেফার করতেন আমার সাথে যাতায়াত কী গাড়ি ছিল ? টয়ােটা সেমি ডিলাক্স। এটা কিনেছিলাম হীলু ভাইয়ের কাছ থেকে। উনি ঢাকার মােত্তালিব কলােনির মালিক ছিলেন। ইস্টার্ন হার্ডওয়ারের মালিক। সিক্সটি নাইনে হজ থেকে ফিরে আসার পর গাড়িটা কিনি। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে আপনার সাথে ঐ গাড়িতে যেতেন? মাঝে মাঝে না ডেইলি। কোথায় যেতেন। আওয়ামী লীগ অফিসে। আর বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে যেতাম। একবার নড়াইলে গেলাম। তখন তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই আমাদের সাথে। গাড়ির কী রং ছিল ? সাদা আচ্ছা ! এখন মনে পড়ে সাদা টয়ােটা গাড়ি! হ্যা। তােমাদের বাড়িতেও ঐ গাড়ি গিয়েছিল। মুজিব কাকু এ গাড়ি করে আসতেন আমাদের বাসায়। হ্যা, ঐ গাড়িতেই উনি আসতেন। তােমার মা কাবাব বানিয়ে আমাদেরকে খাওয়াতেন। তখন ২৫ মার্চ সকাল বেলায় কী হলাে?
আমি আসলাম নয়টার দিকে। এরপর ওসমানী সাহেব আসলেন (জেনারেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী), শেখ আব্দুল আজীজ ভাই আসলেন। তারপর তাজউদ্দীন ভাই তাে এসে এক দুঘন্টা করে থাকতেন ডেইলি। পেপার তৈরি করা, স্টেটমেন্ট তৈরি করা, ইভ্যালুয়েট করা এ সমস্ত ওনাকেই করতে হতাে। He was one dynamo behind শেখ মুজিবুর রহমান। আনসার ডাইরেক্টর আব্দুল আউয়াল সাহেব বললেন যে আনসার বাহিনীর আর্মস-অ্যামুনেশন আছে। এটা প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্টের পুলিশ লাইনে মালখানায় জমা আছে। উনি একসময় যশােরের এসপি ছিলেন। আমার সাথে সেই জন্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আমি তখন যশাের মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। উনি এই অ্যাডভাইসটা দিলেন। আমি এই ব্যাপারটা সিরাজুল আলম খানের সাথে আলােচনা করলাম যে আমাদের তাে অ্যামুনেশন দরকার। প্রত্যেক আনসারের জন্য যে একটা বিরাট আর্মস, বিরাট অ্যামুনেশন, প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারে আছে, আউয়াল সাহেব ত্যাডভাইজ করেছেন যে ওটা আমাদের লােকজনদের ভেতর যেন ডিস্ট্রিবিউট করে দেই। সিরাজুল আলম খান সাহেব হেসে উড়িয়ে দিলেন কথাটা। এরপরে আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম।
বঙ্গবন্ধু ওসমানী সাহেবকে বললেন মুরশেদ কী বলছে, আপনি শােনেন।’ ওনাকে মুরশেদ নামেও অনেকে সম্বােধন করে থাকেন।] আমি ওসমানী সাহেবকে বললাম। উনি বললেন ‘দেখি চিন্তা করে। এরপর দুপুর হয়ে গেল। বাসায় ফিরব খাওয়ার জন্য। ওসমানী সাহেব আমাকে বললেন, ‘আমাকে একটা লিফট দেন।’ ওসমানী সাহেবকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৬ কি। ৫ নম্বর রােডে সামাদ সাহেবের (আবদুস সামাদ আজাদ) বাড়িতে নামালাম। ওসমানী সাহেব আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভিতরে। ওখানে দুপুরে খেলাম। নামাজ পড়লাম। তারপর। তিনটা চারটার দিকে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। এক বালুচ নবাব এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওনার সাথে কথা বললেন। পাঁচটার দিকে আমি ঘরে ঢুকলাম। বঙ্গবন্ধু ও আমীর-উল (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম) বসে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে তােমাকে একটু ঢাকার এসপির কাছে যেতে হবে।’ আউয়াল সাহেব সাথে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তােমরা দুজন ঢাকার এসপিকে বল আর্মস ও অ্যামুনেশন যেন ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করে।’ রাজারবাগে (পুলিশ লাইন) সব আর্মস ও অ্যামুনেশন। রাজারবাগ তখন ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ হেড কোয়ার্টার ছিল। আমরা তখন সার্কিট হাউসের সামনে ঢাকার এস.পির বাড়িতে গেলাম। উনি একটু অসুস্থ ছিলেন। উনি আসলেন। আসলে আমি বললাম। আউয়াল সাহেব ডিটেলস বললেন। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে রিপাের্ট করলাম। তখন আমীর-উল বলল, মুরশেদ ভাই যশােরে খবর দেওয়া দরকার। মশিয়ুর রহমান সাহেবকে একটু খবর দেন। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকালাম। বঙ্গবন্ধু বললেন যা’। তখন আমি বাসায় চলে আসলাম। বাসায় চলে এসে যশােরের মশিয়ুর মামাকে (যশাের আওয়ামী লীগের সভাপতি, শহীদ মশিয়ুর রহমান) ফোন করলাম। সেখানে রওশন আলী সাহেব, তবীবুর রহমান সাহেব এম, এল, এ, এম.পি সবাই ছিলেন। তাে বলে দিলাম যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে পুলিশ লাইনে যত আর্মস ও অ্যামুনেশন আছে সেগুলাে ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়ার জন্য। আমাদের স্বাধীনতার সমর্থকদের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউট করার কথা বলেছিলেন ?
পুলিশ ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করার কথা বলেছিলাম। বাঙালি পুলিশের মধ্যে। পুলিশ লাইনের প্রায় সমস্তই বাঙালি। দু-একজন হাবিলদার বাদে। ওদের কাছে অস্ত্র থাকত না । , ওরা রেস্টে থাকে। পুলিশ লাইনে সাধারণত আন-আর্মড থাকে। আচ্ছা, তাই, মালখানা থেকে তুলে তাদের হাতে যেন অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় ? হ্যা, ডিস্ট্রিবিউট যেন করা হয়। আমীর-উলই বলল, “মুরশেদ ভাই এখান থেকে ফোন করা তাে অসুবিধা, আপনি আপনার বাসায় যেয়ে ফোন করেন। কারণ এটা গােপন ব্যাপার হ্যা। তখন আমি আমীর-উলের অ্যাডভাইজ মতাে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় চলে গিয়ে ফোন করলাম। তখন আটটা সাড়ে আটটা বাজে। এটা ২৫ মার্চ রাতে ? হ্যা ২৫ মার্চ রাতেমাই গুডনেস, এটা তাে সাংঘাতিক! এরপর আমার মা আবার মারা গিয়েছেন ৩ ফেব্রুয়ারি সে বছরেই। মার জানাজায় মুজিব ভাই, তাজউদ্দীন ভাই সবাই এটেন্ড করেছিলেন। আমার বড়ভাই (আতিউর রহমান) তখন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বাের্ডের। হাতিরপুলের বাসায় থাকতেন। (সেখানে জানাজা হয়) যখন আমি বের হলাম তখন (রাত) সাড়ে নয়টা বাজে। মার কবর জিয়ারত করার জন্য। বেরিয়েছি, তারপর মুজিব ভাইয়ের বাসায় যাব। এসে আমি দেখি শাহবাগের মোড়ে ব্যারিকেড। ফেলা হচ্ছে। তখনাে দশটা বাজেনি, দশ বাজে বাজে করছে।
ব্যারিকেড ফেলছে আমাদের ছেলেরা ? হ্যা। আমাদের ছেলেরা ব্যারিকেড দিচ্ছে। তখন আজিমপুর গােরস্থানে যাওয়া অ্যাবানডান করে, এয়ারপাের্ট রােডটা খালি পেলাম সেই এয়ারপাের্ট রােড দিয়ে সােজা চলে আসলাম। চলে এসে দেখি সামনে আবার ব্যারিকেড। তখন বাঁয়ে গ্রিন রােডে ঢুকলাম। ঢুকে যেয়ে একটা গলি। দিয়ে কলাবাগানের ভেতর দিয়ে আমি মিরপুর রােডে উঠলাম। আমার সামনে ধড়াস করে একটা গাছ পড়ল। দেখি কুড়াল হাতে রাশেদ মােশাররফ (মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফের ভাই)। আমরা রাস্তায় আটকে গেলাম। রাস্তায় আটকে গেলে রাশেদ মােশাররফ ছুটে আসল। আমাকে আবার নানা বলে। বলে নানা এ দিকে তাে রাস্তা বন্ধ। তাে এদিক দিয়ে যান।’ আমাকে আট নাম্বার (ধানমণ্ডি) রােড দিয়ে যেতে অ্যাডভাইস করল। তাে আমি আট নাম্বার রােডে ঢুকে, ঐ ব্রিজটা পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গাড়িটা রেখে সােজা ছুটে গেলাম। নিচে কেউ নেই। (হাজী মুরশেদ সাহেব জানান যে, সে রাতে বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে শিশু রাসেল ও বেগম মুজিব ছিলেন। বাকি চার ছেলেমেয়ে বাসার বাইরে ছিল)। শুনসান ? শুনসান। শুধু পুলিশের একটা দারােগা ছিল, সেই দাড়িয়ে ছিল। ভেতরের বারান্দার সামনে। আমি সােজা ওপরে উঠে গেলাম। ওপরে উঠে দেখি বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে বসে আছেন। আমি ঢােকার সাথে সাথে বললেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।
They are coming to arrest me. I have decided to stay.’ ঠিক এই তিনটা কথা উচ্চারণ করলেন। তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে? হা। এ রকমই। ড. কামাল ও আমীর-উল কাকু তােওরা একটু পরেই আসল। বঙ্গবন্ধু কোথায় বসা ? ওপরে বেডরুমে বসাছিলেন। আমীর-উল কাকু ও ড. কামাল হােসেন কি বেডরুমে গেলেন ? , ওনারা নিচের বারান্দায় আসলেন। তারপরে নিচের টেবিলে বসলেন। আপনারা কি তখন নিচে নেমে এসেছিলেন ? হ্যা, আমি তখন ওপর নিচ করছি। প্রচুর টেলিফোন আসছে। মওদুদ (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ) ফোন করে বলল যে হাজী ভাই পালান। তারপর সিরাজুল হক সাহেবের (অ্যাডভােকেট, এম,সি,এ) স্ত্রী বললেন যে, মুজিব ভাইকে বলেন যে পালিয়ে যেতে, ওরা মেরে। ফেলবে। তারপর সুবােধ মিত্র ছিলেন যশােরের এম.সি,এ তিনি বললেন আপনারা পালান। আপনি উপর নিচ করছিলেন ? উপরেও টেলিফোন, নিচেও টেলিফোন। দুইটা লাইন? ২টা টেলিফোন। মুজিব ভাই কোনাে টেলিফোন ধরছিলেন না। তারপর এই সময় আমীর-উল আসল। কামাল হােসেন তাে অ্যাগ্রেসিভ টাইপের না। খুব নরম সরম। মানুষের ভিড়ের বাইরে থাকতেই পছন্দ করতেন। আমীর-উল ছুটে আসল। ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলল। ঐ সময়টায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার যেন কেন। আবারও ছুটতে হলাে। তাে ওর সাথে কী কী কথা হলাে এটি আমি শুনিনি। আর তখন শুনবার মতাে মনের অবস্থাও না। এরপরে বীবুর রহমান আসল। তবীবুর রহমান হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মতাে লম্বা সাইজ। পরে ডাইরেক্টর অব পাবলিক কমিশন হয়। সে এসে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “মুজিব ভাই, পালান।
ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে।’ তখন কী বলল সেটা শােন ‘if they don’t get me, they will massacre all the people, all my people and destroy the city’. এরপরে রাত এগারােটা বেজে গেল, বারােটা প্রায় বাজে বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল। বলে ‘আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম, বললাম যে ফোন এসেছে- ‘মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে আমি কী করব? উনি বললেন, ‘মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল।’ বঙ্গবন্ধু বললেন মেশিন ভেঙে পালিয়ে যেতে। আমি তাকে (বার্তা প্রেরক) সে কথা বললাম। রাত কটায় এ কলটা আসে? Around Twelve (am). আমার হাতে একটা ঘড়ি ছিল। ঘড়িতে দেখলাম একটা দশ-পনেরাে হবে, সে সময় চারদিক আলােকিত হয়ে গেল। পরে শুনলাম ট্রেসার বুলেট বলে ওকে। আমি তখন নিচ ওপর করছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, “কোনদিক দিয়ে এই গুলিগুলাে আসল?’ আমি একটি দিক দেখিয়ে দিলাম। আমারও তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। তারপর বঙ্গবন্ধু আবার ওপরে চলে গেলেন। এরপর আমি ফোন ধরে কথা বলছি- তখন একটা কথা শুনলাম হ্যান্ডস আপ’। তারপর আমি হাত উচু করে ফেললাম। তারপর আর একজন আওয়াজ করল ‘মাত মার। কিন্তু তার আগেই আমার মাথায় আঘাত লাগল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
Oh, My God! এরপর যেটা শুনেছি। স্বাধীনতার পরে পাশেই এ.কে মােশাররফ হােসেন সাহেব থাকতেন, পরে খালেদা জিয়া বা জিয়াউর রহমানের মিনিস্টার হন- কেমিক্যাল কর্পোরেশনের ডাইরেক্টর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পশ্চিমের বাড়িতে থাকতেন। উনি ব্যালকনিতে শুয়ে সব দেখছেন। আমাকে যখন রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে- তখন বঙ্গবন্ধু নিচের বারান্দায় এসে গিয়েছেন এবং আমাকে এই অবস্থায় দেখে বলেছেন, ‘How dare you hit him ? I want him alive.’ এই শব্দটা উনি এমনভাবে আওয়াজ করেছিলেন যে উনি পাশের দোতলার ভেতর। থেকে শুনতে পেয়েছিলেন। আপনি জ্ঞান ফিরে কী অবস্থায় নিজেকে দেখতে পেলেন? তখন আমি গােঙাচ্ছি। দেখি- মাটিতে শুয়ে আছি। পরে রমার কাছে শুনেছি ওটা সংসদ ভবনের সামনের মাঠ। রমা ও বুড়িকেও ওখান থেকে উঠিয়ে নিয়েছিল। ও, সেই বুড়ি! শেখ সাহেবের বাসায় যে কাজ করত আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসত। হ্যা। আর রমা মানে রহমান নামে যে ছেলেটা কাজ করত। এই আমাদের তিনজনকে একটা ট্রাকে নিল। আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা কীভাবে নিয়ে গেল আমি জানতে পারিনি। এরপর সংসদ ভবনে রাখল। রেখে আর একটা গাড়িতে সূর্য ওঠার আগেই আমাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিয়ে গেল। আমি তখন শীতে কাঁপছি। দাঁত কটকট করছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। তখন আমার জ্ঞান এসেছে। আমাকে বসিয়ে রেখেছে। তারপর আমাকে বলছে নজর নিচে রাখি।’ চোখ নিচে রাখ। আমাকে দেখতে দেবে না। এই সময় আজান হলাে। আদমজি পাবলিক স্কুলের সামনে ছােট ট্রাকে আমাকে রেখে দিল। তারপর অফিসে কিছুক্ষণ রাখল। তারপর সিএমএইচে (Combined Military Hispital) আমাকে ভর্তি করে দিল। সি.এম.এইচে দুদিন থাকার পর, মেজর এসবি রহিম তিনি ডাক্তার ছিলেন, ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হকের সূত্র ধরে ওনাদের সাথে আমাদের অ্যাকুয়েনন্টেনস ছিলসিলেটের জায়গির বাড়ির জামাই- উনি আমাকে দেখতে আসলেন। দেখে বললেন, ভাবিকে খবর নিয়ে দেব।’ উনি চলে যাচ্ছেন। এমন সময় এক সিপাই তাকে চ্যালেঞ্জ করল- “কিউ উসকা সাৎ বাৎ কিয়া ? মানা হ্যায়।’ কেন ওর সাথে কথা বললে ? কথা বলা নিষেধ। উনি কী জবাব দিয়ে চলে গেলেন। একটা সিপাই একটি মেজরকে থ্রেট করল।
যেহেতু তিনি বাঙালি। হ্যা তিনি বাঙালি। এরপর দুই তিনদিন ওরা আমাকে হাসপাতালে রাখল। এরপর একটা কাঠের শেডে নিয়ে গেল। সেখানে আরও তিরিশ-চল্লিশ জন বন্দী ছিল। সেখানে মেঝের ওপর আমাকে শুইয়ে রাখল। এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকলাম। একটা ঝড় হলাে কাঠের শেড ভেঙে গেল। পাশের একটা গােডাউনে নিয়ে গেল। এই সময় আমাদের পায়খানা পেশাবে কোনাে পানি দিত না। একটা থালার মধ্যে ভাত আর কিছু ডাল দিয়ে দিত- দশজন খেত এক থালার ভাত। ক্ষুধার যন্ত্রণা সে সময় উপলব্ধি করলাম। তখন থেকেই নিয়ত করলাম যে ক্ষুধার্ত মানুষ আমার কাছ থেকে না খেয়ে যেন ফেরত না যায়। আহ্। এরপরে একই কাপড় একই জামা। যখন রক্তাক্ত অবস্থায় সি.এম.এইচে ভর্তি হলাম, তখন পায়জামা-পাঞ্জাবি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। একটা সিপাই যে পাহারা দিচ্ছিল, সে তার সালওয়ার কামিজ আমাকে দিল। ওটা বদলে ফেললাম। এই সালওয়ার কামিজ দিয়েই আটমাস চলে গেল। (স্ত্রীকে লক্ষ করে) আছে না সেই সালওয়ার কামিজ ? স্ত্রী, হাজজা রােকেয়া মােরশেদ : হ্যা আছে। আর যেটার মধ্যে খেতে দিত। ও রকম সেইম আমরা একটা কিনে রেখেছি। যদি থাকে আমাকে একটু দেখিয়েন। তারপর কী হলাে চাচা ? তারপরে যে আসে সেই বলে “মুজিব কা সেক্রেটারি,মুজিব কা ড্রাইভার’ এই বলে পিটায় আর চলে যায়। এর পরে ইন্টারােগেশনের জন্য নিয়ে গেল আর একটা ব্যারাকে সেখানে নীল গ্লাস ওয়ালা ঘর- সেখানে পুরাে উলঙ্গ করে পেটাতে লাগল,তারপর জুন মাস পর্যন্ত এ ভাবেই চলল মারে যতক্ষণ না অজ্ঞান হই ততক্ষণে মারে। ঠিক মনে হয় যে সময় জান বেরিয়ে যাচ্ছে,সে সময় মার বন্ধ করে দেয়। তারা এত ট্রেনড। তারপরে বলে, বাতাও’। আমি বলি কেয়া বাতায়গা ? আমাদের তাে গােপন করার কিছু ছিল।
আমরা তাে কিছু গােপন করিনি। আমাদের তাে কোনাে প্রিপারেশন ছিল না। আবেগ ছাড়া। কয়েকটা লগি আর চায়নিজ কুড়াল ছাড়া আমাদের আর কিছু ছিল না। অবশ্য সিরাজুল আলম খানদের একটা প্রিপারেশন ছিল। জুন মাসে আমাকে অর্ধমৃত অবস্থায় ৬ দিন হাসপাতালে রেখে দিল। এর মধ্যে আগস্টের দিকে কিছু মানুষ ছাড়া আরম্ভ করল। তখন খালেক ভাই বলে টি.এন্ড.টির এক পিয়ন বাসায় খবর দিল। সে আমার জন্য একটা লুঙ্গি ও একটা গেঞ্জি বাসা হতে নিয়ে আসল। তারা সেটা রাখতে দিল। আগস্ট মাসের ছয় তারিখে মেজর ফারুকী আসল আমাকে দেখতে। বলল কাল সুভা তােমাকো লে যায়েগে, তোমকো গাওয়াই দেনা পরেগা’। বললাম কেয়া গাওয়াই দেগে ? বলল ‘যাে জানতা হ্যায়।’ আমি বললাম, “যাে জানতা হ্যায়- আপলেগ যাে বলেগা, ওহি বলনা পরেগা’। (মেজরের উত্তর) ‘নেহি যাে জানতা হ্যায়, ওহি বলেগা’। (রােকেয়া মােরশেদ সেই নমুনা টিনের পাত্র নিয়ে আসলেন। এরকম পাত্রে বন্দী অবস্থায় খাবার দেওয়া হতাে।) এটার মধ্যেই খাবার দিত?
হা। শেষের দিকে। এটার অর্ধেকের কম ভাত দিত। আর সন্ধ্যায় যেটা দিত সেটা আধা সেদ্ধ কুমড়াের তরকারি বা কিছু টেস্টলেস। কোনমতে বাঁচিয়ে রাখা সেই আরকি আবার যদি পেশাব লাগত। রাত্রে এটাতেই পেশাব করতে হতাে। তারপর পানিও খেতে ভয় পেতাম। তারপর কোন পর্যন্ত বললাম ? অগাস্টে আমাকে গাওয়াই (সাক্ষী) দিতে হবে। তখন আমি মনে মনে ঠিক করলাম- প্লেনে তাে আমাকে নিয়ে যাবে। তখন বাথরুমের ভেতর দিয়ে ইন্ডিয়ান ওশানে ঝাঁপ দিয়ে পড়ব। এ ছাড়া আমার আর কোনাে উপায় নেই। যখন মনে মনে ঠিক করলাম তখন মনটা শান্ত হয়ে গেল। ডেসপারেশন থেকে এই চিন্তাটা আসল। হা। স্বাক্ষী দিতে যাওয়া মানে- কী সাক্ষী ? মুজিবের বিরদ্ধে সাক্ষী দিতে বলবে। তারপর যে টর্চার করবে,সেই টর্চারের ফলে যা বলবে, তাই বলতে হবে। হ্যা সেটাই। এরপরে ওরা আর নিয়ে গেল না। আর আসল না। আমাকে একটা বড় ডায়েরি লেখার মতাে বই দিল। বলল তােম যাে জানতা হ্যায় বােল- লেখ । তােমাৱা যিন্দেগিক শুরু সে লেখ। পেনসিল দিল। তাে- শুরুতেই লিখতে থাকলাম। আপনার কোন ইয়ারে জন্ম ? সাটিফিকেটে ও পাসপাের্টে থারটি টু। অ্যাকচুয়ালি থারটি ওয়ান। 10th December, 1931. আমাদের দেশে তাে বয়স চুরি করা হয়। তারপর কী হলাে? ২৫ সেপ্টেম্বর আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ট্রান্সফার করল। আমাদের ঐ ক্যাম্পটাই খালি করে জেলখানায় পাঠিয়ে দিল। জেলখানায় যেয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম ছয় মাস পর। মনে হলাে যে বেহেশতে আসলাম। তখন আমার চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছে। জেলখানায় থাকতে থাকতে এখন যেখানে নির্বাচন কমিশন সেখানে আমাকে নিয়ে আসল। মেজর ও তিনচার জন আমাকে বলল কী কী জান আমাদেরকে বল। ওরা কথা বলত তুমি করে।’ আমি বললাম যা জানি তা তাে বলেছি। তারপর আবারও কিছু কিছু বললাম। কয়েক মিনিট পরে বলে যাও’। জেলখানায় ফেরত পাঠিয়ে দিল। ২৫ নভেম্বর আমাকে ছেড়ে দিল। আপনার পরিবার পরিজন- যখন জেলে ছিলেন ? আমার বড় বােন, আমার স্ত্রী দুই তিনবার ঢাকা জেলে আমার সাথে দেখা করে এসেছে। (স্ত্রী রােকেয়া মােরশেদকে লক্ষ করে) তখন আপনার মনােভাব কী ছিল? উনি ছাড়া পাবেন কি না ? উনি ছাড়া পাবেন,এই আশা নিয়েই তাে বেঁচে ছিলাম। তারপর কাশেম সাহেব একটা চিঠি দিলেন যে হয় ওনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন না হয় ছেড়ে দেন। উনি এসব (রাজনৈতিক) ব্যাপারে জড়িত না। মিস্টার কাশেম, মালেক (গর্ভনর) কেবিনেটের মিনিস্টার ছিলেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার বশীরকে চিঠি দিলেন। বিগ্রেডিয়ার বশীর ঢাকার ইনচার্জ ছিলেন। আবুল কাশেম সাহেব Former Deputy Speaker of Pakistan- ময়দুল ইসলামের বাবা। উনি একটা চিঠি দিলেন যে He is a deeply religious man.He has no conncetion with politics, রিলেশনশিপের কারণে সে শেখ মুজিবের বাড়িতে যেত। পরে সেই চিঠির কপি ওর থেকে (স্ত্রীকে লক্ষ করে) পেয়েছিলাম।
কাশেম সাহেব ব্রিগেডিয়ার বশীরকে চিঠিটি দিলেন এবং ওটার ভিত্তিতে আপনাকে ছেড়ে দিল ? সম্ভবত প্লাস গভর্নর মালেকের ছােট ভাই আমাদের কাজিন। তিনি আমাদের ভগ্নীপতিমুজিবর রহমান মালেক- টিপু মালেকের আব্বা। আপনি যখন ছাড়া পেলেন তখন তাে আপনার অবস্থা খুবই শােচনীয়। তখন কী ট্রিটমেন্ট চলল? রােকেয়া মােরশেদ ; না তখন তাে ট্রিটমেন্ট সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ চলছে। আমরা কাকরাইলে বাসা ভাড়া দিলাম। যখন উনি বাড়িতে এসেছিলেন- বাসায় বসে থাকতেন। বের হবার ক্ষমতা ছিল না। উনি থরথর করে কাঁপতেন। পা দুটো কাঁপত। দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। খেতেও খুব কষ্ট হতাে। ডিসেম্বরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন উনি মােনাজাত শুরু করলেন যাতে দেশটা স্বাধীন হয়। তারপর কীভাবে আপনার সাথে বেগম মুজিবের দেখা হলাে ? ১৭ ডিসেম্বর সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ে আমার মামাতাে ভাই আবুল ইলিয়াস মজিদ,উনি তখন ব্রিটিশ কোম্পানি এভারি স্কেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। এখন আটলান্টায় থাকেন। ওনার গাড়ি করে ভাবি যেখানে বন্দী আছে সেটা খুঁজে খুঁজে সেখানে গেলাম। ধানমণ্ডির ১৮ নাম্বার রােডে। তাে আমার মাথায় টুপি,মুখে দাড়ি গাড়ি থেকেই নেমে গেটের কাছে যেতেই [আর্মির গার্ড বলে মাত আও’। ১৭ ডিসেম্বর ? হ্যা ১৭ ডিসেম্বর। তখনও পাকিস্তান আর্মি ওনাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। Oh My God, ১৭ ডিসেম্বর! হ্যা বিজয়ের পরের দিন। তাে আমি ভয়ে পিছিয়ে আসলাম। খানিক দূরে আসলে দেখি এম.ই চৌধুরী সি.এস.পি আর হাতেম আলী খান চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওনারা হেঁটে যাচ্ছেন মনিং ওয়ার্ক করে। ওনাদের দুজনকে আমি চিনতাম। আমাকে দেখে বলেন করছেন কী, কাল বিকালে এখানে দুজনকে গুলি করে মেরেছে।’ তখন আমি চলে আসলাম। ভাইকে সাথে করে সাকিট হাউসে ঢুকলাম। সেখানে দেখি একজন মেজর জেনারেল (নাম) গনজালভেস। ওনাকে বললাম মুজিব ভাই এর Family in serious conditionarmy may kill her at any time’ তথন উনি একজন শিখ জেনারেলের সাথে কথা বললেন।
Two star, না three star জেনারেল মনে নেই। দুজন আলােচনা করে,জেনারেল গনজেলভেস আমাকে বললেন, “তােমার গাড়ি আছে ?’ আমি বললাম, ‘আছে, আমার ভাই গাড়ি নিয়ে নিচে বসে আছে।’ তিনি বললেন, ‘আমাকে এয়ারপাের্টে নিয়ে চল।’ ওনাকে নিয়ে এয়ারপাের্টে আসলাম। এয়ারপাের্টে এসে উনি মেজর রাজা বলে একজনের সাথে কথা বললেন। তার সাথে তিনজন সিপাই দিয়ে আমার সাথে ওনাকে আসতে বললেন। মেজর রাজাকে আমার সাথে পাঠালেন, বেগম মুজিবকে রেসকিউ করার জন্য। আর এক ভদ্রলােক ওনাকে গাড়ি অফার করল। দুই গাড়িতে আমরা আসলাম। আপনি কি পেছনের গাড়িতে ছিলেন ? মেজর রাজা আমাদের গাড়িতে ছিলেন। আমার মামাতাে ভাইয়ের গাড়ি। তাহলে আপনার ইনিশিয়েটিভেই বেগম মুজিব ছাড়া পেলেন। আপনিই মেজর জেনারেল গনজালভেসের সাথে সার্কিট হাউসে দেখা করলেন এবং উনি মেজর রাজাকে বললেন আপনার সাথে যেয়ে মুক্ত করতে। হ্যা মেজর রাজা। অথচ সেদিনই পেপারে দেখলাম লিখেছে মেজর অশােক তারা। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ জুলাই, ২০১২। হতে পারে মেজর রাজার অন্য নাম ছিল অশােক তারা। পত্রিকাটিতে হাজী গােলাম মােরশেদের নাম ও অবদান অনুল্লেখিত)। মেজর রাজাকে নিয়ে আপনি ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রােডে গেলেন ? হা। ওনার কোমরে একটা মাত্র গ্রেনেড, হাতে কোনাে অন্ত্র নেই। ওনার সিপাইদের হাতে অন্ত্র আছে। সিপাইদের পেছনের গাড়িতে রাখলেন। উনি একাই হেঁটে গেটের কাছে গেলেন। যেয়ে ওদের সাথে কথা বললেন। তখন ওরা টার্ম দিল যে আমাদের আর্মস-অ্যামুনেশন নিয়ে | যদি চলে যেতে দাও। তাহলে আমরা কিছু করব না। না হলে সব ম্যাসাকার করে দিয়ে যাব।
ওদের কাছে ছােট মাইক্রোবাস ছিল- মেজর রাজা বললেন, ঠিক আছে, তােমরা আর্মসঅ্যামুনেশন নিয়ে চলে যাও।’ তখন ওরা আমস-অ্যামুনেশন নিয়ে পাঁচ-সাতজন ছিল, চলে | গেল। [পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্দেশপ্রাপ্ত ছিল যে তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোনাে ক্ষতি করবে কিন্তু বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে দ্রুত গৃহবন্দি দশা হতে মুক্তির উদ্যোগ ও মুক্ত করার ব্যাপারে হাজী গােলাম মােরশেদের অবদান অনস্বীকার্য। তারপর ভেতরে ঢুকে কী দেখলেন ? দেখলাম সবাই বসে আছে। হাসু বসে আছে, রেহানা বসে আছে, তারপর রাসেল বসে আছে। বড় দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন থােকা ভাই আছেন খােকা ভাই কে ? খােকা ভাই হচ্ছেন হাসুর মামা। থােকা ভাইকে বললাম- (যে অফিসার বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করল তাকে যেন সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়)। হাসু হচ্ছেন শেখ হাসিনা ? হ্যা। ভাবিকে আমি সালাম করলাম। এরপর সম্ভবত শমসের মুবিন চৌধুরীর মা বাড়িতে | ঢুকলেন। তিনি দেখা করে চলে গেলেন আমি চলে আসলাম। চাচা, মুজিব কাকু যখন ফিরে আসলেন- মুক্ত হলেন পাকিস্তান কারাগার থেকে তখন আপনি | আবার ফিরে গেলেন ওনার সাথে কাজ করতে ? হ্যা। ১০ জানুয়ারি ওনাকে যে ট্রাকে আনা হলাে, সে ট্রাকের পেছনে আমি পা ঝুলিয়ে আসলাম। পথে উনি পিপাসায় কাতর হলেন। তখন রেডিও অফিসের সামনে দৌড়ে- সাইফুল বারী বােধহয় ওখানের স্টেশন ম্যানেজার, তার কাছ থেকে একটা জা ও পানি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ালাম।
এরপরে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিটিং করে, বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু সামনে বসলেন, আমি পিছনে বসলাম। ঐ একই গাড়িতে ধানমণ্ডির বাসায় আসলাম। এরপরে ডেইলি আমি যেতাম। বঙ্গবন্ধু Oath (প্রধানমন্ত্রী পদে) নিলেন, সেখানেও গেলাম। তারপর একুশে জানুয়ারি আমি বার্লিনে চিকিৎসার জন্য গেলাম। সেই জাহাজে ক্যাপ্টেন ডালিম, মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী, মেজর হারুর অর রশীদ, লেফটেনেন্ট শমসের মবিন চৌধুরী (তাদের সাথে একই জাহাজে বার্লিনে চিকিৎসার জন্য | গেলাম। আমার চিকিৎসা হয়ে গেল, ওরা বলল, তােমার এখানে তিনমাস থাকতে হবে। রেস্ট নিতে হবে।’ তখন আমার মন আর টানে না। আমি শুনলাম বঙ্গবন্ধু রাশিয়ায় আসছেন। তাে ওদেরকে বলে মস্কোতে চলে আসলাম বাই ট্রেন। থার্ড অথবা ফোর্থ মার্চে আমি মস্কোতে পেীছলাম। শামসুর রহমান (খান) তখন ওখানে অ্যাম্বাসেডর। এয়ারপাের্ট থেকে আমাকে রিসিভ করে ওনার ওখানে নিয়ে গেলেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর সাথে টুর করলাম। লেনিগ্রাদ-স্ট্যালিাদ এসব জায়গায় গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও আমি একই কমপ্লেক্সে থাকতাম। আমরা তখন বােধহয় লেনিন্যাদে, ঐ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে এন্টারপ্রাইজ (ইউ,এস,এস) থেকে সামান্য দূরে (সােভিয়েত) সাবমেরিন ছিল— যদি কোনােভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্টারফেয়ার করত (মার্কিন যুদ্ধ নৌবহর) এন্টারপ্রাইজ ডুবিয়ে দিত (সােভিয়েত সাবমেরিন)। ইউ.এস.এস এন্টারপ্রাইজের কথা বলছিলেন উনি। হ্যা সে বিষয়ে রাশিয়ার তাে একটা প্রস্তুতি ছিল। তারপর আপনি যখন ফিরে আসলেন দেশে। তখন কবে থেকে কাজে লাগলেন ? আমি যখন ফিরে আসলাম তখন প্রতিদিন গণভবনে যেতে থাকলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে ওঠা বসা করতাম। এরপরে বােধহয় মার্চের লাস্ট উইকে Honorary Aide to the Prime Minister এই একটা গেজেট নােটিফিকেশন করে অ্যাপয়েনমেন্ট দিল। তৌফিক ইমাম তখন কেবিনেট সেক্রেটারি ।
তারপর ঐ যেতাম, কাজ করতাম, লােকের সুখ-দুঃখের কথা শুনতাম। তখন প্রত্যেক শহীদ ফ্যামিলিকে দু হাজার টাকা দেওয়া হতাে। সেটার চেক লেখা হতাে, সই হতাে। বঙ্গবন্ধু সই করার সময় পেতেন না। আমি রাত এগারােটা-বারােটার সময় বাসায় যেয়ে ওগুলাে সই করে নিয়ে আসতাম। এরপরে রেডক্রসের মাধ্যমে চিঠিপত্র আসত, পাকিস্তানে যারা আটকে আছে তাদের। সাহায্যের জন্য আবেদন আসত। তাদের চিঠিপত্র নিয়ে আমি ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে দিতাম। বাংলাদেশ রেডক্রস থেকে Disabled freedorn fighters rehabilitation institute করেছিল, এখন সেটা রেডক্রসের হেডকোয়ার্টার, ঐ বিল্ডিংটাতে আমার অফিস ছিল। আপনার প্রত্যাশা কী ? আপনার স্বপ্ন কী ?
আমার স্বপ্ন Justice and Fairness. আর আমার একটা ফর্মুলা আছে, যে ফর্মুলার। প্রথম ইনস্ট্রাকশনটি বঙ্গবন্ধু সই করেছিলেন। একটা গেজেট নােটিফিকেশন হয়েছিল, Order number one one four, dated 24th May, 1972 সেটা এই সি,এস,পি- সেক্রেটারিরা। স্যাবােটাজ করেছে সেটা হারিয়েই ফেলেছে। তার প্রথম লাইনটা হচ্ছে : সকল পত্রের ও আবেদনের প্রাপ্তি স্বীকার করিতে হইবে। অফিসে কোনাে ফাইল পিয়ন-চাপরাশি বহন করিবে না। Relevant officials will take and give it to the relevant officers within seventy two hours. Section officer- (and) Assistant Secretary within forty eight hours, the Deputy Secretary- (and) Joint Secretary within twenty four hours and the Secretary will dispose all the files.
সেটা পাস হয়েছিল ? অর্ডার ইস্য হয়েছিল কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট হয়নি- এক্সিকিউট হয়নি। কিন্তু স্যাবােটাজড হয়েছে নু ঃযবংব নর্ধপৎধঃং আমরা কারাে রেসপেক্ট নষ্ট করতে চাইনি, আমরা কারাে পজিশন নষ্ট করতে চাইনি। আমরা সাধারণ মানুষ। এখন প্রত্যেক গর্ভমেন্ট অফিসের সামনে লিখে দেওয়া উচিত মানুষকে হয়রান, অপমান ও ঘুষ সংগ্রহ কেন্দ্র। রিঃযবৎ ভব িবীপবঢ়ঃরড়হং এইসব ঘটনা ঘটছে। শাসন করবে কে? পলিটিশিয়ান কি আর পলিটিশিয়ান আছে- সে ট্রেডার হয়ে গিয়েছে। আমার কিছু পজিটিভ প্রােপােজাল ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে- ঐড়ঃড় হু ঃযব মড়াবৎহসবহঃ- যড়ঃড় ঃধপশষব ঃযব ঢড়ষরঃরপধষ ঢ়ড়পবংং, একজন মেম্বার অব পার্লামেন্ট কী করবে আর কী করবে না। ডেভেলপমেন্টের সাথে একজন পলিটিক্যাল লিডারের কানেকশন থাকা উচিত। কিন্তু সবাই আশা করে। যে এম. পি সাহেব রাস্তা করে দেবে। কিন্তু রাস্তা করা তাে এম.পি সাহেবের কাজ না। এম.পি সাহেবের কাজ হচ্ছে এড় মরাব ংড়পরধষ ংঃরপব ধহফ ধরহবংং সে তাে আইন প্রণেতামড়ড়ফ মড়াবৎহধহপব রহঃড়পব করার জন্য তার সৃষ্টি।
পঁচাত্তরে বাকশাল গঠনের আগেই আপনি কাজ ছাড়লেন ? তার আগেই আমি কাজ ছেড়ে দেই। আমি চুয়াত্তরের শেষের দিকে গণভবনে যাতায়াত বন্ধ করে দিলাম। রিজাইন করেছিলাম আমি ২৫শে জুন, তিয়াত্তরে। কিন্তু উনি (বঙ্গবন্ধু সেটা একসেপ্ট করেননি। আমি তখন টঙ্গি চলে গিয়েছিলাম। উনি ফোন করে বললেন “তুই যদি না আসিস, আমি ডি.আই.জি দিয়ে তােকে অ্যারেস্ট করিয়ে নিয়ে আনব। তাে আমি চলে আসলাম। তারপর বললাম, ‘আমি এসে কী করব ? আপনি তাে আমার কোনাে কথা শুনবেন না। আমার কথা শুনতেন কিন্তু করতেন না এবং যাদের দিয়ে করাতেন, তারা করতে চাইত না। তাদের দিয়ে করাতে পারতেনও না। বুরােক্র্যাসি ওনাকে টোট্যালি ঘিরেছিল। এই বুরােক্রাসির ভেতরে আমি Total anti people force পেয়েছি। মানুষের প্রতি কোনাে রেসপেক্ট নেই, লাড [ভালােবাসা নেই, মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছাও নেই এবং অন্যকে মর্যাদাহীন করতে পারলেই তারা এনজয় করে। ফরাসউদ্দীনও (ড. মােহাম্মদ ফরাসউদ্দীন- বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ১৯৭৩-১৯৭৫) পি.এস ছিলেন। কিন্তু তিনি দ্র ও সােবার ছিলেন। He was not an anti people force. কিন্তু কিছু করতে পারতেন না। পরে পুলিশ সার্ভিস থেকে আই.জি আব্দুর রহীম সাহেব আসলেন সেক্রেটারি হয়ে। He was a good man. তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কি দেখা হতাে ? হ্যা, দেখা হতাে- তাজউদ্দীন ভাই ছিলেন Behind the scene real কারিগর of our liberations. But for Tajuddin- বঙ্গবন্ধু কখনােই দেশকে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন না। তাজউদ্দীন ভাইয়ের ধীরতা এবং গঠন করবার শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর আইডিয়াকে সেইপে নিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া- তাজউদ্দীন ছিলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি। এক্সটা অর্ডিনারি। আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন দিয়েছিলেন। লিবারেশন ওয়ারের সময় তাজউদ্দীনকে আমীর-উল ইসলাম দিয়েছিলেন।
আমীর কাকুই তাে সে রাতে আল্লুকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করেন- আব্ব যদি বাসায় থাকতেন আব্বকে তাে মেরেই ফেলত- আব্ব ছিলেন ডেথ লিস্টে। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন হাজী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব যদি বেঙ্গল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি না থাকতেন, আবুল হাশিম সাহেবের কাজ, ফিলসফি, মিশন যদি আমাদের সামনে না থাকত, তাহলে আমরা সবাই কমিউনিস্ট হয়ে যেতাম।’ ব্রিটিশ আমলের কথা তিনি বলছিলেন। আমার লাইফে ছােট ছােট টুকরাে ঘটনার সাথে আমি জড়িত আমি অনেক কিছু জেনেছি- শুনেছি কিন্তু তার কোনাে সাক্ষী নেই। কিন্তু আপনি ইতিহাসের কত বড় সাক্ষী।
কিন্তু আমি যে সর্বনাশও করেছি। জিয়াউর রহমানের জন্য পােস্ট ক্রিয়েট করেছি। করে তাকে প্রমােশন দিয়েছি। That post was created on my Insistency, on my request. Deputy Chief of Staff OCHI কোন সালে? সেভেন্টি টু। আমাকে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নানা আমাকে বঞ্চিত করেছে (জেনারেল) ওসমানী সাহেব আমাকে দেখতে পারেন না বলে।’ জিয়াউর রহমান বললেন? হ্যা। বললেন, ‘আপনি বিচার করে দেন। আমি বিচার করতে গেলাম- বঙ্গবন্ধুকে যেয়ে বললাম যে এই হয়েছে- এই হয়েছে জিয়াউর রহমানকে বঞ্চিত করা হয়েছে- ওনার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দাঁড়া, দাঁড়া- থাম-থাম। তারপর ডেপুটি চিফ অব স্টাফের পােস্ট ক্রিয়েট করে বঙ্গবন্ধু ওনাকে বসিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, “তুই নাছােড়বান্দা যা ধৰি ছাড়বি না।’ জিয়াউর রহমান পরে আপনাকে দেখতে এসেছিলেন ? জিয়াউর রহমান- আমি সেভেন্টি সিক্সে কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম, আমাকে অ্যারেস্ট করেছে। কার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন?
বঙ্গবন্ধুর মাজার। টুঙ্গিপাড়ায়। তখন জিয়াউর রহমানের গভর্নমেন্ট। সেভেন্টি সিক্সের ১৫ আগস্ট সকালে আমাকে ধরে নিয়ে ফরিদপুরের জেলে পুরে পনেরাে দিন পচাল। রােকেয়া মােরশেদ : পনেরাে দিন নয়- আঠারাে দিন। আমি ওদেরকে (পুলিশ) জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন ধরেছেন? ওনার কি কোনাে দোষ ছিল ? বলল, না। উনি জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন। আমরা না করায় উনি জিয়ারত করেননি। কিন্তু আমরা। ওনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ধরেছি।’ বিনা অপরাধে- জিজ্ঞাসা করার জন্য ওনাকে ধরল। আঠারাে দিন ফরিদপুরের জেলে! এই হচ্ছে জিয়াউর রহমানের প্রতিদান ! এই হচ্ছে জাতির জনকের মাজার জিয়ারত করার অপরাধ ! বলদা গার্ডেন থেকে যে ফোনটা এসেছিল ওটার মানে কী ছিল? মেসেজ, মানে ওয়্যারলেস পাঠানাে হয়ে গিয়েছে ! কী মেসেজ পাঠানাে হয়েছিল ? সেটা তাে জানি না। কিন্তু সে মেসেজ লিবারেশন ছাড়া আর কী হতে পারে ? আপনার লাইফের সিগনিফিক্যান্ট মুহুর্ত কী ? ডিউরিং সােহরাওয়ার্দী টাইম। তার সাথে যখন আমি থেকেছি তিনি একটা কথা বলেছিলেন যে এমন একটা সময় আসে যখন সব স্ট্রিট লেবারার টু দ্য টপ অব দ্য কান্ট্রি একই সময়ে। একই কথা ভাবে, একই চিন্তা করে ঠিক রেডিও ওয়েভ লেন্থের মতাে, তখুনি দেশ মুক্ত হয়।’ বাহ! কোন সালে একথা বলেছিলেন ? এটা বলেছিলেন ফিফটি থ্রি-ফিফটি ফোরে। সে সময় আমি একজন কর্মী ছিলাম। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমি রাজনীতির সাথে জড়িত। উনিশশাে পঁয়তাল্লিশ সালে রশীদ আলী ডে অ্যাটেনড করেছি কোলকাতায়। (নেতাজি সুভাষ বােসের আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশীদ আলী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন দেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে যুক্ত থাকার অভিযােগে ব্রিটিশ সরকার তাকে বন্দী করলে ওনার মুক্তির দাবিতে ভারত ব্যাপী আন্দোলন হয়।) উনিশশাে ছেচল্লিশ সালে পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশনে আমরা কাজ করেছি। উনিশশাে সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ, পঞ্চাশে আমি মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলাম।
উনিশশাে আটচল্লিশ সালে ঢাকার রাস্তায় রাষ্ট্র ভাষার পক্ষে প্রসেশন করেছি। যশাের ডিসট্রিক্ট মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের সেক্রেটারি ছিলাম। বায়ান্নতে রাষ্ট্র ভাষা সংগঠনের কনভেনর ছিলাম। তিপান্নতে যশাের ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের মেম্বার ইলেক্টেড হই এবং ইস্ট পাকিস্তানে I was the youngest member elected to the district board. এর পর ফিফটি থ্রিতে আমরা মুসলিম লীগের সংস্পর্শ ত্যাগ করি। যুক্রন্ট ইলেকশনে ঝাপিয়ে পড়ি। এই যুক্তফ্রন্ট ইলেকশনের সময় আমি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর খুব নিকট সান্নিধ্যে আসি। তিনি আমাকে নিয়ে সব টুর করতেন। তিনি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিশন করেছিলেন ক্যান্ডিডেটদের পপুলারিটি যাচাই করার জন্য। প্রফেসর
——————-
পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন ও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবীতে ঐক্যবদ্ধ। প্রগতিশীল ও অসামপ্রদায়িক যুন্টের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলিম লীগের (অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিক হিসেবে ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম করণ হয়) নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, নিজাম-এ-ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা আতহার আলী এবং গণতন্ত্রীদলের নেতা হাজী মহম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলী সিলেটি। ঐ নির্বাচনে (৮ মার্চ, ১৯৫৪) পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিন হেরে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানে। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুজফ্রন্ট হয় জয়যুক্ত।
নূরুর রহমানও ছিলেন। পরে তিনি সােহরাওয়ার্দী ক্যাবিনেটের স্টেট মিনিস্টার (অর্থ প্রতিমন্ত্রী ) হন। তাকে আর আমাকে নিয়ে উনি একটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করে দেন। আমরা ঈশ্বরদী, নাটোর, বগুড়া, এসব বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং করতাম। অনেক সময় আওয়ামী লীগের সাপাের্টার বাদ পড়ে যেত। কে,এস,পির (শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক পাটি) সাপাের্টার নমিনেশন পেয়ে যেত। (উদাহরণস্বরূপ পাবনায় আওয়ামী লীগের প্রফেসার হামিদ বাদ পড়ে যান এবং কেএসপির মাওলানা গফুর নমিনেশন পান।) এর জন্য কেউ কেউ আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব খুব জাস্ট মানুষ ছিলেন। অথচ একটা কলংক আছে যে হি ওয়াজ অ্যা কমিউনাল। ফিফটি থ্রি থেকে সিক্সটি থ্রি পর্যন্ত আমি তার সাথে কাজ করেছি। হি ওয়াজ অ্যা টোটালি সেকুলার ম্যান। অথচ ওনাকে কলঙ্কিত হতে হলাে- বড় দুর্ভাগ্য। এখন যে বাংলাদেশ দেখছেন- আপনার কী প্রত্যাশা ? কিছু বলার আছে? আমার বক্তব্য হচ্ছে I am a born politician but I do not do politics. আমি মনে করি politics is a trust and politicians are trustees.আজকে সাধারণ মানুষ সকাল থেকে পিয়নের হাত থেকে শুরু করে সেক্রেটারি পর্যন্ত প্রত্যেকের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত,শােষিত এবং অত্যাচারিত। তাদের কারাে কোনাে স্বাধীনতা নেই। যে কোনাে পর্যায়ের আমলা, পিয়ন, চাপরাশি, তফসিলদার, যুগ্ম সচিব, সচিব, চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মচারী প্রথমে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে, তারপর অপমান করে, তারপর ঘুষ খায়, with very few exceptions, তা হলে মানুষ স্বাধীন হলাে কী করে? এখন Government of the servant, for the servant and by the servant চলছে। আমি সেখানে নিজের নাম লিখতে পারব না। আমার একাশি বছর বয়স। My days are numbered- যেখানে বিবেকের দংশন আর এত অসম্মান সেখানে পলিটিকস করা যায় না। সেদিনের সুদীর্ঘ সাক্ষাঙ্কারটি হাজী গােলাম মোেরশেদ শেষ করলেন আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে- “তুমি আসলে যে আমার মনে হচ্ছে এই গত সাইত্রিশ বছরের মধ্যে আজকের দিনটা আমার জন্য সবচেয়ে বড়দিন।।
হাজী গােলাম মােরশেদের সাক্ষাৎকাটি গ্রহণ করতে গিয়ে আমিও হয়ে উঠছিলাম আবেগ আপুত। ওনারা যে বাংলাদেশের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন সেই লক্ষ্য থেকে আমরা আজও কত দূরে! বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও প্রশাসনে সৎ মানুষের নেতৃত্ব খোজা যেন মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়ানাের মতােই। ওনার স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে আমি ফিরে দেখছিলাম অদেখা যুগকে অবিস্মরণীয় কালের সকাল সন্ধ্যাকে। আজকের যুগে বিরল এমন নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যক্তিত্বকে হয়তাে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে ও তাদের আদর্শকে অনুসরণ করবে। ভিডিও সাক্ষাৎকার। শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২। আনুষঙ্গিক তথ্য যা পরে হাজী গােলাম মােরশেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে (কোস্তারিকা হতে ঢাকায় টেলিফোন সাক্ষাঙ্কার। বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১২) তার কিছু অংশ সাক্ষাঙ্কারের মধ্যে ব্র্যাকেটে উল্লেখিত হলাে।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ