You dont have javascript enabled! Please enable it!
ইন্দিরার সংকটে পাশে মুজিব
 
এগারােই এপ্রিল বৃহস্পতিবার (১৯৭৪) শেখ মুজিব মস্কো থেকে দেশে ফিরে এলেন। তিনি ফিরলেন দুপুরে। আমি সকালের প্লেনে গেলাম কলকাতায়। ইচ্ছে ছিল তার সংগে দেখা করে কলকাতায় যাব। কিন্তু আগেই বলেছি স্ত্রীর অসুস্থতার কথা। কলকাতার টেলেক্স মেসেজ পেয়ে ভােরেই ছুটতে হল ঢাকা ছেড়ে। সুতরাং মাস খানেক আর বঙ্গবন্ধুর সংগে দেখা হল না। এমনকি যােগাযােগও রইল না। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ঘটনা ঘটে গেল। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২০শে এপ্রিল শনিবার দুপুরে মারা গেলেন। সারা ভারত জুড়ে শুরু হল রেল ধর্মঘট মে মাসের গােড়ায়। একই সংগে। ভারতে ডাক ও তার ধর্মঘট হওয়ার কথা শােনা গেল । মে মাসের মাঝামাঝি মুজিব-ইন্দিরা আলােচনা-বৈঠক হল দিল্লীতে। একই সময়ে ভুট্টো ও চৌ এন-লাইয়ের আলােচনা বৈঠক শুরু হল পিকিং-এ। ১৮ই মে শনিবার ভারত পরমাণু বােমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়। ভারতের পরমাণু বােমা বিস্ফোরণে আমেরিকা ক্ষুন্ন এবং জাপান ক্ষুব্ধ হয়। পাকিস্তান উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং চীন নীরব থাকে। কলকাতায় বসেই টের পাচ্ছিলাম, সারা ভারত জুড়ে এক বিরাট ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। এই ঘূর্ণি ঝড়ের লক্ষ্য ইন্দিরা গান্ধী এবং তার কংগ্রেস পার্টিকে আঘাত করা। ‘৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অর্থনেতিক ধাক্কা ভারত তখনও কাটিয়ে ওঠেনি। এই অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি চলছে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির চেষ্টা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘটের নােটিশ দিয়েছেন। শুরু হয়েছে সারা ভারত ব্যাপী রেল ধর্মঘট। চলছে ডাক-তার ধর্মঘট। কলকাতায় ডান ও বামপন্থী দল এক হয়ে বনধ ডাকতে শুরু করেছে। ডান পন্থী কাগজগুলােতে। একযােগে চলছে ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ। আমি এক সময় ভাবতে শুরু করেছিলাম, দিল্লী থেকে সম্ভবত যে কোন সময় ইন্দিরা সরকারের পতনের খবর। পাব। কিন্তু ইন্দিরা সরকারের পতনের খবরের বদলে মে মাসের মাঝামাঝি যখন দিল্লীতে বসলাে মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক এবং ১৮ই মে ঘােষিত হল ভারত কর্তৃক পরমাণু বােমা বিস্ফোরণের অপ্রত্যাশিত সংবাদ, তখন মনে হল, ইন্দিরা সরকার এ যাত্রা ফাড়া কাটিয়ে উঠেছেন। আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেদিন একই সময়ে দিল্লীতে মুজিব-ইন্দিরা এবং পিকিংয়ে ভুট্টো-চৌ এন-লাই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি, সেদিন এ দুটি বৈঠকেই নির্ধারিত হয়েছে ভারত উপমহাদেশের ভবিষ্যত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের মর্মবিদারক বিয়ােগান্ত ঘটনার বীজও রােপিত হয়েছে সেদিন ঐ দুটি বৈঠকেই। অঘােষিত দু’টি শিবিরও সেদিন তৈরি হয়েছে। একটি শিবিরে আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তান। অন্যটিতে রাশিয়া, ভারত ও বাংলাদেশ। অনেক পরে এই ইন্দিরা-মুজিব বৈঠকের নেপথ্য কাহিনী যেদিন জানতে পেরেছি, সেদিন মনে হয়েছে, ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে মধ্যযুগের একটি ঘটনারই যেন পুনরভিনয় ঘটেছে। ঘটনাটি পাঠকদের অনেকেরই জানা। তবু উল্লেখ করছি, শুধু তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য। দিল্লীর সিংহাসনে তখন মােগল সম্রাট হুমায়ুন। পাঠানবীর শের খার আক্রমণে তিনি ব্যতিব্যস্ত। প্রতিবেশী এক হিন্দু রাজ্যের রানী হুমায়ুনকে ভাই। ডেকেছেন। বাইরের এক আক্রমণকারী তার রাজ্য আক্রমণ করায় রানী হুমায়ুনের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। হুমায়ুন পরামর্শ চাইলেন তার সেনাপতিদের কাছে। সেনাপতিরা বললেন : শের খা যে কোন সময় দিল্পী আক্রমণ করতে পারে। সুতরাং হিন্দু রানীর অনুরােধ অনুরােধ রক্ষা করা সম্ভব নয় । হুমায়ুন বললেন : তাকে যে আমি বােন বলে স্বীকার করেছি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিপদে সাহায্য করার। সেনাপতিরা বললেন : বােনকে রক্ষা করার জন্য সম্রাট দিল্লী ছেড়ে যুদ্ধ করতে গেলে শের খা সেই সুযােগে দিল্লী দখল করে নিতে পারে। হুমায়ুন বললেন : আমি জবান দিয়েছি। জবান নষ্ট করতে পারবাে না। পরদিনই তিনি সসৈন্যে এগুলােন হিন্দুরানীর সাহায্যার্থে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আক্রমণকারী পালাল। হুমায়ুন যুদ্ধে জয়ী হলেন। কিন্তু বােনের রাজ্য রক্ষা করে। দিল্পী প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি জানলেন, শের খা দিল্লী দখল করে নিয়েছে। রাজ্যহারা, ভাগ্য-বিড়ম্বিত হমায়ুন ছুটলেন কালাহারের পথে আশ্রয় লাভের আশায়। বিরাট মােগল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে হুমায়ুন তার বিপন্ন পাতানাে-বােনকে রক্ষার জন্য যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সে যুগে; বর্তমান যুগে বাংলাদেশের মত একটি ছােট অনুন্নত দেশের নায়ক হয়েও সেই একই ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-বিরােধী বিরাট আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্য বিনাদ্বিধায় তিনি যদি ইন্দিরার পাশে গিয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তাকে হয়তাে এভাবে স্ত্রী পুত্র পরিজন সহ মর্মান্তিক মৃত্যু বরণ করতে হতাে না।
Source:  ইতিহাসের রক্তপলাশঃ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, আব্দুল গাফফার চৌধুরী
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!