You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীনের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎকার - সংগ্রামের নোটবুক
আম্মা ও ভাইবােনদের সাক্ষাৎকার
আ্ব্বুকে যখন হত্যা করা হয় তখন ছােট বােন সিমিন হােসেন রিমি (লেখক, সমাজকর্মী ও সাংসদ) ও আমি কিশােরী। কনিষ্ঠতম বােন মাহজাবিন আহমদ মিমির (লেখক, কবি ও সমাজকর্মী) বয়স সে সময় নয় বছর ও একমাত্র ছােট ভাই তানজিম আহমদ সােহেল (প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ) পাঁচ বছরের শিশুমাত্র। আব্বু সম্বন্ধে রিমি তার বহুল প্রশংসিত বই আমার ছােটবেলা : ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ (২০০১)-এ বহু মূল্যবান তথ্যের জোগান দিয়েছে এবং স্মৃতিচারণ করেছে। সে লিখে চলেছে অবিরাম। আব্বু সম্বন্ধে আমার প্রথম স্মৃতি চারণামূলক প্রবন্ধ ‘তাজউদ্দীন নেতা না পিতা’র (সচিত্র সন্ধানী/বিজয় দিবস সংখ্যা ১৯৭৯) মধ্য দিয়ে আমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি একজন অসাধারণ মানুষকে সেই প্রচেষ্টা বিবর্তিত হয়েছে আরও নানা লেখার মধ্য দিয়ে। এবারে আব্বুকে ঘিরে আম্মা, রিমি, মিমি ও সােহেলের শৈশবের স্মৃতিভিত্তিক সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে এক মহৎ প্রাণ অনন্য মানুষের চরিত্রের অপ্রকাশিত দিকগুলাে ও তাঁকে হারানাের অন্তহীন বেদনার স্মৃতিমালা উন্মীলিত হলাে।
(যুক্তরাষ্ট্র হতে ঢাকায় টেলিফোনে ধারণ করা এই সাক্ষাৎকার গুলাে তারিখ অনুযায়ী উল্লেখিত হলাে।)
মিমির সাক্ষাৎকার
রিপি : মিমি তােমার ছােটবেলায় আব্বুকে তুমি যেভাবে দেখেছ এবং তাঁকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলাে তােমার মনে দাগ কেটেছে, সে সম্বন্ধে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই। মিমি : আমি একটি মজার ঘটনা দিয়েই আব্বুর স্মৃতিচারণা করব। ১৯৭৪-এর শেষের  দিকের ঘটনা সেটি। আব্বু তখন মন্ত্রিসভা থেকে রিজাইন দিয়ে আমাদের নিয়ে ধানমণ্ডির বাসার দোতলায় উঠেছেন। আম্মা সবেমাত্র পুরাে বাসার দেওয়ালে সুন্দর করে সাদা রং করিয়েছেন। আমি তখন ক্লাস ফাইভে উঠি। নতুন ক্লাসের জন্য আমি সদ্য লসাগু বা লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক শিখেছি মনের আনন্দে আমি সেই লসাগু নতুন রং করা সাদা দেওয়াল জুড়ে লিখে চললাম। আম্মা, আমার ওই দেওয়াল অঙ্কন দেখে মােটেও প্রীত হলেন না। তিনি আমার কান মলে বললেন, ‘দাঁড়াও, তােমার আব্বকে দেখাচ্ছি। আম্মার নালিশ শুনে আব্বু এলেন সরেজমিনে দেখতে। রাগ করার বদলে তিনি মুগ্ধ নয়নে সাদা দেওয়াল ভরা আমার লসাগু দেখে আম্মাকে বললেন, “দেখাে লিলি, কী পাকা হাতের লেখা!
আর একবার আমি ও সােহেল বাথরুমের ঝরনার নিচে হাফপ্যান্ট পরে মহানন্দে গােসল করছিলাম। একবার আমি সােহেলকে ধাক্কা দিয়ে ঝরনার নিচে দাঁড়াচ্ছিলাম। আর একবার সােহেল। বেশ মজা করে আমরা দুই ভাইবােন গােসল করছিলাম। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়াতে আম্মা তাড়া দিলেন এই তােমরা শিগগির গােসল শেষ কর। এরই মধ্যে আন্ধু আমার ভূগােল খাতা নিয়ে বাথরুমের সামনে দাড়িয়ে আমাকে বললেন, ‘এই ভূগােল খাতা কি তােমার ?’ আমি বললাম হ্যা আমার।’ আৰু খুব খুশি হয়ে খাতা খুলে আম্মাকে আমার লেখা ও আঁকা আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, সৌর জগতের ছবি দেখিয়ে বললেন, “দেখাে কী সুন্দর ওর হাতের লেখা ? আমার মনে আছে যে আমাদের একটি সাদা-কালাে জাপানি এনইসি টিভি ছিল। সেই টিভিতে Anna and the King সিরিয়ালটি প্রত্যেক রােববার সকালে আমরা দেখতাম। তারপর আব্বু আমাকে ও সােহেলকে ধানমণ্ডির দোতলার সিঁড়ির কাছের বাথটাবটিতে নামিয়ে দিতেন। ঐটিই একমাত্র বাথটাবওয়ালা বাথরুম ছিল। আমরা মহাফুর্তিতে বাথটাবে ঝাপাঝাপি করতাম। আব্বু বাথরুমের পাশের ঘরের ইজি চেয়ারে বসে পড়তেন। রিপি : আব্বু বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন।
১৯৬৬-তে জেলে যাওয়ার আগে, নিচতলার বাথটাবওয়ালা বাথরুমে তিনি রিমি ও আমার সঙ্গে গােসল করতেন। বাথটাব ভর্তি পানির মধ্যে রিমি ও আমি ঝাপাঝাপি করতাম। গেঞ্জি-লুঙ্গি পরিহিত আলু বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে ঘুমের ভান করতেন। তারপর হঠাৎ হাউ’ শব্দ করে আমাদের চমকে দিতেন। শুধু রাজনৈতিক জীবনই নয়, আলুর চরিত্রের এই কোমল ও উষ্ণদিকগুলাে থেকেও মানুষের জানার ও শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। বাংলাদেশে ও ট্রাডিশনাল অনেক সমাজেই বাবারা সাধারণত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুব একটা ইনভলভড় থাকেন না। রাজনীতিতে জড়িত থাকার। কারণে আল্লুকে আমরা খুব একটা কাছে পাইনি। তা সত্ত্বেও যতটুকু পেয়েছি, তা যেন পরম পাওয়া। মিমি : হা, তাই। আব্বু যখনই সময় পেয়েছেন, আমাদের সঙ্গে সময় কাটানাের চেষ্টা করেছেন। রিজাইন দেওয়ার পর তাঁর হাতে অনেক বেশি সময় ছিল। সেই সময় তিনি ব্যয় করতেন খুব সুন্দরভাবে। মনে পড়ে, তিনি বিকেল ৩টার দিকে ঘরে বিশ্রাম নিতেন। বিকেল ৪টায় দিবান্দ্রিা থেকে উঠে সােহেল ও আমাকে ওনার দুই হাতের দুই কড়ে আঙুলের মাথায় ধরে বৈকালিক ভ্রমণে বের হতেন। আমাদের দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা তিনি মনােযােগের সঙ্গে দেখতেন। উপভােগ করতেন। রিপি : এবারে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই ৪ ও ৫ নভেম্বরের দিনটির কথা।
মিমি ৪ তারিখে মফিজ কাকুর বাসার ঘরের মাটিতে বাবুল ভাইকে রােলিংপিনের মতাে এ-মাথা থেকে ও-মাথা গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলাম। উনি ও মামাগাে, ও মামাগাে আর্তনাদ করে কাঁদছিলেন। ৫ তারিখ সকাল থেকে বাসার উত্তর দিকে আবাহনীর মাঠ থেকে আমাদের বাসার সামনে ছিল বিশাল লাইন। বাসার দক্ষিণে বিডিআর-এর গেট থেকেও আমাদের বাসা পর্যন্ত বিরাট লাইন ছিল। সকলেই লাইন করে নিচতলার সামনের ঘরে রাখা আব্বুকে দেখতে আসছিল। ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা রেজা ভাইকে মিছিল নিয়ে আসতে দেখলাম। আমি বারবার ওপর-নিচ করছিলাম। একবার আম্মাকে দেখছিলাম, আর একবার আব্বুকে দোতলার বারান্দায় বসা আম্মা কেঁদে কেঁদে আক্ষেপ করছিলেন ‘আমি রিট পিটিশন করেছিলাম। পেরােলটা হয়ে গেলেই ও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেত।’ গ্যারেজের কাছে, পিছনের বাগানে আন্ধুকে গােসল করানাের সময় সাঈদ ভাই ও হাসান ভাইয়ের গােসল সংক্রান্ত কথাবার্তা ভেসে আসছিল। তুমি, আমাকে ও সােহেলকে দোতলার বারান্দার জানালার সামনে দাঁড় করালে।
জানালার বাইরে, আম গাছের নিচে ট্রাকে আব্দুকে রাখা হয়েছিল। সােহেল খুব কাঁদছিল। তুমি সােহেলকে বললে, ‘সােহেল কেঁদো না। আমরা বড় হয়ে এর বদলা নেব।’ রিপি : সামগ্রিকভাবে আলুকে কীভাবে তুমি মূল্যায়ন কর ? মিমি : ব্যক্তি হিসেবে আব্দুর সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা আমি লক্ষ করি। একাধারে তিনি এ জগতের হয়েও এ জগতের নন। রবিঠাকুর ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে যেভাবে মনােনিবেশ করেছেন, নিজ ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে উপদেশ দিয়েছেন, তেমনি অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে রচনা করেছেন সােনার তরী’র মতাে মহাকাব্য। আব্বু জাগতিক সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ও ছােটখাটো বিষয়গুলাে যেমন দক্ষতা ও নিপুণতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন ও সুরাহা করেছেন, তেমনি জাগতিক বিষয়াবলির বাইরের মানবিক, আত্মিক ও বিমূর্ত দিকগুলাের সঙ্গেও সমানভাবেই সম্পৃক্ত থেকেছেন। রবিঠাকুরের পরই উনি হাতেগােনা বাঙালির মধ্যে একজন, যিনি যতটুকু স্পৃহা ও উদ্দীপনা নিয়ে জাগতিক বিষয়গুলােকে দেখেছেন তেমনি একই স্পৃহা ও উদ্দীপনায় তিনি মানবিক ব্যাপারগুলােকেও উপলব্ধি করেছেন। রিপি : আম্মার মধ্যেও কিন্তু একই ধরনের আত্মিক, জাগতিক ও মানবিক গুণাবলির সমন্বয় দেখা যায়।  মিমি : হ্যা, সে জন্যেই ওনাদের মধ্যে এত মিল ছিল। ওনারা ছিলেন পরস্পরের যােগ্য জীবনসঙ্গী।
(রবি ও বুধবার, ৪ ও ২১ জুলাই, ২০১০) সােহেলের সাক্ষাৎকার।
রিপি: আব্বুকে যখন হত্যা করা হলাে, তখন তােমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সেই সময় আল্লুকে ঘিরে তােমার স্মৃতির পটে যে ঘটনাগুলাে আজও জাগ্রত, সে সম্পর্কে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই। সােহেল : আমার অল্প বয়সে আব্বু চলে যাওয়াতে ওনার সঙ্গে আমার স্মৃতির সংখ্যা হয়তাে কম কিন্তু প্রতিটি স্মৃতিই খুব মূল্যবান ও দিকনির্দেশনাকারী। বর্তমান রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে আন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিবিদেরা অধিকাংশ সময়ই মানুষের হাততালি নেওয়ার জন্য বা প্রশংসা পাওয়ার জন্য মানুষের সামনে এক রূপ ধারণ করেন কিন্তু পেছনে অন্য রূপ। কিন্তু লােকচক্ষুর বাইরে মানুষ যে কাজটি করে থাকে তার মধ্যেই তাে প্রকাশ পায় তার আসল রূপ। ব্যক্তি আব্বু ছিলেন একজন অসাধারণ দেশপ্রেমিক ও দুর্ধর্ষ ধরনের সৎ মানুষ ঘরে ও বাইরে তিনি দেশপ্রেম বােধ ও সৎ জীবনযাপনের এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন। মনে পড়ে, রাতে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখানাে হতাে ও জাতীয় সংগীত বেজে উঠত, আব্বু সঙ্গে সঙ্গেই দাড়িয়ে পড়তেন এবং আমাকেও অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়াতে বলতেন।
আমি হাত টান টান করে আব্বুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম। এই ঘটনাটির স্মৃতি আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে। আব্বু তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। ওই ধানমণ্ডির বাড়িতেই একবার খাবার সময় যখন আম্মা আমাকে মাছ দিলেন তখন আমি ঘ্যানঘ্যান শুরু করলাম যে মাছ খাব না। আল্লু তখন আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘দেশের মানুষ খাবার পায় না। লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আর তুমি মাছ খেতে চাও ?’ আব্বু যে কথাগুলাে আমাকে বললেন, সেগুলাে বােঝার বয়স তাে তখনাে হয়নি তারপরও আব্বু তাে বিরত থাকেননি দেশ প্রেমের শিক্ষা দিতে। সে সময় ঐ কথা বুঝিনি কিন্তু আজ তা মনকে ভীষণ নাড়া দেয়। ছােটবেলায় আমি খুব চঞ্চল ছিলাম। সবার ছােট বলে বড়দের কাছ থেকে অতি আদর পেয়ে বেশ আহ্লাদিপনা করতাম ও জেদও ধরতাম। আব্ব কিন্তু ছােট বলে বা একমাত্র ছেলে বলে প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি যেমন ভালােবাসা দেখাতেন তেমনি অযথা আবদার করছি দেখলে শাসনও করতেন, যাকে বলে ‘tough love’। আম্মাকেও সতর্ক করতেন, বলতেন ‘বেশি আদর দিয়ে ছেলেটাকে নষ্ট করে দিয়াে না। সে সময় আব্দুর কথা শুনে আম্মাকেই সমর্থন করতাম। কিন্তু আজ বুঝি আব্বু কত সঠিক ছিলেন। অতি শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ন্যায়নীতি বােধের শিক্ষা তিনি দিতেন তার নিজের আচার, আচরণ ও উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে। আবার অজস্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমার শিশুসুলভ কৌতূহলকে নিবৃত্ত করতেন এবং অনেক সময় আমার সঙ্গে এমন আচরণ করতেন যেন মনে হতাে আমিও বড় কোনাে ব্যক্তি। আন্ধু তখন। অর্থমন্ত্রী। আব্বু ও আম্মাসহ আমি গাড়ি করে কাকরাইলের পাশ দিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি এক বিশাল হাতি সেই পথ দিয়ে চলছে। আমি বায়না ধরলাম যে হাতিতে চড়ব। আম্মা আমার মনােযােগ অন্যদিকে সরাবার চেষ্টা করলেন, ভাবলেন, আলু বিরক্ত হবেন।
কিন্তু আব্বু সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি থামিয়ে আমাকে হাতিতে চড়ালেন। সেদিন হাতিতে চড়ে আমার মনে মহা আনন্দ। আমার চার বছরের জীবনের সেটি এক অমূল্য স্মৃতি  আর একবার আন্ধু আমাকে সঙ্গে করে চিড়িয়াখানায় গেলেন। চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা আন্ধুকে খুশিতে ঘিরে ধরেছে। ঐ ভিড়ের মধ্যেও আব্দু একটি জীবজন্তর ছবিওয়ালা ব্যাজ নিজ হাতে আমার শার্টে গেঁথে দিলেন। আন্ধু আমাকে মনে করে নিজ হাতে আমাকে ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন এটা ভেবে সেদিন আমি খুব গর্বিত বােধ করেছিলাম।  আব্বু অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের হেয়ার রােডের সরকারি বাসভবনের আর একটি স্মৃতি মনে পড়ে। বিশাল গাছপালায় ঘেরা সেই বাসভবনের আশপাশে রাতের বেলা কোনো হায়েনা বা শেয়াল-জাতীয় জন্ত এসেছিল। আব্দু ওনার রাইফেলটি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন সােহেল, এসাে। আমি কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা নিয়ে আব্দুর পিছে পিছে গেলাম। সামনে পেছনের মাঠ ও গাছপালার আশপাশ ঘুরে আমরা ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ফিরে আমি বললাম, ‘আল্লু ভয় লাগছে। আব্বু ওনার পিস্তলটি আমার বালিশের নিচে রেখে বললেন, ‘ভয় নেই। এখন ঘুমাও।’ আশ্চর্য ব্যাপার হলাে যে, আব্বু জীবনে কোনাে প্রাণী এমনকি একটি পাখিও হত্যা করেননি এবং কোনাে পশুপাখি জবাইয়ের দৃশ্য সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তিনি অস্ত্র সংগ্রহ পছন্দ করতেন। রাইফেল ও পিস্তল-জাতীয় কিছু অস্ত্র শখ করে কিনেছিলেন। আব্বু আমাকে দায়িত্ব দিতে পছন্দ করতেন। আমার মতামত বিবেচনা করতেন। আমার পাচ বছর বয়সে আমাদের ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে আব্বু আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে ভর্তি করাতে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কাকলী স্কুল ছিল। সে সময় ঐ স্কুলের সামনে গাছের নিচে কোনাে ক্লাস চলছিল। মনে হয় কোনাে আর্টের ক্লাস। আমি স্কুলটা দেখে বললাম। “আব্বু, এই স্কুলে ভর্তি হব না। আমি গাছের নিচে পড়ব না।
এরপর কাছেই গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি দেখে খুব পছন্দ হলাে। স্কুলের সামনের খেলার মাঠে দোলনা ও স্লাইডে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা দেখে মনে হলাে যে এটাই আমার স্কুল হবে। আল্লুকে মনের কথাটি জানাতেই আলু ঐ স্কুলে আমাকে ভর্তি করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেন। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আব্বুকে জানালেন যে তারা স্কুলে শুধু বিদেশিদের ভর্তি করেন। আল্লু যুক্তি উত্থাপন করে বললেন যে স্কুলটি চলছে বাংলাদেশের মাটিতে অথচ বাংলাদেশিদের ভর্তি করা হবে না সেটা কেমন কথা! আব্বুর কথার পরই স্কুলের পলিসি পরিবর্তন করা হয়। তারা বাংলাদেশিদের জন্য, যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ পার্সেন্টের একটি কোটা নির্ধারণ করে। আমি গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হই। জীবজন্তুর প্রতি আব্বুর খুব মায়া ছিল। মুজিব কাকু আমাকে যে খরগােশ দুটি উপহার দিয়েছিলেন তাদেরকে আল্লু নিজ হাতে খাওয়াতে ভালােবাসতেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে খরগােশদের পরিচর্যা করতেন। আবাহনী মাঠে যখনই খেলা হতাে আব্দুর কড়ে আঙুল ধরে আব্বর সঙ্গে খেলা দেখতে যেতাম। জেলে আব্বুকে হত্যা করার পর যখন আব্বুর লাশ আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে আসা। হলাে, তখনকার খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলাে কেমন আলাে-ছায়ার মতাে মনে এখনাে ভাসে। আলােছায়ার উপমাটি দিলাম এ কারণে যে তখনাে মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট হয়নি। আমি অগণিত মানুষের কোলাহল ও হাহাকার শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ঘটনার গভীরতা। আমি শুনতে পারছিলাম যে আন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বুঝতে পারছিলাম যে আব্বু আর নেই। কিন্তু আবারও মনে হচ্ছিল আব্বু আসলেই বেঁচে আছে। মনের মধ্যেই চিন্তার সংঘর্ষ চলছিল।
আমাদের বাসার পেছনে গ্যারেজের সামনের উঠোন মতাে জায়গায় আব্দুকে যখন গােসল করানাে হচ্ছিল, আমি তখন সেখানে ঘােরাফেরা করছিলাম। বােঝার চেষ্টা করছিলাম কী হচ্ছে। আব্বুর মাথার কাছে অনেকক্ষণ বসে আলুকে দেখছিলাম। তারপর আবার ভিড়ের মধ্যে দোতলায় আম্মার কাছে যাচ্ছিলাম। দেখি আম্মা কাঁদছেন। কিছু বিদেশি সাংবাদিক ও দূতাবাস থেকে আগত বিদেশিদের দেখতে পেলাম তারা আম্মাকে সমবেদনা জানিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি একটু ওপর-নিচ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমার ভেতরে অনুভূতিগুলাে কেমন জট পাকিয়ে বিবশ হয়ে যাচ্ছিল। একসময় আমি অঝােরে কান্না শুরু করলাম। মনে হয় তুমি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলেছিলে।  রিপি : আমি বলেছিলাম, ‘সােহেল কেঁদো না, আমরা বড় হয়ে এর বদলা নেব’। এই স্মৃতিটি আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, মিমির সাক্ষাৎকার থেকে জানলাম।। সােহেল : এ রকম মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একটি শিশুর মনে কী আলােড়ন চলছে সে সম্পর্কে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমাদের সামাজিক পরিবেশে অনুভূতিকে প্রায় সময়ই প্রকাশ করার বদলে ভেতরে চেপে রাখতে হয়। বিশেষ করে, একজন শিশু, যে এ রকম একটা নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেছে, সে জানছে না যে কীভাবে সে তার বেদনাময় অনুভূতিকে প্রকাশ করবে। তার কাছ থেকে কেউ জানতে চাইছে না। সবার মাঝেও সে ভীষণ একা। আব্বুকে যখন আব্বুরই হাতে লাগানাে আমগাছের নিচে রাখা হলাে আমি তখন আবারও আব্বুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রাকে করে সবার সঙ্গে আমিও গেলাম বনানি কবরস্থানে। মনে পড়ে, একটা গাছের নিচে আব্দুর কবর খোঁড়া হয়েছিল। রিপি : ওটা ছিল বকুলগাছ। ছােটবেলায় খুব ভােরে আব্বুর সাথে ধানমণ্ডির ২১ নাম্বার রাস্তTয় চলে যেতাম বকুল ফুল কুড়াতে। মালা গেথে উপহার দিতাম আব্বু ও আম্মাকে।
আমাকে বােঝানাে হলাে যে আব্বু বিদেশে  আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। আমার মনে হলাে যে আব্বু হয়তাে মাটির নিচ দিয়েই বিদেশে চলে গিয়েছেন। আমার ছয়-সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম যে আবু আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। যদিও আমার মনের এক অংশ জানত যে আন্ধু মৃত। কিন্তু আব্বু বিদেশে চলে গিয়েছেন, এই কথাটি বিশ্বাসের মধ্যে মনে এক প্রকার স্বস্তি পেতাম। আমার সাত বছর বয়সে আমার আদরের পােষা কুকুর হাইডি রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা যায়।  আমি আমার সে বছরের ডায়েরিতে লিখেছিলাম যে আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলাে আমার বাবার মৃত্যু ও আমার কুকুর হাইডির মৃত্যু। শিশুমন জীবজন্তু ও মানুষকে ভালােবাসার মধ্যে পার্থক্য করে না। সে শুধু বােঝে যে প্রিয়জন, সে যে প্রজাতিরই হােক না কেন, তাকে হারানাের দুঃখ অপরিসীম। শিশুর ভালােবাসা খাটি ও অকৃত্রিম।  জীবনে অনেক দুঃখ-বেদনাকেই আমি অতিক্রম করেছি। কিন্তু আব্বুকে হারানাের বেদনা এখনাে যেন জাগ্রত। রিপি : আব্বুর সমস্ত জীবনটাই ছিল একটা পরিষ্কার আয়নার মতাে। সােহেল : হ্যা, তাই। আব্বুর চালচলন ও চিন্তাধারা ছিল far advanced।তার জীবনের মধ্যে দিয়েই তিনি আমাদের জন্য monumental message রেখে গিয়েছেন। (সোমবার, ৫ জুলাই, ২০১০)
রিমির সাক্ষাৎকার
রিপি : মেয়ে হিসেবে তুমি আব্বুকে কীভাবে মূল্যায়ন কর ? রিমি : আব্বুর কথা আমি মেয়ে হিসেবে আলাদা করে চিন্তা করতে পারি না। উনি এমন একজন আলােকিত মানুষ যে তিনি যদি শারীরিকভাবে বেঁচে না-ও থাকেন, ওনার কাজের মধ্যেই  তিনি চিরজীবী। খুব কষ্ট হয় যে এই মানুষটির অনেক কিছু দেবার ছিল, তার অকালমৃত্যু নির্মম হত্যাকাণ্ড হওয়াতে তিনি সেটা দিতে পারলেন না। তার পরও যেটা মনে করে ভালাে লাগে যে তার কাজ যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে তাঁর রােল মডেল ও আদর্শের অনুকরণে একটা রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণভাবে গঠন করা যায়।  রিপি : তুমি তাে আব্বুর ছেলেবেলার সঙ্গীসাথিদের অনেকেরই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছ, তাঁদের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে আব্দু সম্বন্ধে যে তথ্যগুলাে বের হয়ে এসেছে তা তােমার কাছ  থেকে শুনতে চাই। রিমি : আব্বুর ডায়েরিতে কালুর বাপের (সাবু শেখ) অনেক উল্লেখ পাই। তাকে যখন নব্বই সালে ইন্টারভিউ করি উনি বললেন যে বালক তাজউদ্দীন যখন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলত সে কখনাে ঝগড়া-বিবাদে শরিক হতাে না। বরং সে সব সময় ঝগড়া মিটিয়ে দিত। সাধারণত অল্পবয়সীরা ঝগড়া, মারামারিতে সহজেই জড়িয়ে পড়ে, সে কখনােই ওসবে জড়ত না। ছােটবেলার ঐ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে এমএলএ (প্রাদেশিক সদস্য) নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর এলাকার থানায় চলে গিয়েছিলেন যে দরদরিয়া গ্রামের কোনাে লােকের মামলা যেন থানা গ্রহণ না করে। উনি বলতেন যে যত ব্যস্তই আমি থাকি না কেন তােমাদের বিভেদ হলে আমি সালিশ করে দেব। তিনি মামলা-মােকদ্দমার বিরােধী ছিলেন। মামলা-মােকদ্দমা করে অযথা অপচয়, মনকষাকষি ইত্যাদির বাইরে সুসম্পর্ককে তিনি দাম দিতেন। কালুর বাপ আরও বলেছিলেন যে অন্যের যে কোনাে কাজ, তা যত ছােটই হােক না কেন, আব্বু তা এত আন্তরিকতার সঙ্গে করতেন যেন তার নিজের কাজ। সাধারণত মানুষ অন্যের কাজ কখনােই এত যত্ন নিয়ে করে না।
রিপি : মানুষকে যিনি সত্যিকারের ভালােবাসেন, তিনি তাঁর কাজটিও নিজের মনে করেই করেন। আপন পর ভেদাভেদ করেন না। ভালােবাসার সঙ্গে নিখুঁতভাবে কাজ সম্পন্ন করার অভ্যাসটিও তাঁর চরিত্রের এক অঙ্গ ছিল। কাজ কাজই, সে ব্যাপারে তিনি আপন-পর ভেদাভেদ করতেন না।  রিমি : পরস্পরের সঙ্গে আর সুসম্পর্ক গড়ে তােলার একটা সুন্দর নিদর্শন শফিউদ্দীন দফাদারের ছেলে আজিজের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী ফজর আলীর গুলিতে বালক আজিজ মারা যায়। বন্য শূকর শিকারের সময় এই বালক খেলতে খেলতে বন্দুকের সামনে চলে আসে এবং গুলিবিদ্ধ হয়। আল্লু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং তার প্রাণরক্ষার জন্য রক্তদান করেন। কিস্তু তারপরও তার মৃত্যু ঘটে। তখন আজিজের পরিবার ফজর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলাও আব্দু সালিশের মাধ্যমে মিটিয়ে দেন। আলু বলেন যে এই দুঃখজনক ঘটনা অনিচ্ছাকৃত। আব্বু ঐ শােকসন্তপ্ত ও অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য অনুতপ্ত। দুই পরিবারের মধ্যে মিল করিয়ে দেন। আজও ঐ দুই পরিবারের মধ্যে মিল বিদ্যমান। রিপি : নবী করিম (স.) বলেছিলেন যে পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন ও মিলমিশ করে দেওয়া অতিরিক্ত নামাজ ও দানের চেয়েও উত্তম। আদি (ইয়ােরােপীয় আগ্রাসনের পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী উন্নত সভ্যতার ধারক-বাহক) আমেরিকানদের জীবনধারা পর্যালােচনা করলেও দেখা যায় যে তাদের সমাজে সেই ব্যক্তিকেই সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হতাে, যিনি পরস্পরের মধ্যে শান্তি রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বদা নিয়ােজিত থাকতেন। আব্বুর চারিত্রিক গুণাবলির আলােকে বলা যেতে পারে যে তিনি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
বর্তমানে শাস্তি শিক্ষা, সংঘর্ষ সমাধান” (conflict resolution) মধ্যস্থতা, সালিশ ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা ও আইন প্রতিষ্ঠানগুলােতে পরিলক্ষিত হয়। আন্ধু সেই কাজগুলাে ছেলেবেলা থেকেই করে আসছিলেন।  রিমি : হ্যা, তাই। এখন খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা হয়। আন্তু সেই কতকাল আগে ছাত্রাবস্থায় পল্লি মঙ্গল সমিতি করে তাতে ধর্মগােলা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাৎসরিক ফসল ওঠার পর যারা ধনী, তারা সেই ধর্মগােলাতে আধা মণ করে ধান জমা দিত যাতে আকালের সময় দুস্থ, অভাবী ও গরিব কৃষকেরা সেই মজুদকৃত ফসল থেকে উপকৃত হতে পারে। আব্বুর এ ধরনের সমাজ সচেতনতা ও দায়িত্ববােধ আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি নীরবে এই কাজগুলাে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। রিপি : ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হিসেবে, তার আদর্শকে কীভাবে সামনে নিয়ে আসা যায়। মনে কর?
রিমি : আলাপ, আলােচনা ও গবেষণার মাধ্যমে জানাতে হবে এতে তিনি লাভবান হবেন না। মানুষ ও সমাজ উপকৃত হবে। রিপি : আব্বকে ঘিরে ছােটবেলার বিশেষ স্মৃতি, যা তােমার মনে পড়ছে, তা তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই। রিমি : আব্দুর গাছ নিড়ানাের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। কী অসীম যত্নের সঙ্গে তিনি চারাগাছের মাটি নিড়াতেন। শক্ত মাটিকে দুই হাত দিয়ে ভেঙে গুঁড়া গুড়া করতেন। তারপর কত যত্নের সঙ্গে চারা গাছের শিকড় মাটির ভেতরে বসাতেন। মাটি দিয়ে শিকড় ঢেকে দিয়ে তাতে পানি ঢালতেন তখন আমি দেখে ভাবতাম গাছটা সত্যিই জীবিত। সে একদিন বড় হবে। আব্বুর খুব প্রশংসা করার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। আমি তাে ছােটবেলা থেকেই রান্নাবান্না পছন্দ করতাম। আন্ধু তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীদের বলতেন, দেখ আমার মেয়ে বেঁধেছে’ আব্বু ছােটদেরও দায়িত্ব দিতেন। উনি বিশ্বাস করতেন যে আমরা দায়িত্ব পালন করতে পারব। আব্বু একবাক্যে ছিলেন অনন্য মানুষ।
(সাক্ষাৎকার। বুধবার (১ রমজান ১১ অগাস্ট, ২০১০)
 
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কাণ্ডারী, আহ্বায়িকা ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার
আম্মার শারীরিক অবস্থা বর্তমানে ওঠানামা করছে। সে কারণে এই সাক্ষাৎকার সংক্ষিপ্ত আকারে গৃহীত হলাে। ২০০৭ ও ২০০৮-এ ভিডিওতে আম্মার দীর্ঘ যে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি, তা ভবিষ্যতে প্রকাশের আশা রাখি। রিপি : আম্মা, আব্বুকে একজন মানুষ ও স্বামী হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আম্মা : এমন ব্যক্তিত্ব, এমন স্বচ্ছ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। খুবই মানসম্পন্ন। পরের জন্য অনুভূতি ও বিশ্লেষণমূখী চেতনা খুব প্রখর ও সুদক্ষ ছিল। ওনার কোনাে কথাতে জটিলতা ছিল না। কোনাে জটিল প্যাচের কথা বলতেন না। মানুষ যেটা সহজে বুঝতে পারে, সেভাবেই বলতেন। আমার জীবনে তিনি এক অনন্য-অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমার জীবনে আমি দেখি যে উনি এক অভাবনীয় ও আলােকিত মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন। আমার বিয়ের পর দেখি যে উনি খুব সাধারণভাবে থাকতে পছন্দ করেন। দেশে প্রচুর বৈষয়িক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজে অতি সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন। উনি একটা চৌকিতে থাকতেন। আমাদের বিয়ের সময় ওনার বন্ধুরা নতুন তােশক, বালিশ ও চাদর দিয়ে ঘর সাজিয়ে দেয়। ওনার উপার্জন হতে তিনি দুস্থ, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। নিজের জন্য কিছু রাখতেন না।  ওনার চিন্তাচেতনা ও ব্যবহারের কারণে উনি আমার জীবনে এক আলােড়ন সৃষ্টিকারী মানুষ ছিলেন। (বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০১০)

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ