বাঙলাদেশ: সি পি এম: সি পি আই
ডা. ওমর আলী
একই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-কাঠামাের মধ্যে থেকে এক অংশ অন্য অংশকে উপনিবেশের মতাে শােষণ করবে একথা আমরা শুনিনি কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব অংশে এটা ছিল বাস্তব। আবার একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের এক অংশ আলাদা হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা জানা ছিল না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন বাঙলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উত্তরণ এইরকম আর-একটা বাস্তব।
এই বাস্তবতার অর্থাৎ বাঙলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীন হওয়ার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এই ঘটনা আমাদের মনােভাব অনেক কিছু বুঝতে, বিচার করতে ও বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করেছে।
আমরা জানি এক দেশের মুক্তিসংগ্রাম আর-এক দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করে। এও জানি যে মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম জয়লাভ করলে তার সাফল্য সেই দেশের ভৌগােলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না—তা দ্রুত দেশে দেশে প্রসার লাভ করে। তাই বর্তমান যুগের মহত্তম মুক্তিসংগ্রাম দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধ সারা বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে অভূতপূর্ব প্রেরণা যুগিয়েছে। একই কারণে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য চরিত্রের দিক থেকে ভিন্নতর হলেও ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বােডিয়া, আয়ার্ল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া প্রভৃতি দেশের মুক্তিসংগ্রামীদের উৎসাহ যােগাবে, এবং এমনকি পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কামনাকে ও পাঠানদের পাখতুনিস্তানের দাবি এবং বালুচদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিকে বহুল পরিমাণে অনুপ্রাণিত করবে।
ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে হলেও বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ ও তাদের প্রধান পৃষ্ঠপােষক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত ছিল। তা ছাড়াও এই মুক্তিসংগ্রাম ছিল অবৈজ্ঞানিক ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্ব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা এবং সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যা পুঁজিবাদী, সামন্তবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী শােষণকে বাঙলাদেশে জিইয়ে রেখেছিল দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে।
সুতরাং বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে সাফল্যের অর্থই হলাে সাম্রাজ্যবাদের পরাজয়—শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, প্রকৃত অর্থে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের-বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মধ্যমণির। কেননা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাজেরা বিগত বহু বছর ধরে এবং এই সেদিন পাক-ভারত যুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে প্রচুর আধুনিক ও শক্তিশালী মারণাস্ত্র দিয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে তাকে চাঙ্গা করে রাখছিল পাক ভারত উপমহাদেশে মার্কিনি নয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য। অন্যদিকে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জয় হলাে—অবৈজ্ঞানিক দ্বি-জাতিতত্ত্ব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মন্ধতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার এবং সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় ও প্রতিষ্ঠা।
বাঙলাদেশ আমাদের দেশের বামপন্থী ও গণতন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ করেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, এই ঐক্যকে প্রসারিত করতে হবে একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, আমলাতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। আমাদের জাতীয় জীবনের অগ্রগতির এই হলাে একমাত্র পথ। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য আমাদের কাছে এই তাৎপর্যই বহন করে এনেছে, আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে ভারতের কমিউনিস্ট পাটির গৃহীত নীতির সঙ্গে এর কোথাও কোনাে বিরােধ নেই।
বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের বিস্ময়কর ও তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য ভারতবর্ষের বহু পার্টির বিশেষ করে সি পি এম-এর তত্ত্বগত স্ব-বিরােধীতা ও সুবিধাবাদী অবস্থানকে অত্যন্ত নগ্নভাবে সবার চোখের সামনে হাজির করে দিয়েছে। তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব ঘটনা আদৌ মিলছে না বলে যখন যে রকম তখন সে রকম’ ধরণের সুবিধাবাদী অবস্থান তাকে নিতে হচ্ছে, সুতরাং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া সি পি এম -এর পক্ষে এই অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে আসার কোনাে পথ নেই।
মহান লেনিনের একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা হলাে এই যে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে ধনিকশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদবিরােধী প্রগতিশীল ভূমিকা থাকে। ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে বলা হয়েছিল যে—এটা সাম্রাজ্যবাদের পতন ও সমাজতন্ত্রের উত্থানের যুগ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কী ঘটবে আর কী ঘটবে না তা এখন সাম্রাজ্যবাদী শিবির কর্তৃক নির্ধারিত কোনাে কিছুর মার্কসবাদলেনিনবাদ-সম্মত ব্যাখ্যা তাে দূরের কথা, যুক্তি সম্মত কোন ব্যাখ্যাই দেওয়া যাবে না।
সি পি এম তত্ত্বের গলদ একেবারে গােড়াতেই। এর দায়িত্ব অবশ্য চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের। কেননা, মাওবাদী নেতৃত্বেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এক নতুন তত্ত্ব হাজির করেছিল, যা উল্লিখিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের বিপরীত এবং যে তত্ত্বের ফলে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যাঁরা ১৯৬৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করেছিলেন তাদের ভিত্তি হলাে ঐ মাওবাদী তত্ত্ব।
চীনের চোখে ভারত হলাে সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও সম্প্রসারণবাদী এবং সি পি এম-এর চোখে ভারতরাষ্ট্র হলাে বৃহৎ বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত বুর্জোয়াদের ও জমিদারদের শ্ৰেণীগত শাসনের যন্ত্র। চীন তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল সদ্য-স্বাধীন দেশ] অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব থাকা সত্বেও “যুদ্ধ যে অনিবার্য নয়” —তা প্রথমে মেনে নিয়েও এখন আর মানেনি। সুতরাং যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে উন্নয়নশীল সদ্য স্বাধীন দেশগুলাের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকায় প্রশ্ন চীনের কাছে নিতান্তই অবান্তর। ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামে ধনিকশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদবিরােধী প্রগতিশীল ভূমিকায় লেনিনীয় ততু এইভাবে চীনের বর্তমান মাওবাদী নেতৃত্বের কাছে অসার। চীনা লাইনই সি পি এম-এর তত্বগত ভিত্তি বলে তার মধ্যে এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। তাই সি পি এম শাসক দল ধনিক শ্রেণীর পার্টি নব কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক অংশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।
সি পি এম তত্বগতভাবেই মনে করে যে, কোন সংগ্রাম মার্কসবাদীদের (মার্কসবাদে বিশ্বাসী] নেতৃত্বে পরিচালিত না হলে তার বিপ্লবী সম্ভাবনা থাকে স্বভাবসিদ্ধ বিভেদের কায়দায় বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনগণ সেদিন বিভ্রান্ত হননি। “সাত পার্টি সমন্বয় কমিটি” এবং তার বিপ্লবী বুলি এখন ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে ঠাঁই পেয়েছে আর “বিপ্লবী” মসিউর রহমান এখন পাকিস্তানের চর প্রতিপন্ন হয়ে গ্রেপ্তারের অপেক্ষায়।
সি পি এম-এর মিছিলে মিটিং এ স্লোগান উঠেছিল—“ইন্দিরা ইয়াহিয়া এক হ্যায়।” বলা হয়েছিল— “বাঙলাদেশের মানুষ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়ছে, পশ্চিম বাঙলার মানুষও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়ছে-সুতরাং দুই বাঙলার লড়াই এক,” “ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম বাঙলাকে দিল্লীর উপনিবেশে পরিণত করার চক্রান্ত করছে।” প্রশ্ন তােলা হয়েছিল –“যে সরকার নিজের দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করছে সে কী করে অন্য দেশের মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করবে?” দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছিল—“গণতন্ত্র নিধন যজ্ঞের পুরােহিত ইন্দিরা সরকার কখনই বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মদত দিতে পারে না।”
এ কি শুধু কথার কথা অথবা লেখার জন্যই লেখা? না। সি পি এম তার তত্বগত অবস্থান থেকেই একথা বলেছে, একথা লিখেছে। সি পি এম-এর তত্ব অনুযায়ী ভারত – বর্ষের সরকার বৃহৎ বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত। সুতরাং সে নিজ শ্রেণীস্বার্থেই সাম্রাজ্যবাদের সহযােগি বা দালাল হতে বাধ্য। এ রকম সরকার গণতন্ত্রকে সংকুচিত এবং শেষপর্যন্ত নিধন করতে চাইবে। অতএব এমন কোনাে সংগ্রামকে, তা সে বিশ্বের যে কোনাে প্রান্তেই হােক না কেন, সে সাহায্য করবে না যা স্বাধীনতার জন্য বা গণতন্ত্রের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্যে পরিচালিত হবে।
ঘটনার বাস্তবতা কি ও সি পি এম-এর সযত্নে লালিত ভারতবর্ষের রাষ্ট্রকাঠামাে সম্পর্কিত তত্বকে অত্যন্ত কঠোরভাবে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে দিয়েছে। দেখা গেল, সি পি এম কথিত ‘আধা ফ্যাসিস্ত’, ‘গণতন্ত্রহবে না- সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দ্বারা। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস নয়, ১৯৬০ সালে বিশ্ব কমিউনিস্ট মহাসম্মেলন ঘােষণা করেছিল-সদ্য স্বাধীন দেশগুলাের যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে। দোদুল্যমানতা থাকা সত্ত্বেও মূলত তারা সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী।
এই তত্ত্বের আলােকে এবং ঘটনাবলীর পারস্পরিক যােগসূত্রে অনুসন্ধানের মাধ্যমে মার্কসবাদ-লেনিনবাদসম্মত বিশ্লেষণ নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে গলদ থেকে যাবে একেবারে গােড়ার এবং অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলেও শেষ পর্যন্ত না। তাই বাঙলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওয়ার প্রথম দিকে সংগ্রামের নেতা মুজিবুর রহমান এবং তার পার্টি আওয়ামী লীগ মার্কসবাদা কি না তার হিসাব নিকেশ করতে সি পি এম নেতারা বসে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিসংগ্রাম যখন প্রকৃত পক্ষেই বাস্তব হয়ে উঠল তখন তাতে মার্কসবাদী রং চড়াবার জন্য জনৈক মসিউর রহমানকে আবিষ্কার করে আলীমুদ্দিন স্ট্রীট বসেই সাইনবাের্ডসম্বল ও বাঙলাদেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন “সাত পার্টি সমন্বয় কমিটি” গড়ে প্রচণ্ড হৈ চৈ আরম্ভ করে দিলেই। সুখের কথা সি পি এম-এর নিধনযজ্ঞের পূরােহিত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে- স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, ভারতের হাজার হাজার বীর জাওয়ান বাঙলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, সাম্রাজ্যবাদের চোখেরাঙানি বা সাহায্য বন্ধ করে দেবার চাপের কাছে ভারত সরকার নতি স্বীকার করেনি।
ভারতবর্ষ জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হলাে ১৯৭১ এর ৯ আগস্ট তারিখে স্বাক্ষরিত ভারত, সােভিয়েত মৈত্রী ও সহযােগিতা চুক্তি। এই চুক্তি ভারতবর্ষেকে সাম্রাজ্যবাদী চাপের বিরুদ্ধে সােজা হয়ে দাঁড়াতেই শুধু সাহায্য করেনি, বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কার্যকরী সাহায্য করেছে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজাতিসঙ্ঘে ভারতের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ও তার দোসরদের সমস্ত চক্রান্তকে পর্যুদস্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জানিয়েছে এবং সােভিয়েত রণতরীকে বঙ্গোপসাগরের দিকে পাঠিয়েছে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে উভচর ট্যাংক ও ভারতীয় জাওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর দ্রুত অগ্রগমনের জন্যে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সাহায্য দিয়েছে।
এই ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার গােড়ার দিকে সি পি এম নেতারা নাম-কা-ওয়াস্তে তাকে অভিনন্দন জানালেও চীনের সঙ্গে অনুরূপ চুক্তি করার জন্য ভারত সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, পরে সি পি এম নেতারা তাদের অবস্থান বদলিয়ে মৈত্রীচুক্তি ও সােভিয়েত বিরােধীতা করতে কসুর করেননি বলেছেন—“ভারত-সােভিয়েত চুক্তি বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে পথে বসিয়েছে।” ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি সােভিয়েত সম্পর্কে নেতাদের এই বক্তব্যও কিন্তু শুধু কথার কথা নয়। এর পেছনেও ঐ পার্টির অস্পষ্ট পড়া যায়নি তত্ত্বগত অবস্থান আছে। সি পি এম-এর তত্ত্ব অনুযায়ী সােভিয়েত হলাে শােধনবাদী। যেহেতু শােধনবাদীরা সব সময়ই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করে চলার ***** সেইহেতু সােভিয়েত কখনও বাঙলাদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কোন ইতিবাচক কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে না।
ঘটনা কিন্তু সি পি এম এর ইচ্ছানুসারে অনুযায়ী ঘটেনি। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীরা সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘােষণা সংগ্রামের পক্ষে অন্যতম প্রগতিশীল পার্টিগুলােই এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক বলে অভিনন্দন জানিয়েছে।
বাঙলাদেশের প্রশ্ন চীনের ভূমিকার নিন্দা। করলেও সি পি এম ‘আশা করছে চীন তার মনােভাব বদলাবে। পাকে-প্রকারে তাঁর বােঝাবার চেষ্টা করছেন যে চীনের এই আচরণ সাময়িক। ***** বলেই রেখেছেন যে বাঙালাদেশ প্রশ্নে চীন ও আমেরিকাকে একই ব্র্যাকেটে ফেলা ঠিক হবে না। যদি ঐ একই প্রশ্নে সােভিয়েত ও আমেরিকাকে এক ব্র্যাকেটে ফেলতে তারা কোন দ্বিধা করেননি। বি টি রণদিভে পরিষ্কার বলছেন যে, সােভিয়েত ও আমেরিকা বাঙলাদেশের ব্যাপারে “একটি ঝুটা সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে”।
এখানে সি পি এম-এর তত্ত্ব হলাে-“চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আধুনিক সংশােধনবাদের বিপদের বিরুদ্ধে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অক্ষরাখার সংগ্রামে পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী সাহায্য করেছে।”
বাঙলাদেশের ব্যাপারে চীনের ভূমিকা সবারই জানা। তাই সে নিয়ে অনেক কথা বলা নিষ্প্রয়ােজন। চীনের আচরণ সাময়িক কি না তা এই প্রবন্ধের আলােচ্য বিষয় নয়। শুধু এই টুকু বলে রাখি যে বিগত ১৯৫৪ সালের পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এশিয়াতে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপকে পাকাপাকি করার উদ্দেশ্য স্বাক্ষরিত হরেও বিপ্লবের ইজারাদার চীন কিন্তু আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি। এবং এই সেদিন উত্তর ভিয়েতনামে প্রচণ্ড মার্কিন বােমা বর্ষণ সম্পর্কে টুশব্দটি ও উচ্চারণ করেনি।
বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে সি পি এম অবশ্য তার চিরাচরিত কায়দায় মুক্তিসংগ্রামের সপক্ষে অনেক চেঁচামেচি করেছে এবং মুক্তিসংগ্রামের সাফল্যের অব্যবহিত পূর্বে পলিটব্যুরাের তরফে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে -“বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত করাই হচ্ছে বর্তমান পাক ভারত সংঘর্ষের চূড়ান্ত লক্ষ-আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইয়াহিয়া খা বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধতার উপর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।”
এখানে সি পি এম কার্যত স্বীকার করে নিচ্ছে যে ইন্দিরা সরকারের সৈন্যবাহিনী বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে চূড়ান্ত সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ইন্দিরা সারকার “আধা ফ্যাসিস্ত”, “গণতন্ত্র-নিধনযজ্ঞের পুরােহিত কিংবা বৃহৎ বুর্জোয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত হলে তা কখনই সম্ভব হতাে কি?
পলিটব্যুরাের প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে- “মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ব্যর্থ করতে নিরাপত্তা পরিষদে সি পি এম এখানে তাদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমাধিস্থ করে বিস্ময়ের সঙ্গে হলেও স্বীকার করছে বা স্বীকার করতে বাধা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের ভূমিকা ভুল এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের পক্ষে সহায়ক, চীন যদি “মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অক্ষুন্ন রাখা সংগ্রামে পৃথিবীর শ্রমিকশ্রেণী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী সাহায্য করতাে তাহলে তার ভূমিকা কখনই এরকম হতাে কি?
কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে- সি পি এম এর কোনটা ঠিক? তার তত্ত্ব ও কর্মসূচি? না, সাম্প্রতিক বিবৃতি ও প্রস্তাব? তত্ত্ব ও কর্মসূচির সঙ্গে বিবৃতি ও প্রস্তাব মিলছে না বলে এবং তত্ত্ব ও কর্মসূচিকে সংশােধন না। করে বিবৃতি ও প্রস্তাব রচিত হচ্ছে বলেই এই প্রশ্ন। সােজা কথায়, তত্ত্ব কর্মসূচিকে ঠিক ধরলে বিবৃতি ও প্রস্তাব একটা প্রথম শ্রেণীর ধাপ্পা, আর বিবৃতি ও প্রস্তাবকে ঠিক ধরে তত্ত্ব ও কর্মসূচি ভুল বলে প্রমাণিত হতে বাধ্য। আবার তত্ত্ব ও প্রস্তাবকে ভুল বলা হলে পার্টি ভেঙে নতুন পার্টি গড়ার যৌক্তিকতা থাকে কোথায়?
এইভাবে শুধু পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে জনগণের মধ্যে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই যদি সি পি এমএর একমাত্র কাজ হয় তাহলে জনসাধারণ তার কাছ থেকে কেবলমাত্র বাছা বাছা বিপ্লবী বুলি ছাড়া আর কী আশা করতে পাবে?
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বাঙলাদেশ প্রশ্নে এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই সময় এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। মার্কসবাদ লেনিনবাদসম্মত পদ্ধতিতে ঘটনাবলীর পরাস্পরিক যােগসূত্র অনুসন্ধান করে তাকে বিশ্লেষণ করতে পেরেছে করেই বিভ্রান্তিকর কোন কথাই সে বলেনি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই পার্টির ভবিষদ্বাণী তাই সম্পূর্ণ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তত্ত্ব ও কর্ম সূচির সঙ্গে বিবৃতি ও প্রস্তাব সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল বলেই কোনাে ক্ষেত্রে তাকে সি পি এম এর মতাে টোক গিলতে হয়নি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম থেকেই বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঠিক চরিত্র উদঘাটন করে তার সমর্থনে জাতীয় জনমতকে সংগঠিত করেছে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধীতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়শীল প্রস্তাবসমূহের বিরুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়া ‘ভেটো প্রয়ােগ করেছে। পলিটব্যুরাে সােভিয়েত রাশিয়ার এই ভূমিকার প্রশংসা করেছে এবং এই ভূমিকাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বর্তমান সংঘর্ষে বাইরের শক্তিসমূহ যাতে হস্তক্ষেপ না করে সেজন্য সােভিয়েত রাশিয়া সতর্ক করে দিয়ে যে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরাে সেই সিদ্ধান্তকেও অভিনন্দিত করে।”
অর্থাৎ সি পি এম স্বীকার করছে যে বাংলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েত ভূমিকা সঠিক ও বলিষ্ঠ। এর দ্বারা সােভিয়েত রাশিয়া বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে পথে তাে বসায়ইনি বরং সাফল্যের উত্তুঙ্গ শীর্ষে তুলে ধরেছে। সােভিয়েত যদি শােধনবাদী হতাে তাহলে এরকম হতে পারতকি? পলিটব্যুরাে এও বলেছে – “এটা বিস্ময়ের ব্যাপার যে চীনা জনগণের সাধারণতন্ত্রী সরকার—স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত [বাঙলাদেশের লেখক] জনগণের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া শাসককে সমর্থন করছে।”
আন্দোলন গড়ে তুলেছে, জনসঙ্ঘের উস্কানিমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছে, “দুই বাঙলার চেকপােস্ট পুড়িয়ে ফেলার মতাে দায়িত্বজ্ঞানহীন স্লোগান ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেছে, ভারত সরকারের প্রতিটি দ্বিধা ও দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে জনমতকে সজাগ করেছে এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বাঙলাদেশ প্রশ্ন সঠিকভাবে বুঝতে কার্যকর সাহায্য করেছে। সােভিয়েত রাশিয়া ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঠিক ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অবদান অনস্বীকার্য। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ঐক্যের যে ভিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়েছে তার ওপর আজ শােভা পাচ্ছে বিরাট অট্টালিকা।
বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে ভিতের কথা অনেকের মনে পড়ে না, তা চোখের আড়ালে চলে যায় বলে। কিন্তু তাতে কি ভিতের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা অস্বীকার করা যায়?
সূত্র: সপ্তাহ, ২১ জানুয়ারি ১৯৭২