পাক বর্বরতার কবলে সাংবাদিকরা
রাইফেল মেশিনগান আর ট্যাঙ্কের উপরে কামান-রকেটের সম্ভার নিয়ে নিজের দেশের নিরস্ত্র মানুষদের উপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের রক্তে নিজেদের হাত রাঙাতে পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের একটুও কুণ্ঠা নেই, দ্বিধা নেই। পৈশাচিক উল্লাসে স্বাধীনাত-সংগ্রামী মানুষদের বাড়িঘর, শিক্ষায়তন, বিশ্ববিদ্যালয় আগুনে পুড়িয়ে, চলন্ত বুলডােজারের দম্ভের চাপে দেশের সংস্কৃতিকে মাড়িয়ে গুড়িয়ে জঙ্গী বর্বরতার ইতিহাসে নতুন নতুন পাতা সংযুক্ত করে চলেছে। বিশ্বের শান্তিকামী স্বাধীনতা প্রিয় মানুষেরা এই ভয়ঙ্কর হত্যা ও ধ্বংস দেখে পাকিস্তানি জঙ্গীশাহিকে ধিক্কার দেবার ভাষা নিছয় খুজে পাচ্ছে না। বিশ্বের অনেক জায়গায় অমন বর্বরতা বারে বারে এসেছে, আসছে এবং এখনাে কোথাও কোথাও চলছে। কিন্তু সেসব বর্বরতাকেও হার মানালাে পাকিস্তানি জঙ্গী বর্বরতা। বর্বরতার সিড়ি বেয়ে কত তাড়াতাড়ি আরও নিচুতে আরও অনেক নিচুতে নেমে যেতে হয়, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি শােভনতাকে জঙ্গী বুটের তলায় কেমন করে মাড়িয়ে চলতে হয় ইয়াহিয়া খানের বর্বর সরকার তাও দুনিয়াকে দেখাতে একটুও লজ্জা পাচ্ছে না। দুনিয়ার নানা দেশের প্রায় ত্রিশজন সাংবাদিককে ফৌজী বন্দুক মেশিনগানের প্রহরায় ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে বৃহস্পতিবার রাত্রি থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আটক রাখা হয়েছে। বাইরে বেরুলেই গুলি করে তাদেরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী নিরস্ত্র মানুষদের মত সাবাড় করে দেওয়ার হমকিও দেওয়া হয়েছে। ঘণ্টা সাতেক পর, শুক্রবার সন্ধ্যায় এই বন্দীশালা থেকে তাদের বের করে এনে একটি মিলিটারী ভ্যানে পুরে ঢাকার বিমানঘাটিতে নিয়ে আসা হল। সেখানেও ঘণ্টা নয়েক ধরে তাদের আটকের অভিজ্ঞতা সেখানে এতক্ষণ না খাবার, না পানীয়-কোনও কিছুরই ব্যবস্থা নেই। তার পরের যে ঘটনা সৃষ্টি করতে অসভ্য আদব-কায়দায় পাক জঙ্গীশাহির লজ্জায় একটুও বাধে নি, তার কথা শুনে কিন্তু তামাম সভ্য দুনিয়ার মাথা লজ্জায় হেট হয়ে যাচ্ছে। শর্টহ্যান্ডের নােটবই, পাণ্ডুলিপি, টেপরেকর্ডার, ক্যামেরা সাংবাদিকদের যার কাছে যা কিছু পাওয়া গেছে সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই না তাও নিখুঁতভাবে দেখতে সাংবাদিকদের সকলকেই উলঙ্গ করতেও ওদের অদ্ভুত আদব-কায়দায় একটুও বাধলাে না। সামরিক প্রহরায় করাচিতে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে তাদের নিজের নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। করাচিতেও কিন্তু আর একবার তাঁদের খানাতল্লাসির হুজ্জোত পােয়াতে হয়েছে। সাংবাদিকদের এই অভিজ্ঞতার কাহিনী যে বর্বরতার ইতিহাসে একখানি নতুন পাতা জুড়ে দিয়েছে, সেকথা একটুও মিথ্যা নয়।
সাংবাদিকদের কাজ সংবাদ সংগ্রহ ও তা প্রচার করা। শুধু স্বাভাবিক অবস্থায় নয়, যুদ্ধ বিপ্লব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এই সব ভয়ংকর ব্যাপার ঘটলেও বিশ্বের সব দেশেই সাংবাদিকদের নূন্যতম সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। জেনেভা কনভেনশনে এটি সভ্য দুনিয়ার একটি স্বীকৃত নীতি। কিন্তু ভিয়েতনামের মত দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এই নীতি লঙ্ঘনের সংবাদ কখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু সভ্য দুনিয়ার সভ্য নীতির সম্মান যে নেই অসভ্য পাকিস্তানি জঙ্গীশাহিতে, আজ সারা বিশ্ব সুস্পষ্টভাবে তার প্রমাণ পেল!
রক্তপিপাসু পাকিস্তানি জঙ্গীশাহির অত্যাচারের কাহিনী যাতে বিশ্বে না ছড়িয়ে পড়ে তারই জন্য তাদের যে। এত সতর্কতা, এত অসভ্য আচরণ, সে-কথা তাদের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে এসে সাংবাদিকরা দুনিয়াকে শােনাচ্ছেন। আগেই তাে সেন্সরের কড়া বেড়াজাল দিয়ে তাদের হাত পা বাঁধা হয়েছে, যাতে সত্য সংবাদ বাইরে না প্রকাশ পায়। এখন সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে একসঙ্গে একেবারে দেশ থেকে বার করে দিয়ে ওরা ওদের পৈশাচিক তান্ডব নির্বিঘ্নে চালাতে পারবে বলে মনে করেছে। কিন্তু নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপরে জঙ্গী সরকারের যত কড়া, যত নির্মম, যত বিবেকবােধহীন, যত মনুষ্যত্ববিরােধী অত্যাচার চলুক না কেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষবাই যে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ইতিহাসের আবর্জনা কুন্ডে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিশ্চিত বিজয়ের সূর্যালােকে ধন্য হবে—এই অমােঘ সত্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যও অপেক্ষা করছে। অসভ্য পাক জঙ্গীশাহিও নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বলে ধরে নিয়েছে। আর সেই পরাজিতের মনােভাবেই আক্রন্ত হয়ে নিজের দেশবাসীদের হত্যা করে, বিশ্বের সাংবাদিকদেরও লাঞ্ছিত করতে তাদের বাধছে না এখন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ মার্চ ১৯৭১