You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৭শে আগস্ট, সোমবার, ১৯৭৩, ১০ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত রোধের ঐক্যবদ্ধ আহ্বান

স্বাধীনতার শত্রু ও সমাজবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত দিনের পর দিন চরম আকার ধারণ করছে। এই ষড়যন্ত্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ না করতে না পারলে দেশের অবস্থা এক মারাত্মক ও ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হবে। দেশের তিনটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকগণ গত পরশু সংবাদপত্রে একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করেছেন। এই যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) সাধারণ সম্পাদক পংকট ভট্টাচার্য এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম। নেতৃত্রয় স্বাধীনতা ও সমাজবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশের জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। নেতৃত্রয় যুক্ত বিবৃতিতে হরতালের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্যে দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দুষ্কৃতিকারী, গুপ্তহত্যা, মওজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানী, কালোবাজারী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্যে বিবৃতিতে আবেদন জানানো হয়েছে। বিবৃতি বলা হয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতা, বিশৃঙ্খলা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং সবরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যে দেশের এই তিনটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। নেতৃত্রয় যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন যে, প্রায় দুশ’ বছরে বৃটিশ শাসন এবং পঁচিশ বছরের উপনিবেশ থাকায় এদেশে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারেনি, ফলে খাদ্য, বস্ত্র ও তৈলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে আসছি। বিগত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এই দেশটির যে বিপুল সম্পদ অপচয়িত হয়েছে, তাতেও আমাদের কোন সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতির কারণেই আমরা জীবনের চতুর্দিক থেকে দুর্ভোগের কালোছায়ায় আবৃত হয়ে পড়েছি। অনেকে আবার এই দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে নানা রকম দুর্যোগ ডেকে আনারও কম ফন্দি-ফিকির করছে না। দুষ্কৃতিকারী, চোরাচালানী, গুপ্তঘাতক, মওজুতদার, মুনাফাশিকারীরা গণজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। যৌথ বিবৃতিতে নেতৃত্রয় তাই এদের নির্মূল করার জন্যে জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেছেন। নেতৃত্রয় বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন যে, আভ্যন্তরীন ও বিদেশী শক্তি বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী, মাওপন্থী, পাকিস্তান ও তাদের স্থানীয় চররা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যেমন ঠিক এখনো তেমনি দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন এবং বিঘ্নিত করার জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এরা এখন দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়ানোর চেষ্টাও চালাচ্ছে বলে নেতৃত্রয় বিবৃতিতে বলেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার জন্যে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে এবং বিদেশে সম্ভাব্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলেও নেতৃত্রয় অভিযোগ করেছেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টির তিন সাধারণ সম্পাদকের এই যৌথ বিবৃতি তাই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
আমাদের বিশ্বাস, ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী ছাড়া দেশের বিরাজিত সমস্যাবলীর সমাধান করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কাজেই সময় থাকতেই প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিককে আজ ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্বাধীনতার শত্রুদের শক্ত হাতে প্রতিরোধকল্পে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে বর্তমানে খাদ্য, বস্ত্র ও নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যের যে আকাশ-ছোঁয়া দাম, সে দামের ব্যাপারেও একটা কিছু করা দরকার। কলে-কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে হবে বলাটাই যথেষ্ট নয়, প্রকৃত প্রস্তাবেও উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা দেশের মানুষের জীবনে শান্তি নেমে আসুক—এই চাই। আমরা চাই ভুয়া জনদরদীরা যেন দেশের মানুষকে আর ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাতে না পারে। নেতৃত্রয় তাই যৌক্তি কারণেই উল্লেখ করেছেন যে, মওলানা ভাসানী ৩ দফা দাবীর নামে স্বাধীনতার পর থেকে এক জঘন্য খেলায় মেতে উঠেছেন।
বর্তমানে দেশের যে মারাত্মক অবস্থা তাতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকত্রয় যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন, এ সম্মিলিত আহ্বানের একান্ত দরকার ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা একটা কথা বলতে চাই যে, শুধু স্বাধীনতার শত্রুদের প্রতিহত করার আহ্বান জানালেই সকল সমস্যার রাতারাতি কোন সমাধান হয়ে যাবে না। তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রতিটি কর্মীকেই এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পরিত্যক্ত দোকান-পাট নিয়ে কারচুপি

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পূর্তমন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেন ঢাকার নিউমার্কেটের পরিত্যক্ত বাষট্টিটি দোকানের আয়-ব্যয় সম্পর্কে সাংবাদিক সম্মেলনে এক ভাষণদান করেছেন। পূর্তমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দোকানগুলোর পরিচালনা ব্যবস্থা সম্পর্কে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রশ্ন জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। মন্ত্রী জানিয়েছেন, স্বাধীনতা লাভের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত ‘নগর কমিটি’ পরিত্যক্ত সম্পত্তির মধ্যে দোকানগুলোরও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরিত্যক্ত সম্পত্তির দায়িত্ব নগর কমিটির উপর অর্পণ করেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার নিজের দায়িত্বও শেষ করেন। এদিকে নগর কমিটিও পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিশেষ করে দোকানগুলোর হস্তান্তর দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত হয়, দোকানের আয়-ব্যয়ের সুশৃঙ্খল কোন হিসাব রাখেনি। মন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেনের মতে, দোকানের সম্পদ সম্পর্কেও কোন হিসাব নগর কমিটি রাখেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে যথেষ্ট শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে বলে মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যে অনুমেয়। নগর কমিটি দোকানগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব দোকান কর্মচারী সমিতির উপর অর্পণ করে। মন্ত্রী এরূপ একটি সমিতির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে অভিযোগ আনেন যে, দোকান কর্মচারীরা এখন শুধু পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আর খুশী নয় তারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দোকানগুলোর মালিক হওয়ার জন্যে। এ ব্যাপারে কয়েকটি কর্মচারী সমিতি মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত প্রেরণ করেছে।
আমাদের পূর্তমন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেনের এ তথ্য প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নিউমার্কেটের পরিত্যক্ত বাষট্টিটি দোকানের অব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে আমরা সারাদেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অব্যবস্থার নমুনা তুলে ধরতে পারি। স্বভাবতঃই প্রশ্ন তোলা যায়—কেন পরিত্যক্ত দোকানগুলোর হিসাব পত্র সরকার ঠিকমতো রাখেননি? নগর কমিটির নামে গুটিকতক মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের উপায় ছাড়া এটাকে আর অন্য কিছু ভাবা যায় না। ‘নগর কমিটি’ গঠন করে সরকার তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরিত্যক্ত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের ও হস্তান্তরের। সে দায়িত্ব পালনে যে যথেষ্ট কারচুপি রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এবং সে কারণেই যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, নিউমার্কেটের পরিত্যক্ত দোকানগুলোর হিসাব নেওয়া হয়নি কেন অশুভ অভিসন্ধিতে—তাহলে তা কি একেবারেই অমূলক হবে? ‘নগর কমিটি’ কেন পরিত্যক্ত সম্পত্তির সম্পদের হিসাব না রেখে দোকান কর্মচারীদের উপর পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন তার কারণ জনগণের আজ জানা উচিত। এই হিসাব না রাখার কারণে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ যে বে-হিসাবের খাতায় বিনষ্ট হয়ে যায়নি তাইবা কে বলবে। জনগণের সম্পদ নিয়ে যারা কারচুপি করে তারা জনগণের শত্রু। এদের সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত, সরকার একটি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে যারা ব্যবসা চালিয়েছে অথবা কারচুপির মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনষ্টি ঘটিয়েছে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
নগর কমিটি কেন হিসাব না রেখে সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে তারও মূল কারণ উদ্ঘাটন করা হোক।
আমাদের মতে, দোকান কর্মচারী সমিতির দ্বারা পরিত্যক্ত সম্পত্তি পরিচালিত হোক। দোকানে লভ্যাংশের অংশ পাবার অধিকার তাদের দেওয়া হোক। কিন্তু দোকানের মালিকানা তারা পেতে পারে না। কেননা পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক দেশের জনগণ। এ ব্যাপারে তাই পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। যে সকল সমিতি মালিক হওয়ার প্রচেষ্টা করছে তারা যে ‘নগর কমিটি’র নেতৃবৃন্দের অথবা অন্য কোন প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে বা ইন্ধনেই করছে তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। আমরা সরকারকে সকল প্রভাব কাটিয়ে উঠে জনগণের সম্পত্তির যথার্থ হেফাজত ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানরূপে প্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান জানাই। আর মূলতঃ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সেটাই মহান দায়িত্ব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!