You dont have javascript enabled! Please enable it!

নয়াদিল্লী তৈরী থাকুন

ঢাকার জনপথে দখলদারী পশ্চিমা সৈন্যরা ট্যাঙ্ক নামিয়েছে। আকাশ থেকে জঙ্গী বিমানগুলাে বােমা ফেলছে। বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। স্বাধীন বঙ্গদেশে জনতা উত্তাল। তারা ইয়াহিয়ার ঘাতকদের বিরুদ্ধে জান কবুল করে লড়ছেন। এ লড়াই সমানে সমানে নয়। একদিকে নিরস্ত্র গণতন্ত্রী জনতা এবং অন্যদিকে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সুশিক্ষিত সৈন্যদল। একের সম্বল স্বাধীনতা রক্ষার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং অপরের সম্বল পশুশক্তি। আত্মগােপন করেছেন মুজিবর। মাঝে মাঝে তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে গােপন বেতার কেন্দ্র থেকে। এ কণ্ঠে জ্বলছে দাবানল। হাজার হাজার শহীদ এবং মুক্তিযােদ্ধা দিচ্ছেন তাঁর ভাষা। উদ্বেলিত বঙ্গদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত। প্রত্যেকটি ভারতীয় রাগে ফেটে পড়ছেন। ইয়াহিয়া খানের নরমেধযজ্ঞ তারা সহ্য করতে পারছেন না। লােকসভায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে জনগণের অধীর উৎকণ্ঠা সংগ্রামী বাঙালী জনতার প্রতি তাদের স্বতস্ফূর্ত মমত্ববােধ। দলমতের ভেদাভেদ উঠে গেছে। সবাই একযােগে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ দিচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্বরণ সিং সতর্ক। সরকার আরও সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু সংবাদ পাবেন কোথা থেকে? সব পথ বন্ধ । এমন কি কূটনৈতিক সংবাদের আদান প্রদানের প্রদানের প্রবাহও থেমে গেছে। বেতার কেন্দ্রগুলাে পাঞ্জাবী সৈন্য দলের দখলে। ওদের দেওয়া সংবাদ মিথ্যার ভরপুর। একমাত্র ভরসা, স্বাধীন বাংলা সরকারের গােপন বেতার কেন্দ্র। বঙ্গদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হবে আগামী ক’টি দিনে। জোর লড়াই অবশ্যই চলবে। শহরগুলােতে দখলদারী সৈন্যবাহিনীর দাপট চরমে পৌঁছবে। গ্রামাঞ্চলগুলাের স্বাধীনতা ওরা কেড়ে নিতে পারবে না। মুক্তিযােদ্ধাদের তাড়া খেয়ে প্রাণের দায়ে বিদেশী খুনীরা হয়তাে ঢুকবে ভারতে। নরহন্তারা মানবতার শত্রু। অপরাধীর পাপ্য ব্যবহার তাদের জন্য মজুত থাকবে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশ্ন আলাদা। ওরা যদি অবস্থার চাপে ভারতের আতিথা চান তবে সীমান্তের জনতা অবশ্যই তাদের অভ্যর্থনা জানাবেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত তাদের স্বাগত জানানাে রাজনৈতিক কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনের পথে কোন বাধা মানবেন না সীমান্তের সাধারণ মানুষ। ইসলামাবাদের শাসকচক্র শৃগালের মত ধূর্ত। ওদের বিশ্বাস নেই। বঙ্গদেশকে নিয়ে তারা যে শঠতা এবং হিংস্রতাব নজির রেখেছেন তারপর ভারতের সর্তক না হয়ে উপায় নেই। কাশ্মীর সীমান্তের উপর রয়েছে পাঞ্জাবী স্বৈরাচারীদের শােনদৃষ্টি। সিন্ধী শয়তান ভুট্টো তাদের দোসর। অধিকৃত কাশ্মীরে গত দু’তিন বছর ধরে চলছে হানাদারদের সামরিক শিক্ষা। ওরা হয়তাে আবার অনুপ্রবেশ করবে কাশ্মীরে। পাক সৈন্যদের সাহায্যে বাধাবে সীমান্ত সংঘর্ষ। তারপর করাচী বেতার প্রচার করবে, বঙ্গদেশের অস্থির অবস্থার সুযােগ নিয়ে পাকিস্তানের উপর চড়াও হয়েছে ভারত। বি বি সি তার স্বভাবসিদ্ধ পদ্ধতিতে করাচী বেতারের পাে ধরবে। এ সম্ভাবনাকে কার্যে পরিণত হতে দেওয়া অদূরদর্শিতা। অবিলম্বে আরও সৈন্য পাঠাতে হবে কাশ্মীর সীমান্তে । বন্ধ করতে হবে অনুপ্রবেশের রগুলাে। এক পা ভারতের মাটিতে দিলে কোন পাকিস্তানি বেয়াদব যেন জান নিয়ে স্বদেশে ফিরতে না পারে। সতর্কতা হিসাবেই এ ব্যবস্থার আশু প্রয়ােজন।
কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে আর একটা কঠিন সমস্যা অপেক্ষমান। মুজিবর হয়ত করবেন বঙ্গদেশে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার ঘােষণা। তার বিশেষ দূত বেরিয়ে গেছেন বিশ্বপ্ররিক্রমায়। হয়ত এটা সম্ভাব্য ঘােষণার পূর্বভাস। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছেই হয়ত আসবে কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রথম অনুরােধ। বৃটেন দেবে তার চিরাচরিত কমনওয়েলথ আলােচনার দোহাই। এ দোহাই ভারতের বেলায় খাটে না। নিজের স্বার্থ এবং আদর্শের প্রশ্নে কমনওয়েলথকে থােড়াই কেয়ার করে বৃটেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র সরবরাহ এবং রােডেশিয়ায় শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্তদের তােষামােদ তার জ্বলন্ত সাক্ষী। ভারতের মাটিতে মুজিবরের বিশেষ দূত স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। স্বাধীন বঙ্গসরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের অনুরােধ এলে তা প্রত্যাখ্যান ভারতের আদর্শ বিরােধী। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন গণতান্ত্রিক শক্তি। এ শক্তির অমর্যাদা এবং তাকে বিলুপ্ত হতে দেওয়া অন্যায়। ইসলামাবাদের বিশ্বাসঘাতকদের কাছে কি পেয়েছে ভারত? পর পর দুটি যুদ্ধ এবং নিরবিচ্ছিন্ন শত্রুতা। আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের কোন নমুনা রাখেন নি পাঞ্জাবী সামরিক চক্র। গণতন্ত্রী ভারত এবং গণতন্ত্রী স্বাধীন বঙ্গদেশ রাজনৈতিক সমধর্মী। তাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান এবং পরে সামরিক সাহায্য প্রেরণ ভারতীয় আদর্শের অনুকূলে। নিষ্ক্রিয় বসে থাকার সময় নেই। রক্তে ভিজে যাচ্ছে সােনার বাংলার ধূলিকণা। এ রক্তস্রোত থামাতে হবে। বিশ্বের গণতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপ আলােচনা আরম্ভ অবশ্য কাম্য। রাষ্ট্রসংঘ গণহত্যার নির্বাক দর্শক থাকতে পারে না। প্রয়ােজন হলে ভারতকে এগিয়ে যেতে হবে। ইয়াহিয়া খানের নরমেধযজ্ঞের প্রতিবাদ উঠাতে হবে বিশ্বসভায়। খুনীর হাত থেকে মারণাস্ত্র কেড়ে নেবার দায়িত্ব ভারতের এবং বিশ্বজনমতের। এটা পররাজ্যের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ নয়। এটা স্বাধীন দেশের গণতন্ত্র রক্ষার কঠিন কর্তব্যের এবং মানবতার চিরন্তন আহ্বান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!