You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ইয়াহিয়ার ইরান সফর

ইয়াহিয়া সফর শেষে ইসলামাবাদ পৌঁছে জানান তার সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। আসন্ন সাধারন পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পক্ষে ইসলামী দেশ গুলির অবস্থান শক্ত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কালিদাস বৈদ্য এর বই নিয়া কিছু বিরূপ পোস্ট প্রসঙ্গে  কালিদাসের বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব বইটা হাতে আসলো কয়েক দিন হইল অন লাইনে জামাতের একটি সাইট থেকে। বইয়ে কালিদাস কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হইলেন এবং কিভাবে তারা কাজ করেছেন সেই বিষয়ে আলোচনা। বইয়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে মুজিব কেন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি? কেন তাদের প্লান মত পালাইল না সে বিষয়ে অনেক সমালোচনা আছে। বিএনপি জামাত চক্র সেই অংশটা নিয়াই ব্যাপক অনলাইন লেখালেখি করছে এই লেখা তৈরি করার সময়ে নজরে পড়ল। মুজিব যে ১৯৬২ সন থেকেই নিউক্লিয়াসের বাইরে এদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গেছেন সেই জিনিষ কিন্তু তারা আড়াল করে গেছে আর এই জন্যই এই পোস্ট। কেউ কেউ কায়েদে আজমের সাথে মুজিবের ছবি এডিট করে বুঝাইতে চাইয়াছে মুজিব স্বাধীনতা চান নাই। তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হইতে চাহিয়াছিলেন। আর তাই যদি হইত তা হইলে এত আলোচনা জালাও পোড়াও হইত না। মার্চ কেন জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারিতেই প্রধানমন্ত্রী হইতে পারতেন । ১৫ দিনে তিন গভর্নর ৩ জেনারেল এর প্রয়োজন হইত না। নিচে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হইল।
কালিদাস বৈদ্য এর জন্ম বাগেরহাটের চিতলমারীর সামন্তগাতি। মধুমতী নদীর পশ্চিমেই এই গ্রাম। তাদের বাড়ির কাছেই শেরে বাংলা এর জমিদারী ছিল। দেশ ভাগের সময় কালিদাস ছিলেন ছাত্র, অন্যদের সঙ্গে কোলকাতায় চলিয়া যান। কিন্তু ১৯৫০ সালেই তিনি ফিরিয়া আসেন ঢাকা। মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র থাকার সময় ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত করতে শুরু করিয়াছিলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে উলে¬খযোগ্য ভুমিকা নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় গড়ে ওঠে তখন থেকেই”।
কালিদাস বৈদ্য পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্রত নিয়ে ১৯৫১ সালের শেষ দিকে তিনি চিত্তরঞ্জন ছুতার ও নিরোদ মজুমদার সহ ঢাকায় আসেন। নীরদবাবু ও চিত্তরঞ্জন সুতার সমাজসেবার কাজে যোগ দিলেন।
বইয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশের ব্যাখ্যা
১) শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় ইসলামিয়া (বর্তমান মৌলানা আজাদ) কলেজে ভর্তি হন এবং প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ারদির কাছে রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়ে মুজিব গড়ে উঠলেন ইসলামের এক নির্ভীক সেনাপতি রূপে।
২) সোহরাওয়ারদির সেনাপতি রুপে কলকাতায় তিনি হিন্দু নিধনে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
মন্তব্য- সোহরাওয়ারদি নিজের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনের ঝুকি নিয়ে কলকাতায় রয়ে গেলেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান্ধীর সাথে দেড় বছর কাজ করেন। তরুন শেখ মুজিবের দাঙ্গায় সক্রিয় অংশ নেয়ার প্রশ্ন আসে না কারন তাহার পরিবারের ব্যাবসা ছিল হিন্দু প্রধান উত্তর কলকাতাতে। আবুল হাসিমের বা আবুল মনসুর প্রমুখ উগ্র মুসলিম নেতাদের বইয়ে উক্ত দাঙ্গায় মুজিবের ভুমিকা লেখা আছে যেখানে তাকে শান্তির সপক্ষে নিয়োজিত থাকার কথা বলা হয়েছে।
৩) তিনি আবুল হাসিমকে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা বলেছেন। হাসিম আসলে অখণ্ড বাংলার দাবিদার ছিলেন এবং তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসাবেই বসবাস করে আসছিলেন। ৫০ এর দাঙ্গার পর আক্রান্ত হয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়ে এদেশে আসেন।
৪) ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে চিত্তরঞ্জন বরিশালের একটি হিন্দু আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন।
৫) টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি ২৫-৩০ টি গ্রাম ছিল মুসলমান আর বাকি সব ছিল হিন্দু গ্রাম। কালিদাস সেই হিসাবে ধারনা প্রসুত বলেছেন মুজিবের পরিবার হিন্দু থেকে সৃষ্ট। প্রকৃত সত্য হইল মুজিবের পূর্ব পুরুষ ইরাকি বংশোদ্ভূত আলেম যিনি এই এলাকায় বসতি গড়ার পর অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলমান হইয়াছিল।
৬) মুজিব ছিলেন সুঠাম, সুদর্শন, সুউচ্চ কণ্ঠস্বর, বাকচাতুর্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা পূর্ণ এবং সাহসী নেতা ছিলেন। তিনি ই সোহরাওয়ারদিকে আওয়ামী লীগ গঠনে বাধ্য করেছিলেন।
৭) ন্যাপ গঠনের কালে শেখ মুজিবের নেত্রিত্তে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ন্যাপের সম্মেলনে হামলা করে। প্রকৃত তথ্য হইল মুজিব এই সময়ে এই সব ঝামেলায় ছিলেন না। তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় অনেকটাই চুপ ছিলেন। ( দৈনিক আজাদ )
৮) শেখ মুজিব সাম্প্রদায়িক ছিলেন কারন ১৯৫৮ সালে আওয়ামী শাসনামলে অপারেশন ক্লোজ ডোর এর সময়ে তার দল হিন্দুদের প্রতি অনেক অত্যাচার করেছিলেন ( ইহা সত্য নয় কারন কেন্দ্রে তখন ফিরোজ খান নুনের রিপাব্লিকান সরকার ক্ষমতায় ছিল। এই কাজ ছিল কেন্দ্রিয় সরকারের কাজ। ইহা সেনা প্রধান আইউব খানের সামরিক শাসন জারীর প্রাথমিক কার্যক্রম ছিল )।
৯) তিনি এবং চিত্তবাবু মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন (১৯৬২)। তারা বলেন এক মাত্র তিনি পারবেন স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করতে। তারা মুজিবকে জানান তাদের সম্প্রদায়কে তারা এই আন্দোলনে সামিল করবে। মুজিব খুশি মনে প্রস্তাব গ্রহন করেন।
১০) স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে অন্যান্য দলের সাথে তারা আলাপ আলোচনা করেন। ভাসানি ন্যাপ এর করিম , জাতীয় লীগের আতাউর রহমান, অলি আহাদ তাদের সাথে একমত হন। তিনি বলেন মুজিব কোন কারনে পিছু হটলে তারা এই দুই জনকে বিকল্প তালিকায় রাখেন। (৭১ এ অলি আহাদ মুক্তিযুদ্ধে শরিকানা পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া মৌলবাদীদের সাথে একতাবদ্ধ হন)।
১১) ৬ দফা অন্যদের সাথে আলোচনার আগেই কালিদাস এর সাথে আলোচনা হয় এই সময়ে চিত্তরঞ্জন জেলে ছিলেন। ১৯৬৬ শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের সেই আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের বিশ্বাস এই স্বায়ত্তশাসনের এই আন্দোলন এক সময়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রুপ নেবে। তখন থেকেই তাদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হইত। এই আলোচনা গোপনেই হইত। বিশেষ কিছু বাড়িতে বৈঠক গুলি হইত তা ছিল সংক্ষিপ্ত।
১২) লাহোরে ৬ দফা প্রকাশে তারা খুব আনন্দিত হন। ৬ দফা মুজিবের দলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং এক পর্যায়ে দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।
১৩) আইউব খান শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পর তার পরিবারকে দেখাশুনার কেউ ছিল না। মোল্লা জালালুদ্দিন একমাত্র নেতা যিনি এই দায়িত্ব পালন করে যাইতেছিলেন। এই পর্যায়ে ৬ দফা দাবি চালাইয়া নেয়ার মত কোন নেতা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পরে। শেষে আমেনা বেগম ভালভাবেই এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৪) শেখ মুজিব ও চিত্তরঞ্জন জেলে বসে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করনীয় নির্ধারণ করেন। প্রথম সাক্ষাতে কালিদাস চিত্তরঞ্জন জানতে পারেন মুজিবের উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে।
১৫) জেলেই শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা নেন। কালিদাস ও চিত্তরঞ্জন খুব আনন্দিত হন। (৬৮ এর জানুয়ারি এর আগে)
১৬) রহস্যময় শেখ মুজিবের লন্ডন ভ্রমন ( বিস্তারিত প্রকাশ করেন নাই তবে ধারনা করা যায় ফাণ্ড সংগ্রহ)
১৭) গোপনে ৬ দফার নামে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে মনোনিবেশ করেন কালিদাস ও চিত্তরঞ্জন। মুজিবের নির্দেশে ঢাকায় সংখ্যালঘু সম্মেলন করেন। কুমিল্লার ধিরেন্দ্র নাথ দত্ত (৭১ এ নিহত) ও ছাত্র লীগের স্বপন দত্ত( জাতীয় পতাকার প্রথম ডিজাইনার) সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। তারা এ জন্য মুজিবকে দায়ী করেন। সভায় পরে জাতীয় গন মুক্তিদল গঠন করা হয়। কালিদাস সাধারন সম্পাদক হন চিত্তরঞ্জন সদস্য হন। সভাপতি হন কার্ত্তিক ঠাকুর। ৭০ এর নির্বাচনে কার্ত্তিক বাবু তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলেন।
১৮) গনমুক্তি দলের বৈঠকে গোয়েন্দা হানা হয়। সেখানেই প্রথম তারা জানেন যে পুলিশ তাদের ৩ জনের পরিকল্পনার কথা জানে। (পৃষ্ঠা ১১৫)
১৯) স্বাধীনতার প্রস্তুতি কার্যক্রমের অংশ হিসাবে চিত্তরঞ্জন কে কলকাতায় পাঠানো হয়। ( চিত্তবাবুর ফিরে আসার প্রয়োজন হয় নাই বাংলাদেশ থেকে নেতারা কলকাতা গিয়ে দেখলেন কে কোথায় উঠবেন তা সব ঠিক করা)
২০) মুজিব প্রধানমন্ত্রিতের লোভে স্বাধীনতার দাবী পরিত্যাগ করছেন? (অসহযোগের সময় কালিদাস মুজিবের সাক্ষাত পাইতেছিলেন না আর অনেক জনের মতই তারা চাইতেছিলেন মুজিব সাংবাদিক সম্মেলন করে বা প্রেসে বিবৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করুক বা ভারতে পালাইয়া যাক। মুজিব এই নীতিতে রাজী ছিলেন না। এই পর্যায়ে মুজিবের গোপন পরিকল্পনা কেবল জানত জহুর আহম্মদ চৌধুরী( ৮ এপ্রিল ১৯৭২ এর ভাষণ) এবং আব্দুর রাজ্জাক ( জি ডব্লিউ চৌধুরী )। এই জন্যই এই গ্রুপ খুব সহজে ভারতে যাইতে পারিয়াছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের বিষয় জহুর সাহেবকেই দেয়া হয়েছিল( ৯ এপ্রিল ১৯৭২ আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ মুজিবের বক্তৃতা) যা অন্যরা জানত না।
সামগ্রিক মন্তব্য ঃ কালিদাস বাবু এবং চিত্তরঞ্জন কলকাতায় প্রবাসী সরকারে যুক্ত হতে পারেন নাই। ফলে তাদের মনোবেদনা বেশী ছিল। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী চিত্তবাবুকে শেখ মুজিব এমপি করেছিলেন। কালিদাসকে করেন নাই। তাদের চাওয়া পাওয়া আরও বেশী ছিল। এমপি সত্ত্বেও চিত্ত রঞ্জন কলকাতাতেই বেশী থাকতেন। ১১ আগসট ১৯৭৫ এর পর ভারতে যাওয়ার পর আর বাংলাদেশে আর আসেন নাই। কালিদাস পরে বাংলাদেশী নাগরিক ছিলেন না। এরশাদের আমলে তারা স্বাধীন বঙ্গভুমি আন্দোলন করে পরিচিতি পান।
এরা দুই জন মুজিব বাহিনী গঠনের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িত ছিলেন। মুজিব বাহিনীর ভুমিকা কি ছিল তা সবাই জানে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!