You dont have javascript enabled! Please enable it!

জামাতের অর্থের উৎস!

যেকোন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনার জন্য কমবেশি অর্থের প্রয়ােজন হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলাের কথাই বলছি। সাধারণত সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা ও বিত্তবান মহলের কাছ থেকে সংগৃহীত এককালীন অনুদান দ্বারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে। দলের সম্মেলন, সভাসমিতি, সংসদ নির্বাচন প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মের বাইরেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এসব অর্থ সংগ্রহের সূত্র বাইরের লােকদের জানার কথা নয়। তবে অনেক সময় বাহ্যিক তৎপরতা দেখে কিছুটা অনুমান করা যায়। বাংলাদেশে জামাতের আর্থিক অবস্থা অন্য আর পাঁচটা রাজনৈতিক সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জামাতের ঢাকা মহানগর কার্যালয়টি জাঁকজমকের দিক থেকে যেকোন বহুজাতিক সংস্থার অফিসকেও হার মানিয়ে দেয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এতাে বিপুল অর্থ তারা পায় কোথেকে? কারা এবং কি স্বার্থে। তাদের এই অর্থ প্রদান করে থাকে? পাকিস্তান আমলে জামাত-কর্মীদেরকে জাকাত ও কোরবানীর চামড়া তুলতে দেখা গেছে। সে সময় কোন কোন মহল থেকে জামাতের বিরুদ্ধে গরীবের হক জাকাত ও কোরবানীর চামড়া বিক্রিলব্ধ অর্থ রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করার অভিযােগ ওঠে। কিন্তু জামাত তখন এসব অভিযােগ সম্পর্কে প্রতিবাদ করে। মূলত জামাত তখন প্রতিবাদ করলেও এই অভিযােগ ভিত্তিহীন ছিলাে না। এককালের জামাত নেতা মওলানা কাউসার নিয়াজির একটি ঐতিহাসিক চিঠিতে তার প্রমাণ রয়েছে। এটি তিনি ১৯৬৪ সালের ৩১ অক্টোবর মওদুদী সাহেবকে লেখেন। উক্ত চিঠির এক জায়গায় মওলানা নিয়াজি লিখেছেন, “আজ প্রায় দেড় বছর পর দেখছি, দোষ ক্রমে বেড়েই চলছে, কমছে না। পারস্পরিক শত্রুতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেনদেনের ব্যাপারে কর্মীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের নেতাদের ভূমিকাও অত্যন্ত দুঃখজনক। আমানত নষ্ট হচ্ছে। ওশর ও জাকাতের অর্থ নিছক রাজনীতি, নির্বাচনী কর্মসূচী এবং সার্বক্ষণিক কর্মীদের বেতনে ব্যয় করা হচ্ছে।  প্রচলিত রাজনৈতিক আলােচনা অত্যন্ত প্রাধান্য লাভ করেছে। আমাদের সভা-সমিতিতে আল্লাহ ও রাসূলের আলােচনা নামকাওয়াস্তে করা হচ্ছে।

ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আমরা অলসতার শিকার হয়ে পড়েছি। এটা সম্ভবত আমাদের বই-পুস্তকের অবচেতন প্রভাবের  পরিণতি। কারণ এসব বই-পুস্তকে ইবাদতকে মূল লক্ষ্যের মাধ্যম ও উপায় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আমরা আমাদের কর্মীদেরকে ধারণা দিয়েছি, জনসভা রাজনৈতিক ফললাভের উপলক্ষ মাত্র, আমরা সব সময় হাসপাতাল ও অন্যান্য জনসেবামূলক কাজগুলােকে জামাতের প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মাপকাঠিতে বিবেচনা করে যাচ্ছি। তাতে করে আমরা কোন রাজনৈতিক কিংবা সাময়িক উদ্দেশ্য হাসিলের সুযােগ ছাড়া জনসেবার কোন কর্মসূচী বাস্তবায়িত করি না।” মওলানা কাউসার নিয়াজির এই ঐতিহাসিক চিঠিটি একটি দর্পণ তাতে জামাতিদের ধর্মের নামে, জনসেবার নামে কদর্য চেহারাই ভেসে উঠেছে। শরিয়তের বিধানে জাকাতের অর্থব্যয়ের নির্ধারিত খাত আছে। পবিত্র কোরআনে জাকাতের অর্থব্যয়ের খাত পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব খাতের বাইরে জাকাতের অর্থ প্রদান করলে জাকাতই আদায় হবে না। এমনকি মসজিদ নির্মাণ কাজেও জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। যে গরীব মানুষটি জাকাত পাওয়ার যােগ্য, তাকে দেয়ার সময় বলে দিতে হবে, তােমাকে জাকাতের অর্থ দিচ্ছি।’ অথচ পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী জামাত মানুষের জাকাতের অর্থ নিয়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীদের বেতন দিচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করছে। জামাত নেতারা কি জঘন্য প্রকৃতির আগে তাে শুধু দেশীয় বিত্তবানদের কাছ থেকে জামাত অর্থ সংগ্রহ করতাে। এখন নাকি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও কোটি কোটি টাকা জাকাত সংগ্রহ করছে। আর সেসব টাকা রাজনৈতিক কাজে ব্যয় করছে। সত্যি তাদের কি পরকালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহির এতটুকু ভয় নেই ?  শােনা যায়, জামাতিরা নাকি ২৬টি চ্যানেল থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে থাকে।

এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ১৯৮৭ সংখ্যায় বলা হয়েছে : “১৯৭১ সালের গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ধর্ম ব্যবসায়ী জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। এদের কর্মতৎপরতা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের প্রধান উৎস হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ। জামাত বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যার অর্ধশত অংগ সংগঠনসহ শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সকল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা দিয়ে জামাত এদেশের মানুষের সমর্থন ক্রয় করছে। আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানে জামাতে ইসলামীর বিভিন্ন অপকৌশল এবং স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের বিচিত্র তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় আমরা জামাত এবং শিবিরের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। জামাতের জনৈক ফয়সাল আহমেদ আলােচনা প্রসঙ্গে আমাদের জানান,  প্রয়ােজনের সময় ‘৭১-এর অস্ত্রগুলাে আবার ব্যবহার হবে। জামাত কাউকে ক্ষমা করবে না।” [ উক্ত সাময়িকীর ১৭ এপ্রিল, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয়েছে, কিন্তু টাকা যােগায় কে ? কেননা এই সংগঠনে সদস্য চাঁদা বলে কিছু নেই। টাকার উৎস সম্পর্কে জামাতিরা কেউ কথা বলতে চায় না। একটি সূত্র আভাস দিয়েছে, বিদেশে লােক পাঠানাের মধ্য দিয়ে টাকা আসে। গত এক বছর ধরে গােলাম আযমের ব্যক্তিগত অনুমােদন ছাড়া কেউ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার ভিসা পর্যন্ত পায় না। এর অনেক প্রমাণ আছে। সম্প্রতি দু’জন বাংলাদেশী সাংবাদিক ইসলামী সংবাদ সংস্থায় চাকরি পেয়েও এ কারণে ভিসা পাননি। জানা গেছে, ঐ দেশটি থেকে প্রতিমাসে জামাতের অনুসারীরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা পাঠায়। এ কারণেই সম্ভব হয়েছে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি সমাপ্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়ােজন করা।” জামাতের অর্থ সংগ্রহের উৎস উল্লেখ করে সৌদি আরবে প্রবাসী একজন বাঙ্গালী একটি চিঠি লিখেছেন। এই চিঠিটি বিচিত্রা’র ১৮ নভেম্বর, ১৯৮৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ সংগ্রহে জামাতের নতুন পদ্ধতি’ শীর্ষক উক্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, কিছুদিন আগে আমাদের বাসায় বাংলাদেশের ‘খাঁটি মুসলমান পার্টি জামাতে ইসলামীর’ একজন ঈমানদার কর্মী একটি ভিডিও ক্যাসেট এনে দেখালাে।

তাতে দেখলাম, ১৯৭১ সালের নরপশু গােলাম আযম, সুন্দরভাবে পুরাে মুখে দাড়ি, গায়ে ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বন্যাদুর্গত এলাকায় তার দোসর আব্বাস আলী খানসহ খিচুড়ি বিতরণ করছেন। জামাতের ‘ঈমানদার কর্মীটি’র কাছে শুনলাম বিদেশে তাদের প্রত্যেক সহকর্মীর কাছে, বাংলাদেশ থেকে জামাতে ইসলামীর কর্তারা বহু ভিডিও ক্যাসেট পাঠিয়েছে। আমি তাদেরই একজন সমর্থক সেজে উক্ত কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম ক্যাসেটগুলাে তাদের কাছে কেন পাঠানাে হয়েছে। কর্মীটি আমাকে তাঁদের ‘ঈমানদার’ কর্মীর একজন ভেবে বললাে, তাদের কাজ উক্ত ক্যাসেটগুলাে ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হােক সৌদিবাসীদের দেখাতে হবে এবং বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালীদের উক্ত ক্যাসেট দেখিয়ে তাদের পার্টির সমর্থক বানিয়ে মােটা অংকের চাঁদা আদায় করতে হবে। যদি চাঁদা আদায় করতে কোন কর্মীর কোন ক্রটি হয় তাহলে জামাত থেকে তার সদস্য পদ বাতিল হবে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের পরিবারের ওপর জুলুম করা হবে বলে একটি হলুদ কাগজে করে নির্দেশনামা পাঠানাে হয়েছে প্রত্যেক কর্মীর কাছে। যার দরুন সৌদিয়ায় অবস্থানকারী প্রত্যেক জামাতকর্মী মরিয়া হয়ে উক্ত নির্দেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর। এভাবে জামাত নেতারা আরব দেশগুলাে থেকে তাঁদের কর্মীদের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করে ঐ টাকায় অস্ত্র কিনে আমাদের দশের নিরীহ সরল ছেলেদের ইসলামের দোহাই দিয়ে খুনী বানাচ্ছে। খুন করছে আমার নিস্পাপ ভাইদের। নির্যাতন করছ আমার মা-বােনদের। দিদারুল বশর চৌধুরী দুদু, পােস্ট বক্স নং-১১০৬১, জেদ্দা, কে.এস.এ.।”  ১৪ মার্চ, ১৯৮৬ সংখ্যায় বলা হয়েছে, “সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জামাতে ইসলামী এবং জামাত সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির ধর্মের নামে ভাঁওতাবাজির রাজনীতির অছিলায় প্রচুর পরিমাণে অর্থ খরচ করেছে। তারা নতুন নতুন বাড়ি কিনছে, মােটর সাইকেল ও গাড়ি কিনছে, অত্যাধুনিক কায়দায় অফিস সাজাচ্ছে, নামে-বেনামে রয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক প্রেস।

তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক কর্মচারীদের খরচ বহন, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্মী সম্মেলন, জনসভা প্রভৃতি দেখে জনমনে জামাতের টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছুদিন পূর্বে ইসলামী ছাত্র শিবিরের একটি দলিল থেকে তাদের টাকা যােগানাের বিদেশী উৎসের চাঞ্চল্যকর প্রমাণ পাওয়া গেছে। দলিলটিতে দেখা যায়, দু’বছরের জন্য ইসলামী ছাত্র শিবিরের ৫টি প্রকল্পের জন্যে খরচ দেখানাে হয়েছে মােট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫ শ’ ৩৩ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের বর্তমান মুদ্রামানে এর পরিমাণ ২ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬ শ’ ৯৫ টাকার মতাে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৪শ’ ডলার তাদের নিজেদের সংগঠন ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে দলিলে বলা হয়েছে। বাকি ৫ লাখ ৫৩ হাজার ১শ’ ৩৩ মার্কিন ডলার চেয়ে তারা সৌদি আরবের একটি উৎস জনৈক ফৈয়াজ ভাই-এর কাছে আবেদন জানিয়েছে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলের সঙ্গে তাদের তৎকালীন সভাপতি আবু তাহেরের চিঠি রয়েছে। দলিলে ৫টি প্রকল্পের বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ ছিল নিম্নরূপ :

১। প্রচার ও প্রকাশনা – (ক) মুদ্রণ যন্ত্রপাতি বাবদ ২৭ লাখ টাকা, অন্যান্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাড়ি নির্মাণ বাবদ ১২ লাখ টাকা। মােট ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। (খ) বিক্রয় কেন্দ্রসহ প্রকাশনার মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার।

২। ফুলকুঁড়ি শিশুসংগঠনের মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।

৩। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা কোর্স (দলিলে উল্লেখ আছে বাইবেল করেসপনডেন্স কোর্সের মত) বাবদ মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ২০ হাজার মার্কিন ডলার।

৪। ছাত্র কল্যাণ ও বৃত্তি খাতে খরচ দেখানাে হয়েছে মােট ১৫ লাখ ৮ হাজার টাকা।

৫। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মােট বাজেট দেখানাে হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। “ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ জামাতের একটি অঙ্গ কিংবা সহযােগী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর শুধু কুয়েতের জাতীয় অর্থ সংগ্রহ কমিটির কাছ থেকেই ২৫ লাখ টাকা পেয়ে থাকে। এরপরও অর্থ চেয়ে চিঠি ও টেলেক্স পাঠানাে হয়। কুয়েতের উক্ত কমিটি আরাে অর্থ প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করে পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠির আরবী ও বাংলা অনুবাদ নিচে দেয়া হলাে : 

কিন্তু ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ তাদের বুকলেটে আয়ের যেসব উৎস উল্লেখ করেছে, তাতে কুয়েতের এই উৎসটি উল্লেখ করা হয়নি।  “উপরােক্ত বিবরণ থেকেই বােঝা যায়, জামাতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলাের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিঃসন্দেহে বেশ জোরালাে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের পূর্বে আমরা জামাতের ঢাকা শহরের বিভিন্ন অফিসে গিয়েছি বিস্মিত হয়েছি জামাতের ঢাকা মহানগরী অফিসে গিয়ে। মূল্যবান রেফ্রিজারেটর এবং এয়ারকুলার পর্যন্ত রয়েছে এ অফিসটিতে। আর আসবাবপত্র এমন চকচকে এবং আধুনিক যা যেকোন বহুজাতিক কর্পোরেশনের অফিসগুলােকেও হার মানায়। শােনা যায়, জামাতের বিভিন্ন অফিসের এই রমরমা অবস্থা বজায় রাখার জন্য জামাতের মােট বাজেটের সিকি ভাগ খরচ হয় আর বাকি অর্থ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।” 

সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ১৯৮৭ সংখ্যায় আরাে বলা হয়েছে : “জামাতে ইসলামী একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে তারা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে থাকে। বাস্তব ক্ষেত্রে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় আদর্শের কোন প্রতিফলন নেই। শুধুমাত্র এ কারণেই তারা সৌদি রাজতন্ত্রের দেয়া মােটা অঙ্কের পেট্রোডলার গ্রহণ করে ইসলামে রাজতন্ত্র বৈধ করার চেষ্টা করছে। যদিও পবিত্র ইসলামে রাজতন্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থ কেন্দ্র করে কখনাে কখনাে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জামাতিদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। আর তখন ধর্মের নামে তাদের ভন্ডামি প্রকাশ হয়ে পড়ে। অর্থ ভাগাভাগি কেন্দ্র করে দলত্যাগ করেছেন জামাতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় একজন রােকন— ঢাকা সেন্ট্রাল রােডের জনৈক সােহরাবউদ্দিন আহমেদ।

পদত্যাগ পত্রটি তিনি জামাতে ইসলামীর আমীরের নিকট পাঠিয়েছেন। স্বহস্তে লিখিত পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন : “.প্রত্যক্ষ দর্শন ও অভিজ্ঞতার আলোেক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ সংগঠন ইসলামী আন্দোলন থেকে  বিচ্যুত হয়ে ক্রমশ ভিন্ন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। সংশােধনের কোন পথ এবং পদ্ধতি এর মধ্য থেকে করা সম্ভব নয় বলে আমার দৃঢ় –(অস্পষ্ট)– জন্মেছে।” পদত্যাগ পত্রের শেষাংশে তিনি জামাতিদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ এনেছেন এবং তাদের অর্থ সরবরাহের প্রধান উৎস যে সৌদি আরব তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন : “বর্তমানে জামাতের কিছু তরুণ নেতা জামাতকে প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার পরিবর্তে সৌদি বাদশাহীর প্রতি বাধিত করছে। গরীব রােকন ও কর্মিগণের সরলতা ও ঝরানাে রক্তকে নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে লাগাচ্ছে।”

“সম্প্রতি দলত্যাগ করেছেন এমন একজন জামাত সমর্থিত শিবির কর্মী জানান, অর্থ ভাগাভাগি কেন্দ্র করে জামাতের ভেতর বেশ কয়েকটি গ্রুপিং আছে এবং এদের মধ্যে অনেকেই দলত্যাগ করেছেন। দলত্যাগীরা যাতে দলত্যাগের আসল কারণ বাইরে প্রকাশ না করে তার জন্য নাকি তারা নানা ধরনের হুমকিও দিয়ে থাকে। তিনি আরাে জানান, যেসব কারণে ইসলামী ছাত্র শিবির আজ দু’ভাগে বিভক্ত সেগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ইস্যু হচ্ছে জামাতের আর্থিক বিষয়। সুলতান আহমেদ নেতৃত্বাধীন শিবিরের এই বিক্ষুব্ধ অংশটি  সম্পূর্ণভাবে বর্তমান জামাত বিরােধী।” ” কথায় আছে, ‘পাতিলের ভাত একটা টিপলেই বুঝা যায় সবগুলাে সিদ্ধ হয়েছে কিনা। জামাতের অর্থের উৎস বা অর্থ সংগ্রহের উৎস প্রমাণাদির অভাবে উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও তার অঙ্গ বা সহযােগী সংগঠনের অর্থের দু’একটা উৎস থেকে সহজে অনুমান করা যায় বাংলাদেশের আদর্শ-বিরােধী ইসলামের মুখােশধারী এই দলটি দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে থাকে। এই প্রসঙ্গে স্বভাবতই প্রশ্নজাগে—দাতা দেশগুলাে জামাতকে কি উদ্দেশ্যে এই বিপুল অর্থ সরবরাহ করে থাকে। জামাতই বা এই অর্থ এদেশে কিভাবে ব্যয় করছে। এই অর্থ সংগ্রহে বিশেষ করে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে রাষ্ট্রের আইন-কানুন অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা। দেশের অর্থনীতিতে এই অঢেল অর্থের কিরূপ প্রভাব পড়ছে। উপরে উল্লিখিত কয়েকটি তথ্য থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়, জামাত ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলাের অর্থ সংগ্রহের প্রধান উৎস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাে। এসব দেশ অবশ্যই জানে, মুক্তিযুদ্ধে জামাতের ভূমিকা কি ছিলাে এবং আজো যে জামাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এ বিষয়টিও সেসব দেশের অজানা থাকার কথা নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে জামাতকে অর্থ সরবরাহ করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী তৎপরতায় সহযােগিতা করারই নামান্তর। আরব দেশগুলাের এই আচরণ আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ মনে করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম আরব দেশগুলাের কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার আশা করি না।

আর যদি বলা হয়, জামাতের সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন মুসলিম দেশের গরীব জনসাধারণকে সাহায্যের কর্মসূচীর অধীন জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলােকে সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই অর্থ বাংলাদেশের আদর্শ বিরােধী একটি রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে দেয়া হবে কেন? আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত তহবিল রয়েছে। ত্রাণ তহবিল রয়েছে। আরব বন্ধু দেশগুলাে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অর্থ হস্তান্তর করতে পারেন। তাছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশী অর্থ গ্রহণের নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন রয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়েও বলা যায়, কোন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের সাহায্য গ্রহণের পূর্বাহ্বে সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হয় ব্যয় সম্পর্কেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে বিস্তারিত তথ্য জানাতে হয়। অভিযােগ রয়েছে, জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাে বিদেশী অর্থ গ্রহণের সময় দেশে প্রচলিত আইনকানুন অনুসরণ করছে না। জামাত ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ ও তার ব্যয় সম্পর্কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রশ্ন রয়েছে। একথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাতের অর্থ সবাইকে দেয়া যায় না। এই অর্থ ব্যয়ের নির্ধারিত খাত রয়েছে। যাদের বা যেসব খাতে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের বিধান রয়েছে তার বাইরে ব্যয় করা যাবে না। অন্যথায় জাকাতই আদায় হবে না।

যাকে জাকাতের অর্থ দেয়া হবে, তাকে জানিয়ে দিতে হবে, আপনাকে জাকাতের অর্থ দেয়া হচ্ছে। জাকাতের অর্থ দ্বারা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা যাবে না। কিন্তু জামাত বা তার অঙ্গ ও সহযােগী সংগঠনগুলাে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সংগৃহীত জাকাতের অর্থ দেশের গরীব জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করছে কিনা কেউ বলতে পারবে না। অপরদিকে দেখা যায়, অঢেল অর্থ তারা রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করছে। এ থেকে স্বভাবতই ধরে নেয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাকাত ও ইসলাম প্রচারের নাম করে সংগৃহীত অর্থ তারা রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করছে। কারাে কারাে মতে নিজেরাও ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। পবিত্র ইসলামের নামে জামাতিদের এই অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের আলেম সমাজও নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এ ব্যাপারে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক, বিশেষ করে আলেম সমাজের প্রতিবাদ করা ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।  অপরদিকে সরকারের অজানা সূত্রে বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিপুল অর্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা শুধু প্রচলিত আইন-কানুন বিরােধীই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তুলছে, মুদ্রার অবমূল্যায়নে ইন্ধন যােগাচ্ছে।

কিন্তু সরকার রহস্যজনকভাবে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাের আয়-ব্যয় দেখতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের বিরাট কূটনৈতিকবহর রয়েছে। তাদের মাধ্যমে এ ব্যাপারটির প্রতি সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। সরকারের পক্ষে জামাতের দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরােধী এসব তৎপরতা বন্ধ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।  সরকার যদি জামাতের এসব তৎপরতা প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে মােকাবেলার একটা কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে এই নীতি দেশ, জাতি, এমনকি সরকারের জন্যও কল্যাণকর হবে না। আজকের ইরান তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ইরানের রেজা শাহও এক সময় এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। পরিণামে তাঁকেও দেশ ত্যাগ  করতে হয়েছে। বিদেশে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাঁর পরিবার-পরিজন ও আত্মায়স্বজনদের প্রবাসে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

Reference:

জামাতের আসল চেহারা – মওলানা আবদুল আউয়াল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!