You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966 | মুজিবকে ভুট্টোর ওপেন চ্যালেঞ্জ | ৬ দফা নিয়ে তর্কযুদ্ধ | অবশেষে কী হল? - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিব-ভুট্টো তর্কযুদ্ধ

ভুট্টো তখন আইয়ুবের বিদেশমন্ত্রী। তিনি আইয়ুবকে বললেন : মুজিবকে জেলে না পুরে তার সংগে আগে আমাকে রাজনৈতিক লড়াই করতে দিন। এই লড়াই হল তিনি ছফদফা দাবি নিয়ে মুজিবকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান জানাবেন। মুজিব রাজি হলে ঢাকায় জনসভা ডাকা হবে। সেই সভায় তিনি মুজিবের সংগে ছয়দফা নিয়ে তর্ক করবেন। প্রমাণ করে দেবেন ছয়দফা অত্যন্ত অন্যায় ও বাজে দাবি। জনসাধারনের সামনে এইভাবে তিনি মুজিবকে পরাস্ত ও ব্যর্থ করে দেবেন। আইয়ুব সম্ভবত ভুট্টোর এই প্রস্তাবে প্রথমদিকে রাজি হয়েছিলেন না। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে বসে ভুট্টো শেখ সাহেবকে তার সংগে তর্কযুদ্ধে নামার আহ্বান জানালেন। চারদিকে বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দিল।

 

সকলের মনে প্রশ্ন, শেখ সাহেব কি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন? আমরা ইংরেজ নাইটদের মধ্যে মধ্যযুগে ডুয়েলের গল্প পড়েছি। বাংলাদেশেও দুই মােল্লার মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ওয়াজের মাহফিলে বাহাস’ হতে দেখেছি। কিন্তু দুইজন আধুনিক রাজনৈতিক নেতার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে তর্ক যুদ্ধ? এ সম্পূর্ণ নতুন। আমরা সাংবাদিকরা ছুটলাম শেখ সাহেবের ধানমণ্ডির বাসায়। শেখ বাইরে ইজি চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন। উত্তেজনায় তখন আমাদের রয়ে সয়ে কথা বলার সময় নেই। সরাসরি প্রশ্ন করলাম : মুজিব ভাই, আপনি কি ভূট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন? বঙ্গবন্ধুর পাশে তাজুদ্দিনসহ আরাে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বসা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। বললেন : আমার প্রশ্নের জবাব দেবে তাজুদ্দিন। আমরা তাজুদ্দিনকে ঘিরে ধরলাম : কি খবর তাজুদ্দিন ভাই? তাজুদ্দিন বললেন ; আমি আজ বিকেলে আওয়ামী লীগ অফিসে একটা সাংবাদিক সভা ডেকেছি। সেখানে এ প্রশ্নের জবাব দেব।  বিকেলে আমরা ছুটলাম আওয়ামী লীগ অফিসে। তাজুদ্দিন ভাবলেশহীন মুখে বসে কাগজ পড়ছেন। কাগজ থেকে মুখ তুলেই বললেন : আপনারা সকলেই এসেছেন? কে একজন বললেন : হ্যাঁ, সবাই উপস্থিত। তাজুদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রেস রিলিজের একটা করে কপি দিলেন সকলের হাতে। বললেন : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। আমরা নিজেদের অজান্তে আনন্দ ধ্বনি করে উঠলাম। এরপরের ঘটনা দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত। করাচী, পিণ্ডি ও ঢাকার কাগজে বিরাট খবর বেরুলাে : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। ঢাকার পল্টনের জনসভায় দুই নেতা মুখােমুখি তর্ক যুদ্ধে নামবেন। জনসভার দিনক্ষণ ঠিক হল। বিরাট দল নিয়ে ঢাকা এলেন ভুট্টো। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মনে মনে তখন একটু ভীত। পারবেন কি শেখ মুজিব ভূট্টোর সংগে তর্ক যুদ্ধে? শেখ মুজিব জনপ্রিয় জননেতা। কিন্তু ভুট্টোর মত তিনি পণ্ডিত নন। ভুট্টোর মত বাকচাতুরি তিনি জানেন না। তাছাড়া তার সংগে বিরাট বিশেষজ্ঞ দল। তাজুদ্দিনকে ফোন করলাম। তিনি বললেন : উহু এখন আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। ভুট্টোর সংগে তর্ক যুদ্ধে মুজিব ভাই যেসব কথা বলবেন, আমি তার ফ্যাকটস-ফিগার জোগাড় করতে ব্যস্ত। মুজিব যে ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন একথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানাের  জন্য ভুট্টোর কাছে গেলেন তাজুদ্দিন। তাজুদ্দিনের সংগে কিছুক্ষণ কথা বলেই ভুট্টো গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমরা পরে কনভেনশন লীগের নেতাদের কাছে শুনেছি, তাজুদ্দিনের সংগে আলাপের পর ভুট্টো মন্তব্য করেছেন, হি ইজ ভেরি থরাে। শেখের যােগ্য লেফটেনান্ট আছে দেখছি।

 

 

পল্টনের জনসভায় যােগ দেওয়ার জন্য দূর দূরান্ত থেকে ঢাকায় লােক আসতে শুরু করলাে। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করলেন, ওইদিন ঢাকায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করা দুরূহ হবে। সুতরাং গাড়ি ঘােড়া চলাচলের জন্য ডাইভার্সন রােডের ব্যবস্থা করা হল। সভা হবে বিকেলে। সকালেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুপুরের মধ্যে বিদ্যুৎ বেগে খবর ছড়িয়ে পড়লাে, সারা ঢাকায় কাউকে কিছু না জানিয়ে ভুঠো বিনা ঘােষণায় ঢাকা ছেড়ে রাওয়ালপিণ্ডি চলে গেছেন। এই খবর নিয়ে ঢাকার কোন কোন কাগজ বিশেস সংখ্যা বের করলেন। একটি কাগজ হেডিং দিলেন, “ভুট্টোর পলায়ন।”  তাজুদ্দিনকে ভুট্টো ক্ষমা করেননি। ক্ষমা করেনি পাকিস্তানীরা। ১৯৭১ সালে তাজুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর টিক্কা খানের প্রচার দফতর থেকে ঢাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। তাতে বলা হয়।  “তাজুদ্দিন আসলে ভারতীয় ব্রাহ্মণ। মুসলমান নাম গ্রহণ করে তিনি আওয়ামী লীগে ঢুকছেন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চক্রান্ত সফল করার জন্য।” এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তাজুদ্দিন সম্পর্কে বাংলাদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল সেদিনের পাকিস্তানী জংগীশাহী।

Reference:

ইতিহাসের রক্ত পলাশঃ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফফার চৌধুরী, p. 43-44