বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পােলারাইজেসন দ্রুত বাড়তে থাকে। শুধু ডান ও বাম এই সাধারণ দুই ভাগের মধ্যেই পােলারাইজেসন সীমাবদ্ধ ছিল না। ডানের মধ্যে যেমন বহু উপদল সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি হয়েছিল বামের মধ্যেও। এই দুই গ্রুপের মধ্যেও। এই দুই গ্রুপের মধ্যে তাজুদ্দিন গ্রুপ ছিল সম্ভবত সেন্টার-লেফট। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পুর্নগঠিত আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের পেছনে প্রকৃত বুদ্ধিদাতা ও কর্মীপুরুষ ছিলেন তাজুদ্দিন। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে যখনি আওয়ামী লীগের পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় অফিসে গেছি, তখনই দেখেছি তাজুদ্দিনকে হয় শেখ মুজিবের বিবৃতি অথবা দলীয় সভায় তােলার জন্য প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে। ফর্সা গােলগাল চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ । বেশি মানুষের ভীড়ে লাজুক এই শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির মানুষটি প্রখর ব্যক্তিত্বশালী নেতা ছিলেন না। কিন্তু তার শিক্ষা, বুদ্ধি, সংগঠন-শক্তির সংগে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, সাহস ও জনপ্রিয়তার মিশ্রণে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। আমি তাজুদ্দিনকে ঠাট্টা করে ডাকতাম চৌ অব বেংগল। অর্থাৎ বাংলাদেশের চৌ এন-লাই। চৌ এন-লাইকে আমি ১৯৫৬ সালে ঢাকায় দেখেছি। তাজুদ্দিনও চৌ এর মত ছােটখাটো। তবে অত পাতলা নন। কিন্তু রাজনীতিতে দু’জনেই স্বল্পভাষী ও নেপথ্য-বিহারী মানুষ। তাজুদ্দিন অবশ্য বৈঠকী-বক্তা হিসেবে অদ্বিতীয়। তখন তার কথা থামানাে যেত না। সময় ও সুযােগ পেলে স্বাধীন বাংলার পুনর্গঠনে তাজুদ্দিন যে চৌ-এর মতই বিশ্বয়কর কর্মশক্তির পরিচয় দিতে পারতেন, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। চৌ মাওয়ের সংস্পর্শে আসার পর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তার ছায়ার নিচে রাজনীতি করেছেন। তার বিরােধী বা বিকল্প নেতা হেওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং মাওয়ের সংগে প্রকাশ্য-বিরােধ সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু নিজের নীতি ও কর্মপদ্ধতিতে ছিলেন অটল। তাজুদ্দিনও তেমনি শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসার পর তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের ছায়ার নিচেই রাজনীতি করেছেন। মােশতাকের মত বার বার দল বদল করেননি। মুজিবের সংগে প্রকাশ্য-বিরােধ এড়িয়ে চলেছেন। তবে নিজের নীতি ও কর্মপদ্ধতিতে থেকেছেন অবিচল। তাজুদ্দিনের আরেকটি বড় গুণ ছিল, তিনি ছেলেবেলা থেকে ডায়েরি লেখার অভ্যেস করেছিলেন। তার ব্যক্তিগত ডায়েরিকে তাই বলা চলে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাস। বদরুদ্দিন উমর বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উপর যে বই লিখেছেন, তার মূল ভিত্তি তাজুদ্দিনের ডায়েরি । যদিও উমর বহু স্থানে তা রাজনৈতিক মত প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যকে বিকৃত এবং অর্ধ-সত্য যােগ করেছেন। তাজুদ্দিন প্রসংগে এখানে একটু বেশি করে বলছি এজন্যেই যে, চীনা। রাজনীতিতে চৌ-এর নীরব অথচ গঠনমূলক ভূমিকার মতই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাজুদ্দিন নীরব অথচ একটি ঐতিহাসিক গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে গেছেন। এই ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক ভুলভ্রান্তি এবং ক্রটি ও বিচ্যুতি হয়তাে তার ছিল । কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তার এই ভূমিকাটিকে সম্প্রসারণের ও শক্তি বৃদ্ধির সুযােগ দেওয়া হলে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এতবড় বিপর্যয় এত সহজে হয়তাে ঘটতাে না। তাজুদ্দিনকে
পাকিস্তানীরা বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সহকর্মীরা কি ভয় করতেন তার একটা ঘটনা বলি। ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সেই রুদ্ধশ্বাস দিনগুলাের কথা। ভুট্টোও এসেছেন ঢাকায়। আছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে। কড়া মিলিটারি পাহারা । আমরা ক’জন বাঙালি সাংবাদিক তার সংগে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়েছি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। দুজন সহকর্মীর সংগে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে আলাপ করছিলেন। একসময় আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে উর্দুতে বলে উঠলেন : আলােচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাইনা। ইমােশনাল এপ্রােচে মুজিবকে কাবু করা যায় । কিন্তু তার পেছনে ফাইল-বগলে চুপচাপ যে ‘নটরিয়াস’ লােকটি বসে থাকে, তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজুদ্দিন, আই টেল ইউ, উইল বি ইউর মেইন প্রবলেম । আমি তােমাদের বলছি এই তাজুদ্দিনই হবে তােমাদের জন্য বড় সমস্যা। আমি সংগে সংগে কথাটা নােট বইয়ে টুকে নিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, কথাটা একদিন কতবড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাড়াবে। তাজুদ্দিনকে ভুট্টো আরাে এক কারণে ভয় করতেন। অপ্রাসংগিক, তবু সে কাহিনী এখানে বলছি। ১৯৬৬ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছ’দফা দাবি ঘােষণা করেছেন। দেশময় বিরাট চাঞ্চল্য। আইয়ুব খা ঘােষণা করেছেন, তিনি অস্ত্রের ভাষায় শেখ মুজিবের দাবির জবাব দেবেন। (বলাবাহুল্য, আইয়ুবের এই অপূর্ণ বাসনাই ১৯৭১ সালে টিক্কা ইয়াহিয়া এবং ১৯৭৫ সালে মুশতাক-ভুট্টো পূর্ণ করেছেন)। ভুট্টো তখন আইয়ুবের বিদেশমন্ত্রী। তিনি আইয়ুবকে বললেন : মুজিবকে জেলে না পুরে তার সংগে আগে আমাকে রাজনৈতিক লড়াই করতে দিন। এই লড়াই হল তিনি ছফদফা দাবি নিয়ে মুজিবকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান জানাবেন। মুজিব রাজি হলে ঢাকায় জনসভা ডাকা হবে। সেই সভায় তিনি মুজিবের সংগে ছয়দফা নিয়ে তর্ক করবেন। প্রমাণ করে দেবেন ছয়দফা অত্যন্ত অন্যায় ও বাজে দাবি। জনসাধারনের সামনে এইভাবে তিনি মুজিবকে পরাস্ত ও ব্যর্থ করে দেবেন। আইয়ুব সম্ভবত ভুট্টোর এই প্রস্তাবে প্রথমদিকে রাজি হয়েছিলেন না। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে বসে ভুট্টো শেখ সাহেবকে তার সংগে তর্কযুদ্ধে নামার আহ্বান জানালেন। চারদিকে বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দিল। সকলের মনে প্রশ্ন, শেখ সাহেব কি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন? আমরা ইংরেজ নাইটদের মধ্যে মধ্যযুগে ডুয়েলের গল্প পড়েছি। বাংলাদেশেও দুই মােল্লার মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ওয়াজের মাহফিলে বাহাস’ হতে দেখেছি। কিন্তু দুইজন আধুনিক রাজনৈতিক নেতার মধ্যে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে তর্ক যুদ্ধ? এ সম্পূর্ণ নতুন। আমরা সাংবাদিকরা ছুটলাম শেখ সাহেবের ধানমণ্ডির বাসায়। শেখ বাইরে ইজি চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন। উত্তেজনায় তখন আমাদের রয়ে সয়ে কথা বলার সময় নেই। সরাসরি প্রশ্ন করলাম : মুজিব ভাই, আপনি কি ভূট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন? বঙ্গবন্ধুর পাশে তাজুদ্দিনসহ আরাে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বসা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। বললেন : আমার প্রশ্নের জবাব দেবে তাজুদ্দিন। আমরা তাজুদ্দিনকে ঘিরে ধরলাম : কি খবর তাজুদ্দিন ভাই? তাজুদ্দিন বললেন ; আমি আজ বিকেলে আওয়ামী লীগ অফিসে একটা সাংবাদিক সভা ডেকেছি। সেখানে এ প্রশ্নের জবাব দেব। বিকেলে আমরা ছুটলাম আওয়ামী লীগ অফিসে। তাজুদ্দিন ভাবলেশহীন মুখে বসে কাগজ পড়ছেন। কাগজ থেকে মুখ তুলেই বললেন : আপনারা সকলেই এসেছেন? কে একজন বললেন : হ্যাঁ, সবাই উপস্থিত। তাজুদ্দিন আওয়ামী লীগের প্রেস রিলিজের একটা করে কপি দিলেন সকলের হাতে। বললেন : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। আমরা নিজেদের অজান্তে আনন্দ ধ্বনি করে উঠলাম। এরপরের ঘটনা দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত। করাচী, পিণ্ডি ও ঢাকার কাগজে বিরাট খবর বেরুলাে : শেখ মুজিব ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। ঢাকার পল্টনের জনসভায় দুই নেতা মুখােমুখি তর্ক যুদ্ধে নামবেন। জনসভার দিনক্ষণ ঠিক হল। বিরাট দল নিয়ে ঢাকা এলেন ভুট্টো। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মনে মনে তখন একটু ভীত। পারবেন কি শেখ মুজিব ভূট্টোর সংগে তর্ক যুদ্ধে? শেখ মুজিব জনপ্রিয় জননেতা। কিন্তু ভুট্টোর মত তিনি পণ্ডিত নন। ভুট্টোর মত বাকচাতুরি তিনি জানেন না। তাছাড়া তার সংগে বিরাট বিশেষজ্ঞ দল। তাজুদ্দিনকে ফোন করলাম। তিনি বললেন : উহু এখন আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। ভুট্টোর সংগে তর্ক যুদ্ধে মুজিব ভাই যেসব কথা বলবেন, আমি তার ফ্যাকটস-ফিগার জোগাড় করতে ব্যস্ত। মুজিব যে ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন একথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানাের জন্য ভুট্টোর কাছে গেলেন তাজুদ্দিন। তাজুদ্দিনের সংগে কিছুক্ষণ কথা বলেই ভুট্টো গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমরা পরে কনভেনশন লীগের নেতাদের কাছে শুনেছি, তাজুদ্দিনের সংগে আলাপের পর ভুট্টো মন্তব্য করেছেন, হি ইজ ভেরি থরাে। শেখের যােগ্য লেফটেনান্ট আছে দেখছি। পল্টনের জনসভায় যােগ দেওয়ার জন্য দূর দূরান্ত থেকে ঢাকায় লােক আসতে শুরু করলাে। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করলেন, ওইদিন ঢাকায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করা দুরূহ হবে। সুতরাং গাড়ি ঘােড়া চলাচলের জন্য ডাইভার্সন রােডের ব্যবস্থা করা হল। সভা হবে বিকেলে। সকালেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুপুরের মধ্যে বিদ্যুৎ বেগে খবর ছড়িয়ে পড়লাে, সারা ঢাকায় কাউকে কিছু না জানিয়ে ভুঠো বিনা ঘােষণায় ঢাকা ছেড়ে রাওয়ালপিণ্ডি চলে গেছেন। এই খবর নিয়ে ঢাকার কোন কোন কাগজ বিশেস সংখ্যা বের করলেন। একটি কাগজ হেডিং দিলেন, “ভুট্টোর পলায়ন।” তাজুদ্দিনকে ভুট্টো ক্ষমা করেননি। ক্ষমা করেনি পাকিস্তানীরা। ১৯৭১ সালে তাজুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর টিক্কা খানের প্রচার দফতর থেকে ঢাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। তাতে বলা হয়। “তাজুদ্দিন আসলে ভারতীয় ব্রাহ্মণ। মুসলমান নাম গ্রহণ করে তিনি আওয়ামী লীগে ঢুকছেন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চক্রান্ত সফল করার জন্য।” এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তাজুদ্দিন সম্পর্কে বাংলাদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল সেদিনের পাকিস্তানী জংগীশাহী।
Reference:
ইতিহাসের রক্তপলাশ-পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফফার চৌধুরী