You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ আমি আধুনিক সেলুনে কাজ করছিলাম। বেলা ১১ টার সময় ৪ জন পাক সেনা আধুনিক সেলুনে চলে আসে এবং আমাকে, শ্রী অজীৎ ভবেন ও জগদীশকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে ধরে ফেলে এবং সবাইকে কালেক্টরেটে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে ছাড়া বাকি তিনজনকে রাইফেল, বেতের লাঠি ও বুট দিয়ে গুঁতা, প্রহার আর লাথির পর লাথি মারতে থাকে।

তাদের এইভাবে বেলা তিনটা পর্যন্ত মারার পর জিন্নাহ রাস্তার উপর তাদের ফেলে রেখে আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। তারপর আমার বাড়ি গিয়ে আমার বড় ভাইকে খোঁজ করে কিন্তু তাকে বাড়ি না পেয়ে ঘরের মধ্যে শেখ সাহেবের যে ফটো ছিল তা ভেঙ্গে ফেলে এবং পরে ওতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার বড়ভাই শ্রী পশুপতি সরকার আওয়ামী লীগ করতেন। তারপর আমাকে বাড়ি হতে শহরে নিয়ে আসার সময় একজন বেলুচ মিলিটারী আমাকে মুড়ি ও গুড় কিনে দেয় খাবার জন্য। আমি মুড়ি মুখে দিতেই একজন পাঞ্জাবী মিলিটারী লাথি দিয়ে তা আমার মুখ হতে ফেলে দেয় এবং অকথ্য ভাষায় আমাকে গালাগালি দেয়। তারপর আমাকে কালেক্টরেটে নিয়ে আসে। সেখান হতে তাদের গাড়িতে করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে গাড়ি হতে নামিয়ে মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে হাজির করে। তারপর কর্ণেল আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার নিকট নাকি ওয়ারলেস পাওয়া গেছে? আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে হাওলাদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তোর ভাই কোথায় আমাদেরকে বলে দিবি আর না হয় স্বীকার করবি যে আমার নিকট ওয়ারলেস পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি কোন কথাতেই রাজি না হবার দরুন আমার পাছায় ও পিঠে ২৫ টা বেত মারে এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার জ্ঞান ফিরে পাই। তারপর প্রায় ৪০ জনকে মারতে মারতে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আবার বেতের ছড়ি দিয়ে মারতে মারতে গাড়ি হতে নামায়। গাড়ি হতে নামিয়ে রৌদ্রের মধ্যে চিত করে শুইয়ে রাখে। তারপর বুকের উপর উঠে বুট দিয়ে খচতে থাকে। এইভাবে বেলা ১১ টা হতে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত রৌদ্রের মধ্যে শুইয়ে রাখার পর আবার রাইফেলের গোড়া দিয়ে মারতে থাকে। মারার পর আবার গাড়িতে করে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে এসে রেখে দেয়। এইভাবে প্রত্যেকদিন অত্যাচার করার দরুণ দ্বিতীয় দিন বুটের খচনের সঙ্গে সঙ্গে তিন জন আমির, লতিফ ও গৌর নামক তিন ব্যাক্তি মারা যায়। তিন দিন পর পর এক বেলা খাবার দিত। আর পানি চাইলে প্রশ্রাব করে নিয়ে এসে দিত। পায়খানা করতে চাইলে মার আরম্ভ করে দিত।

এইভাবে ৬ ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের উপর একই উপায়ে অত্যাচার করার পর ৭ ই এপ্রিল মেজর আমাদেরকে ডাকে। আমরা ৩৫ জন মেজরের নিকট হাজির হই। মেজর সবার স্টেটমেন্ট নেবার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তা হলে তোমাকে কোন অপরাধে ধরে নিয়ে আসে। আমি প্রতি উত্তরে বলি স্যার আমি ওয়ারলেস চিনি না। আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগ করেন। তাকে বাসায় না পেয়ে আমাকে ধরে আনে। তারপর মেজর ৪ জনকে রেখে ৩১ জনকে ছেড়ে দেয়। যে চারজনকে রেখে দেয় তারা হলো অরুণ, অমলা সোম, কেষ্ট এবং আর একজন নাম না জানা। ওদের চার জনকে কারেন্ট চার্জের জন্য নিয়ে যায়। তারা ফিরে আসে না। তারপর আমি ৭ ই এপ্রিল উক্ত ৩১ জনের সঙ্গে ক্যন্টনমেন্ট হতে মুক্তি পেয়ে বাড়ি চলে আসি।

স্বাক্ষর/-

শ্রী গণপতি সরকার

কোতোয়ালী, যশোর

১৬/০৩/১৯৭৩

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!