You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়া খাঁকে ভাসানির চ্যালেঞ্জ

বরুন সেনগুপ্ত 

বাংলাদেশ, ১৫ মে-বিশ্বের সকল রাষ্ট্র এবং বিশেষ করে ইয়াহিয়া খার প্রতি মৌলানা ভাসানীর চ্যালেঞ্জ, “কারাে মনে যদি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি সম্পর্কে কোনও সন্দেহ থাকে তাহলে জাতি সংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে গণভােটের ব্যবস্থা করতে পারেন। দেখবেন বাংলার শতকরা ৯৯ জনেরও বেশি লােক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন।”  শনিবার বিকালে বাংলাদেশের কোনও এক এলাকায় বাংলাদেশের প্রবীণ নেতার সঙ্গে আমি দেখা করি। বুড়াে হয়েছেন ভাসানী সাহেব। বয়স ৮৯। কিন্তু তবু শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সজাগ। পরনে ছিল লুঙ্গি এবং খদ্দরের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবী। পাটির উপর বসে বসেই কথা বলছিলেন। বলতে বলতে মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। আমি একবার বললাম, “আপনি যদি একটু ধীরে ধীরে বলেন তাহলেও আমার কোনও অসুবিধা নেই।” উনি জবাব দিলেন, “আপনি অমন জওয়ান লােক। আপনিও পশুদের ওই অত্যাচার দেখলে সুস্থ থাকতে পারবেন না। ওদের অত্যাচারের কথা যত শুনি, যত দেখি ততই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি।”  মৌলানা ভাসানী বলেন, “হিন্দুস্তানের নামে যতই মিথ্যা প্রচার করা হউক না কেন পূর্ববাংলার স্বাধীনতার দাবি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যুবক, বুদ্ধিজীবি হিন্দু মুসলমান সকল শ্রেণীর প্রাণের দাবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ভারতের কোনও সংস্রব নেই।

ভারত সরকার, ভারতের জনসাধারণ যা করেছেন শুধু মানবতার খাতিরেই করছেন।” সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির প্রতি আবেদন জাতীয় আওয়ামী পারটির নেতা এইদিন আবার রাশিয়া, চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশে বিশেষ আবেদন জানান। তিনি বলেন, “আমি চীন, রাশিয়া প্রভৃতি সমাজতন্ত্রবাদ বিশ্বাসী রাষ্ট্রের কাছে আবার অনুরােধ জানাচ্ছি যে তারা যেন অবিলম্বে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকারের অমানুষিক অত্যাচার থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা কল্পে অগ্রসর হন। না হলে তারা সাম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ, সামন্তবাদ ও শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যতই প্রচার করুন না কেন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ মােটেই তা বিশ্বাস করবে না।” বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানবার অনুরােধ সহ ভাসানী সাহেব মস্কো, পিকিং এবং ওয়াশিংটনে তার পাঠিয়েছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করি আপনি কি কোনও উত্তর পেয়েছেন?

মৌলানা ভাসানী বলেন, “ওরা যদি নিজেদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে জালেম ইয়াহিয়া সরকারকে এখনও অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকেন তাহলে একমাত্র তাদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য তা করছেন দুনিয়ার কেউই বিশ্বাস করবে না যে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের প্রতি ওদের বিন্দুমাত্র মনুষত্ববােধ আছে।”

নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙ্গালীদের মধ্যেই থাকব

তিনি এখন কী করতে চান? মৌলানা ভাসানী জবাব দেন, “আমার বয়স এখন ৮৯ বছর। আমি পাকিস্তান আন্দোলনে এবং বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে মােট ৩১ বছর জেলে ও জেলের আভ্যন্তরীণ সেলে জীবনযাপন করেছি। মৃত্যুর জন্য আমার মােটেই ভয় নেই। স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকারের সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারাবার ভয়ে আমি অন্য কোনও দেশে যাওয়ার কথা চিন্তা করি না। আমার একমাত্র চিন্তা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী শােষক গােষ্ঠীর কবল থেকে মুক্ত করা। তাই আমি যতদিন জীবিত থাকব ইনসাল্লা বাংলাদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালীদের মধ্যে থেকেই জীবনযাপন করব।” আমি এই পর্যন্ত লিখেই থামছিলাম। মৌলানা ভাসানী বললেন, “থামবেন না। লিখুন। মিথ্যা একশবার বললে সত্য হয় এটা কুখ্যাত গােয়েবেলসের থিওরি।

কিন্তু আমাদের প্রিয় নবি বলেছেন মিথ্যা হাজার বার বললেও কখনও সত্য হয় না। এবং মিথ্যাবাদীকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মােটেই পছন্দ করে না।”  মৌলানা সাহেব পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচারের এক বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, “শত্রু ….লক্ষ মানুষকে বিনা বিচারে ও বিনা অপরাধে হত্যা করেছে তাই নয়, ৬২ হাজার গ্রামের লক্ষ লক্ষ বাড়িঘর, মসজিদ মন্দির, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। মূল্যবান সােনারূপা অলঙ্কার লুট করে নিয়ে গিয়েছে। কত যে লুট করেছে তা আমার পক্ষে বলা কঠিন। কিন্তু শতাধিক বৎসরেও এই ক্ষতি পূরণ হবে কিনা সন্দেহ। বহু প্রাচীন গ্রন্থাবলী, যা শুধু দুমূল্যই নয়, দুষ্প্রাপ্যও-সে সবও ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করলেও তা সংগ্রহ করা আর সম্ভব হবে না।”

বাংলাদেশ অবাঙালীদের ওপর বাঙালীরা অত্যাচার করেছেন বলে পাক সরকার যে প্রচার চালাচ্ছেন মৌলানা ভাসানী বলেন, “তা সম্পূর্ণ অসত্য।” তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, “বিহারী ও অন্যান্য দেশের মােহাজেরদের প্রতি বাঙালীরা পারটিশনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যে বন্ধুসুলভ ভ্রাতৃত্বভাব দেখিয়েছে তার তুলনা অন্য কোনও দেশে পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত রেজিস্ট্রি অফিসে, খাজনা আদায়ের অফিসে, রেলে, স্টিমারে, মামলা মােকদ্দমায়, মােহাজের দলের জন্য কোটি কোটি ট্যাকস আদায় করা হয়েছে। এই ট্যাকস দেওয়ার ব্যাপারে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কোনও বাঙালী কোনও দিন প্রতিবাদ করে নাই। বরং বাঙালীরা সর্বদাই দাবি জানিয়েছে এবং আন্দোলন করেছে যেন মােহাজেদের জন্য সংগৃহীত ট্যাকসের আয় করের হিসাব দেওয়া হয়।”

কলােনী 

মৌলানা ভাসানী তারপরও অনেকখানি আলােচনা করলেন। পূর্ব বাংলায় পাক শােষণের দীর্ঘ বিবরণ দিলেন। তিনি বললেন : এটা ছিল ওদের কলােনী, শােষণের ক্ষেত্র। এখানে যে ওরা কী শােষণ চালিয়েছে আপনারা, জানেন না। বলতে বলতে তিনি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। আমি বললামঃ আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাক। আপনি বিশ্রাম করুন। আমি ওঠে দাঁড়ালাম।

মৌলানা বললেন ঃ আচ্ছা তাহলে তাই হােক। কী জানেন, এত অত্যাচার, এত জুলুম দেখলে সুস্থ থাকা যায় না। আচ্ছা আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাক…।

Reference:

১৬ মে ১৯৭১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!