You dont have javascript enabled! Please enable it!

শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবের মতের সাথে একাত্মতা পােষণ করবার পর মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের ভেতরে-বাইরে এবং ভারতবর্ষের সাথে সাহায্য-সহযােগিতার সম্পর্ক প্রসারিত করবার প্রয়ােজন এবং সেই সমস্ত দিক বিবেচনায় একটি সরকার গঠন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। সেই সরকার গঠনের ব্যাপারেই আমরা এম, আর, সিদ্দিকী, আব্দুর রউফ এঁদের সাথে আলােচনা করেছি। তারা সবাই একমত হলেন একটা সরকার গঠন এখনই প্রয়ােজন। দিল্লীতে বসেই আমরা কিছু চিঠিপত্র পেলাম। যেমন সৈয়দ সুলতান সাহেবের কাছ থেকে, ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঞার কাছ থেকে। এই চিঠিগুলােতে লেখা ছিল যেন অবিলম্বে সরকার গঠন করা হয় এবং তাজউদ্দীন সাহেব যেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তখন আমরা সবাই একমত হলাম যে, হাইকমান্ড হিসেবে যেটা কাজ করছিল সেটাই এখন ক্যাবিনেট হিসেবে কাজ করুক এবং তাজউদ্দিন সাহেব তার প্রধানমন্ত্রী হােন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেবের প্রচণ্ড দ্বিধা ছিল নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানাের বিষয়টিতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি তাে আওয়ামী লীগকে চেনেন না, এটা নিয়ে আওয়ামী লীগে কিন্তু নানা রকম ভুল বােঝাবুঝির চেষ্টা করানাে হবে।’ আমি বললাম, কিন্তু সরকার গঠন করা ছাড়া এই মুহূর্তে তাে আর কোন উপায় নেই। এরপর আমাদের হাইকমান্ডের মতাে করেই আমরা একটি সরকার গঠন করি। আমরা যে সরকার গঠন করেছিলাম তা ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির। যুদ্ধ পরিচালনা করার মত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারের পরিধি ছােট রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। প্রফেসর রেহমান সােবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান তখন দিল্লীতে উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব, রেহমান সােবহান এবং আমি একসাথে মিলে বক্তৃতার একটা খসড়া তৈরি করি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন, যার কিছু অংশ রেহমান সােবহান এবং কিছুটা আমি লিখি । এই সময় তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলে মিলিয়ে দেখা হচ্ছিল যে বক্তব্যের কথাগুলাে রাজনৈতিকভাবে ঠিক হচ্ছে কিনা। তিনি নিজেও কোন পয়েন্ট যােগ করছিলেন, কোনটা বাদ দিচ্ছিলেন। এভাবেই আমরা একটি খসড়া বক্তৃতা প্রথমে ইংরেজিতে লিখি, তারপর বাংলায় অনুবাদ করা হয়। দিল্লীতে বসেই বক্তৃতাটি টেপে ধারণ করাহয়। এই টেপটির মুখবন্ধে আমার কণ্ঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ধারণ করা হয়। দিল্লীতেই সীলমােহর তৈরি করা হয় যেটা আমারই হাতের আঁকা, চারিদিকে গােলচক্র, মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। তাজউদ্দীন সাহেব এটি অনুমােদন করেন। আমরা সেই মনােগ্রামসহ লেটারহেড ছাপিয়ে ফেলি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লিখে। একটি সরকারের প্রাথমিক যে বিষয়গুলাে থাকে তার প্রায় সব ঠিক করে ফেলি। আমরা যাতে যােগাযােগের জন্য সীমান্ত এলাকাগুলােতে যেতে পারি সেই জন্যে মিসেস গান্ধী একটা ছােট প্লেনের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল নগেন্দ্র সিংকে আমাদেরকে সমর বিষয়ে সহায়তা করার জন্য উপদেষ্টা হিসেবে দিলেন। তারপর আমরা কলকাতায় ফিরে আসি। কলকাতায় ফিরে এসেই আমরা জানতে পারি, সেই ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডের বাড়িতেই চিত্ত সূতার থাকতেন, কিন্তু অন্য নামে—যার ফলে কেউ আমাদেরকে জানাতে পারেনি যে এখানে চিত্ত সূতার থাকেন। এই বাড়িতে তখন শেখ মণি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রব, আব্দুল কুদুস মাখন প্রমুখ যুব-ছাত্র নেতারা উপস্থিত হয়েছেন। আমরা যে একটা সরকার গঠন করেছি এরকম আভাস-ইঙ্গিত তারা পেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়েছে যে আমরা কাউকে না বলে দিল্লীতে চলে গিয়েছি। ইতােমধ্যে মনসুর আলি সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব এবং প্রায় ৪০/৫০ জন আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতৃস্থানীয় লােকজন কলকাতায় এসে গেছেন। তখন আমরা সবাইকে একসাথে নিয়ে আলােচনায় বসলাম। এই সময় যুব নেতাদের কাছ থেকে বিশেষ করে শেখ মণি এবং সিরাজুল আলম খানের কাছ থেকে একটা দাবি উঠল যে, যুদ্ধ অবস্থাতে একটা রেভলুশনারি কাউন্সিল তৈরি করতে হবে, এখানে কোন মন্ত্রিসভা তৈরি বা গঠনের প্রশ্ন ওঠে

—শুধু এমপিদেরকেই নয়, কাউন্সিলে যুবক এবং অন্যান্যদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। এই বৈঠকে দেখলাম বেশির ভাগ লােকজনই উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। তাজউদ্দীন সাহেব যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, আমরা সেভাবেই জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণ টেপ করেছি, শ্রীমতি গান্ধী এবং দিল্লীতে এই কথাটি সবাই জানে, কাজেই তিনি খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে ছিলেন।

আমিরুল ইসলাম, সহিউদ্দিন্ ,বাদল রশিদ , আযিযুর রাহমান আক্কাস এম এন এ ১৯৭১ কুষ্টিয়া ৭

 

আমি তখন কতকগুলাে যুক্তি উত্থাপন করি যে, আমাদের একটা লিগ্যাল আরগুমেন্ট হচ্ছে, আমাদের একটা জনপ্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র আছে। একটা নির্বাচন হয়ে গেছে, সেই নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি, কিন্তু আমাদেরকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। আমাদেরকে সংবিধান তৈরির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অতএব আমাদের একটা সরকার গঠন করবার যেমন নৈতিক দায়িত্ব আছে, তেমনি একটা সরকার গঠনের আইনগত অধিকারও আমরা পেয়েছি। পৃথিবীর খুব কম স্বাধীনতা যুদ্ধে এ ধরনের পরিস্থিতি থাকে। আইনগত কোন স্বীকৃতি যেখানে থাকে না, সেখানে তখন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হয়, অর্থাৎ যার আইনগত ভিত্তি অত্যন্ত নড়বড়ে থাকে। কিন্তু এখানে আমাদের আইনগত ভিত্তি এত শক্তিশালী, কাজেই এই জিনিসটা আমরা হারাতে চাই না। এছাড়াও যদি আমরা একটা বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করি এবং কাল যদি চট্টগ্রাম, বরিশাল বা সিলেটে আরাে কয়েকটি এমন সরকার হয় তাহলে কোটা আসল, কোনটা কী এ নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। অতএব এই সমস্ত বিপর্যয় এড়াতে যেহেতু একটি আইনানুগ সরকার গঠন করবার ক্ষমতা আমাদের আছে সেহেতু এটাই আমাদের প্রথম করা দরকার এবং বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা। হাইকমান্ড অনুযায়ী মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে কারােই আপত্তি থাকার কথা নয়। তাজউদ্দীন সাহেব দলের সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে জাতির এই দুর্দিনে ভারতের সাহায্য-সহযােগিতা পাবার জন্য তিনি দিল্লী গেছেন—কর্তব্যের ডাকে তিনি সেখানে গেছেন এবং দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সে অধিকার তার আছে। এই যুক্তিগুলাে এত জোরালাে ছিল যে এর বিরুদ্ধে আর কোন কথা উঠতে পারল। ধীরে ধীরে সকলেই আমাদের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন। তখন এই প্রশ্ন যারা কোন একটা মতলব থেকে তুলেছিলেন তারা যদিও এই যুক্তি অস্বীকার করতে পারছিলেন না, কিন্তু মনে মনে ফুসছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সকলেই এই কথাটা মেনে নিলেন। তার পরদিন আমাদের যাবার কথা বিভিন্ন অঞ্চলে। কামরুজ্জামান সাহেব ও মনসুর আলি সাহেবকে রাজি করাতে হবে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য, যেহেতু দুজনই সরকারের অংশ। ভােরবেলা আমি চলে গেলাম কামরুজ্জামান সাহেবের কাছে। তাকে জানালাম আমরা কোথায় যাচ্ছি, সেখানে তাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে। আমরা সরকার গঠন করেছি, এতে তার সম্পূর্ণ সমর্থন আছে কিনা তাও জানতে চাইলাম।

কামরুজ্জামান সাহেব বললেন যে, এতে তার সম্পূর্ণ সহযােগিতা এবং সমর্থন রয়েছে। তিনি বললেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেন, আপনারা যে সরকার গঠন করেছেন তাতে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। যদিও গতরাতে আমরা বলেছিলাম একটা বিপ্লবী সরকারের কথা, বিশেষ করে ছেলেরা বলেছিল সেটা, কিন্তু আপনি যে যুক্তি দিয়েছেন তারপর আমি আপনার কথা মেনে নিয়েছি।’ এরপর তিনি বললেন যে, তাঁর স্ত্রী এবং পরিবার পথে আছে, তারা না আসা পর্যন্ত তাদের জন্য কলকাতায় অপেক্ষা করতে হবে, তাই তিনি যেতে পারছেন না। মনসুর আলি সাহেবকে অনুরােধ করাতে তিনি রাজি হলেন। মনসুর আলি সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, আমি, শেখ মণি, তােফায়েল আহমদ ও গােলােক মজুমদারসহ আমরা রওনা হলাম। দমদম এয়ারপাের্ট থেকে বিমানটি টেকঅফ করল। প্লেনটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে পারে এবং খুব অল্প জায়গার ভেতর নামতে পারে। আমরা এইরকমভাবে কয়েক জায়গায় নামলাম। আগে থেকেই খবর দেয়া ছিল বিএসএফ-এর মাধ্যমে যে, যেখানে যেখানে আমাদের নেতাদের লােকজনদের পাবে তাদেরকে যেন বর্ডারের কাছে নিয়ে আসে যাতে আমরা তাদের সাথে আলাপ-আলােচনা করতে পারি। আমরা ধুবড়িতে নেমে কোন নেতার সন্ধান পেলাম না। তারপর ওখান থেকে শিলিগুড়িতে এসে নামলাম। এখানে একটা ডাকবাংলােতে উঠলাম। এখানে কর্নেল নূরুজ্জামান এবং আবদুর রউফকে আমরা ডেকে পাঠালাম। তারা রংপুর, নীলফামারী এ সমস্ত এলাকা থেকে আসলেন। তারা আসার পর তাদের সাথে আলাপ-আলােচনা হল। কর্নেল নূরুজ্জামানকে বলা হল, আপনি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে কাজ করবেন। ইতােমধ্যে আমরা ৬ জন সেক্টর কমান্ডার নির্বাচন করেছি। ১০ এপ্রিলে তাজউদ্দীন সাহেবের যে বক্তৃতা প্রচার করা হবে সেই বক্তৃতাতেও সেক্টর কমান্ডারদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং কে কোন্ সেক্টরের দায়িত্বে থাকবেন তারও উল্লেখ আছে। এদিকে গােলােক মজুমদারের সাথে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে, সেই বক্তৃতার টেপটা তাকে দিয়ে দেব এবং শিলিগুড়ির ওখান থেকে এই ভাষণ রেডিওতে প্রচার করা হবে। সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী আমি তাকে টেপটা দিয়ে দিলাম। এরই মধ্যে শেখ মণি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললেন, ‘মামা, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। তাজউদ্দীন সাহেব এবং শেখ মণি একটা ঘরে গিয়ে আলাপ করতে লাগলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক তারা আলাপ করার পর সেখানে। আমাকে ডাকা হল। আমি যাবার পর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “দেখেন, শেখমণি বলছে টেপ করা বক্তৃতাটা আজকে যাতে প্রচার করা না হয়, এটা দু-তিনদিন পর হলেও কোন অসুবিধা হবে না। আমরা যখন আগরতলা যাচ্ছি, সেখানে যারা আছে তাদের সাথে আলাপ করে একমত হয়ে এটা করা যাবে।’ শেখ মণি বিপ্লবী সরকারের কথা বলেছিলেন এবং গতরাতেই একটা আলাপআলােচনার মাধ্যমে যুক্তির মাধ্যমে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠে একমত হতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আগরতলাতে যাওয়ার পর এটা নিয়ে আবার একটা ঝামেলার যে আশঙ্কা তা আমি খুব অনুভব করলাম।

শেখ মণি, তাজউদ্দীন ও বঙ্গবন্ধু। ছবি স্বাধীনতার পরের।

সেইসাথে যারা সত্যিকার অর্থে তখন যুদ্ধে লিপ্ত তাদের কাছ থেকে আমরা চিঠিপত্র-খবরাখবর পাচ্ছি প্রত্যেকেই চাপ দিচ্ছেন যে সরকার গঠন করতে একদিনও যেন দেরি না হয়। দ্বিতীয়ত, এটা যদি প্রচারিত না হয় তাহলে দিল্লীতে এটা বুঝে ফেলবে যে, আমাদের সরকার গঠন করার ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোন অসুবিধা রয়েছে এবং সেটা ভবিষ্যতে আমাদের যে কোন কাজে তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না। এ সমস্ত ভেবে আমি এর প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু শেখ মণি খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। আমি তখন সমস্ত যুক্তিগুলাে তাদের দিলাম যে কেন এই সরকার গঠনের কথা এখনি প্রচার করার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। সেইসাথে আরাে বললাম যে, আগরতলাতে হােক বা যেখানেই হােক, যাদের সাথে আমাদের দেখা হবে তারা এটা মেনে নিতে বাধ্য। কারণ, আমরা তাে এমন কাউকে নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছি না যে লােকগুলাের নাম আগে ছিল না। যারা যেভাবে কাজ করছিলেন তারা সেভাবেই কাজ করতে থাকবেন। এটা হচ্ছে আমাদের ধারাবাহিকতা, এবং তাজউদ্দীন সাহেব যখন ঢাকাতে ছিলেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর মতই কাজ করছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানের মতই কাজ করছিলেন। অতএব আমরা এটা নূতন কিছু করছি না যে এটা কেউ অনুমােদন করবে না। এটা তাে আগেই অনুমােদিত হয়ে আছে। তখন শেখ মণি বললেন, ‘আপনি অত বুঝবেন না আমাদের ভেতরের কথা, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী অথরিটি দিয়ে গেছেন।’ এই কথাটাই মণি বলতে চাইলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে একটা অথরিটি দিয়ে গেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব আমার আর শেখ মণির মধ্যকার বিরােধটা মিটানাের জন্য বললেন, ঠিক আছে, মণি যখন বলছে যে আগরতলাতে গিয়ে এই সরকার অনুমােদন করানাের জন্য যা কিছু করা দরকার সে তা করবে, তখন তার কথাটা মেনে নিন। আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত মনে বললাম ঠিক আছে, দেখি আমি কী করতে পারি। ইতােমধ্যে বক্তৃতার টেপ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে চলে গেছে, কাজেই এটা। ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা আমি ঠিক জানি না।’ আমি বাইরে এসে গােলােক মজুমদারকে ফোন করলাম। আমি বললাম, “যে টেপটা আমি আপনাকে দিয়েছি সেটা কোথায় ?’ তিনি বললেন, যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে সেটা চলে গেছে।’ আমি বললাম যে, ‘টেপটার সম্প্রচার আপাতত কি স্থগিত করা যায়?’ তখন তিনি বললেন, যদি আপনারা বন্ধ করতে চান তাহলে আমি হয়ত চেষ্টা করলে এখনাে করতে পারি। কিন্তু তা করা কি ঠিক হবে? বরং এটা করলে নানা জায়গায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।’ তখন আমি গােলােক মজুমদারকে বললাম যে, তাহলে যেভাবে এটা নির্ধারিত হয়েছে। সেভাবে চলতে থাকুক।’ এই একটিমাত্র কাজে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কথা অমান্য করেছিলাম। এটা ঠিক হয়েছিল, কি সঠিক হয়নি তা বিচার করবে আগামী ইতিহাস। আর পরবর্তীকালে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে সেগুলাে দেখলে। বােঝা যাবে এটা বন্ধ করার চেষ্টার পেছনে কী চিন্তাভাবনা বা ষড়যন্ত্র ছিল। আমি ফিরে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম ‘গােলােক মজুমদারকে আপনার ইচ্ছার কথা বলেছি। তিনি হয়ত বা চেষ্টা করবেন এটা বন্ধ করার ব্যাপারে। কিন্তু টেপটা এখন আর তার হাতে নেই।’ এর পরে রাতে আমরা খেতে বসেছি; খাবার টেবিলে শুধু তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ মণি আর আমি। কারণ সেই সময় তােফায়েল আহমদ অসুস্থ হয়ে কলকাতাতে চলে গেছেন। মনসুর আলি সাহেবের জুর, তিনি শুয়ে পড়েছেন। আমি রেডিওটা অন করে দিয়েছি, এই সময় খবর হয়। রেডিও অন করতেই শুনি একটি ঘােষণা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ প্রচার করা হবে। আমরা তিনজনই তিনজনের চোখের দিকে তাকালাম। কারাে মুখে কোন কথা নেই, আমরা চুপচাপ। আমরা চুপচাপ রেডিও-র ঘােষণা শুনলাম আর খেয়ে নিলাম। সকলেই বুঝলাম যে কী হয়ে গেছে। তারপর এই খবরটাকে নিয়ে পৃথিবীর সব রেডিও, ভারতের রেডিও পরদিন সকালবেলা থেকে সব স্টেশনের মাধ্যমে অনরবত প্রচার করতে লাগল। এদিকে কামরুজ্জামান সাহেব যখন সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানান তখন আমি মনসুর আলি সাহেবের সাথেও কথা বলি। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “আপনি তাজউদ্দীন সাহেবকে বলুন, এই সরকারে আমার সম্পূর্ণ মত আছে। গতকাল যেটুকু পার্থক্য ছিল তা আর কোনদিন আমার কাজের ভেতরে প্রকাশপাবে না।’ এখন থাকলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব আর মােশতাক সাহেব।

সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন

 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এতে মত দেবেন নিশ্চয়ই, কারণ তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি করে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে। অতএব তার মত পেতে কষ্ট হবে না। এই চারজন যখন মত দিলেন তখন মােশতাক সাহেব কিছুতেই এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। সেদিক থেকে এই ক্যাবিনেট যে একটা কার্যকর ক্যাবিনেট হবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। পরদিন সকালবেলা প্লেনে করে ময়মনসিংহের উপর যে তুরা পাহাড়, সেই পাহাড়ের কাছে আমরা নামলাম। ওখানে আমরা শুনতে পেলাম যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আবদুল মান্নান সাহেব একটা রেস্ট হাউসে আছেন, পাহাড়ের নিচে বিএসএফ-এর লােক পাঠানাে হল। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল তাদের এসে পৌছাতে। আমরা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং তাজউদ্দীন সাহেব দুজন সেখানেই একান্তে আলাপ করলেন। সমস্ত ঘটনা, যা ঘটেছে, সব বিবৃত করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ফিরে এসে বললেন যে, তার সম্পূর্ণ মত আছে এবং আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে আমরা আগরতলার পথে রওনা দিলাম। আমরা আগরতলাতে পৌছলাম সন্ধ্যায়; তখন ওখানে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য এলাকার সদস্যরা উপস্থিত হয়েছেন। এর ভেতরে মােশতাক সাহেব, ওসমানী সাহেব, এম, আর, সিদ্দিকী সাহেব পৌছেছেন। আমাদের প্রথম বৈঠক হল কর্নেল ওসমানীর সাথে। তাঁর সাথে কথা হল যে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে সংগঠিত করব। কর্নেল ওসমানী তাঁর মতাে করে পরিকল্পনার কথা বললেন যে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা যাবে। তাতে কর্নেল ওসমানীর যে ধারণা সেটা ছিল একটা ট্রাডিশনাল যুদ্ধের ধারণা। তার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী একটা ডিভিশন গঠন করতে হবে। এটা একদিকে যেমন ছিল অবাস্তব, অন্যদিকে তা ঠিক আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত জনযুদ্ধের সম্পূরক চিন্তা ছিল না। তার কথা সকলেই শুনলেন, তিনি সিনিয়র ব্যক্তি সকলের চাইতে এবং এ ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান আছে, তাই কেউ কিছু বলছেন না।

Reference:

আমীর-উল ইসলাম

তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!