You dont have javascript enabled! Please enable it!

দুপুরে কোন রকম তারকারি ও প্লেট ছাড়াই মাটিতে লবন দিয়ে কিছু ভাত দেওয়া হয় এবং বলা হয় “তুমলোক বাঙ্গালী হ্যায়, চাউল খাও”।

২৫শে মার্চের পরে রাজশাহী শহরকে পাক বাহিনী  তাদের আয়ত্তে আনে। বাংলাদেশের স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দকে খুজতে থাকে এবং ধরে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। এপ্রিলের প্রথম দিকে বেলদার পাড়ার দুজন যুবক যথাক্রমে বাদল ও অন্যজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার উপরে গুলি করে হত্যা করে।

বর্বর সৈন্যদের এলোপাতাড়ি গোলাগোলির আওয়াজে গ্রামবাসী প্রাণের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আমি এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে মা সহ ভারতে আশ্রয় নেই এবং জুন মাসের ১ তারিখে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে নেবার জন্য বেলদার পাড়ায় আসি।

৩ দিন পর পাক বাহিনী রাত ৯টার সময় বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেফতার করে। অবশ্য শান্তি কমিটির দালালদের কুপ্ররোচনায়। গ্রেফতার করার সময় বাড়ির চারিদিকে এবং ছাদের উপর থেকে গোলাগোলি করে এক বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। গ্রেফতার করার পর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে গুলি করার জন্য আমাকে লাইনে দাঁড় করায়। কয়েকজন সৈন্যের উদারতার জন্য গুলি করতে বিরত হয় কিন্তু শারীরিক নির্যাতন চালায়। অতঃপর আমাকে জিপে করে হাত বাঁধা অবস্থায় স্থানীয় সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে অন্ধকারময় বন্ধ ঘরে পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দেয়ালের দিকে মুখ করিয়ে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে। এবং যাতে বসতে না পারি তার জন্য সামরিক বাহিনীর লোকেরা কড়া পাহারা দিতে থাকে। সকালের দিকে এক কাপ চা ও একখানা রুটি খেতে দেয়। ঐ সার্কিট হাউজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের উপরে বর্ণনাতীত শারীরিক নির্যাতন চালায়।

নির্যাতনের এক পর্যায়ে জনৈক পদস্থ কর্মচারী ছাত্রদ্বয়কে চাকু লাগাতে নির্দেশ দেয়। কিম্ভূতকিমাকার বিশাল বপু বিশিষ্ট একজন সৈন্য অফিসারের নির্দেশের মর্মানুযায়ী তাদের পেটে কুকুরের মতো কামড়িয়ে মাংস ধরে টানাটানি করতে থাকে। ছত্রদ্বয় আর্তচিৎকার করতে থাকে। তিনজনই পূর্বপরিচিত হলেও কেউ কাউকে পরিচয় দেবো না বলে একমত হই।

পরের দিন আমিসহ দু’জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাবার পর ক্যাম্পের খোলা আঙ্গিনায় আমাদের গায়ের জামা খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। জামা খোলা হলে ১০/১২ জন বর্বর সৈন্য বেত, চাবুক দ্বারা এলোপাতাড়িভাবে প্রহার শুরু করে। রক্তাক্ত অবস্থায় যতক্ষণ না তারা অজ্ঞান হয় ততক্ষণ ঐ অবস্থা চালাতে থাকে। অতঃপর পা ধরে টেনে পাশের একটি ছোট কোঠায় পাশাপাশি রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্রদের মধ্যের একজনকে যিনি বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন তাকে পুনরায় টেনে আঙ্গিনায় নিয়ে যায় এবং পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টোভাবে রডের সাথে টাঙ্গিয়ে দেয়। “তুমলোক লিডায় হ্যায়” বলে চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করে। তার শরীর দিয়ে দর দর করে বিগলিত ধারায় রক্ত গড়াতে থাকে। অত্যাচারের এক পর্যায়ে হঠাৎ ছেলেটির পায়ের দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়। তখন তারা সাময়িকভাবে অত্যাচার বন্ধ করে দেয়। অজ্ঞান অবস্থাতেই পুর্বোক্ত ঘরে পুর্বোক্ত পদ্ধতিতে রেখে দেয়া হয়।

সারা দিন ও রাত অভুক্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। পরদিন সকালে শুধু এক কাপ চা পান করতে দেয়। তারপর এক এক করে পাশের ঘরে সিকিউরিটি অফিসার সেলিমের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি প্রথমবারের মত বিবৃতি নিলেন। বিবৃতি নেয়ার মাঝে মাঝে অফিসারটি নিজের হাতে গ্লাভস পরে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। এর ফলে মাটিতে পড়ে গেলে বুট দিয়ে শরীরে চড়ে নির্যাতন করতে থাকে। এবং জ্বলন্ত সিগারেট শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঠেসে ধরে। বলাবাহুল্য, অত্যাচার করে তারা পাশবিক আনন্দ উপভোগ করে। এবং নিজেদের খুশিমতো বিবৃতি তৈরী করে। বিবৃতি নেবার পর পুর্বোক্ত ঘরে আবার বন্দী করে রাখে এবং দুপুরে কোন রকম তারকারি ও প্লেট ছাড়াই মাটিতে লবন দিয়ে কিছু ভাত দেওয়া হয় এবং বলা হয় “তুমলোক বাঙ্গালী হ্যায়, চাউল খাও”।

পরের দিন সকাল আটটায় জিপে করে উক্ত সিকিউরিটি অফিসারের তত্ত্বাবধানে তিনজনকেই জুবেরী হাউসের দোতলার একটি কক্ষে রাখা হয়। এবং সেখানে কড়া সামরিক পাহারা ছিল। সেখানে পাশের কক্ষে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন দারোগাসহ ১০/১২ জন পুলিশের লোক ইউনিফর্মসহ বন্দী ছিলেন। এদের অনেকেই আমার পরিচিত ছিলেন। আমাদের কক্ষে একজন ইউসি চেয়ারম্যানসহ আরো ৬/৭ জন সাধারণ মানুষ ছিলেন। সেখানে তিনদিন থাকাকালে কোন শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও অপমানজনক অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। যেমনঃ- “তুমলোক গাদ্দার হ্যায়, তুমলোক বেইমান হ্যায়, তুমলোক হিন্দু হ্যায়।”

ঐ তিনদিনের এক রাতে আমাকেসহ আরো দুজনের (উপরোক্ত ছাত্রদ্বয় নন) নাম ডেকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে এবং সাহসে ভর করে আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হাম লোগকো কাঁহা লেয়ে যায়েংগে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমলোক কালমা পড়নে পড়নে চলো, তুমলোগকো খতম করেগা।”

নীচে আসার পর সাথী দুজনের নাম ধাম জিজ্ঞাসাবাদের পর দু’জনকে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সম্ভবত তাদেরকে হত্যা করা হয়। পুনরায় বিবৃতি নেওয়া হবে এই উক্তির প্রেক্ষিতে আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। পরের দিন বেলা তিনটায় দুজন ছাত্রসহ আমাকে এক সঙ্গে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় মিলিটারি ট্রাকে নাটোরের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে বুট দিয়ে আমাদের উপর সীমাহীন অত্যাচার করে। জেল গেটের খাতায় “ফাইট এগেইনেস্ট গভর্নমেন্ট” লিখে নেয়। জেল গেটের আঙ্গিনায় তখন তিনজনের উপরে বেয়নেট, লাঠি, বেত, বুট ইত্যাদি দ্বারা নির্যাতন করতে থাকে।

নির্যাতনের পর বিকাল পাঁচটায় আমাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে একটি কুঠুরীতে বন্দী করে। সেখানে আরো দুজনকে বন্দী অবস্থায় দেখা যায়। অবশ্য জেল গেটেই তাদের হাতের বাঁধন ও চোখের পট্টি খুলে দেয়।

নাটোর জেলখানায় তিনটি কোঠায় তিনশ জনের মত কয়েদী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ সালেহ আহমদ, অধ্যাপক মুজিবর রহমানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। বলা প্রয়োজন যে ইপিআরদের জন্য তিনটি কোঠার একটি রিজার্ভ ছিল। প্রত্যহ পানি আনা, রাস্তা মেরামত, পুকুর পরিষ্কার, মিলিটারিদের খেলার মাঠ তৈরীসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হতো। এবং সে সময়ে তাদের উপর অত্যাচার করা হতো।

জেলখনায় মাস দুয়েক কাটানোর পর আমাকে জনৈক এফআইটি অফিসারের নিকট বিবৃতি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানে বিবৃতি আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে বৈদ্যুতিক চাবুক দ্বারা প্রহার করে। শেষ পর্যন্ত যে বিবৃতিতে তারা সই করিয়ে নেয় তাতে সত্য অপেক্ষা মিথ্যাই ছিল বেশী।

নাটোর জেলখনায় মিলিটারীদের অত্যাচারের সময় জেলখানাতেই জনৈক কয়েদী মারা যান।

স্বাক্ষর/-

মোঃ আবুল ওয়াহেদ

১৬/০৮/১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!