ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার ও শেখ মণি – আব্দুল গাফফার চৌধুরী
১৯৭৪ সালে ত্রিশে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সভা এবং পাঁচই এপ্রিল তারিখে সাতজন ছাত্র নিহত হওয়ার পর আমার মনে সন্দেহ দেখা দেয়, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কোন্দল সৃষ্টি করে মুজিবের জন্য এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। তা না হলে যখনি তিনি দেশের বাইরে যান, তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এমন খুনােখুনি কাণ্ড কী করে ঘটে? ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবের জন্য এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুজিব যখন আলজেরিয়ায়, তখনাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন ছাত্র নিহত হন। মুজিব দেশে থাকলে সব পরিস্থিতিই সরকারের আয়ত্বে, আর তিনি বাইরে থাকলেই অরাজকতা শুরু তার কারণ কি? তাহলে কি তার আমলাতন্ত্র, থানা, পুলিশ, সেনাবাহিনী কোন কিছুই কাজ করছে না? নাকি ভিতরের অথবা বাইরের উস্কানীতে তারা নিস্ক্রিয়? ৩০শে মার্চ রাত্রে জনপদ অফিসের নিউজ ডেস্কে আমাকেই বসতে হল। রিপাের্টার অদূরে বসে ছাত্রলীগের সভার খবর লিখছেন। ছাত্রলীগের সভার মােটামুটি খবর আমরা পেয়েছি। তারা আওয়ামী লীগ, যুবক লীগের কিছু সংখ্যক নেতা, কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ তুলে তাদের বিচার দাবি করেছেন। সেই তালিকায় আছেন গাজী গােলাম মােস্তফা, ব্যবসায়ী আবিদুর রহমান প্রমুখ। পুরাে তালিকাটির নাম আমার মনে নেই। আমার ডায়েরিতেও তখন অত নাম লেখা সম্ভব হয়নি। সে রাতেই শেখ মণি আনীত অভিযােগের জবাব হিসেবে একটি বিবৃতি প্রচার করলেন। সেই বিবৃতির একটি কপি পাঠানাে হল ‘জনপদে’। মণি নিজে আমাকে ফোনে অনুরােধ জানালেন, বিবৃতিটি যেন কাটছাট না করে ছাপানাে হয়। তাকে বললাম ; আমি ছাত্রলীগের অভিযােগ এবং আপনাদের জবাব সবই ছাপাব। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ঝগড়ায় আমার কোন ভূমিকা নেই। মণি বললেন ; আপনার সংগে কি এখনি একবার দেখা হতে পারে? বললাম : কোথায়? মণি বললেন ; তাহলে পূর্বাণীর জলসা ঘরে আসুন। কথা হবে। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করবাে। আমার ড্রাইভার এয়াকুব রাত দশটা বাজলেই ছুটি নেওয়ার জন্যে উসখুস করে। তাকে বললাম ; আজ বাবা, তােমাকে একটু বেশি রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হবে। যথা সময়ে পূর্বাণীতে হাজির হলাম। মণির গাড়ির ড্রাইভার প্রাক্তন মুক্তিযােদ্ধা। আমাকে কয়েকবার ঐ গাড়িতে লিফট দিয়েছে। আমি জানি সে সশস্ত্র। কিন্তু আমাকে দেখলেই সে হেসে ফেলে। বিনয় বচনে কথা বলে। আজও আমার পুরনাে অস্টিন গাড়ি দেখেই সে দৌড়ে এসে দরােজা খুলে দিল। বললে : যান, মণিভাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। পূর্বাণী ইন্টারন্যাশানাল হােটেলের জলসা ঘর আজ প্রায় খালি। কয়েকজন বিদেশী বসে চুরুট কুঁকছেন। একটা খালি টেবিলে একা বসে মণি কফি খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে কিছু খাবারের অর্ডার দিলেন। খেতে বসে মণি বললেন ; আমরা কোথায় এসে পৌছেছি জানেন? প্রশ্ন করলাম ; আমরা মানে কারা? ; বঙ্গবন্ধুর সমর্থকেরা। : কোথায় পৌছেছেন? : পাহাড়ের একেবারে চুড়ােয় । হেসে বললাম ; একটু ভুল হলেই অতল খাদে পতন। মণি বললেন ; পতন-উত্থান একটা রিলেটিভ টার্ম। বর্তমান অবস্থায় আপনার ভূমিকা কি? বললাম । আমি একজন নগণ্য সাংবাদিক। ‘জনপদের’ বেতনভােগী সম্পাদক। তবু বঙ্গবন্ধু মাঝেসাজে আমাকে তার কাছে ডাকেন, তাই বাইরের লােকে আমাকে কিছুটা দাম দেয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ভূমিকার কি কোন দাম আছে? মণি বললেন ; আছে। আপনি লিখতে পারেন। লিখে আপনি বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল সমর্থকদের সাহায্য করতে পারেন। বললাম : বঙ্গবন্ধুর তাহলে একদল প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থকও আছে? মণি বললেন ; আছে। তারা সুযােগের অপেক্ষায় আছে, কখন বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রগতিশীল নীতিকে আঘাত হানবে। বললাম : এই আঘাত সামাল দেবার কোন প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে। মণি বললেন : নিশ্চয়ই আছে। নইলে আমরা গণঐক্যজোট গঠন করবাে কেন? বললাম : এই গণ-ঐক্যজোটের সংগে গণ অর্থ জনতার কোন সম্পর্ক আছে কি? না এটা নেতায় নেতায় ঐক্যজোট? মণি বললেন : আপনি হলে কি ধরনের জোট গঠন করতেন? বললাম : আগে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশকে সংহত, সুগঠিত করতাম। নিজের দল থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীদের উচ্ছেদ করতাম। তারপর স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন এমন দল বা দলগুলাের সাথে ঐক্যজোট গড়ে তুলতাম। মণি বললেন : আমরা কি করেছি? বললাম : আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আজ কয়েকটা স্পষ্ট কথা বলতে চাই। আওয়ামী লীগ আজ নীতিগত দ্বন্দে নয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দে দ্বিধাবিভক্ত। তারই সুযােগ নিয়ে দলের ভেতরে এবং বাইরে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আপনারা আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ নিজেরাও এক থাকতে পারছেন না। তাজুদ্দিন সাহেব নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল নেতাদের একজন। আমার অভিযােগ, ব্যক্তিগত উচ্চাকাংখার জন্যে তাকে দলের ভেতরে এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে হেয় করা হয়েছে। তাজুদ্দিনকে দুর্বল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশকেই দুর্বল করা হয়েছে। এর সুযােগে শক্তিশালি হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল মােশতাক গ্রুপ। তারা দলের ভেতরে থেকে গণ ঐক্যজোটের সকল কার্যক্রম ও কর্মসূচি ব্যর্থ করে দিচ্ছে। | মণি বললেন ; আপনার অভিযােগ ঠিক নয়। তাজুদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে হটিয়ে দেশের নেতা হতে চান। বললাম : বিশ্বাস করিনা। তাজুদ্দিন চান, বঙ্গবন্ধুর পর দলের ও দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে । আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। বঙ্গবন্ধুর পর দলের নেতা কে হবেন, তা ঠিক করার গণতান্ত্রিক পন্থা ও পদ্ধতি উন্মুক্ত থাকা প্রয়ােজন। মণি একটু বিরক্ত হলেন। বললেন : সকল সময় তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি চলে বললাম : আমি তত্ত-কথা বলছি না। রাজনীতি সম্বন্ধে তত্ত্ব-কথা বলার অধিকার ও যােগ্যতা আমার নেই। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি যা বুঝেছি, তাই আপনাকে বলছি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী নেতা। তার মূল শক্তি আমলা ও সৈন্যবাহিনী নয়। কারণ, পাশ্চাত্য কায়দায় টেনিং প্রাপ্ত এবং গণ-বিরােধী মানসিকতা দ্বারা তৈরি আমলা ও সেনাবাহিনী বেশিদিন বঙ্গবন্ধুর পেছনে থাকবে না এবং থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তি তিনটি। এক, প্রতিবেশি গণতান্ত্রিক ভারতের সংগে মিত্রতা। দুই, দেশের শ্রমিক, কৃষক ও যুবশক্তির সমর্থন। তিন, একটি সুগঠিত ও শক্তিশালি রাজনৈতিক দল। মণি বললেন ; আপনার শেষের বক্তব্যের সংগে আমি এক মত। বললাম ; তাহলে আসুন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য যে চক্রান্ত হয়েছে, তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করি। প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে আঘাত না করে আঘাত করা হয়েছে তার শক্তির ভিত্তিকে। প্রথমেই অপপ্রচার শুরু হয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচাইতে বড় বন্ধুকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন মাসের মধ্যে মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে চোরাচালানী, সম্পদ পাচারকারী এবং বাংলাদেশের কাছে পচামাল বিক্রেতা হিসেবে। অত্যন্ত কৌশলে এই প্রচার চালিয়েছে বাংলাদেশের মার্কিন, চীন ও পাকিস্তানী লবী এবং পরাজিত সাম্প্রদায়িক দলগুলাে। আপনারা তখন এই অপপ্রচার বন্ধ করে জনসাধারণের কাছে সত্য কথা প্রকাশের দৃঢ়তা দেখাননি। কেন দেখাননি তার রাজনৈতিক কারণও আমি জানি। যা এখানে আলােচনা করতে চাই না। ভারতকে জনসাধারণের কাছে হেয় করার পর শুরু হল শ্রমিকলীগে ভাংগন সৃষ্টির চেষ্টা। রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও আবদুল মান্নানের ঝগড়ায় শ্রমিক লীগ শুধু ধ্বংস হয়নি, সাধারন মানুষের আস্থাও হারিয়েছে। শ্রমিক লীগে এমনভাবে কোন্দল সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষের কাছে এই দলের নেতাদের কোন ইমেজ না থাকে। বরং লুটপাটের দল ও দুর্নীতিবাজ নেতা হিসেবে শ্রমিক লীগ ও শ্রমিক নেতারা যাতে চিহ্নিত হন সেভাবেই প্রচারণা চালানাে হয়েছে। শ্রমিক লীগের পর এবার ছাত্র ও যুবলীগের পালা। সবশেষে আসবে আওয়ামী লীগের পালা । তারপর? তারপর এক চরম মুহুর্তে জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন-বঞ্চিত বঙ্গবন্ধুকে শেষ আঘাত হানা হবে। আর বঙ্গবন্ধুর যদি পতন ঘটে, তাহলে আপনারাও কেউ বাঁচবেন না। সুতরাং বৃথাই এখন নিজেরা নেতৃত্বের কোন্দলে মেতেছেন। মণি বললেন ; আপনার সংগে রাজনীতি আলােচনা করা বৃথা। বললাম : তাহলে আপনার বক্তব্য কি বলুন। শেখ মণি স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাইলেন না। যা বললেন, তার সারমর্ম হল, বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীলেরা আবার জোট বাধছে; সুতরাং ভালােমন্দ বিচার না। করে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ হিসেবে তার গ্রুপকে আমাদের সমর্থন। জানানাে উচিত। আর এখানেই তার সংগে আমার মতানৈক্য। সেদিন মণিকে বার বার যে কথাটা বলতে চেয়েছি তা হল, নীতিগত আনুগত্য ছাড়া ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে কোন দেশেই প্রগতিশীল রাজনীতি শক্তিশালী হতে পারে না। মণি চান, তার প্রতি এখন যারা ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাচ্ছেন, তারা এককালে মােনায়েম খার এন, এস, এফ, বা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের গুণ্ডা হােক বা প্রাক্তন রাজাকার আলবদর হােক, তাদের নিয়ে তিনি গ্রুপ গঠন করবেন। অন্যদিকে যারা নীতিগতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম সােস্যালিজমে বিশ্বাসী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পােষণ করে না, তাদের জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রেই পাত্তা দেয়া হবে না। এই নীতির সর্বনাশা দিক হল, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগে তখন আইয়ুব খা-মমানেম খার আমলের সুবিদাবাদী দল ভােল পাল্টিয়ে এসে আসর জাকিয়ে বসছিল। আর আওয়ামী লীগের যারা প্রকৃত কর্মী – যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী, যারা পাকিস্তানী শাসনে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ভােগ করেছেন, তারা ক্রমশই পিছনে হটে যাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের কিছু নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীও এই সুবিধাভােগী ও রাতারাতি বড়লােক হওয়ার দুর্নীতিময় পথে পা বাড়াননি, তা নয়। কিন্তু তারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয় । আর সংখ্যাগরিষ্ঠ যে অংশের দুর্নীতি ও সমাজবিরােধী কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে এত দুর্নাম কুড়াতে হয়েছে, তারা কেউ দুর্দিনে বা সংগ্রামের দিনে আওয়ামী লীগের বন্ধু বা সমর্থক ছিলেন না। সেদিন কথায় কথায় অনেক রাত হল । মণি বললেন : অনেক রাত হয়েছে। চলুন, ওঠা যাক। আপনার গাড়ি ছেড়ে দিন। আমার গাড়িতে আপনাকে বাসায় পৌছে দেব। বললাম ; এত রাতে আপনাকে আবার একা ফিরতে হবে। তার চাইতে আমি আমার গাড়িতেই বাসায় ফিরবাে। মণি একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন : আপনার সংগে কথা অসম্পূর্ণ রইল। বললাম ; এই ধরনের কথা সাধারণত অসমাপ্তই থাকে। আপনি আগে নিজের দল ঠিক করুন। পরগাছা ও সুবিধাবাদীদের সরিয়ে প্রগতিশীলদের ঐক্যবদ্ধ করুন। আর এখনতাে আপনার হাতেও দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। বাংলার বাণী। মণি বললেন : কি করবাে বলুন? ইত্তেফাকের মানিক মিয়া এখন বেঁচে নেই। তার ছেলেরা আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কৌশলে লিখছে। ইত্তেফাক’ আওয়ামী লীগের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত । ফলে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি আরাে বাড়ছে। আমাদের নিজস্ব একটা পত্রিকা দরকার। বললাম : বেশতাে, আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে একটি দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলেই হতাে। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের কোন নেতা ব্যক্তিগত মালিকানায় নতুন কাগজ ও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করছেন এটাও শত্রুপক্ষ প্রচারণার মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। মণি বললেন : আওয়ামী লীগ বেসিক ইন্ড্রাষ্ট্রি এবং বড় বড় কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করার নীতিতে বিশ্বাসী। যে কোন ধরনের ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদের নীতি সে ঘােষণা করেনি। বললাম ; সংবাদপত্র এখন বড় শিল্প। একটি দৈনিক কাগজ ছাপাখানা সহ প্রতিষ্ঠায় এখন ২৫ লাখ টাকার বেশি লাগে। সেদিক থেকে আপনি এখন বাংলাদেশী টার্মে-বড় শিল্পপতি। বঙ্গবন্ধুর সমস্যার কথাও ভেবে দেখুন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মিশর ও সিংহলের মত সংবাদপত্র শিল্পকে জাতীয়করণের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানিক মিয়ার ‘ইত্তেফাক পত্রিকা ও মানিক মিয়ার পরিবারের প্রতি দুর্বলতা বশত তিনি তা পারেন নি। ইত্তেফাক পত্রিকাকে ব্যক্তি মালিকানায় রাখার অনুমতি দিতে গিয়ে আপনাকেও দৈনিক বাংলার বাণী’ প্রকাশে সম্মতি দিতে হয়েছে। দিতে হয়েছে জনপদ প্রকাশের অনুমতি। তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিদার চাইতে সরকারের শত্রুপক্ষের সুবিধা হয়েছে। তারা নানা আবরণে নানা পত্র পত্রিকা বের করে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারে লিপ্ত। তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেই তারা বাক স্বাধীনতা গেল, গণতান্ত্রিক অধিকার গেল বলে চীৎকার শুরু করে। আজ তাদের সংঘবদ্ধ মিথ্যা প্রচারের সামনে তিনটি সরকারি দৈনিক এবং আপনার কাগজ সহ দুটি সরকার সমর্থক দৈনিক অসহায়। মণি বললেন; এই অবস্থা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবাে। বললাম ; যদি না পারেন? মণি বললেন ; আপনার রাজনীতি তত্ত্ব নিয়ে। আমাদের রাজনীতি বাস্তব নিয়ে। সুতরাং বাস্তব অবস্থা আমরা ভাল বুঝি। বললাম ; আপনাদের সাফল্য কামনা করি। পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে দু’জনে বিদায় হলাম।
শেষ মার্চের রাত। ঢাকায় শীত চলে গেছে। আবার গরমও পড়েনি। আকাশে মেঘ নেই। বরং তারার সমাহার – যেন নীলকণ্ঠী হাঁসের গলায় দুলছে অসংখ্য মােতির মালা। ইয়াকুব বঙ্গভবনের সামনে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে টয়েনবি সার্কুলার রােডে এসে পড়ল। জনশূন্য রাজপথ। দু’একটা রিক্সা ক্রিং ক্রিং শব্দে পাশ কাটাচ্ছে। বাতি নেই। কেরােসিনের দাম বেশি। তাই রিকশাঅলারা বাতি রাখে । পুলিশও করে না আইন পালন নিয়ে কড়াকড়ি। আমার কে, এম, দাশ লেনের বাসার সামনে এসে দেখি, একটা সবুজ টয়ােটা করােনা গেট জুড়ে দাড়িয়ে। বাতি নেবানাে৷ ইয়াকুব দু’বার হর্ণ দিল। কিন্তু নট নড়ন চড়ন। আমি গাড়ি থেকে নামতে যাব, টয়ােটা থেকে নেমে এলেন দু’জন অল্প বয়সী লােক। একজন বললেন : গাফফার ভাই না? বললাম : হ্যা। আপনারা কে? কি চান? প্রথমজন বললেন : আমরা ছাত্রলীগের কর্মী। আপনার সংগে কথা বলতে এসেছি। বললাম : এত রাত্রে? : রাত দশটা থেকে জনপদ অফিসে বসে থেকেছি। ওরা বললেন, আপনি শেখ মণির সংগে কথা বলতে গেছেন। তাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। বললাম : রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি কথা হবে? প্রথমজন বললেন : শেখ মণি চাচ্ছেন ছাত্রলীগ থেকে কিছু কর্মী ও নেতাকে সরিয়ে নিয়ে পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করতে। আমরা প্রধান ভাইয়ের সংগে আছি। জনপদ’ যদি আমাদের সমর্থন দেয়, তাহলে আমরা ছাত্রলীগের সকল শাখাকে। নির্দেশ দেব, তারা যেন বাংলার বাণীর বদলে জনপদের প্রচার বৃদ্ধির চেষ্টা করে। বললাম : আমি জনপদের মালিক নই। সুতরাং এ সম্পর্কে কোন আলােচনা করতে পারি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আপনাদের বক্তব্য জনপদে ছাপা হবে। শেখ মণির মন্তব্যও ছাপা হবে। এবার দ্বিতীয়জন বললেন, ইত্তেফাকও আমাদের বক্তব্য ছাপাৰে। সহসা প্রশ্ন করলাম : আপনাদের সংগে তােফায়েল, এবং শেখ শহীদ আছেন তাই না। ওরা দু’জনেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। বললাম ; আজ তাহলে যাই। অনেক রাত হয়েছে। আরেকদিন জনপদ অফিসে আসেন, কথা হবে। এরপর পাঁচই এপ্রিলের সেই বিভীষিকাময় দিনটি। মাঝরাতের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হলেন ছাত্রলীগের সাতজন নেতা। তাদের মধ্য একজন কোহিনুর ছিলেন শেখ কামালের ব্যক্তিগত বন্ধু । গুজব রটলাে, এরা শেখ মণির সংগে যােগ দিয়ে পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং প্রধান গ্রুপের সংগে একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্যও প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে তখনও মস্কোতে। কিছুদিনের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা প্রধান গ্রেফতার হলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মনসুর আলী এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ব্যাপারে কঠোর মনােভাব গ্রহণ করলেন। দলীয় নেতার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ আন্দোলন শুরু করলাে। কিন্তু মনসুর আলী রইলেন অবিচল। ঢাকায় গুজব রটলাে তােফায়েলের মাথার উপরে গ্রেফতারী পরােয়ানা ঝুলছে। শেখ ফজলুল হক মণি এবং তােফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পাচ্ছিল এবং নেপথ্যে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন খােন্দকার মােশতাকের সমর্থক তরুণ প্রতিমন্ত্রীদের গ্রুপটি। এদের মধ্যে আছেন ফরিদপুরের কে, এম, ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ।
Reference:
ইতিহাসের রক্তপলাশ-পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফফার চৌধুরী
Facebook comments:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার ও শেখ মণি – আব্দুল গাফফার চৌধুরী১৯৭৪ সালে ত্রিশে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানে…
Posted by সংগ্রামের নোটবুক on Sunday, August 25, 2019