You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | যুবসমাজের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান | আচার্য সত্যেন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৬ই ফেব্রুয়ারী, বুধবার, ২৩শে মাঘ, ১৩৮০

যুবসমাজের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান

গত সোমবার থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের তিন দিনব্যাপী জাতীয় কংগ্রেস শুরু হয়েছে। আজ কংগ্রেসের সমাপ্তি দিবস। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দশ হাজার যুব প্রতিনিধিদল এই কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক যুব-কর্মীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার জন্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার প্রগতিশীল যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য এসেছেন।
আওয়ামী যুবলীগের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দেশের প্রগতিশীল যুবসমাজকে লক্ষ্য করে যে ভাষণ দেন তা নানান দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশকে শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য যুব সমাজের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনার জন্য যে লাখো লাখো বীর সন্তানরা শহীদ হয়েছেন তাদের রক্ত দান বৃথা হয়ে যাবে যদি আমরা দেশকে শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারি। আর এ নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব দেশের যুবসমাজের উপর অর্পিত।
তিনি আরো বলেন যে, দেশের স্বাধীনতাকে বানচাল করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশি অর্থে পরিপুষ্ট এক শ্রেণীর দালাল আজ দেশের সর্বত্র আগুন লাগাবার স্লোগান দিচ্ছে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ওরা অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। এদের এই অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে আর বরদাস্ত করা হবে না। এদের দমন করার জন্য দেশের যুবসমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে শুধু তাই নয়, দেশের যুবসমাজকে স্বাধীনতা-উত্তর পুনর্গঠনের কাজেও আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দেশের বর্তমান অবস্থার সামগ্রিক একটা চিত্র তুলে ধরে আরো বলেন, দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করতে হলে সকল প্রগতিশীল ও দেশ প্রেমিক দলগুলোকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে।
তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, গণতন্ত্রের নামে দেশের বুকে নৈরাজ্যের রাজনীতি চলতে দেয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশে নৈরাজ্যের রাজনীতি অবসানে তার সরকার বদ্ধপরিকর এবং এ প্রশ্নে যুবসমাজকেও কঠোর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য তিনি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন একাত্তরের পচিশে মার্চ আমি তোদের হাতে কোন অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি- আমি কেবল তোদের হুকুম দিয়েছিলাম শত্রুর মোকাবেলা করে জন্মভূমির স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে। তোরা আমার হুকুম মতো কাজ করেছিস। আমি তোদের নিয়ে গর্বিত। তোরা তো আজও বেঁচে আছিস। তা সত্বেও কি করে আজ দেশের বুকে সন্ত্রাস হচ্ছে। গুপ্তঘাতক এরা মানুষকে হত্যা করছে- দুর্নীতি চলছে সমাজদেহে। আজ আমি তোদের সেই প্রশ্নই করতে চাই। আমি তোদের বলতে চাই, দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ আশা- ভরসা তোরা। তোরা বাংলার যুব সমাজ। বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সামগ্রিক দায়িত্ব আজ তোদেরই নিতে হবে। আপদে-বিপদে সহায়-সম্পদে তোদের তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাদের কাছ থেকে আস্থা অর্জন করতে হবে- সম্মান অর্জন করতে হবে। আমার ডাকে আবার তোরা এগিয়ে আয়- যেন আমি কোনদিন না বলতে পারি যে, আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
বস্তুতঃ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠানকালে জাতির পিতা তার প্রিয় সন্তান এদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উদ্দীপ্ত যুবসমাজের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন তা অবশ্যই সময়োপযোগী। বাংলাদেশের যুব মানস আজ কি চায় দেশের বর্তমান কালের পাহাড়প্রমাণ জটিলতা অরাজকতা দুঃখ আর দৈন্য দুর্দশা লাঘবে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের যুব সমাজ আজ কি দিক নির্দেশ দাবি করে একথা জাতির জনকের চাইতে আর কে বেশি বোঝেন বা বুঝতে পারেন? জাতির জনক তাই তাদের সেদিকে নির্দেশ দিয়েছেন এই ভাষণের মাধ্যমে। আজকের যুব মানসের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন তিনি পুনরায়। তাদের নির্দেশ দিয়েছেন দুঃখ-দৈন্য, শোষণ-বঞ্চনা, অভাব আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রয়োজনবোধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ও জীবনাদর্শ ভিত্তিক মুজিববাদের সফলকায়েমের মাধ্যমে এদেশে জাতির পিতার আজন্ম লালিত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত-নিবেদিত প্রাণ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিটি কর্মী এবার থেকে জীবন-মরণ পণ করে কাজে লেগে যাবেন। কেননা তাঁরা যে আলোর বরপুত্র সমাজতন্ত্রেরই অমৃত সন্তান বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মানুষ। তাদের এ যৌবন জল তরঙ্গের ঘাতে প্রতিঘাতে এদেশ ও এই সমাজের বুকে ভেসে যাবে সকল অন্যায় অবিচারের সামান্যতম চিহ্ন। পরিশেষে বলবোঃ
যাত্রা শুরু হোক হে নবীন,
কর হানি দ্বারে –
নবযুগ ডাকিছে তোমারে।

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ

বিজ্ঞান-সাধক আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মহাপ্রাণ উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক শোকবাণী প্রেরণ করেছেন। শোকবাণীতে বঙ্গবন্ধু ডঃ বসুকে ‘প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এবং বাংলার এক মহীয়ান সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শোক বাণীতে বলেছেন যে, ‘বিজ্ঞান সাধনা এবং মানবতার সেবায় ডঃ বসুর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ শুধু স্বদেশে নয়, বিদেশেও বিজ্ঞান সাধনায় কৃতী পুরুষ হিসেবে অর্জন করেছেন বরমাল্য। সত্যেন্দ্রনাথের বিজ্ঞান প্রতিভা তার ছাত্রজীবন থেকেই বিকশিত হতে থাকে। বিজ্ঞান পঠন-পাঠন এবং গবেষণার মধ্য দিয়ে তার মৌলিক প্রতিভা ধীরে ধীরে পরিব্যপ্ত হতে থাকে। ১৯২১ সালে সতেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে ‘প্রাঙ্ক সূত্র ও কোয়ান্টাম প্রকল্প’ সম্পর্কিত একটি সুবিখ্যাত গবেষণা পত্র রচনা করেন। আইনস্টাইন স্বয়ং এই প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন এবং আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রটির সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘আমার মতে আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি জটিল সমস্যার এ এক দ্যোতনাময় সমাধান।’ আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সুখ্যাতি অর্জন করাতে সতেন্দ্রনাথ বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতির শিরোপা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বহু সংখ্যায়নের এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করতে সক্ষম হন। শুধু পদার্থবিদ্যায় নয়, জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি অধ্যাপক মেঘনাথ সাহার সঙ্গে সংযুক্তভাবে গবেষণাকর্মে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ডঃ বসুর অপরিসীম নিষ্ঠার পরিচয় নিহিত রয়েছে। বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, পদ্মবিভূষণ এবং ভারতের জাতীয় অধ্যাপক হিসেবেও তিনি স্বীকৃতি অর্জন করেন। সাহিত্য, সঙ্গীত এবং খেলাধুলায়ও আচার্য সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগ ছিল। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন এবং শিল্পকলায় তার বৈদগ্ধও আজ সর্বজনস্বীকৃত। বিজ্ঞানের মাধ্যমে তিনি স্বদেশের উন্নয়ন সাধনের জন্য অনলস পরিশ্রম করে গেছেন। বিশেষ করে মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার প্রতি তার টান ছিল। ঢাকা থেকে তাই তিনি ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ এবং ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকা প্রকাশ করে মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ গঠন করতেও কার্পণ্য করেননি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অবিস্মরণীয় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়ের’ উৎসর্গে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। চিন্তায়, সাধনায়, ধ্যানে, স্বপ্নে, কল্পনায় এবং সর্বোপরি আচার-আচরণে তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি, আশুতোষ, রবীন্দ্রনাথ, জগদানন্দ, রামেন্দ্রসুন্দর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে ধারাটি উদ্বোধন করেছিলেন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ, সন্দেহ নেই, সেই ধারাটিকে সার্থক উত্তর সাধক হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহন করে গেছেন। মানুষ হিসেবেও সতেন্দ্রনাথ ছিলেন নিরহংকার এবং হৃদয় বান। জরা বার্ধক্য তাকে কখনো সৃজনশীল কর্মপ্রবাহ থেকে নির্বাসন দিতে পারেনি। সতেন্দ্রনাথ বিশ্ববিশ্রুত গবেষক হিসেবে বাঙালি বিজ্ঞানীদের উৎসাহ এবং অমিত প্রেরণা যুগিয়েছেন। সেই আচার্য সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হল। আমরা একজন খাঁটি বাঙালি বিজ্ঞান সাধককে চিরদিনের মতো হারালাম।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন