You dont have javascript enabled! Please enable it!

এপ্রিলে পাকবাহিনী যশোর পুরোপুরি দখল করে নেয়। আমরা পালিয়ে যাই গ্রামে। সেখান থেকে ভারতে যাবার পথ না পেয়ে পুনরায় শহরে ফিরে আসি। জুলাই মাসের ১৭ তারিখে পাকসৈন্যরা আমাকে ডাক্তার খানা থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে সার্কিট হাউসে নিয়ে গিয়ে ব্রিগেডিয়ারের সামনে হাজির করে। ব্রিগেডিয়ার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। মেজর আনোয়ারের সামনে হাজির করাবার জন্য বসিয়ে রাখে। সেখানে সুবেদার মেজর আমীল হোসেন এবং একটি হাবিলদার ছিল নাম ইকবাল শাহ এবং আরও অনেকে ছিল। হঠাৎ করে অন্য সিপাই এসে আমাকে মারধর শুরু করে তখন সবাই মার আরম্ভ করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি মেজর আনোয়ার হোসেন সামনে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কোন রাজনৈতিক দলে আছ? আমি উত্তর দিই ন্যাপে আছি। তারপর একটি ছোট্ট কামরাতে নিয়ে যায়, রাতে কোন খাবার এমনকি পানিও দেয়নি। প্রশ্রাব করতে চাইলেও মারধর করেছে। তারপর দিন সুবেদার ইকবাল শাহ আমাকে বলে, যেহেতু মেজর খুরশীদ আনোয়ারের মেয়েকে এক সময় চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছি সেহেতু আমাকে নাকি মেরে ফেলা হবে না। ওকে আমি পানির জন্য অনুরোধ করি কিন্তু পানি দেয়নি। সন্ধ্যাবেলা আউন্স দুই পানি এবং একমুঠি পচা ভাত দেয়।

জুলাই মাসের ২০ তারিখে আবার মেজর সাহেবের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যখন বাঙ্গালী সৈন্যরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করে তখন ওরা কি খেত? আমি উত্তর দেই ‘ছোলা’, অমনি সবাই মিলে মারধোর শুরু করে। দুধ, ডাব, ভাত পাঠিয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি হ্যাঁ বলেছিলাম কারণ তখন পাকসৈন্যরা সব খবরই সংগ্রহ করেছে।

জুলাই মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত সিপাইরা দুবেলা নিয়মিত মারধর করতো। পাঁচ মিনিট সময় দিত তার মধ্যে প্রশ্রাব, পায়খানা, হাতমুখ ধোওয়া সব করতে হতো, দেরি হলে বেত মারতো। সারাদিন খাবার দিত না, সন্ধ্যাবেলা কিছু পচা ভাত এবং আউন্স দুই পানি দিত। পানি চাইলে বলতো তোমরা আমাদের পানি বন্ধ করেছিলে।

১ লা আগস্ট আবার মেজরের সামনে হাজির করে। মেজর প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খাঁকে চিনি কিনা বললে আমি চিনি বললাম। মেজর আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট দেয়। কোর্ট থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে সুবেদার মেজর আমীর হোসেন আমাকে ভীষণভাবে মারধর শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার আর চলবার ক্ষমতা ছিল না। তখন থেকে কিছু কিছু খাবার দিত। সিপাইরা মারধর করতো নিয়মিতভাবে। মফিজ চৌধুরী, নড়াইলের অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডাঃ মাহবুবুর রহমান এবং আজিজুর হক, এ, বি, এম, বদরুল আলম এরা সবাই আমার সাথে ছিলো।

পুরা আগস্ট মাস প্রায় আমি অজ্ঞান থাকতাম। আগস্ট মাসে আমার মেয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে অনুরোধ করে আমার মুক্তির জন্য কিন্তু কোন কাজ হয়নি এবং অপমানিতা হয়েছে। উপর থেকে কি অর্ডার আসে জানিনা তারপর আমাকে মুক্তি দেয়। যখন মুক্তি দেয় তখন আমার জ্ঞান ছিল না। রাত সাড়ে আটটার সময় প্রত্যহ ধৃত লোকদের মুখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে বাইরে নিয়ে যেত। শুনতাম অবাঙ্গালীরা ছুরি দিয়ে জবেহ করেছে। ধরে নিয়ে এসে পিটিয়ে হত্যা করেছে। উপরে পা ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে মারতে মারতে মেরে ফেলতো। গুহ্যদ্বারের ভিতর বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিত, খবরাখবর না দেওয়ার জন্য বরফ ঢুকিয়ে দিত। বাগছড়া হাইস্কুলের শারীরিক শিক্ষককে ধরে নিয়ে গিয়ে খবর না দেওয়ার জন্য অত্যাচার শুরু করে। বিছানার উপর শুইয়ে একটি কেমন যন্ত্র দিয়ে চাপ দিত তারপর ইলেকট্রিক শক দিত, উপরে ঝুলিয়ে মারধর করতো। মেয়েদের ধর্ষণ করে কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেকে বসিয়ে বাচ্চাটিকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে কিন্তু মেয়েটিকে রেখে দেয়। জোর করে পাকিস্তানের পক্ষে ভালো আছি বলে জোর করে জবানবন্দী রেকর্ড করতো টেপ রেকর্ডে। গুলি করে, ছুড়ি দিয়ে হাত পা কেটে, উপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। অনুমান ৮/১০ হাজার লোক মারা যায় এখানে। কর্নেল শামস এবং মেজর বেলায়েত আলী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। হাজার হাজার মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। স্বামীকে মারধর করে জোর করে বেয়োনেট দেখিয়ে স্ত্রীকে তুলে নিয়েছে পাকসেনারা। একই মেয়ের উপর ৫/৭ জন আর্মি ধর্ষণ করেছে।

স্বাক্ষর/-

ডাঃ এস, এম, আহাদ আলী খান

থানা- কোতোয়ালী, যশোর

০৯/০৩/১৯৭৩

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!