সেই দিনের মত মামলার কার্যক্রম শেষ হবার পর আমি সেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আবার দেখা করি। সেলের পেছনের দিকে রেডিও ছেড়ে আমরা আলাপআলােচনা করতাম যাতে আইবি-র লােকরা শুনতে না পায়। বঙ্গবন্ধুকে আমি বললাম, “এই বৈঠকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু হওয়া দরকার পূর্ব বাংলার ছয় দফা, স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং তার সাথে সাথে এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং আপনার মুক্তি। এইগুলাে গােল টেবিলের সামনে আনা কর্তব্য। এখনই যদি বলে দেন যে যাবেন না, তাহলে এই কথাটি উত্থাপন করার সুযােগ পাওয়া যাবে না। অতএব যাবেন না, এই কথাটি বৈঠক যেদিন হবে এর আগের দিনও বলতে পারেন। তাই এই মুহূর্তে না বলবেন না।’ তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কী করা যায় ? তুমি কী করতে পার, কী করতে বল?’ আমি বললাম, আপনার সেইরকম কোন লােক আমি দেখছি না।’এর চাইতে বেশি কিছু বললাম না। কারণ আমি জানি মােশতাক সাহেব তখন কপ (সম্মিলিত বিরােধী দল)-এর সেক্রেটারি হিসেবে নিজেকে সামনে নিয়ে আসার ব্যাপারে চেষ্টা করছেন, এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বা আমাদের ছয় দফার ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমি লক্ষ্য করিনি। অপর সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব তখন ময়মনসিংহে থাকেন। ঠিক জাতীয় ক্ষেত্রে ওই রকম একটা ভূমিকা পালন করবার মত অবস্থা, পরিস্থিতি, সময়, সুযােগ কোনটাই তার সে সময় ছিল না। তখন অনেক ভেবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীনকে মুক্ত করাতে পারলে গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দিতে রাজি হতে পার। একটি দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দু’জনই যেখানে বন্দি আছে, সেখান কী করে আমরা গােল টেবিল বৈঠকে যাব? তাকে ছাড়তে হবেএই শর্তে গােল টেবিল বৈঠকে যাবার কথা তুমি আলােচনা করতে পার।’ বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে আমি সােজা তৎকালীন শাহবাগ হােটেলে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) নসরুল্লাহ সাহেবের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, যে তিনি খুব ভগ্নমনােরথ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাঁর জিনিসপত্র সব প্যাক হয়ে গেছে, তিনি এয়ারপোের্টে যাবেন। যেহেতু আওয়ামী লীগ গােল টেবিল বৈঠকে যেতে রাজি হয়নি সে কারণে এটা খুব ফলপ্রসূ হবে না—এ রকম একটা ধারণা নিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। আমি রুমে ঢােকার সাথে সাথে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কোন খবর আছে কিনা। আমি তাকে বললাম, আমি আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই।’ তখন তার রুম থেকে সবাই আগেই এয়ারপাের্টের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন। রুমে তিনি থাকলেন, তার হুক্কা থাকল, আর সাথে আমি। কিছু কথা আমি হােটেলের রুমে বললাম, আর কিছু কথা একটি ভাড়া করা ট্যাক্সিতে বসে এয়ারপাের্ট যাবার পথে। আমি বললাম, “যদি তাজউদ্দীন সাহেবকে বের করে আনা যায় তাহলে গােল টেবিল বৈঠকে যাবার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি দু’জনই যেখানে জেলে তখন সিদ্ধান্ত হতে পারে না।’ তিনি বললেন, “ঠিক হ্যায়।’ এয়ারপাের্টে গিয়ে আমাকে বললেন, বসাে, আমি আসছি।’ তিনি ফোন করতে গেলেন। টেলিফোন করে এসে আমাকে বললেন, কাল সন্ধ্যার আগেই তাকে (তাজউদ্দীন) বাসায় পাওয়া যাবে।’ পরদিন ঠিকই সন্ধ্যার পরে আমি এসে দেখি যে তাজউদ্দীন সাহেব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছেন।
কর্নেল নাসের তাজউদ্দীন সাহেব আর আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেখানে বন্দি ছিলেন সেখানে পৌছে দিলেন। তারপর আমরা তিনজন মিলে আলাপ করি আমাদের কৌশল কী হবে, গােল টেবিল বৈঠকে কীভাবে আমরা আমাদের দাবিগুলাে নিয়ে ধাপে ধাপে এগুতে থাকব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার দাবিটা সামনে আসবে, তারপরে আমরা গােল টেবিল বৈঠকে যাব। এইভাবে তিনি ব্রিফ করলেন, সেই ব্রিফ নিয়ে তাজউদ্দীন ভাই এবং আমি ফিরে এলাম। আমাদের লাহাের হয়ে পিন্ডিতে যাবার কথা, আমি আগেই লাহাের চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে লাহাের বার এসােসিয়েশন এবং আজগর খান এদের সাথে লবি। করলাম। আজগর খান একটা বিবৃতিও দিলেন যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা দরকার। কাসুরি সাহেব ও অন্যান্য নেতারা এতখানি উৎসাহিত ছিলেন না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ব্যাপারে। তারপর তাজউদ্দীন সাহেব পিন্ডিতে এলেন। এর আগেই ড. কামাল হােসেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উকিল নিযুক্ত হয়েছেন। এখন ড. কামাল হােসেন, তাজউদ্দীন সাহেব, আমি—আমরা তিনজন মিলে এই লবির মূল কাজটা করছি। ইতােমধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, মান্নান সাহেব, ময়েজউদ্দিন সাহেব, সামসুল হক সাহেব, মােস্তফা সারােয়ার এঁরা এসে গেছেন। লাহাের এবং পিন্ডিতে আমরা কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আইয়ুব খানের আইন মন্ত্রী এস, এ. জব্বারের সাথে আমরা লিয়াজো রক্ষা করতাম। জব্বার সাহেব আমাদেরকে বলেছিলেন যে, তিনি চেষ্টা করছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এনে গােল টেবিল বৈঠক করা যায় কিনা। তিনি এক গভীর রাতে এসে বললেন, “আমার হাত ঠাণ্ডা কারণ আমি এটা করাতে পারছি না এবং ঘটনা অন্যদিকে মােড় নিচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘এই পর্যন্ত রাজি করানাে গেছে যে শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। সে সময় গােল টেবিল বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একটা অনমনীয় মনােভাব ছিল। আবার এদিকে পত্রপত্রিকায় এটাই আসছে যে, আওয়ামী লীগের অনমনীয় মনােভাবের জন্য বােধ হয় গােল টেবিল বৈঠক ভেঙে যাচ্ছে, বা সাংবিধানিক যে সঙ্কট, এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ করে ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভােটএর ভিত্তিতে পাকিস্তানের একটা সংবিধান রচনা করা বা গণতন্ত্রায়ন করার যে সম্ভাবনা সেটা আওয়ামী লীগ ভেঙে দিচ্ছে—এই রকমভাবে প্রচার হচ্ছে। তখন বােধ হয় কোরবানির ঈদও আসন্ন। করাচীর কাগজ এবং পথেঘাটে এ রকম কথাহচ্ছে, এবার আওয়ামী লীগ এত কোটি লােককে কোরবানি দেবে—এই রকম মিথ্যা প্রচার চলছে। আবার এদিকে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আইয়ুব খানের সরকার আস্তে আস্তে ক্ষমতাচ্যুতির দিকে এগুচ্ছে ইসলামাবাদে, করাচীতে, লাহােরে আইয়ুবের বিরুদ্ধে স্লোগান, মিছিল চলছে। পূর্ব বাংলাতেও এই রকম আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলন দারুণভাবে দানা বেঁধে উঠেছে। ইতােমধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। ক্যান্টনমেন্টে অত্যন্ত টেনশান হচ্ছে বাঙালিদের ভেতরে। সেই রকম পরিস্থিতিতে দুটো ভাগে বিভক্ত আর্মিকেও একটা মীমাংসার দিকে আনা হচ্ছে এবং তারা আরাে হার্ডলাইন-এর দিকে চলে যেতে পারে। এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযােগীদের জীবননাশ করবার একটা ষড়যন্ত্র বা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র, বা এটা ছাড়াও ক্যান্টনমেন্টে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সৃষ্টি করে হত্যার গুজব অর্থাৎ নানা প্রকারের একটা গুজবে গােলযােগ সৃষ্টি করতে চাওয়া হচ্ছে। সেই সময় আমাদেরকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এদের কাছ থেকে প্যারােলের প্রস্তাব পেয়ে তাজউদ্দীন সাহেব, ড. কামাল হােসেন, আমি—আমরা তিনজন ঠিক করলাম তাদের প্যারােলের প্রস্তাবে আমরা। যদি হ্যা বা না কোনটাই না বলি, বলি যে, ঠিক আছে, আমরা ঢাকাতে যােগাযােগ করি, তাহলে আমরা একটা রিজনেবুলনেস্ দেখালাম এবং একই সাথে সময় পেলাম। আলােচনা যখন প্রায় ভেঙে যাচ্ছে, তখন তাজউদ্দীন সাহেব সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে বললেন যে, আমরা এই প্যারােলের প্রস্তাব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের কাছে যাচ্ছি, তিনি কী বলেন শুনতে হয়। কিন্তু এতে তার সহকর্মী মােশতাক সাহেব, নজরুল ইসলাম সাহেব কিছুটা অসন্তুষ্টই হলেন। কারণ তাঁদের কাছে একটা ব্রিফ-ই ছিল যে, হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে হবে, আর না হলে আমরা এখনই বাড়িতে ফিরে যাব। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব খুব ঝুঁকি নিয়ে বললেন যে, আমরা ঢাকাতে যাব, গিয়ে এই প্রস্তাব শেখ সাহেবকে বলব, তিনি কী সিদ্ধান্ত দেন সেটা আমি এসে আপনাদেরকে জানাব। এই যে একটা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় সেই অবস্থার সম্পূর্ণ ডায়মেনশনটা বুঝে একটা যে ডিপ্লোম্যাটিক মুভ তিনি নিলেন, এতে তাঁকে অনেক অপ্রীতিকর কথার সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তী পর্যায়ে। এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়েছে যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে নিয়ে আসবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধেও এই কথা প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব, কামাল সাহেব, আমি,—পরিষ্কার ছিলাম আমাদের বিবেকের কাছে। আমাদের যে চিন্তা বঙ্গবন্ধুর সাথে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলের বিষয়ে যে কৌশলের কথা বলেছিলেন, সেইভাবেই আমরা এগিয়েছিলাম । ঢাকায় ফিরে আসার পর আমরা তিনজন মানিক মিয়াকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাই। মানিক মিয়া এবং তাজউদ্দীন সাহেব সেলের ভেতরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বললেন আর আমরা দু’জন বাইরে অপেক্ষা করলাম এবং সেদিন ওই কথাই নিয়ে আসা হল যে, তিনি প্যারােলে যেতে রাজি নন। অর্থাৎ এই যে সময়টা আমরা পেলাম তার ফলে আমরা যে আলােচনা ভেঙে দিচ্ছি এই রকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হলাম না। আবার এদিকে সরকারও সময় পেল তারা কতটুকু নতি স্বীকার করবে বা না করবে সেই বিষয়ে ভাববার। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, স্বৈরাচারদের একটা মজার ব্যাপার আছে, তারা যখন একবার ছাড় দিতে শুরু করে তখন তাদের সম্পূর্ণটাই মেনে নিতে হয়, বিকল্প থাকে না। এটাও তখন আমরা আলাপ করেছিলাম। তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমরা একমত হয়েছিলাম যে, পাকিস্তানিরা একবার যখন ছাড় দিতে শুরু করেছে তখন এটা যদি আমরা একটু ধরে রাখতে পারি তবে সম্পূর্ণটাই অর্জন করতে পারব। কিন্তু আমাদেরকে এখন এমনভাবে চলতে। হবে যেন ঘটনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা নিয়ে যেতে পারি। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন দেখি পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে বেইল পিটিশন মুভ করবার চেষ্টা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু অথবা আমরা কেউ জানি না এই সম্বন্ধে, অথচ রেডিওতে প্রচার হয়ে গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান বেইল নিয়ে গােল টেবিল বৈঠকে যাচ্ছেন। ইতােমধ্যে ঢাকা শহরে বিরাট মিছিল শুরু হয়ে গেছে। লােকজন আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ধাওয়া করে। ওদের অপপ্রচার এবং দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাজউদ্দীন ভাই এবং আমাদের সঙ্গে আলােচনা করে বঙ্গবন্ধু তখন খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন যে, না, আমি যাব না। কারণ এই যে প্রচার হচ্ছে, এটা আমাকে শেষ করবার জন্যে হচ্ছে। এরপর বেইল পিটিশনের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেল। তার পরদিন সম্পূর্ণভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হল।
- আমীর-উল ইসলাম
- তাজউদ্দীন-আহমদ-আলোকের-অনন্তধারা