You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৮ই ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার, ২৫শে মাঘ, ১৩৮০

এ সুপারিশ কার্যকর করুন

পৌরসভাগুলো সহ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গুলোর আর্থিক সংকট লাভের পন্থা নিরূপণের জন্য ইতিপূর্বে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছিল সেই কমিটি সম্প্রতি তার সুপারিশ পেশ করেছে গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। এই সুপারিশ অনুযায়ী এখন থেকে প্রমোদ করের সবটাই পৌরসভা গুলো পেতে পারে। আগে এই করের শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ তারা পেতো। সিনেমার টিকিট থেকে এই করের সিংহভাগ আদায় হয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রায় সব কয়টি পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো এক দারুণ আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ টাকার পৌরকর অনাদায় পড়ে থাকায় এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন অসুবিধার দরুণ পৌরসভা ও অন্যান্য স্থানীয় সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করে। একমাত্র ঢাকা পৌরসভারই অনাদায় করের পরিমাণ এখন এক কোটি টাকার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, দেশের স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা গুলোর আর্থিক অসুবিধা দূর করে এইসব সংস্থার অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য বর্তমান সরকার ভাবনা চিন্তা করেছেন এবং সেজন্যই উপরোক্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটির এখন থেকে সকল প্রকারের প্রমোদকর স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা গুলোকে প্রদানের জন্য সুপারিশ করেছেন। এই সুপারিশ অনুযায়ী সরকার এখন স্থানীয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমেই সকল প্রমোদকর আদায় করবেন। এই কমিটি সিনেমা, টেলিভিশন, বিভিন্ন হোডিং প্রভৃতি বিজ্ঞাপনের জন্য স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা গুলোকে কর ধার্যের জন্য আলাদাভাবে ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশও করেছেন। অন্যদিকে নগর শুল্ক সুষ্ঠুভাবে যাতে আদায় হয় সেজন্য নগর শুল্কের পরিবর্তে বিক্রয় কর আদায় করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা গুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আরো বহুবিধ নানা কর বসানোর জন্য স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা গুলোকে ক্ষমতা দেয়ার জন্য উক্ত কমিটির সুপারিশ করেছেন।
বস্তুতঃ এই কমিটির সুপারিশগুলো পেশ করেছেন, আমরা নিঃসন্দেহে এটাকে একটি বাস্তবমুখী এবং সর্বজন গ্রহণযোগ্য সুপারিশ বলে ধরে নিতে পারি। কেননা আমাদের শাসনতান্ত্রিক ধারা ও সরকারি নীতি অনুযায়ী এখন থেকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও পৌরসভা গুলোকে তাদের আওতাধীন এলাকাগুলোর উন্নয়ন তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্বেও তারাই থাকবেন। জাতীয় সরকার কেবল তাদের চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা এবং এর সাথে সাথে জাতীয় উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য সরাসরি ভাবে কাজ করে যাবেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও পৌরসভাগুলোর দায়িত্ব আগের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। আর এ জাতীয় দায়িত্বের পরিমাণ যতই বাড়ছে বা বাড়বে অর্থের প্রয়োজনেও ঠিক ততটাই বাড়ছে ও বাড়বে অপরিহার্য কারণেই। এমতাবস্থায় কর্মের সাথে তথা দায়িত্ব সম্পাদনে সাথে আর্থিক সঙ্গতি যদি না বাড়ে, তবে যাকে যত বড় দায়িত্ব দেয়া হোক না কেন অথবা দায়িত্বের পরিমাণ যত ছোটই হোক না কেন, তার কোনোটাই সম্পাদন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না- উঠার কথাও না।
অন্যদিকে কর ধার্য করা যেমন সহজ- আদায় করা তত সহজ নয় কোনোদিনই। করের পরিমাণ যত নগণ্যই হোক না কেন তা আদায়ের জন্য যদি কোন সঠিক ও বাস্তব ব্যবস্থা না থাকে তবে সেই কর কোন দিনই ঠিকমত আদায় হতে পারেনা। তদুপরি কর আদায়ের ভার যে সংস্থার উপর অর্পিত হয়ে থাকে তারা যদি সেই আদায়কৃত অর্থের নিয়ামক না হতে পারে, তবে এই কর আদায়ের ক্ষেত্রে ও তাদের অমনোযোগী হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও পৌরসভাগুলো এতদিন কেবল কর ধার্য ও আদায়রই মালিক ছিলো- কিন্তু সেই অর্থ নিজেদের কোনো পরিকল্পনা মাফিক ব্যয় করার সুযোগ খুব বেশি একটা পেতো না। আজ যে অনাদায়ী করের বোঝা কেবল বেড়েছে, এর কারণ যেমন একশ্রেণীর মানুষের কর আদায়ে নিস্পৃহ মানসিকতা তেমনি আদায়কারীদের ঔদাসীন্যতা। এমতাবস্থায় সেই মানসিকতা ঔদাসীন্যের এবার অবসান ঘটতে বাধ্য। আমরা সেটাই মনে করি এবং সুপারিশ কার্যকর করার আহ্বান জানাই।

খুদে শার্দুলদের প্রতি অভিনন্দন

গতকাল ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জুনিয়র টাইগারদের রজত জয়ন্তী উৎসব। পঁচিশ বছর আগে জন্ম হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। কিন্তু পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বারংবার এই বাঙালি বীরদের প্ররোচনা দিয়ে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে চেয়েছে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বরাবর বাঙ্গালীদের প্রতি ছিল বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর জওয়ানরা তাই একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর মর্যাদার অধিকারী হয়েও পশ্চিমা প্রভুদের শ্যেন দৃষ্টির কবলে পড়ে নানারকম অবমাননাকর আচরণের মোকাবেলা করতে হতো। তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করেও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ভাইয়েরা স্বদেশকে স্বাধীন এবং স্বজাতিকে অত্যাচারীর নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য একান্ত সংগোপনে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে দ্বিধাবোধ করেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জুনিয়র টাইগারদের অবদান সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরীহ বাঙালিদের ওপর রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন স্বদেশবাসীকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এই ক্ষুদে শার্দুল বাহিনী অমিত বিক্রমে এগিয়ে এসেছিল। পাকিস্তানী সামরিক প্রভুদের তথাকথিত নিয়ম শৃংখলার রজ্জু ছিন্ন করে মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে বাঙালি জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এই ক্ষুদে শার্দুলদের দুর্বার অভিযানে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। একাত্তরের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সামরিক প্রভুরা জয়দেবপুরে এই ক্ষুদে শার্দুলদের উপর হুকুম দিয়েছিল নিরীহ জনসাধারণের প্রতি নির্বিচারে গুলি বর্ষণের। কিন্তু ক্ষুদে শার্দুলরা সেদিন পাকিস্তানী সামরিক প্রভুদের হুকুম তামিল করতে গিয়ে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ না করে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে দায়িত্ব পালন করেছিল। খুদে শার্দুলদের এই আচরণের পর পাকিস্তানি সামরিক প্রভুরা তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। ছাব্বিশে মার্চ থেকে স্বাভাবিক নিয়মেই এই বীর বাঙ্গালী সৈনিকরা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছিল। এবং এমনিভাবে বাঙালি সৈনিকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রাম গড়ে তোলার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল। দিনে দিনে মুক্তি সংগ্রাম যতই জোরদার হয়ে উঠছিল, বাঙালি সৈনিক ভাইয়েরা ততই দুর্বার আক্রমনাত্মক অভিযান পরিচালনায় মত্ত হয়েছিল। হানাদার পাকবাহিনীকে দেশের মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়নের জন্য এবং হানাদার বর্বর সেনাদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়ার জন্য জীবনকে বাজি রেখে রক্তাক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খুদে শার্দুলরা মাতৃভূমিকে মুক্ত করার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। একাত্তরের ডিসেম্বর মাসে এই ক্ষুদে শার্দুলদের সক্রিয় অভিযানেই পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে উঠেছিল। তারপর ষোলই ডিসেম্বর বাংলার বীর সৈনিক রা বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিল। তাই গতকাল যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হল, তখন আমরা তাদের আর একবার অভিনন্দন না জানিয়ে পারলাম না। খুদে শার্দুলরা বাংলার আশা, বাঙালি জাতির গর্ব। এদের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের পতাকাকে চির সমুন্নত রাখার জন্য খুদে শার্দুলদের শহীদ সেনানীদের প্রতি সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা নিবেদন করা উচিত। সংগ্রামে, শপথে আমরা আজ খুদে শার্দুলদের অবিস্মরণীয় অবদানকে স্মরণ করছি। বাঙালি জাতির সেবায় তাদের ভূমিকাকে সমুজ্জল রাখার জন্য প্রার্থনা করছি। বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে এই ক্ষুদে শার্দুলরা মহিয়ান করে তুলেছে। বাঙালি জাতির তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতেও এই ক্ষুদে শার্দুলরা দেশ ও জাতির সেবায় সুদৃঢ় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে। আমাদের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে ক্ষুদে শার্দুলদের অগ্রযাত্রা চির অব্যাহত থাক, এই আমাদের কামনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!