বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৭ই ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ২৪শে মাঘ, ১৩৮০
বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতি রক্ষা
গত সোমবার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রেস কাউন্সিল বিল ১৯৭৪ এবং সংবাদপত্র কর্মচারীদের (চাকরির শর্তাবলী) বিল ১৯৭৪ গৃহীত হয়েছে। বিলটি উত্থাপন করেছেন তথ্য ও বেতার দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী এবং সাংবাদিক জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তুমুল করতালির মধ্যে দুটি বিল জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হওয়ায় এক্ষণে আইনে পরিণত হল। এই দুটি বিল সংসদে উত্থাপন এবং অনুমোদন লাভ করায় একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর জন্য তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ ত্রিশ বছর যে সংগ্রাম যে ত্যাগ ও সাধনা চালিয়েছিলেন- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল তার সাথে অঙ্গীভূত। গত দুর্যোগের রাজনৈতিক জীবনের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বাধীনতার সাথে সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নেও অনেক বক্তব্য রেখেছেন। পাকিস্তানি আমলে দীর্ঘ চব্বিশটি বছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ প্রেস কাউন্সিল গঠনের জন্য সাংবাদিকরা অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী কোনদিনও সেই কথায় কর্ণপাত করেইনি- পরন্তু ১৯৬০ সালে আইয়ুব খান তার সামরিক শাসনের আবরণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এবং সংবাদপত্রের টুটি চেপে ধরার জন্য প্রেস এ্যন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স নামক এক নিবর্তনমূলক আইনের জগদ্দল পাথর চেপে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সেল মূলক আইনটির বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তাঁর সরকার এই অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। সোমবার রক্ষিত হলো এই প্রশ্নে প্রদত্ত তার দ্বিতীয় দফা প্রতিশ্রুতি। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরে একদিকে বঙ্গবন্ধুর সরকার যেমন ধন্য হয়েছেন, তাঁরা আস্থাভাজন হয়েছেন- অভিনন্দিত হয়েছেন সারা জাতির কাছে। কাজেই সোমবার ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ ইং এদেশের সরকার এবং সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সংবাদপত্র শিল্পের সাথে জড়িত সকল কর্মচারীদের জন্য অবশ্যই একটি ঐতিহাসিক দিন। তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলবো এদিন বিজয়ের দিন এবং এ বিজয় সরকারের- সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সাংবাদিকদের এবং সংবাদপত্রের সাথে জড়িত প্রতিটি কর্মচারীর- তথা দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতার। এ দুটি বিল উত্থাপনের জন্য আমরা অভিনন্দন জানাব- ধন্যবাদ জানাবো তথ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী এবং আমাদেরই সাবেক সহকর্মী জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে।
বস্তুতঃ দীর্ঘ ২৪ বছর পর্যন্ত সাংবাদিকরা একটি প্রেস কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। এবং সেই সংগ্রামী বীজ উপ্ত হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই। এদিন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভার উদ্বোধনী ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু প্রেস কাউন্সিল গঠনের দাবিটি নীতিগতভাবে মেনে নেন। কেননা এই প্রেস কাউন্সিলই হবে জাতীয় সরকার ও জাতীয় সংবাদ পত্রের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্রের বাহন। এই ঐতিহাসিক দাবি পূর্ণ হওয়ায় আমরা আনন্দিত এবং এই কাউন্সিল গঠনের ব্যাপারে যে নীতি নির্ধারিত হয়েছে তাও দেশের সাংবাদিক সমাজের সকল দাবীরই সামগ্রিক পরিপূরক। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বুদ্ধিজীবি মহলের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব থাকায় আমরা অবশ্যই আশা করতে পারি যে, এই কাউন্সিল সবসময়ই একটি নিরপেক্ষ রায় দানে সক্ষম হবে। সর্বোপরি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা বা হারানোর নিয়ামক হতে পারবেন।
সোমবার সংসদে গৃহীত হয়েছে সংবাদপত্র কর্মচারীদের (চাকুরীর শর্তাবলী) বিল ১৯৭৪ ইং। এই বিলের মাধ্যমে এই প্রথমবারের মতো সংবাদপত্র শিল্পে কর্মরত সাংবাদিক, অসাংবাদিক ও কর্মচারীদের জন্য এককথায় সংবাদপত্র শিল্পের সাথে জড়িত সকল কর্মচারীর জন্য একটি বেতন বোর্ড গঠনের আইন পাশ হলো। এই বেতন বোর্ড গঠনের সংগ্রামের ইতিহাস যেমনি ব্যাপক তেমনি বৈচিত্র্যময়। পাকিস্তানি আমলে ও ১৯৬০ সালে এবং ১৯৬৯ সালে এই ধরনের দুটি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ দুটি বোর্ডের রোয়েদাদই ছিল যেমন ত্রুটিপূর্ণ, তেমনি সংবাদপত্রের মালিক তথা বৃহৎ পুঁজির আইনের ফ্যাকড়ায় তাদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা সম্বলিত। এবারকার বেতন বোর্ড অন্ততঃ অতীতের সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক মূল্যায়নের প্রশ্নের সক্ষমতা লাভ করবে বলেই আমরা আশা করি।
পরীক্ষা পিছানোর ঐতিহ্য পরিত্যাজ্য
১৯৭২ সালে এস,এস,সি পাশ করে যেসব ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ভর্তি হয়, তারা প্রথমে শুনেছিল শিক্ষাবর্ষের গরমিলকে ফিরিয়ে আনার জন্য বোর্ড দুই বছরের স্থলে এক বছরেই ছাত্র-ছাত্রীদের ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে নেবে। সে মোতাবেক বোর্ড পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করেন ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস। তারপর সেই তারিখ পরিবর্তিত হয়ে ৩রা নভেম্বর ধার্য করা হয়। আবার সেই তারিখও পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে ১৯৭৪ সালের ২৮শে জানুয়ারি। শেষ খবরে আবার পরীক্ষার দিন পিছিয়ে একেবারে ২১শে মার্চ ধার্য করা হয়। গত সোমবারে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সহযোগী পত্রিকায়।
পরীক্ষা পেছানোর কারণ সম্পর্কে জানা গেছে নির্ধারিত সিলেবাস এক বছরের শেষ করাতে বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি হওয়াই নাকি এর কারণ।
এরই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন রাখা যায় যে, এক বছরের মধ্যে দুই বছরের পাঠ্যক্রম যে সঙ্গত কারণেই শেষ করা যাবে না, সে কথা বুঝতে এত বিলম্বই বা কেন এবং এতবার এতঘাটে ঠোক্কর খাওয়া কেন? অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের জুলাই থেকে ৩রা নভেম্বরে, ৩রা নভেম্বর থেকে ‘৭৪-এর ২৮শে জানুয়ারি এবং সবশেষে ২১শে মার্চে পরীক্ষা নিয়ে আসা কেন? এক বছরে পাঠ্যক্রমের অগ্রগতি কতটা এবং কী পরিমান হয়েছে, এটা একটু অনুধাবন করলেই বোঝা যেত আর কতটা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।
তাহলে কি ধরে নেব যে, বোর্ড কর্তৃপক্ষ স্কুলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ না রেখেই পরীক্ষা পরিচালনা করতে চাইছেন? যদি তাই হয় তাহলে এটা অবাস্তব পরিকল্পনা (পরীক্ষা পেছানোর বহর দেখে অন্ততঃ তা মনে করা ছাড়া গত্যন্তর নেই) বলতে হবে। যদি তা না হয় তবে এইভাবে পরীক্ষা পিছানোর ঐতিহ্য সৃষ্টি করার ব্যাপারে কোন প্রজ্ঞার নিদর্শন রাখা হচ্ছে বলে আমরা মনে করতে পারছিনা।
সাধারণ পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি অনুযায়ী আমরা বলতে পারি যে, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় থেকে দেশের শিক্ষাবর্ষে যে অনিয়ম দেখা দেয় আজ পর্যন্ত তা নিয়মে ফিরে এলোনা। এভাবে পরীক্ষা পিছাবে এবং শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে গেলেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অস্বস্তি ও মানসিক উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়, অভিভাবকরাও অনিশ্চয়তায় ভোগেন এবং সর্বোপরি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক আঘাত হানে এবং সুদূরপ্রসারী ফল রেখে যায়।
পরীক্ষা পিছানোর আরও একটা প্রত্যক্ষ কারণ আমরা দেখি। তা হলো খাতা দেখার বিলম্ব। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে যে, পরীক্ষা গ্রহণের তিন মাস বা তার অধিক কাল পর্যন্ত পরীক্ষার খাতা বিতরণ করা হয়নি। ফলে ফল বেরোতে অস্বাভাবিক সময় লাগছে। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৭২ সালের এইচ, এস, সি পরীক্ষার্থীদের ফল আট মাস পরে বেরিয়েছে এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে পেরেছে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে। অর্থাৎ পরিক্ষা দিয়ে পাশ করে আবার শিক্ষাবর্ষ শুরু করার মধ্যবর্তী সময় দাঁড়িয়েছিল প্রায় এক বছর।
এমনি ১৯৭১-৭২ সালের এমএ ফাইনাল পরীক্ষা হতে চলেছে ১৯৭৪ সালের মার্চে। ১৯৭২-৭৩ সালের পরীক্ষা বা ১৯৭৩-৭৪ সালের পরীক্ষা তবে কবে হবে? এইভাবে এস, এস,সি, এইচ,এস,সি অনার্স এম,এ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রের পরীক্ষা যদি খামখেয়ালিপনা করে কেবল পিছিয়েই দেয়া হয়, তাহলে শিক্ষাবর্ষের ক্ষতিপূরণ কি হবে?
শিক্ষাবর্ষের ক্ষতিপূরণ করার দুটো পথ ছিল। এক স্বাধীনতা সংগ্রামের যুপকাষ্ঠে একটি শিক্ষাবর্ষকে বলি দেওয়া, দ্বিতীয় অতি দ্রুত কাজ করে শিক্ষাবর্ষকে পুরিয়ে নেয়া। প্রথমটা হয়নি, অতএব দ্বিতীয়টাই করতে হতো। সেখানেও চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
তৎকালীন পাকামো একবার জুলাই থেকে শিক্ষাবর্ষের শুরু করার জন্য ১৫ মাস দু’বছর চালিয়ে যখন জুলাই মাস থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হল তখন তাদের খামখেয়ালীপনার পূর্ণ ফল পেকে উঠেছিল। অতএব আবার জানুয়ারি থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে গিয়ে নয় মাসে বছর করতে হয়েছিল। এতে পরিকল্পকদের কিছু এসে যায় নি কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের যথেষ্ট হয়রানি গিয়েছিল।
একটা সদ্য স্বাধীন দেশে ওই ধরনের খামখেয়ালিপনা আমরা আর দেখতে চাই না। তাই পরীক্ষা পরিচালনার ব্যাপারে একচেটিয়া বোর্ডেই দায়ী থাকবে কেন? স্কুল গুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করতে হবে, এবং নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তনের সম্ভাবনা রাখতে হবে .০১% ভাগ। অতঃপর পরীক্ষার ফল একটা যুক্তিসঙ্গত সময়ের ব্যবধানে বের করতেই হবে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির অজুহাত না দেখিয়ে প্রয়োজনবোধে পরীক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা কাজ করতে হবেই। অতএব হঠকারিতা না করে ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে সাধ্যের মধ্যে যা কিছু করণীয় তা পালন করে দেশের শিক্ষা নীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে হবে। এই পর্যায়ের ব্যর্থতা অবশ্যই দেশ গড়ার কাজের অন্যতম বিরাট অন্তরায়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক