You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, সোমবার, ২১শে মাঘ, ১৩৮০

বাংলাদেশ যুগোস্লাভিয়া যুক্ত ইশতেহার

গত পরশু বাংলাদেশের যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো পাঁচদিনব্যাপী সফর শেষে ঢাকা ও বেলগ্রেড থেকে একযোগে এক যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি যুগোস্লাভিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অগ্রসর হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির ঐক্য ও সংহতি আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা চালানো হবে। যুক্তি ইশতেহারে যুগোস্লাভিয়া দৃঢ় আশা পোষণ করেছে যে, বাংলাদেশ অচিরেই জাতিসংঘের তার ন্যায্য আসনের সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। মার্শাল টিটো এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা কল্পে বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য সংকট সম্পর্কে ইশতেহারে বলা হয়েছে, ইসরাইলে সৈন্যরা দখলীকৃত এলাকা থেকে সরে গেলে এবং প্যালেস্টাইনী জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিরসন হবে, এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে না। বাংলাদেশ ও যুগোস্লাভিয়া ঐক্যমত পোষণ করে ঘোষণা করেছে, সারা বিশ্বের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা একমাত্র জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে, ফলপ্রসূ হবে। যুক্ত ইশতেহারে তাই বাংলাদেশ ও যুগোস্লাভিয়ার জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, প্রেসিডেন্ট টিটো তাতে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন। দিল্লি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই উপমহাদেশে শান্তি আবহাওয়া গড়ে উঠবে এবং সৎ প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করার একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক স্থাপিত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
ইন্দোচীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্পর্কেও যুক্ত ইশতেহারেও অভিন্ন অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, প্যারিস শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে এবং লননল সরকারের প্রতি বাইরের অনভিপ্রেত সাহায্য বন্ধ না হলে কম্বোডিয়ায় শান্তির আশা দুরাশায় পরিণত হতে বাধ্য। যুক্ত ইশতেহারে চিলির আলেন্দের সরকারকে উৎখাত করে সামরিক জান্তা যে ন্যাকারজনক পরিস্থিতির উদ্রেক করেছে, তার গভীর নিন্দা করা হয়েছে এবং সেইসঙ্গে লাতিন আমেরিকায় নির্যাতিত জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি জানানো হয়েছে সমর্থন। এছাড়া যুক্ত ইস্তেহারে বাংলাদেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় যুগোস্লাভিয়া সম্ভাব্য সর্বোচ্চ রকম দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ নীতির অন্যতম প্রবক্তা। বাংলাদেশ জোট-নিরপেক্ষ গোষ্ঠী ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নবীনতম সদস্য। মার্শাল টিটোই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি বাংলাদেশ সফর করলেন। মার্শাল টিটোর বাংলাদেশের সফর তাই বিশেষ তাৎপর্যময়। বিশেষ করে বাংলাদেশ যুগোস্লাভ যুক্ত ইশতেহারের মধ্যে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে, তাতে এই দুই দেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় হবে। আজকের বিশ্বের নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী হিসেবে ইতিমধ্যেই একটি সুনির্দিষ্ট আসন দখল করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে জোট নিরপেক্ষতার প্রতিফলন ঘটেছে। বৃহৎ শক্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজনেতা গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে, বাংলাদেশ- যুগোস্লাভিয়ার এই যুক্ত ইশতেহার একটি মূল্যবান দলিল হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

সোনালী আঁশের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে

গত শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে বাংলাদেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী স্বর্ণসূত্র ‘পাট’ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের কিভাবে বাণিজ্যিক স্থিতিশীলতা আনা যায় এবং কিভাবে এর উন্নতি করা যায়, সে সম্পর্কে সদস্যরা বিভিন্ন বক্তব্যও পেশ করেন। তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ বৈঠকে পাট চাষীদের বিভিন্ন সমস্যা, পাট সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, পাটের রপ্তানি বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পন্থা, পাটের স্বল্পতা, শিপিং সমস্যা, পাটের বৈদেশিক বাজার, পাট গুদামে আগুন, চোরাচালান, বাণিজ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে সদস্যেরা পাটের রাজ্যের বর্তমান নৈরাজ্য ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সম্পর্কে দারুণ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সদস্যেরা মিলিতভাবে অভিমত প্রকাশ করেন যে, পাটের বর্তমান নির্ধারিত মূল্য মোটেই চাষীর প্রয়োজনীয়তা উপযোগী নয় এবং এ মূল্যের পুনঃ নির্ধারণ করা উচিত। এবং পাট সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত তদন্তের উদ্দেশ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে যাবতীয় ব্যবস্থাদিও গ্রহণ করা উচিত।
যাহোক, দেশের অন্যান্য পত্র-পত্রিকার মত আমরাও বারবার বিভিন্ন সংবাদ সম্পাদকীয় নিবন্ধের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শুধু একটি কথার উপরেই জোর দিয়ে এসেছি যে, দেশের এ স্বর্ণ-সূত্র রক্ষায় ব্যর্থ হলে, আমাদের সোনার দেশ গড়ার কোন পরিকল্পনায় প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের এত লেখালেখি ও আলোচনায় কত পক্ষের কুম্ভ নিদ্রা কতটুকু ভেঙেছে বা পাট রাজ্যের নানান সমস্যা বাস্তবে কতটুকু দূর হয়েছে বলা মুশকিল। তবে আলীসদের এ অব্যাহত আলোচনার সময় উপযোগিতা বা প্রয়োজনীয়তার শুভ প্রতিক্রিয়ার দিকটা আমরা সানন্দে গ্রহণ না করে পারছি না। কারণ, এভাবে সর্বস্তরে এক এক করে আলোচনা অব্যাহত থাকলে নিশ্চয়ই এমন একটা পর্যায়ে আমরা পৌঁছুতে পারব যখন পাটের রাজ্যের আসল সমস্যা বা দুর্বলতা কোথায় তা’ আমরা জানতে পারবো এবং একবার সে সমস্যা বা দুর্বলতার আসল রূপ ও ধরন চিহ্নিত করতে পারলে আমরা হয়তো তা’ সমাধান করার সহজ পথটিও খুঁজে পাব।
কারণ, আমাদের মনে হয়, পাট রাজ্যে আমাদের আসল সমস্যা কি এবং কিভাবে সে সমস্যার জন্ম নেয় বা কিভাবে দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় বা ঠিক কারা কারা কিভাবে দুর্নীতি করে সে সম্পর্কে আমাদের কারোরই অস্পষ্ট ছাড়া স্বচ্ছ ধারণা নেই বলেই পাটের সমস্যায় আমরা এত হিমশিম খাচ্ছি। তবে, সবচেয়ে বড় কথা পাটকে দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে নিয়ে জাতির স্বার্থে বিদেশি চক্রান্ত প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে। তা’ না হলে সবই শুধু অরণ্যে নিষ্ফল রোদন হবে।

বিমানবন্দরে বিদেশি মাল

গত শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরের নাকি বিদেশ থেকে বেআইনিভাবে আমদানিকৃত প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঘড়ি, টেলিভিশন, রেডিও, স্যুটের কাপড় ও সিগারেট আটক করা হয়েছে। বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগ এহেন আটকের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা নাকি মতও প্রকাশ করেছেন যে, তাদের ফাঁকি দিয়ে আরও প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ওই জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য ইতিমধ্যে চোরাচালান হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রতিদিনই বিপুল পরিমানের এজাতীয় চোরাচালানকৃত দ্রব্য বিদেশ থেকে আসছে। এমনি ধরনের আরেকটি চালান তারা ধরেছেন গত শনিবারও। উদ্ধার করেছেন ২২ তোলা সোনা, ২৫টি টেলিভিশন সেট, তিনটি রেডিও সেট, ৩টি শেফার্স কলম, বেশকিছু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, কয়েকটি ওয়াশিং মেশিন এবং বিপুল পরিমানের স্যুটের কাপড়। অথচ ধরা পড়ে মাল গুলোর মালিক বা মালিকদের কোন সন্ধান নাকি পাওয়া যায়নি। গতকালকের বাংলার বাণীতে এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বিদেশ থেকে এজাতীয় দ্রব্যের এহেন চোরাচালান বাংলাদেশে কিন্তু এটাই প্রথম নয়- বরং এটাকে একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই হরদমই এসব কাজ কারবার চলছে অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই। তবে মাঝেমধ্যে কেন জানি কাস্টমস কর্তারা হঠাৎ দায়িত্ব সচেতন হয়ে যান এবং তাতে করে এখানে দু-একটা বহর ধরা পড়ে, পত্রিকার খবর বেরোয়, সাধারণ মানুষ কিছুটা চমকিত হয়ে সে খবর পড়েন। তারপর ব্যাপারটা যেন আবার কোথায় তলিয়ে যায়- ধরা পড়া মালগুলোর কি গতি হয় অথবা এ মাল গুলোর অদৃশ্য আমদানিকারক কোন দিন ধরা পড়ে কিনা বা ধরা পড়লেও তার কি সাজা হয়, পত্রিকাওয়ালারাও সেই খবর আর জানতে পারেন না, সাধারন মানুষরাও আর কিছু শোনেন না। গোটা ব্যাপারটাই তখন স্তব্ধ হয়ে যায়। কাস্টমস কর্তাদের মতোই যদি ইতিমধ্যেই আরো ২০ লাখ টাকার এ জাতীয় পণ্যের চোরাচালান হয়ে যায় তাহলে তাদের যোগ্যতা এবং অস্তিতের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি ? হরদমই এ ধরনের মাল আসার প্রশ্নে তাদের ভূমিকা কতখানি?
শোনা যায়, এ জাতীয় চোরাচালানের সাথে নাকি বাংলাদেশ বিমানের কিছু ক্রু জড়িত রয়েছেন। অবশ্য বিমানের কোনো কর্মচারীর সাহায্য ছাড়া যে এ ধরনের চোরাচালান হতে পারে সেটা বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন এসব মাল আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রারই বা জোগান দিচ্ছেন কারা? আমাদের দাবি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গোটা ব্যাপারটা তদন্ত করে আসল বিষয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবেন এবং এ জাতীয় অন্যায় ও অসৎকাজের হাত থেকে দেশকে রক্ষার ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার সাথে সাথে দোষী ব্যক্তিদের তারা যেই হোন না কেন শাস্তিদানের প্রশ্নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!