৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রদত্ত ড. হেনরি কিসিঞ্জারের প্রেস ব্রিফিং এবং মি. কেনেথ কিটিং-এর মন্তব্য
(ক) ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রেসিডেন্ট নিক্সন (Nixon)-এর জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি এ কিসিঞ্জার (Henry A Kissinger)-এর দেয়া একটি সংবাদ সম্মেলনের জন্য তৈরি ব্যাকগ্রাউন্ড ব্রিফিং থেকে উদ্ধৃত। অ্যারিজোনার সিনেটর ব্যারি গােল্ডওয়াটার (Barry Goldwater) হােয়াইট হাউস থেকে এর প্রতিলিপি সংগ্রহ করে ৯ ডিসেম্বর দি কনগ্রেশনাল রেকর্ড (Tre Congressional Record)-এ অন্তর্ভুক্ত করেন। ৫ জানুয়ারি সাধারণ্যে প্রচারিত। এই নথিতে সে সময়ের নিক্সন প্রশাসনের মার্কিনী নীতিমালা ধরা পড়েছে। উদ্বোধনী বিবৃতি এ ধরনের কিছু মন্তব্য শােনা গেছে যে, আমাদের প্রশাসন ভারতবিরােধী। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ধারণা। ভারত একটি মহান রাষ্ট্র। এটা সবচেয়ে জনাকীর্ণ অবাধ রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই দেশ শাসিত হয়। যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন প্রশাসন ভারতের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ব্যাপারে এক ধরনের আন্তরিক তাগিদ অনুভব করে এসেছে এবং এই লক্ষ্যে মার্কিন জনগণ এ পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলার দান করেছে। ফলে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলােতে আমরা যখন ভারতের সাথে কোনাে বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করছি, তা আমরা করছি অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার সাথে ।
আমরা যেমনটি দেখেছি, ২৫ মার্চ থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতি আমি একটু বর্ণনা করতে চাই। ২৫ মার্চ নিঃসন্দেহে সেই দিন, যেদিন থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই কার্যকলাপ, যা বর্তমান দুঃখজনক পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কখনাে সমর্থন করেনি এবং যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই স্বীকার করে এসেছে যে, পরিণামে এই ঘটনা ভারতের ওপরে উল্লেখযােগ্য প্রভাব ফেলবে। আমরা আরাে স্বীকার করেছি যে, ভারতে শরণার্থীদের অব্যাহত প্রবাহ সাম্প্রদায়িক বিরােধের প্রান্তবর্তী একটি দেশে সাম্প্রদায়িক বৈপরীত্যের ঝুঁকির জন্ম দিয়েছে। আমরা জানি যে, উন্নয়নকামী একটি দেশের রুগ্ন অর্থনীতির ওপরে এটা ইতােমধ্যেই একটা চাপ সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র একই সাথে দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রথমত, মা, সুর দুর্দশা লাঘব ও শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন; এবং দ্বিতীয়ত, শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব যেখান থেকে হয়েছে, সেই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান। |মার্চ ১৯৭১-এ সংঘটিত ঘটনাবলি যুক্তরাষ্ট্র বিস্মৃত হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্চ ১৯৭১ এর পরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে উন্নয়ন খাতে কোনাে ঋণ বরাদ্দ করেনি।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক রসদপত্র পাঠানাের কথা চারপাশে বেশ জোরেশােরে শােনা যাচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, এ বছরের মার্চ মাসের শেষদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলির পর যুক্তরাষ্ট্র যে কোনাে নতুন লাইসেন্স মুলতবি রেখেছে। কোনাে মার্কিন ডিপাে অথবা মার্কিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনাে ডিপাে থেকে যে কোনাে ধরনের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে অস্ত্রশস্ত্র যাচ্ছে, সেসব যাচ্ছে পুরনাে লাইসেন্সের মাধ্যমে বাণিজ্যিক চ্যানেল দিয়ে। এগুলাে মূলত খুচরাে যন্ত্রাংশ – কোনাে মারণাস্ত্র বা সম্পূর্ণভাবে তৈরি অস্ত্র নয়। এ বিষয়ের গুরুত্ব বােঝাতে গেলে বলা যায় যে, এ বছরের মার্চের শেষভাগ অথবা এপ্রিলের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ঘটনাবলির অব্যবহিত পর যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের অস্ত্রশস্ত্রের চালান বাতিল করেছে এবং ৫ মিলিয়ন ডলারের চেয়েও কম। মূল্যমানের সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। সেখানেও পাইপলাইনে যে অংশ অবশিষ্ট আছে, সেটা। বাতিল করা হয়েছে। এটা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গির বর্তমান বিবর্তন প্রসঙ্গে কোনাে ঘােষণা দেয়নি। কারণ, সমস্যার একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে শরণার্থী প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র দিল্লী ও ইসলামাবাদ – উভয় ক্ষেত্রেই তার প্রভাব খাটাতে চেয়েছিল।
একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানাের উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছিলাম এবং আমি যদি কোনাে দ্বিমতের কথা বলি, তাহলে সেটা ভারত সরকার ও আমাদের মধ্যেকার। সেটা এ রকম: ভারত সরকারের সাথে বিভিন্ন সময়ে আমরা কথা বলেছি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সেক্রেটারি অভ স্টেট আঠারােবার দেখা করেছেন; অগাস্টের শেষভাগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে তার সাথে আমি সাতবার সাক্ষাৎ করেছি। আমরা সকলেই বলেছি যে, রাজনৈতিক বিবর্তনের অনিবার্য পরিণতি পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্ত্বশাসন এবং আমরাও এটারই পক্ষে। কিন্তু পার্থক্য হল এই যে, ভারত সরকার এত দ্রুত এটার সমাধান চাইছিল যে, সেটা আর রাজনৈতিক বিবর্তন না থেকে তার পরিবর্তে রাজনৈতিক অচলাবস্থায় রূপান্তরিত হত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখানে এলে তাকে আমরা সীমান্ত থেকে পাকিস্তানের একপাক্ষিকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব সম্পর্কে বলেছি। তার দিক থেকে কোনাে সাড়া মেলেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখানে থাকাকালীন তাকে আমরা বলেছি যে, আমরা পাকিস্তান ও কারারুদ্ধ মুজিবুরের মনােনীত আওয়ামী লীগ সদস্যদের মধ্যে আলােচনার ব্যবস্থা করতে পারি। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ভারতে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে তাকে আমরা বলেছি যে, আমরা এমন কি পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নিখুত রাজনৈতিক সময়কাঠামাে নির্ধারণের জন্যও আলােচনায় বসতে প্রস্তুত আছি । আমরা যখন বলি যে, কোনাে ধরনের সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়ােজন নেই, তখন আমরা এটা বলি না যে, ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
আমরা কখনাে বলি না যে, ভারতের সমস্যার প্রতি আমাদের কোনাে সহানুভূতি নেই অথবা ভারতকে আমরা গুরুত্ব দিই না। এই দেশ, যে ভারতের সাথে অনেক দিক থেকে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে আছে, নিদারুণ দুঃখের সাথে শুধু এই বাস্তবতাটুকুই মেনে নিতে পারে যে, গৃহীত সামরিক পদক্ষেপের পেছনে, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তেমন জোরালাে কোনাে কারণ ছিল এখন আমরা জাতিসংঘে যদি এই মত প্রকাশ করি, যা আমরা কখনাে করি না, কারণ উপমহাদেশ ইস্যুতে আমরা নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থাকতে চাই অথবা আমরা হয়ত বিশ্বের একটি মহান রাষ্ট্রের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ত্যাগ করতে চাই; কিন্তু যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি যে, যদি – কথায় যেমন বলে – রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নয়, বরং সংখ্যাধিক্য – ধরা যাক, আক্রমণকারীর আছে ৫০০ মিলিয়ন – সামরিক আক্রমণের অধিকার নির্ধারণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই সংখ্যার দিক থেকে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে এবং সেক্ষেত্রে আমরা এমন এক পরিস্থিতির শিকার হব, যেখানে ভবিষ্যতে আমরা আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য দেখব এবং প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে বড় যে স্বপ্ন শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা, তা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে; শুধু মার্কিনী জনসাধারণই নয়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ। প্রশ্ন ও উত্তর প্র. এই প্রথম আধা-সরকারি ব্যাখ্যায় আমেরিকা কেন ভারতকে অভিযুক্ত করার অবস্থান গ্রহণ করেছে, এবং আপনি কেনই বা এতদিন পরে এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন? সারা বিশ্বের ধারণা যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আগ্রাসী হিসেবে দেখছে অর্থাৎ ভারতবিরােধী। অথচ এখানে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আসলে তা নয়। এই কথাটা এত দেরিতে জানাচ্ছেন কেন?
উ. দীর্ঘদিন আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে যে, বিষয়টি বল প্রয়ােগের মতাে নগ্ন রূপ। পরিগ্রহ করেছে, এবং সামরিক অভিযানের পর প্রথম দুই সপ্তাহ আমরা ডিপার্টমেন্ট অভ স্টেটের উদ্যোগে ব্যক্তি পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা দুই দফা আবেদন জানিয়েছি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছেও আমরা আবেদন জানিয়েছি। গত শুক্রবারে পরিস্থিতি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে এবং বিষয়টি জনগণকে জানানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন আমি অবশ্যই, আপনি যেভাবে বললেন, ভারতবিরােধী হিসেবে আমাদের চরিত্রচিত্রণের ব্যাপারটি মেনে নিতে পারি না। প্র. আমি বলেছি, গত শুক্রবারে স্টেট ডিপার্টমেন্টের দেয়া প্রথম প্রেক্ষাপট ব্রিফিঙের কারণে সারা বিশ্বের জনগণ যুক্তরাষ্ট্রকে যে ভারতবিরােধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সে সম্পর্কে। উ. এই সঙ্কটে আমাদের সামরিক শক্তি ব্যবহারের বিরােধিতা করা হয়েছে এবং আমরা বিশ্বাস করি না যে, সামরিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া প্রয়ােজন ছিল। আমরা বিশ্বাস করি, পূর্ববঙ্গে একটি দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে যেটা শুরু হয়েছে, এখন সেটা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে সেই বিচ্ছিন্ন অংশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেবার চেষ্টায় পরিণতি পেয়েছে। কাজেই, গত শনিবারে যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছিল, আজকের বক্তব্যে প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তার কোনাে অসামঞ্জস্য নেই। আজকে যা বলা হল, তা প্রেক্ষাপটেরবিশ্লেষণমাত্র, যা শনিবারের আলােচনাকে টেনে এনেছে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিষয়টি উপস্থাপন। করলেই বােধ হয় ভাল হত। সূত্র: নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন, পারী সংস্করণ, ৬ জানুয়ারি ১৯৭১।
(খ) সেক্রেটারি অভ স্টেট উইলিয়াম পি রজার্স (William P Rogers)-এর কাছে ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাঠানাে ভারতে নিয়ােজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং (Kenneth B Keating)-এর গােপন তারবার্তার সামান্য ভিন্ন রূপ; দি নিউ ইয়র্ক টাইমস (The New York Times)-এর কাছে কলামিস্ট জ্যাক অ্যান্ডারসন (Jack Anderson)-এর দেয়া: মি. কিটিং বলেছেন যে, সকালের অয়্যারলেসে প্রাপ্ত ফাইল রিপাের্টিং ‘হােয়াইট হাউস অফিশিয়াল্স’-এ বিদ্যমান বিরােধ ও তার নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ব্যাখ্যা-সম্পর্কিত ইন্টারন্যাশনাল প্রেস সার্ভিস (ইউ.এস,আইএ.]-এর প্রতিবেদকের লেখা পড়ার ব্যাপারে তিনি বেশ আগ্রহী ছিলেন। প্রশাসনের বর্তমান অবস্থান জনগণকে অবহিত করার প্রয়ােজনীয়তা তিনি। স্বীকার করলেও এটা বলতে তিনি বাধ্য হলেন যে, এই বিবৃতির কোনাে কোনাে অংশ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর গত আট মাসের অভিজ্ঞতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষত, পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ১৫৫ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কে আই পি এস কৈফিয়ত দিয়েছে যে, এটা করা হয়েছিল ভারত সরকারের সুনির্দিষ্ট অনুরােধের প্রেক্ষিতে। তার মনে আছে এবং ২৫ মে নয়া দিল্লীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিংয়ের সাথে তার আলােচনা প্রসঙ্গে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে তিনি জানিয়েছিলেন যে, সমস্যার কোনাে ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের আগে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যক্রমের ব্যাপারে ভারতের অনীহা আছে। কারণ, এ ধরনের পদক্ষেপ ইয়াহিয়াকে তার দায় থেকে মুক্তি দেবে [জেনারেল মােহাম্মদ আগা ইয়াহিয়া খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
শরণার্থীদের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে এই বিবৃতি ৫ সেপ্টেম্বরে দেয়া ইয়াহিয়ার ঘােষণার যথার্থতা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, এই ক্ষমা তাদের জন্য যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযােগ নেই’। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদূত কিটিংয়ের কাছে এটা সাধারণ আমলাতান্ত্রিক সাবধানবাণীর চেয়ে অতিরিক্ত কিছু বলে মনে হয়েছে। এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, সেক্রেটারি (মি. রজার্স ও ড. কিসিঞ্জার – দুজনেই রাষ্ট্রদূত ঝা (লক্ষ্মী কান্ত ঝা (Lakshmi Kant Jha), যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ােজিত ভারতের রাষ্ট্রদূতাকে বলেছিলেন যে, ওয়াশিংটন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে। মি. কিটিং বলেন, সমস্যা সমাধানের উপায় আমাদের হাতে নেই, এই মর্মে বারংবার দেয়া আমাদের বিবৃতি এবং আলােচনা হলে তার ফলাফল স্বাধীনতা না হলেও স্বায়ত্ত্বশাসন হবে, আমাদের এই ধারণার ব্যাপারে তিনি অবহিত ছিলেন। কিন্তু স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে মত দিয়ে কোনাে বিবৃতি দানের কথা তিনি জানেন না বলে জানালেন। বিবৃতি অনুযায়ী, ডিপার্টমেন্ট থেকে ঝাকে ১৯ নভেম্বর এটাও জানানাে হয় যে, “পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সময়কাঠামাে প্রস্তুত করার জন্য ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পাকিস্তানের রাজধানী আলােচনায় বসতে প্রস্তুত।” রাষ্ট্রদূত কিটিং বলেন যে, এই আলােচনা প্রসঙ্গে একমাত্র যে নথিটি (২১ নভেম্বরে তার কাছে পাঠানাে ডিপার্টমেন্টের একটি বার্তা) তাঁর কাছে আছে, সেখানে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনাে কিছুর উল্লেখ নেই।
ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপক প্রচেষ্টা, দিল্লী ও ইসলামাবাদ থেকে পাওয়া রিপাের্ট এবং ওয়াশিংটনের সাথে তার নিজস্ব আলােচনার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রদূত কিটিং বলেন, এই বক্তব্যটি তার। বােধগম্য হয়নি যে, “সমাসন্ন সামরিক অভিযান সম্পর্কে ওয়াশিংটনকে সামান্যতম ধারণাও দেয়া হয়নি।” উদাহরণের জন্য ১২ নভেম্বর প্রকাশিত ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ইন্টেলিজেন্স বুলেটিন নাম্বার ২১৯-৭১ দ্রষ্টব্য, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুদ্ধ অত্যাসন্ন। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে মুজিবুরের সাথে তাঁর অ্যাটর্নির মাধ্যমে যােগাযােগ করার লক্ষ্যে অনুমতি দিয়েছে বলে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, সেটা অতিকথন বলে মনে হয়। কারণ ইসলামাবাদ ১১৭৬০ (পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানাে বার্তা) অনুযায়ী, ২৯ নভেম্বর ইয়াহিয়া রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড [জোসেফ ফারল্যান্ড (Joseph Farland), পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত)-কে ফারল্যান্ড-ব্রোহীর সম্ভাব্য আলােচনা ছাড়া আর কোনাে বিষয়েই কথা বলেননি, যে আলােচনায় বিচারের সর্বশেষ অবস্থা ও ধরন সম্পর্কে ব্রোহীর কাছ থেকে ফারল্যান্ড একটা সামগ্রিক ধারণা পেতে পারেন। মি, কিটিং বলেন যে, ব্রোহীর মাধ্যমে মুজিবুরের সাথে যােগাযােগ করার জন্য ইয়াহিয়ার কোনাে অনুমােদন সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। (মি. ব্রোহী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন আন্দোলনের নেতা এবং পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানে কারারুদ্ধ ও বিচারাধীন শেখ মুজিবের ডিফেন্স অ্যাটর্নি। যা হােক, অত্যন্ত অসন্তোষের সাথে যে কথাটা আমরা সকলেই জানি, তা হল, ২ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে বলেন যে, ব্রোহী তার সাথে দেখা করতে অনিচ্ছুক। পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে।
বলে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, সেটা সত্য গােপন করে। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের মতাে যথেষ্ট জনবল জাতিসংঘের কখনাে ছিল না বা তারা সেটা করতেও চায়নি। এটা সব সময়ই পাকিস্তান সরকারের হাতে ছিল। মি. কিটিং বলেন যে, তাঁর মন্তব্য এই দুঃখজনক ঘটনাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য অতি গােপনীয় নয়, এটা জেনেই তিনি তার ভাষ্য জানিয়েছেন। তিনি যা কিছু জানেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিশ্বাস করেন না যে, বিবৃতিতে প্রদত্ত এসব বক্তব্য আমাদের অবস্থান সুসংহত করেছে অথবা, আরাে গুরুত্বপূর্ণ, আমেরিকার বিশ্বাসযােগ্যতা সমৃদ্ধ করেছে।
কিটিং সূত্র: নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন, পারী সংস্করণ, ৬ জানুয়ারি ১৯৭২
সময় ও স্থান ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল ১১:০০, সিচুয়েশন রুম, হােয়াইট হাউস
সার-সংক্ষেপ
পশ্চিম অংশে বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপরে প্রাপ্ত পরস্পরবিরােধী রিপাের্ট পর্যালােচনা করা হয় । সিআইএ ভারতের দখলকৃত পূর্ব পাকিস্তানি এলাকা মানচিত্রে দেখাতে সম্মত হয়। প্রেসিডেন্ট ৯৯ মিলিয়ন ডলারের সাথে সংশ্লিষ্ট আর কোনাে অপ্রত্যাহারযোেগ্য ঋণপত্র (letter of credit) ইস্যু এবং ৭২ মিলিয়ন ডলারের পিএল ৪৮০ (PL 480) ঋণ কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের উদ্দেশ্যে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য আজ বিকেলে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাথে আনুষঙ্গিক আলােচনার পরিকল্পনা করা হয়। কিসিঞ্জার ১৯৫৯-এর মার্চে পাকিস্তানের সাথে সম্পাদিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির গােপন/বিশেষ ব্যাখ্যা চান। কিসিঞ্জার: প্রতি আধা ঘণ্টায় একবার করে প্রেসিডেন্টের অসন্তোষের মুখােমুখি আমি হচ্ছি যে, ভারতের সাথে আমরা যথেষ্ট কঠোর হচ্ছি না। আবার তিনি আমাকে ডেকেছেন। কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারছি না যে, তার ইচ্ছাই আমরা পালন করছি। তিনি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করতে চান। অথচ তার ধারণা, আমরা করছি ঠিক তার উল্টোটা। হেমূস: পশ্চিম অংশের সংশ্লিষ্ট রিপাের্টগুলাে দুই পক্ষেই পরস্পরবিরােধী । অমৃতসর, পাঠানকোট ও শ্রীনগর এয়ারপাের্ট আক্রমণের ক্ষেত্রেই শুধু রিপাের্টগুলাের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানিরা বলছে, সারা সীমান্ত জুড়ে ভারতীয়রা আক্রমণ করছে, অথচ ভারতীয় অফিশিয়ালরা এটা অস্বীকার করছেন। পূর্ব অংশে সংঘর্ষ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। এবং পাকিস্তানিরা দাবি করছে যে, বর্তমানে সেখানে মাত্র সাত জায়গায় লড়াই চলছে। কিসিঞ্জার: ভারতীয়রা কি পাকিস্তানি ভূখণ্ড দখল করে নিচ্ছে? হেমস: হ্যা, ছােট ছােট এলাকা তাে অবশ্যই। সিসকো; ভারত কোন এলাকাগুলাে দখল করেছে, সেটা যদি মানচিত্রে চিহ্নিত করে দেখাতে পারতেন, তাহলে বােধ হয় ভাল হত। পশ্চিমে কি মনে হয় পুরােদমে লড়াই চলছে? মুরার বর্তমান পরিস্থিতি বেশ বিভ্রান্তিকর। কারণ, পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের এমন তিনটি এয়ারফিল্ড আক্রমণ করেছে, যেগুলােতে স্বল্প সংখ্যক ভারতীয় বিমান থাকে। হেমস: আজ ১:৩০ মিনিটে মিসেস গান্ধী তার বক্তৃতায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। মুরার: পাকিস্তানের আক্রমণের ব্যাপারটি বিশ্বাসযােগ্য নয়। এটা হয়েছে শেষ বিকেলের দিকে যার কোনাে মানে হয় না। এ সম্পর্কে আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট তথ্য নেই ।
কিসিঞ্জার; এমন হতে পারে যে, ভারতীয়রা প্রথমে আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানিরা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে যতটা সম্ভব জবাব দিয়েছে। মুরার; এমন অবশ্য ঘটতেই পারে। কিসিঞ্জার: প্রেসিডেন্ট চান না, ৯৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ কার্যক্রমের আওতায় আর কোনাে অপ্রত্যাহারযােগ্য ঋণপত্র খােলা হােক । ৭২ মিলিয়ন ডলারের পিএল ৪৮০ ঋণ কার্যক্রমও তিনি স্থগিত রাখতে চান। উইলিয়ামস: এটা করলেই চতুর্দিকে এ নিয়ে কথা উঠবে। প্রেসিডেন্ট কি এদিকটা ভেবে দেখেছেন? কিসিঞ্জার: এটা তার নির্দেশ। তার পরেও এ বিষয়ে আমি কথা বলে দেখব । প্রশ্ন করলে আমরা বলতে পারি যে, আমরা আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম পর্যালােচনা করে দেখছি এবং উপমহাদেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নতুন অর্থসাহায্য বরাদ্দ স্থগিত কক্স হয়েছে। এর পরের বিষয়টি হল জাতিসংঘ। আরউইন: পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে সেক্রেটারি আজ ডেকে পাঠাচ্ছেন। জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট করার জন্য বিষয়টি তিনি জাতিসংঘে উত্থাপন করতে চান। কিসিঞ্জার: প্রেসিডেন্ট এটার পক্ষে। তিনি চান, যত দ্রুত সম্ভব নতুন এই বিশাল কাজের কিছু নিশ্চয়তা পাওয়া যাক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ যদি কোনাে কার্যকর ভূমিকা না। রাখতে পারে, তাহলে বলতেই হবে যে, এর কার্যকারিতা ফুরিয়ে গেছে এবং মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে জাতিসংঘের দেয়া নিশ্চয়তা অর্থহীন হয়ে গেছে। সিসকো: রাষ্ট্রদূতের সাথে আজ বিকেলের আলােচনাশেষে আপনার জন্য আমাদের একটি সুপারিশ থাকবে।
রাষ্ট্রদূত যাতে দেশে তার করার মতাে পর্যাপ্ত সময় পান, সেটা মাথায় রেখেই আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বানের পরিকল্পনা করতে পারি। কিসিঞ্জার; আমাদেরকে অ্যাকশন নিতে হবে। যত দোষ, প্রেসিডেন্ট আমাকে দিচ্ছেন, অথচ আপনারা দিব্যি আছেন। সিসকো: সেটাই দস্তুর ! কিসিঞ্জার: বুশের জন্য তৈরি আগের খসড়াটিও নিরপেক্ষ । সিসকো: আমি আবার বলছি, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের পর সেক্রেটারি আপনাকে।
রিপােট করবেন। আমরা বুশের বক্তৃতার খসড়া আপডেট করব। কিসিঞ্জার; আমরা বলতে পারি যে, আমরা রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের মূল কাজ হবে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা । সিসকো: কোসিগিন বা মিসেস গান্ধী – কারাে তরফ থেকেই আমরা কোনাে সাড়া পাইনি। উইলিয়াস; আমাদের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ কি পাকিস্তানের জন্যও প্রযােজ্য হবে? কিসিঞ্জার: প্রেসিডেন্টের সাথে আমার আলােচনা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল। এ বিষয়ে। পাকিস্তান সম্পর্কে এখনাে তিনি কিছু বলেননি। সিসকো: আমরা ভারতের সাথে কাজ করলে বলতে পারি যে, পাকিস্তান পরিস্থিতি আমরা ‘পর্যবেক্ষণ করছি। কিসিঞ্জার: ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের পদক্ষেপের সাথে মেলাতে গেলে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হবে। আগামী সােমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলে আমি প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত পেতে পারি ।
প্যাকার্ড: সামনে সাপ্তাহিক ছুটি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলােকে আমাদের এখনই প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা দিয়ে রাখা উচিত। | কিসিঞ্জার: সকালে আমাদের একটি ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ প্রয়ােজন হবে। চুক্তিতে আমাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হবে। একটি চিঠি অথবা স্মারকলিপির কথা। আমার মনে পড়ছে, যেখানে বিদ্যমান একটি চুক্তির এরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, ভারতের দিকে আমাদের একটু বিশেষ পক্ষপাত আছে। জানুয়ারি ১৯৬২-তে আমি যখন পাকিস্তান ভ্রমণ করি, তখন একটি গােপন দলিল অথবা মৌখিক বােঝাপড়ার কথা আমাকে ব্রিফ করা হয়, যেটা সিয়াটো (SEATO)-র প্রেক্ষাপটের অতিরিক্ত একটি অনুষঙ্গ । সম্ভবত সেটা ছিল প্রেসিডেন্টের একটি চিঠি। মার্চ ১৯৫৯-র দ্বিপাক্ষিক চুক্তির একটি বিশেষ অনুবাদ।
প্রস্তুতকারী: /-অনুস্বাক্ষর জেম্স এম নয়েস (James M Noyes) ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর নিয়ার ইস্টার্ন আফ্রিকান অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স অনুমােদিত | (স্বাক্ষর অস্পষ্ট)। জি ওয়ারেন নাটার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অত্ ডিফেন্স ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স-এর পক্ষে tot: Secdef, Depsecdef, CICS, ASD (ISA), PDSAD (ISA), DASD: NEASA & PPNSCA, Dep Dir: VSCC & PPNSCA, CSD files, R&C files, NESA. সূত্র: নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন, পারী সংস্করণ, ৬ জানুয়ারি ১৯৭২
(খ) ৪ ডিসেম্বরের সভার কার্যবিবরণী
বর্ণনাসম্বলিত স্মারক দ্য জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ ওয়াশিংটন, ডি সি ২০৩০১
গােপন ও স্পর্শকাতর স্মারক:
চিফ অফ স্টাফ, ইউ,এস, আর্মি
চিফ অফ স্টাফ, ইউ.এস, এয়ার ফোর্স
চিফ অফ নেভাল অপারেশন্স
কম্যান্ডান্ট অভ দ্য মেরিন কোর
বিষয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ওপরে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা; ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ১. আপনার অবগতির জন্য উল্লিখিত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি স্মারক সংযােজিত হল। ২. এন.এস.সি, সিস্টেমের তথ্যাদির স্পর্শকাতরতা ও স্মারকের বিস্তারিত ধরনের কারণে এটা সম্পর্কে জানার অধিকার সীমিত রাখার জন্য অনুরােধ করা যাচ্ছে।
চেয়ারম্যান, জে সি এস-এর পক্ষে: এ কে ননাইজেন (A K Knoizen) ক্যাপ্টেন, ইউএস নেভী। এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারম্যান, জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ সভার প্রতিবেদন গােপন ও স্পর্শকাতর দ্য জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ ওয়াশিংটন, ডিসি ২০৩০১
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
নথির জন্য স্মারক
বিষয়
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ওপরে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা; ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ১. এনএসসি ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ শনিবার ১১০০টায়
হােয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি পর্যালােচনার জন্য সভায়
মিলিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. কিসিঞ্জার । ২. উপস্থিত সদস্যবৃন্দ ক, প্রধান:
ড. হেনরি কিসিঞ্জার ড. জন হান্না (John Hannah), এআইডি। মি, রিচার্ড হেমস, সিআইএ ড. জি ওয়ারেন নাটার, ডিফেন্স অ্যাডমিরাল এলমাে জুমওয়াল্ট (EImo Zumwalt), জেসিএস মি. ক্রিস্টোফার ফন হােলেন (Christopher Van Hollen), স্টেট
খ, অন্যান্য:
মি. জেমস নয়েস, ডিফেন্স মি. আরমিস্টেড সেলডেন, ডিফেন্স রিয়ার অ্যাডমিরাল রবার্ট ওয়েল্যান্ডার (Robert Welander), ওজেসিএস ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড কে (Howard Kay), ওজেসিএস মি. হ্যারল্ড সভার্স (Harold Saunders), এনএসসি। কর্নেল রিচার্ড কেনেডি (Richard Kennedy), এনএসসি মি, স্যামুয়েল হােসকানসন (Samuel Hoskanson), এনএসসি মি, ডােনাল্ড ম্যাকডােনাল্ড, এআইডি মি. মরিস উইলিয়ামস, এআইডি মি. জন ওয়ালার (John Waller), সিআইএ মি, ক্রস ল্যানিজেন (Bruce Lanigen), স্টেট
মি. ডেভিড শেলডার (David Schnelder), স্টেট ৩. সারসংক্ষেপ: অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
অনুরােধ জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হবে। মার্কিন সরকার-জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডের পক্ষপাতিত্ব থাকবে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানের প্রতি বর্তমানে বহাল অর্থনৈতিক সাহায্য বাতিল করা হবে না। জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের ওপরে বাড়তি
কোনাে চাহিদা আরােপ করা হয়নি। | ৪. মি. হেস এই বলে সভা আরম্ভ করেন যে, ভারতীয়রা এখন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক
আক্রমণ চালাচ্ছে এবং আজ সকালে তারা সবদিক দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ভারতীয়রা পাকিস্তানের আটটি এয়ারফিল্ড আক্রমণ করলেও পশ্চিমে এখন পর্যন্ত কোনাে স্থল-আক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘােষণা না করলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, “ভারতের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ আমাদের সামনে।” মিসেস গান্ধী এই বলে এর জবাব দিয়েছেন যে, পাকিস্তানের এই যুদ্ধ ঘােষণা চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। ভারত অবশ্য যুদ্ধ ঘােষণা করবে না বলে ঠিক করেছে । ভারতীয়রা করাচীর একটি প্রধান তেল-ডিপােতে আক্রমণ চালিয়েছে এবং এর ফলে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড তৈরি হয়েছে। এটা বেশ কিছুদিন ধরে জ্বলবে এবং ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য একটি সহজ টার্গেট হয়ে রইবে । মি. হেমস বলেন যে, সােভিয়েতদের ধারণা, বর্তমান সমস্যার প্রেক্ষাপটে বৃহৎ শক্তিবর্গের মুখােমুখি হবার
আশঙ্কা নেই। ৫. ড, কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, ভারত সর্বাত্মক আক্রমণ ঘােষণা করলে আমাদের জাতিসংঘ
প্রতিবেদনে অবশ্যই তার প্রতিফলন ঘটা উচিত । ৬, মি, হেমস বলেন, আমরা জানি না কোন পক্ষ এই অ্যাকশন শুরু করেছে। গতকাল
পাকিস্তান কেন ছােট ছােট চারটি এয়ারফিল্ড আক্রমণ করল, সেটাও আমরা জানি না।
৭. ড. কিসিঞ্জার অনুরােধ করেন যাতে সােমবারের মধ্যে সিআইএ একটি প্রতিবেদন তৈরি
করে, যাতে থাকবে, কে কার উদ্দেশ্যে কী করেছে এবং কখন? ৮, মি. ডি পালমা পরামর্শ দেন যে, আমরা যদি জাতিসংঘে আমাদের আলােচনায় ভারতের
ঘােষণার প্রসঙ্গ টানি, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই ইয়াহিয়ার মন্তব্যের কথাও উল্লেখ
করতে হবে। ৯. ড. কিসিঞ্জার উত্তর দেন যে, তাকে প্রেসিডেন্ট বিশেষ নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তাঁর
নির্দেশিত পংক্তিসহ বিবৃতিটি হয় আমলাদের কেউ তৈরি করবেন, না হয় সেটা হােয়াইট
হাউসে তৈরি করা হবে। ১০. মি. হেমস ভারতের সরকারি ভাষ্যে উল্লেখকৃত ‘সামগ্রিক (no holds barred)’ শব্দটির
উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, পাকিস্তানি পক্ষ থেকেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। ১১. ভারতীয়রা যে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে আছে, সেটা তাদের কোনাে কার্যকলাপ থেকে বােঝা
যাচ্ছে কি না, সেটা ড. কিসিঞ্জার জানতে চান। ১২. মি. হেমস বলেন যে, শব্দটি ছিল ‘সামগ্রিক’। ১৩, পাকিস্তানিরা কী বলেছে, ড, কিসিঞ্জার তা জানতে চান। মি, হেস জানান যে, তাদের
ব্যবহৃত পরিভাষা ছিল ভারতের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ’। ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, এর মধ্যে আপত্তিকর কিছু নেই। তারা (পাকিস্তানিরা) নিজেদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, বরং
এটা বললে তেমন অসংযত বা আক্রমণাত্মক শােনা যায় না। ১৪. এরপরে ড, কিসিঞ্জার জানতে চান জাতিসংঘে কী হচ্ছে। এর উত্তরে মি. ডি পালমা
জানান যে, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জাপান ও সম্ভবত ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহ্বান করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সভা আহ্বানের জন্য আমাদের অনুরােধসম্বলিত চিঠিতে জাপান কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব খুঁজে পেয়েছে। জাপানিরা শান্তিপূর্ণ আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে। আমরা অবশ্য জাপানিদের কাছে আমাদের প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করিনি। ১৫. ড. কিসিঞ্জার চিঠিটি দেখতে চান এবং অনুরােধ করেন, জাতিসংঘে আমাদের প্রস্তাবনা
যাতে এই চিঠির মাধ্যমে ঘােষণা করা হয় । মি. ডি পালমা এতে সম্মতিসূচক সাড়া দেন। ১৬. ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, এই চিঠিতে কোনাে জোরালাে বক্তব্য নেই বলে জাতিসংঘে
আমাদের অবস্থান অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে । ১৭. রাষ্ট্রদূত বুশ যদি বুঝতে পারেন কী তার বলা উচিত, তাহলে অন্য কে কী মনে করল,
সেটার পরােয়া তিনি করেন না। ১৮, ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি যারা দূরে রাখছেন,
তারা প্রেসিডেন্টের ক্রোধ উৎপাদন করছেন। প্রেসিডেন্ট এক প্রহেলিকা’র মধ্যে আছেন যে, তাঁর নির্দেশে সবকিছু হচ্ছে; এই নয় যে, যা কিছু ঘটছে, সেটা শুধু তাঁকে জানানাে হচ্ছে ।
১৯. মি. ডি পালমা জানান যে, নিরাপত্তা পরিষদের সভা (সেদিন) বিকেলে না সন্ধ্যায় আহ্বান
করা হবে, সেটা তিনি জানেন না। সভার প্রাথমিক বিবৃতিগুলাে অবশ্য ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাই দেবে। তিনি পরামর্শ দেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটোর বিবৃতি দেয়া হয়ে যাবার পর প্রথমদিকেই রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্য দেয়া উচিত। শুরুর দিকে আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিলে সেটার প্রভাব বেশি হবে বলে তিনি মনে করেন। ড. কিসিঞ্জার
এতে কোনাে আপত্তি করেননি। ২০. মি. ডি পালমা জানতে চান, আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করার আগেই অন্যদেরকে আমরা
আমাদের পক্ষে আনতে চাই কি না। এতে অবশ্য সময় লাগবে । ড. কিসিঞ্জার পরামর্শ। দেন যে, এভাবে এগুনাের চেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্রয়ােজনে এককভাবে, আমাদের বিবৃতি দিয়ে ফেলা উচিত। ড, কিসিঞ্জারের মত অনুসারে, একমাত্র যে পথটি বর্তমানে আমাদের সামনে খােলা আছে তা হল, আমাদের বৃহত্তর স্ট্র্যাটেজির প্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা। সকলেই জানেন, কীভাবে এটা ঘটবে এবং সকলেই এটাও জানেন যে, ভারত শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। কাজেই, আমাদের অবস্থান ব্যক্ত করে আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত আলােচনার জন্য উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের প্রয়ােজন একটি সিদ্ধান্ত, যা রাষ্ট্রদূত বুশ তার বক্তৃতার মাধ্যমে ঘােষণা করবেন। অন্যেরা যদি আমাদের সাথে আসতে চায়, চমৎকার। কিন্তু যে কোনাে অবস্থায়
রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে হবে। ২১. ড, কিসিঞ্জার বলেন, আমাদের অবস্থান ব্যক্ত করাটা জরুরি। জাতিসংঘে আমাদের এই
প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রবল, কারণ সােভিয়েতরা ভেটো প্রয়ােগ করতে পারে । এই যুদ্ধ বন্ধ করতে জাতিসংঘেরও খুব সামান্যই করণীয় আছে। তিনি যা বলেন, তার সারসংক্ষেপ হল এই যে, তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রদূত বুশের বক্তৃতার মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘে প্রকাশ করা হবে এবং সেটা অবিলম্বে । পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সাধারণ আলােচনায় আমরা অবশ্যই অংশ নেব,
কিন্তু কোনাে নির্দিষ্ট পরামর্শ, যেমন: মুজিবের মুক্তি, আমরা দেব না। ২২. ড. কিসিঞ্জার জানতে চান, পরিষদে ভারতীয়রা কাজ শুরু করতে কতটা দেরি করতে
পারে । মি. ডি পালমা বলেন, তারা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারে অথবা আমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে । মি, ফন হােলেন বলেন যে, তারা যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করবে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে তারা মনােসংযােগ করতে সমর্থ হবে। মি. ডি পালমা বলেন, তারা বড়জোর তিন-চারদিন দ্বিধাগ্রস্ত থাকবে যা, মি, হেমসের মতে, তাদের পূর্ব পাকিস্তান দখল করার পক্ষে যথেষ্ট সময়। মি. ডি পালমা বলেন, আমরা সব সময়ই ভােটের জন্য চাপ প্রয়ােগ করতে পারি । ড. কিসিঞ্জার পুনরাবৃত্তি করেন যে,
জাতিসংঘ থেকে লাভজনক কিছু পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। ২৩. মি. ডি পালমা মত প্রকাশ করেন যে, কোনাে না কোনাে পক্ষের ভেটো দেবার আশঙ্কা।
খুবই প্রবল।
২৪. অর্থনৈতিক সাহায্য প্রসঙ্গে ড. কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন যে, শুধু ভারতকে অর্থ সাহায্য
দেয়া বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অবশ্য বলেন যে, ঘােষণাটি তিনি প্রেসিডেন্টের সামনে পাঠ করতে চান, যাতে প্রেসিডেন্ট অনুধাবন করতে পারেন তিনি কীসের মধ্যে জড়াচ্ছেন। এই মি. উইলিয়ামস জানতে চান, পাকিস্তানকে কেন অর্থ। সাহায্য দেয়া বন্ধ হবে না, বিবৃতিতে সেটা ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজন আছে কি না। ড.
কিসিঞ্জার বলেন যে, শুধু প্রেক্ষাপটের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। ২৫. কৃষি বিভাগের বরাত দিয়ে মি, উইলিয়ামস বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভােজ্য তেলের
দাম কমছে। কাজেই ভারতের সাথে পি এল ৪৮০ বাতিল করলে স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়তে পারে। এরপরে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে, গমের পরিবর্তে তেল পাঠানাে যায় কি না। ড. কিসিঞ্জার বলেন, সােমবারে বাজারের লেনদেনের প্রেক্ষাপটে এর জবাব
দিতে হবে। ২৬. এর পরে ড. কিসিঞ্জার সামরিক পরিস্থিতির ওপরে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী চান।
অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট বলেন, তাঁর ধারণা ছিল যে, রসদ ও সরবরাহ-সঙ্কট প্রবল হওয়ার আগে পর্যন্ত পাকিস্তানিরা এক অথবা দুই সপ্তাহ নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হবে। তিনি আশা করেছিলেন, সােভিয়েতরা ভারতে তাদের অবস্থান পাকা করবে এবং বিসাগ (Visag)-এ অবস্থিত নৌঘাটি স্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য চাপ প্রয়ােগ করবে। তার ধারণা ছিল যে, সােভিয়েতরা ভারতের সাথে তাদের বর্তমান সম্পর্কের ভিত্তিতে সামরিক সুবিধা অর্জনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য হাসিল করতে
চাইবে। ২৭. ড. কিসিঞ্জার ঘােষণা করেন যে, পরবর্তী সভা সােমবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে আহ্বান
করা হবে।
স্বাক্ষর/ এইচ এন কে এইচ এন কে (H N Kay) ক্যাপ্টেন, ইউএসএন সাউথ এশিয়া/এমএপি ব্রাঞ্চ, জে৫ এক্সটেনশন ৭২৪০০
সূত্র: প্রাগুক্ত
(গ) ৬ ডিসেম্বরের সভার ওপরে স্মারক
দ্য জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ ওয়াশিংটন, ডি সি ২০৩০১
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
নথিভুক্তির জন্য স্মারক
বিষয়
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ওপরে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা; ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
এনএসসি ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা ৬ ডিসেম্বর সােমবার সকাল ১১:০০টায় হােয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ড.
কিসিঞ্জার। ২. উপস্থিত সদস্যবৃন্দ ক. প্রধান:
ড. হেনরি কিসিঞ্জার মি. ডেভিড প্যাকার্ড, ডিফেন্স রাষ্ট্রদূত ইউ আলেক্সিস জনসন (U Alexis Johnson), স্টেট জেনারেল উইলিয়াম ওয়েস্টারমিেরল্যান্ড (William Westermoreland), জেসিএস মি. রিচার্ড হেমস, সিআইএ।
মি, ডােনাল্ড ম্যাকডােনাল্ড, এআইডি খ, অন্যান্য
মি. ক্রিস্টোফার ফন হােলেন, স্টেট মি. স্যামুয়েল ডি পালমা, স্টেট মি, ব্রুস ল্যানিজেন, স্টেট মি. জোসেফ সিসকো, স্টেট মি. আরমিস্টেড সেলডেন, ডিফেন্স মি. জেমস নয়েস, ডিফেন্স । মি. জন ওয়ালার, সিআইএ মি. স্যামুয়েল হােসকানসন, এনএসসি কর্নেল রবার্ট কেনেডি (Robert Kennedy), এনএসসি। মি. হ্যারল্ড সভার্স, এনএসসি রিয়ার অ্যাডমিরাল রবার্ট ওয়েল্যানডার, ওজেসিএস
ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড কে, ওজেসিএস
মি. মরিস উইলয়ামস, এআইডি ৩. সারসংক্ষেপ; একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশ যে প্রবল সমস্যার মুখােমুখি, আলােচনার
একমাত্র বিষয় ছিল সেটাই । ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, সমস্যাটি এখন নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়ােজন। পাকিস্তানকে সম্ভাব্য সামরিক সাহায্য দানের বিষয়টিও যাচাই করে দেখা দরকার। কিন্তু সেটা হবে ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। পূর্ব অঞ্চল থেকে পশ্চিমে ভারতীয় সৈন্য পুনর্বহালের ব্যাপারটি এবং ভারতের সাম্প্রতিক সমুদ্র অবরােধের আইনগত দিকটিও খতিয়ে দেখা হয়। বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনার মাধ্যমে মি. হেমস সভার কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পূর্ব অঞ্চলে প্রবল লড়াই চলছে, যদিও পশ্চিম অঞ্চলে ভারত মূলত রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করছে। মি. হেমসের ধারণা, আগামী দশ দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের জন্য ভারত চাপ সৃষ্টি করবে। পূর্ব অঞ্চলের আকাশে বর্তমানে ভারতের আধিপত্য সুস্পষ্ট। পাকিস্তানি স্থলবাহিনী ও রসদঘাটির ওপরে তারা আনুমানিক এক শত বিমান দিয়ে আক্রমণ চালাতে পারে। ভারতীয় স্থলবাহিনী অবশ্য এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আক্রমণের মূলধারা প্রধানত এই প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। ঢাকার এয়ারফিল্ড ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। যশাের এলাকায়। ভারতীরা সামান্যই সফলতা পেলেও জামালপুর দখল করেছে বলে তারা দাবি করছে । পশ্চিমে ভারতীয় আক্রমণ অবশ্যই শুধু বিমান আক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। স্থলে পাকিস্তানিরা আক্রমণাত্মক ভূমিকাই পালন করছে এবং পাঞ্জাবে তারা বিমান আক্রমণ চালিয়েছে। সামগ্রিক চিত্র হল এই যে, পাকিস্তানিরা ৬২টা ভারতীয় বিমান আর ভারতীয়রা ৪৭টা পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস করেছে বলে দাবি করছে। নৌযুদ্ধে ভারতীয়রা একটি পাকিস্তানি ডেস্ট্রয়ার ডুবিয়ে দিয়েছে এবং আরেকটি ডুবিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করছে। ভারতীয়রা পূর্ব-সমুদ্রে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিনও ডুবিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করছে । ভারতের প্রতি মস্কোর সমর্থন উত্তরােত্তর জোরালাে ও সােচ্চার হচ্ছে এবং লড়াই বন্ধ করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের কোনাে উদ্যোগকে সমর্থন দেয় নি। ড. কিসিঞ্জার এরপরে সামরিক প্রসঙ্গে জানতে চান, পাকিস্তানিরা কতদিন পূর্ব অঞ্চলের দখল বজায় রাখতে সমর্থ হবে। জেনারেল ওয়েস্টারমােরল্যান্ড জানান যে, বড়জোর তিন
সপ্তাহ। ৬. ড. কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে। মি. হেমস।
বলেন যে, বাস্তব সত্য এটাই যে, বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি স্বাধীন।
রাষ্ট্র।
রাষ্ট্রদূত জনসন পরামর্শ দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীকে জামিন হিসেবে রাখা হতে পারে। জেনারেল ওয়েস্টারমিেরল্যান্ড এতে গুরুত্ব আরােপ
করে বলেন যে, ভারতীয় নৌবাহিনীর তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেয়ার কোনাে উপায় নেই । ৮ ড, কিসিঞ্জার বলেন যে, নাটকে এর পরের অঙ্কে থাকবে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের
দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করার ব্যাপার। ৯. পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত পনেরাে লক্ষ উর্দু ভাষাভাষী (বিহারী) প্রসঙ্গে মি. উইলিয়ামস
বলেন যে, তাদেরকেও জামিন হিসেবে রাখা হতে পারে। ১০, ড. কিসিঞ্জার জানতে চান যে, এদের ওপরে ইতােমধ্যেই কোনাে ধ্বংসযজ্ঞ চালানাে
হয়েছে কি না। মি. উইলিয়ামস বলেন যে, তিনি নিশ্চিত যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। ড. কিসিঞ্জার জানতে চান যে, এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কিছু আছে কি না। জবাবে মি, উইলিয়ামস বলেন যে, মানবতা সংরক্ষণকারী আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড সম্ভবত তাদের পক্ষে দাঁড়াবে। ড. কিসিঞ্জার জানতে চান যে, এদের দুর্দশার দিকে এখনই আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ট আমাদের করা উচিত কি না। মি. উইলিয়ামস বলেন যে, এদের অধিকাংশই বসবাস করে রেলওয়ে জংশনগুলাের আশেপাশে এবং শহর এলাকায়। ফলে জাতিসংঘের মাধ্যমে তাদের পক্ষে কিছু ত্রাণ কার্যক্রম ভালভাবেই শুরু করা যেতে পারে। ব্যাপক রক্তপাত ঠেকাতে হলে খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে বলে ড. কিসিঞ্জার পরামর্শ দেন। মি, সিসকো বলেন, যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে এখনই কিছু করতে পারবে না, সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি এদিকে
ফেরানাের চেষ্টা করা যেতে পারে। ১১. পাকিস্তানে আটকে পড়া ৩০০,০০০ বাঙালি প্রসঙ্গে মি. উইলিয়ামস বলেন যে, তারা খুব
বিপন্ন অবস্থার মধ্যে আছে। মি, সিসকো এই প্রেক্ষাপটে বলেন যে, সাধারণ পরিষদে এটা খুব আকর্ষণীয় একটি মানবিক ইস্যু হতে পারে এবং আমরা পরিষদের কর্মতৎপরতার ওপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি। মি. ম্যাকডােনাল্ড ১৯৫৪ সালে উত্তর
ভিয়েতনাম থেকে জনসাধারণের ব্যাপক স্থানান্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। | ১২. সামরিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মি. উইলিয়ামস বলেন, তাঁর ধারণা, ভারতীয় আক্রমণের
প্রাথমিক লক্ষ্য হবে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব অঞ্চলের পাকিস্তানিদের রসদ ও সরবরাহের বাকি অংশটুকুও নষ্ট করে ফেলা। তিনি বলেন যে, ভারতীয়রা পাকিস্তানিদের নিয়মিত বাহিনী ধ্বংস করার লক্ষ্যে মূল আক্রমণ রচনা করবে বলে তিনি মনে করেন। তার বিশ্বাস, পূর্ব অঞ্চলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটাই বর্তমান পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব, যেহেতু এটা বিংশ শতাব্দীর এক ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। | ১৩. জেনারেল ওয়েস্টারমােরল্যান্ড বলেন, মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করার জন্য ভারতীয়দের
সম্ভবত তিন অথবা চার ডিভিশন সৈন্য প্রয়ােজন। বাকি অংশ পশ্চিমে অবস্থিত
সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার কাজে লাগানাে হতে পারে। | ১৪. মি, সিসকো মত প্রকাশ করেন যে, ভারতীয়রা যেহেতু বন্ধুভাবাপন্ন জনসাধারণের সাথে
কাজ করবে, পাকিস্তানিদের নিরস্ত্রীকরণের অব্যবহিত পরেই তারা তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করবে। কাজেই, তারা যত দ্রুত সম্ভব, মুক্তিবাহিনীর হাতে সামরিক দায়িত্ব।
অর্পণ করবে। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ধরন ও সময় পশ্চিমের পরিস্থিতির ওপরে
ব্যাপকভাবে নির্ভর করবে বলে তিনি মনে করেন । ১৫. এক প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল ওয়েস্টারমিেরল্যান্ড জানান, পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে
সৈন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সীমাবদ্ধতা আছে এবং এর ফলে একটি ইনফ্যান্ট্রি
ডিভিশন স্থানান্তর করতে তাদের কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় প্রয়ােজন। ১৬. মি. সিসকো বলেন, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যরা দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান গ্রহণ করলে
সেক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়ােজন। মি. ফন হােলেন মন্তব্য করেন যে, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার দুই অথবা তিন সপ্তাহের মধ্যেও ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার শুরু না হলে বাঙালিরা তাদেরকে দখলদার হিন্দু বাহিনী হিসেবে দেখতে শুরু
করবে। ১৭. মি, ফন হােলেন ভারত থেকে শরণার্থী প্রত্যাবাসন সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশ যেহেতু মূলত মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চল, ভারত থেকে এক কোটি শরণার্থী,
যাদের অধিকাংশই হিন্দু, ফিরে এলে নতুন এক জটিল সমস্যার জন্ম হবে। ১৮. জেনারেল ওয়েস্টারমারল্যান্ড জানান যে, পশ্চিমে ভারতীয়দের অবস্থা বেশ সুবিধাজনক।
পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বিন্যাস প্রসঙ্গে তিনি সংক্ষিপ্ত আলােচনা করেন এবং বলেন যে, ভারতীয়রা তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থায় আছে। তিনি বলেন যে, তার ধারণা ছিল, পাকিস্তানিরা কাশির ও পাঞ্জাবের দিকে তাদের মূল আক্রমণ পরিচালনা করবে। অন্যদিকে ভারতীয়দের লক্ষ্য হবে হায়দারাবাদ, যাতে করাচী পর্যন্ত পাকিস্তানিদের যােগাযােগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি চিন্তাও করেননি যে, ভারতীয়রা একেবারে করাচী পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা নিয়েছে। তিনি আরাে ইঙ্গিত দেন যে, ভারতীয়দের বর্তমান গতিবিধির উদ্দেশ্য পাকিস্তানিদেরকে কাশির এলাকা থেকে তাদের রিজার্ভ
সরিয়ে আনতে বাধ্য করা। ১৯. মি. প্যাকার্ড পাকিস্তানিদের জ্বালানি তেল ও লুব্রিক্যান্ট সরবরাহের পরিস্থিতি সম্পর্কে।
জানতে চান। মি. হেমস জানান যে, বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ। স্থলপথে, যেমন
ইরান থেকে, পরিবহনের জন্য যােগাযােগব্যবস্থাও অত্যন্ত দুর্বল। ২০. মি. উইলিয়ামস বলেন যে, দক্ষিণদিকে ভারতের আক্রমণের কারণ নিঃসন্দেহে
রাজনৈতিক। সীমান্তে ভারতীয়রা যেহেতু লড়াই করতে চায় না, তাদেরকে কাশ্মিরে অবশ্যই জায়গা দিতে হবে। পার্লামেন্টে সমালােচনা ঠেকানাের জন্য সম্ভবত মিসেস গান্ধী
দক্ষিণাঞ্চলে কিছু পাকিস্তানি ভূখণ্ড দখল করতে চান। ২১. এরপরে ড, কিসিঞ্জার জাতিসংঘের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চান। মি. সিসকো জানান যে,
বর্তমানে আমরা রাষ্ট্রদূত বুশের সাথে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করছি । নিরাপত্তা পরিষদের দুটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সােভিয়েতরা ভেটো প্রয়ােগ করেছে। অবশ্য শান্তির জন্য হুমকি’সংক্রান্ত ধারার আওতায় নিউ ইয়র্কে সাধারণ পরিষদের একটি জরুরি সভা আহ্বানের। ভিত্তি প্রস্তুত করাই আছে। পরিষদে এই সমস্যা সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটের ভিত্তিতে উত্থাপিত হতে পারে।
২২, ড. কিসিঞ্জার ও মি, সিসকো ঐকমত্যে পৌঁছান যে, সাধারণ পরিষদের সভায় গৃহীত যে
কোনাে প্রস্তাবনায় মূল দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে: যুদ্ধবিরতি ও সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার । ড, কিসিঞ্জার বলেন যে, জাতিসংঘে আমাদের প্রতিনিধি বর্তমান পরিস্থিতি মােকাবেলায় এখন পর্যন্ত খুবই ভাল কাজ করেছেন। মি. সিসকো বলেন যে, যদিও এই সমস্যা ভােটে অনুমােদনসাপেক্ষে সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে বলে মনে হয়, তারপরেও আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সেখানে ১৩৬টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব আছে । ফলে, যে কোনাে ধরনের প্রতিকূলতা মােকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। মি, ডি পালমা বলেন যে, পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপিত হবার পর ঘটনা নতুন এক মােড় নেবে; যেমন: ভারতীয়রা আর সমস্যার রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ব্যাপারে আগ্রহ
দেখাবে না। তখন এটা আর কোনাে সমস্যা বলে স্বীকৃত হবে না। ২৩. মি. ডি পালমা বলেন যে, আজ ৩:৩০ মিনিটে কাউন্সিলের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবার
কথা এবং আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি কাউন্সিল যাতে এই সমস্যাটি পরিষদে স্থানান্তর করে। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে না, সে
বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। ২৪. ড. কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন, আজকের মধ্যেই সাধারণ পরিষদে এই ইস্যুটি গৃহীত হবে,
এমন আশা আমরা করতে পারি কি না। জবাবে মি. ডি পালমা বলেন, ঘটনা সম্ভবত এ
রকমই ঘটবে। ২৫. ড. কিসিঞ্জার বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে আমরা যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, এখানেও আমরা
সেই একই বক্তৃতা দেবাে। কিন্তু শরণার্থী ও আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের ভাষা সম্পর্কে
তার কিছু বলার আছে। ২৬, ড, কিসিঞ্জার নির্দেশ করেন যে, ভারতীয়দের প্রতি এখন থেকে আমরা নিস্পৃহ আচরণ
করব। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে খুব বেশি সম্মান প্রদর্শনের প্রয়ােজন নেই । ২৭. এরপরে বর্তমান ভারতীয় নৌ ‘অবরােধ’-এর আইনগত অবস্থান সম্পর্কে ড. কিসিঞ্জার
প্রশ্ন করেন । মি, সিসকো বলেন যে, মার্কিন জাহাজকে বাধা দানের দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা প্রতিবাদ করেছি। অবশ্য যুদ্ধরত অবস্থায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে নিয়ােজিত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার মতাে কোনাে আনুষ্ঠানিক ঘােষণা এখনাে পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে করা হয়নি। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এটা অঘােষিত যুদ্ধ। স্টেট অবশ্য এ। বিষয়ের বৈধতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে। রাষ্ট্রদূত জনসন বলেন যে, তাঁর।
জানামতে ভারতীয় অবরােধ আরােপের কোনাে বৈধ ভিত্তি নেই। | ২৮, ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, একটি খসড়া প্রতিবাদ রচনা করতে হবে। আমরা যদি এটা বৈধ।
নয় বলে মনে করি, তাহলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানাব। মি.
সিসকো বলেন যে, এ ধরনের একটি প্রতিবাদপত্র তিনি তৈরি করবেন। ২৯, ড, কিসিঞ্জার এরপরে জানতে চান যে, পাকিস্তানকে সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তরের জন্য
জর্ডান বা সৌদি আরবকে মনােনয়ন দানের অধিকার আমাদের আছে কি না। মি. ফন হলেন জবাবে বলেন যে, অস্ত্র হস্তান্তরের জন্য কোনাে তৃতীয় দেশকে অনুমতি দানের
অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কারণ, আমরা যখন এটা তাদেরকে দিয়েছি, তখন আমরাই তাদেরকে প্রকৃত প্রাপকের, যেমন পাকিস্তানের কাছে সরাসরি বিক্রি অনুমােদন করিনি। গত জানুয়ারিতে আমরা পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার একটি বিধানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মি. সিসকো বলেন যে, এ ধরনের হস্তান্তর করতে হলে জর্ডানের নিজের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে বলে এই দায় থেকে আমরা তাদেরকে নিষ্কৃতি দিলে তারা কৃতজ্ঞই থাকবে। মি, সিসকো আরাে বলেন যে, পাকিস্তানিদের অবস্থা উত্তরােত্তর খারাপ
হচ্ছে বলে তাদের দিক থেকে অব্যাহতভাবে জরুরি সাহায্যের আবেদন আসবে। ৩০. ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হয়ত এ ধরনের অনুরােধ রাখতে পারেন। বিষয়টি
যদিও প্রেসিডেন্টের গােচরে আনা হয়নি, তবুও প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, পাকিস্তানিরা পরাজিত হােক। মি. প্যাকার্ড তখন বলেন যে, এ বিষয়ে কী করা যায়, তা আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত। মি. সিসকো এটি সমর্থন করেন; কিন্তু বলেন যে, এটা করতে হবে গােপনে। আগামীকাল (৭ ডিসেম্বর)-এর মধ্যে ড. কিসিঞ্জার এ বিষয়ে
একটি প্রস্তাবনা চান। ৩১. মি. সিসকো বলেন, যে বিষয়ে আমাদের আগ্রহ আছে তা হল, কী কী রসদ ও সরঞ্জাম
সহজলভ্য করা যায় এবং সেসব সরঞ্জাম সরবরাহের সম্ভাব্য উপায়। তিনি বলেন যে, ভারতীয়রা যাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করে না ফেলে, সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। সাহায্য দানের বিষয়টির দিকে ড, কিসিঞ্জার দৃষ্টি ফেরান এবং অনুরােধ করেন, যাতে এখন থেকে যেসব ঋণপত্র খােলা হবে, সেসব অপ্রত্যাহারযােগ্য না থাকে। মি. উইলিয়ামস বলেন যে, ভারতের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়, এ ধরনের যাবতীয় সাধারণ আর্থিক সাহায্য আমরা বাতিল করেছি, যা এই অঙ্ককে ১০ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানকে আমরা যে সাহায্য করেছি, সেটা ভারতের প্রতি বিদ্বেষবশত নয়। কারণ, ভারতীয়রা উন্নয়নের জন্য প্রাপ্ত সমস্ত অর্থসাহায্য যুদ্ধখাতে ব্যয় করছে। অথচ সাহায্যের বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের কৃষিখাত ও মানবিক ত্রাণকার্যের জন্য পৃথক করে রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রায়ােগিক, রাজনৈতিক ও আইনগত দিক থেকে প্রমাণ করা সম্ভব যে, ভারত ও পাকিস্তানকে দেয়া সাহায্যের মধ্যে পার্থক্য আছে।
আরাে নিশ্চিত করার জন্য ড. কিসিঞ্জার বলেন যে, ভারতকে সাহায্য প্রদান বন্ধ প্রসঙ্গে আলােচনায় যা বন্ধ করা হয়েছে, তার ওপরে গুরুত্ব আরােপ করতে হবে — যা বহাল
আছে তার ওপরে নয়। ৩৪, এরপর ড. কিসিঞ্জার সৈন্য অপসারণ প্রসঙ্গে জানতে চান। মি. সিসকো বলেন যে, ঢাকা
থেকে সৈন্য অপসারণ বন্ধ করা হয়েছে। ড. কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। মি. উইলিয়ামস বলেন যে, এটা নিয়ে এখন খুব বড় সমস্যার মুখােমুখি আমাদের হতে হবে। বলে মনে হয় না। কিন্তু পরবর্তী বসন্তের মধ্যে দুর্ভিক্ষ হবারই আশঙ্কা বেশি। ড.
কিসিঞ্জার জানতে চান যে, বাংলাদেশে ত্রাণকার্যের জন্য আমাদের কাছে আবেদন জানানাে হবে কি না। মি, উইলিয়াস বলেন যে, মাসে ১৪০ টন খাদ্যসামগ্রী যদি আমরা চট্টগ্রামে পাঠাতে পারি, তাহলে সমস্যা খুব জটিল আকার ধারণ করবে না । কিন্তু এখন কিছুই যাচ্ছে না। তিনি আরাে বলেন যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সব ধরনের সাহায্য প্রয়ােজন হবে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত জনসন যােগ করেন যে, বাংলাদেশ একটি ‘আন্তর্জাতিক ঝুড়ি’তে রূপান্তরিত হবে। মি. উইলিয়াস বলেন যে, শরণার্থী প্রত্যাবাসন, জনগণের স্থানান্তর এবং তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য ব্যাপক সাহায্যের প্রয়ােজন হবে। ড. কিসিঞ্জার বলেন, এ বিষয়ে এখন থেকেই আমাদের পর্যবেক্ষণ শুরু করা
উচিত। ৩৬. মি. উইলিয়ামস বলেন, শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য ভারত বরাবরই নগদ অর্থসাহায্য
চেয়েছে। পরিবর্তে ভারত তাদের খাদ্য ও অন্যান্য বিষয়ে সহায়তা করবে। এর ফলে ভারত বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। নগদ অর্থের পরিবর্তে আমরা সাহায্য হিসেবে দ্রব্যসামগ্রী দিতে পারি কি না, এ বিষয়ে আগামীকালের মধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের
ওপরে গুরুত্ব আরােপ করেন। মানবিক সাহায্য আমরা বন্ধ করতে চাই না। আমরা নগদ
| অর্থের বদলে দ্রব্যসামগ্রী প্রদান করতে চাই। | ৩৭. এরপর সভা মুলতবি ঘােষণা করা হয়।
স্বাক্ষর/ এইচ এন কে এইচ এন কে ক্যাপ্টেন, ইউএসএন সাউথ এশিয়া/এমএপি ব্রাঞ্চ, জে৫ এক্সটেশন ৭২৪০০
| সূত্র: প্রাগুক্ত
(ঘ) ৮ ডিসেম্বরের সভার ওপরে স্মারক
গােপন ও স্পর্শকাতর
দ্য জয়েন্ট স্টাফ। দ্য জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ ওয়াশিংটন, ডি সি ২০৩০১
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম – লে জেনারেল জে এফ আর জেকব