৯ অগাস্ট ১৯৭১-এ ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি
পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান আন্তরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরাে সুদৃঢ় ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে, বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার আরাে অগ্রগতি এশিয়া ও সারা বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনীয় মৌলিক জাতীয় কল্যাণ নিশ্চিত করে, এই বিশ্বাসে, বিশ্বজনীন শান্তি ও নিরাপত্তা সুসংহত করা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস হ্রাস ও উপনিবেশবাদের অবশিষ্টাংশ নির্মূল করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাসম্পন্ন রাষ্ট্রসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযােগিতার নীতিতে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সমুন্নত রেখে, বর্তমান বিশ্বে বিরােধ নয়, বরং সহযােগিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যাবলির সমাধান করা যেতে পারে, এ ব্যাপারে প্রত্যয়ী হয়ে, জাতিসংঘের সনদ (United Nations Charter)-এর লক্ষ্য ও নীতিমালা মেনে চলার ব্যাপারে তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা পুনরায় ব্যক্ত করে, এক পক্ষে ভারত প্রজাতন্ত্র (Republic of India) এবং অপর পক্ষে সােভিয়েত ইউনিয়ন। (Union of Soviet Socialist Republics),
বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যে কারণে নিম্নবর্ণিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে নিয়ােজিত করা হয়েছে:
ভারত প্রজাতন্ত্রের পক্ষে: সর্দার শরণ সিং, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী।
সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে: মি. এ এ গ্রোমিকো (A A Gromyko), পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী। যারা উপযুক্ত আকারে যথার্থ ক্রম অনুযায়ী তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞান উপস্থাপন করেছেন, নিম্নবর্ণিত শর্তাবলিতে একমত হয়েছেন:
(ধারা ১)
চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় নির্দিষ্ট বিধিসম্মতভাবে ঘােষণা করছে যে, দুই দেশ ও তাদের জনগণের মধ্যে। স্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব বিদ্যমান থাকবে। প্রত্যেক পক্ষ অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় উল্লিখিত নীতিমালা এবং সাম্য ও পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে গঠিত পরস্পরের সাথে বিদ্যমান আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সৎ প্রতিবেশীসুলভ ও ব্যাপক সহযােগিতাপূর্ণ সম্পর্ককে আরাে সংহত করবে।
(ধারা ২) তাদের দেশসমূহের জনগণের স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযােগিতা করার সদিচ্ছার দ্বারা চালিত হয়ে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় কার্যকর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে এশিয়া ও সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষা ও সুসংহত করা এবং অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ করে পারমাণবিক ও প্রচলিত অস্ত্রসহ সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ কার্যকর করার লক্ষ্যে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। (ধারা ৩) জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সমস্ত জাতি ও জনগােষ্ঠীর সমতার মহিমান্বিত আদর্শের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় সব ধরনের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের প্রতি নিন্দা জানাচ্ছে এবং এসবের চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ দূরীকরণের সংগ্রামে তাদের প্রতিজ্ঞার কথা পুনর্ব্যক্ত করছে।
উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সমর্থনে অন্যান্য রাষ্ট্রকেও চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় সহযােগিতা প্রদান করবে। (ধারা ৪) সব দেশের সাথে বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা দৃঢ়তর করার লক্ষ্যে সােভিয়েত ইউনিয়নের শান্তিকামী। নীতির প্রতি ভারত প্রজাতন্ত্র শ্রদ্ধাশীল। সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বিশ্বজনীন শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংরক্ষণ এবং বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা হ্রাসের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে এই নীতিমালায় সন্নিবেশিত আছে, তা পুনর্ব্যক্ত করছে। (ধারা ৫) এসব লক্ষ্য অর্জন করতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতার প্রতি গুরুত্ব আরােপ করে বিশ্বজনীন শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গভীরভাবে আগ্রহী চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় উভয়পক্ষের ওপরে প্রভাব পড়ে —এমন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিতে দুই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকদের মধ্যে আলােচনা সভা, পারস্পরিক মত বিনিময়, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও বিশেষ দূতদের ভ্রমণ এবং কূটনৈতিক মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরের সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করবে।
(ধারা ৬) পরস্পরের মধ্যে অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক সহযােগিতার ওপরে গুরুত্ব আরােপ করে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধাজনক ও সম্পূরক সহযােগিতা প্রসারিত করবে এবং সমতা, পারস্পরিক কল্যাণ ও সবচেয়ে সমর্থিত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে বর্তমান চুক্তি ও ২৬ নভেম্বর ১৯৭০-এ সম্পাদিত ইন্দো-সােভিয়েত বাণিজ্যচুক্তিতে বর্ণিত সন্নিহিত রাষ্ট্রের সাথে বিশেষ ব্যবস্থাসাপেক্ষে বাণিজ্য, পরিবহন ও যােগাযােগব্যবস্থার প্রসার ঘটাবে।
(ধারা ৭) বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, পর্যটন ও ক্রীড়াক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় পরস্পরের সাথে পরস্পরের বন্ধন ও সম্পর্কের আরাে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
(ধারা ৮) দুই দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে বিধিসম্মতভাবে ঘােষণা করছে যে, অপরপক্ষের বিপক্ষে পরিচালিত কোনাে সামরিক অভিযানে তারা যােগ দেবে না বা অংশ নেবে না। চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন থেকে বিরত থাকা এবং অপর পক্ষের সামরিক ক্ষতির কারণ হয় এমন কোনাে কাজে এবং তার সীমানাভুক্ত এলাকার ব্যবহার রােধ করার অঙ্গীকার করছে।
(ধারা ৯) চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে অপর পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়ােজিত কোনাে তৃতীয় রাষ্ট্রকে কোনাে ধরনের সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করছে। যে কোনাে পক্ষ এ ধরনের আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকির মুখােমুখি হলে চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয় এই হুমকি নিরসন এবং তাদের রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে যথাশীঘ্র দ্বিপাক্ষিক আলােচনায় বসবে।
(ধারা ১০) চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের কোনাে পক্ষই অন্য কোনাে রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রসমূহের সাথে প্রকাশ্যে বা গােপনে এমন কোনাে দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ হবে না, যা এই চুক্তির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। চুক্তিবদ্ধ পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে আরাে ঘােষণা করছে যে, অন্য কোনাে রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রসমূহের সাথে তারা এমন কোনাে দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ হবে না, যা অপর পক্ষের সামরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
(ধারা ১১)
এই চুক্তি বিশ বছর মেয়াদের জন্য সম্পাদিত হল এবং কোনাে পক্ষ মেয়াদ অতিক্রান্ত হবার। বারাে মাস আগে অপর পক্ষকে চুক্তি বাতিলের নােটিশ প্রদান না করলে পরবর্তীতে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য আপনা-আপনিই এর মেয়াদ বেড়ে যাবে। এই চুক্তি অনুমােদনসাপেক্ষ এবং স্বাক্ষরের এক মাস পর মস্কোতে অনুমােদিত চুক্তিপত্রের হস্তান্তরের তারিখ থেকে এই চুক্তি বলবৎ হবে।
(ধারা ১২) এই চুক্তির কোনাে ধারা অথবা ধারাসমূহের ব্যাখ্যায় দ্বিমত দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝােতার মানসিকতা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলােচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করা হবে।
উল্লিখিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সমানভাবে বিশুদ্ধ ভাষ্যসহ হিন্দী, রুশ ও ইংরেজিতে প্রস্তুতকৃত বর্তমান চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন এবং তাদের সিলমােহর দিয়েছেন।
নয়া দিল্লীতে এক হাজার নয় শত একাত্তর সালের অগাস্ট মাসের নবম দিবসে সম্পাদিত ।
সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে (স্বাক্ষর) এ এ গ্রোমিকো পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী
ভারত প্রজাতন্ত্রের পক্ষে। (স্বাক্ষর) সর্দার শরণ সিং পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী
সূত্র: সারভাইভ্যাল, বর্ষ ৮, অক্টোবর ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৩৫১~৩।
সূত্র : সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম – লে জেনারেল জে এফ আর জেকব