You dont have javascript enabled! Please enable it!

৮ মার্চ ১৯৭৮-এ ফিল্ড মার্শাল এস এইচ এফ জে মানেকশ’র

প্রেরিত প্রশ্নমালা এবং লেফটন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জেকবের উত্তর

১. ১৯৭১-এর যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নে বিবেচ্য বিষয়সমূহ ক. প্রয়ােজনীয় সৈন্য-সংখ্যা; খ, নৌ ও আকাশশক্তির ব্যবহার; গ. গােয়েন্দা-কার্যক্রমে আমাদের সৈন্যদের ক্ষমতা; ঘ, সামগ্রিক বিজয় অর্জনের সময়সীমা। ২. অপারেশনের সাফল্যের পেছনে যেসব উপাদান কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে, যেমন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য, চমৎকার আন্তঃবাহিনী সহযােগিতা, উদ্দীপিত সুশিক্ষিত সেনানায়ক ও সেনানীরা। ৩. ১৯৭১-এর ইন্দো-পাক যুদ্ধকে এঞ্জিনিয়রদের যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এঞ্জিনিয়রদেরকে এই যুদ্ধে ১০,০০০ ফুট ব্রিজ তৈরি করতে হয়। অনেক সমস্যা ছিল; যেমন: উভচর যানবাহনগুলােকে নদী পার করা, খরস্রোতা নদী, নদী ও খালের প্রাচুর্য, কর্দমাক্ত নদীতট এবং শক্ত মাটির অভাবে হেলিকপ্টার এয়ার ব্রিজিং’-এর সঙ্কট। পরিকল্পনায় ও পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনায় এই বিষয়গুলােকে কেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল? সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সেনাবাহিনীর জন্য ব্রিজস্থাপন কীভাবে আমরা নিশ্চিত করেছি এবং সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মূল বাহিনীকে কীভাবে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি? ৪. যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালীন ট্যাকটিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক্যাল গােয়েন্দা-তথ্যের ওপরে আমাদের বেসামরিক ও সামরিক গােয়েন্দা-ব্যবস্থার কতটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিল। অপারেশনের আগে ও অপারেশনের সময় গােয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহে ও প্রকৃত লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা। গােয়েন্দা-তথ্যাদি সংগ্রহ ও আমাদের সৈন্যদেরকে তা প্রদানের কাজে বেসামরিক জনগােষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছিল কি? ৫. ট্যাকটিক্যাল যুদ্ধে বিমান-আক্রমণ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিল কি না এবং করে থাকলে কীভাবে সেটা সমন্বিত ও সংঘটিত হয়? ৬. যুদ্ধে সৈন্যদল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জুনিয়র কম্যান্ডার ও এনসিও (N()())-দের গুরুত্ব আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন? ফিল্ড মার্শাল এস এইচ এফ জে মানেকশ’, এমসি।

৮ মার্চ ১৯৭৮ মানেকশ’র প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমি নিচের উত্তর পাঠিয়ে দিই: ১. ১৯৭১-এর যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়নে বিবেচিত বিষয়সমূহ  ক, প্রয়ােজনীয় সৈন্য-সংখ্যা: আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে দেয়া আঞ্চলিক দায়িত্ব পালনের জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ করা হয়, সেটা পর্যাপ্ত ছিল। অগাস্ট ১৯৭১-এ আর্মি হেডকোয়ার্টার্স থেকে ইস্যু করা অপারেশন নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে সৈন্য বরাদ্দ করা হয়, যা পরবর্তীতে (১) প্রবেশপথ খুলনা ও চট্টগ্রাম’ দখল; এবং (২) যত বেশি সম্ভব এলাকা অধিকারে নিয়ে আসাতে এসে থামে। আপনার হয়ত স্মরণ আছে যে, অপারেশন রুমে অনুষ্ঠিত আলােচনায় অপারেশনের লক্ষ্য, বিশেষত আক্রমণের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত খুলনা প্রসঙ্গে আপনার ডিএমও (DMO), কেকে (KK) ও আমার মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়। সে সময় আমি বলেছিলাম, সমাসন্ন নৌ-অবরােধের কারণে এই বন্দরগুলাে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি আরাে বলেছিলাম, প্রধান ভূ-রাজনৈতিক কেন্দ্র হল ঢাকা। তাই উত্তরাঞ্চলে আক্রমণের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দকৃত সৈন্যসংখ্যা অপর্যাপ্ত ছিল। আপনি ভালভাবেই অবগত আছেন, পরবর্তীতে ঢাকা দখলের লক্ষ্যে উত্তরদিকের চীন। সীমান্ত থেকে আমরা আরাে সৈন্য আনার ব্যবস্থা করি। নৌ ও আকাশশক্তির ব্যবহার: পাকিস্তানের সামগ্রিক শক্তি বিবেচনা করে আমাদের নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপরে যথাক্রমে একটি নৌ-অবরােধ আরােপ এবং সেনাবাহিনীকে সহযােগিতার লক্ষ্যে আকাশে একটি সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব অর্পিত ছিল । 

রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষের নৌ ও আকাশশক্তি খুব সীমিত থাকায় এই দায়িত্বগুলাে কার্যকরভাবে পালিত হয়। পাকিস্তানের আকাশশক্তি প্রসঙ্গে বলা যায় যে, আকাশযুদ্ধে তারা তেমন কোনাে কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। একমাত্র এয়ারফিল্ড ঢাকায় তাদের ফাইটারগুলাে জড়াে করা ছিল। আমাদের বিমানবাহিনীর উপযুক্ত আক্রমণ সেগুলােকে অকার্যকর করে রাখে। এরপরে আর কোনাে বিমান আক্রমণ হয়নি। এই অঞ্চলে নৌবাহিনী নিয়ােজিত করার ব্যাপারে পাকিস্তানের সামর্থের অভাবের কারণে নৌ-অবরােধও সফলভাবে কার্যকর করা হয় । গ. গােয়েন্দা কার্যক্রমে আমাদের সৈন্যদের ক্ষমতার পরিধি: একমাত্র যে গােয়েন্দা ব্যবস্থা আমাদের পক্ষে কার্যকরভাবে কাজ করে, সেটা সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (SI)। যেসব যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম আমরা ব্যবহার করেছিলাম, সেসব ছিল সেকেলে এবং অপরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত। তার ওপরে এর নিয়ন্ত্রণ ছিল ডিরেক্টর অভ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (DMI)-এর হাতে। কোনাে নিখুঁত নির্দেশনা দেবার পক্ষে দিক-নির্দেশক যন্ত্রগুলাে অনুপযােগী ছিল। আপনার হয়ত মনে আছে, আমার ক্রমাগত অনুরােধের প্রেক্ষিতে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের নিয়ন্ত্রণভার আপনি সরাসরি ইস্টার্ন কম্যান্ডের ওপরে ন্যস্ত করেন। যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কার্যকরভাবে।

আমরা সেগুলাের পুনর্বিন্যাস করি এবং পাকিস্তানি সেনাবিন্যাস ও শক্তি সম্পর্কে মােটামুটি সঠিক ধারণা লাভ করতে সমর্থ হই। প্রকৃতপক্ষে, এটাই ছিল আমাদের একমাত্র নির্ভরযােগ্য মাধ্যম। পরে আমরা কোড-ব্রেকিংও শুরু করি, কিন্তু শুধু ন্যাভাল কোডটাই আমরা ভাঙতে পেরেছি। সামগ্রিক বিজয় অর্জনের সময়সীমা: ‘সময়সীমার বিষয়টি আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারিনি এবং সামগ্রিক বিজয় অর্জন’ বলতে আপনি ঠিক কী বােঝাতে চেয়েছেন, সেটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। যুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত আগে আর্মি হেডকোয়ার্টার্সে সামগ্রিক বিজয়ের ধারণাটি জন্ম নেয়। আমার জানা মতে, এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনাে সময়সীমা কখনাে বেঁধে দেয়া হয়নি। ইস্টার্ন কম্যান্ডে প্রাথমিকভাবে আমরা তিন সপ্তাহের একটি সময়সীমা ধরে নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের আশা ছিল, পরিস্থিতি অনুকূল হলে সময় আরাে কম লাগবে। ২. অপারেশনের সাফল্যের পেছনে যেসব উপাদান কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে, যেমন: সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য, চমৎকার আন্তঃবাহিনী সহযােগিতা, উদ্দীপিত সুশিক্ষিত সেনানায়ক ও সেনানীরা। ক. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য: কী ছিল আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য? রাজনৈতিক লক্ষ্য যদি হত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তাহলে কর্ম-পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ দখল করা। এটা পরিষ্কার হয়ে থাকলে অগাস্টের অপারেশন নির্দেশিকায় উল্লেখ না করে যুদ্ধের ঠিক অব্যবহিত আগে করা হল কেন? সুনির্দিষ্টভাবে যদিও কোনােকিছুই। বলা হয়নি, আমার ধারণা, মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত করা এবং সরকার প্রতিষ্ঠিত করার পর তাকে স্বীকৃতি দেয়াই ছিল আমাদের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য। আপনার স্মরণ থাকতে পারে যে, ময়মনসিংহ এলাকায় এই চেষ্টা করা হয়। এবং এটা ব্যর্থ হয়ে যাবার পরে পূর্বাঞ্চলের দিকে মনােযােগ দেয়া হয়। তখন সেখানে সুনির্দিষ্ট কোনাে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল কি? খ, আন্তঃবাহিনী সহযােগিতা: কম্যান্ড পর্যায়ে আন্তঃবাহিনী সহযােগিতার ক্ষেত্রে চমৎকার বােঝাপড়া ছিল। গ. উদ্দীপিত সুশিক্ষিত কম্যান্ডার ও সৈন্যদল: ছিল। ৩, ১৯৭১-এর ইন্দো-পাক যুদ্ধকে এঞ্জিনিয়রদের যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এঞ্জিনিয়রদেরকে এই যুদ্ধে ১০,০০০ ফুট ব্রিজ তৈরি করতে হয়। সমস্যা ছিল অনেক; যেমন: উভচর যানবাহনগুলাে নদী পার করা, খরস্রোতা নদী, নদী ও খালের প্রাচুর্য, কর্দমাক্ত নদীতট এবং সে কারণে হেলিকপ্টার এয়ার ব্রিজিং’-এর প্রয়ােজনীয় , ইত্যাদি। পরিকল্পনায় ও পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনায় এই বিষয়গুলােকে কেমন গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল? কীভাবে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সেনাবাহিনীর জন্য ব্রিজ স্থাপন নিশ্চিত করেছি এবং সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মূল বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি?

এই যুদ্ধকে বরং কৌশলের যুদ্ধ বলাটা অধিকতর সঙ্গত হবে । যুদ্ধের সময় চলাচল ও লড়াই করতে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করাই এঞ্জিনিয়রদের কাজ। ব্রিজ তৈরি এ ধরনেরই একটি ব্যাপার। স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল বিশেষত লক্ষ্যস্থল নির্বাচন এবং পাকিস্তানিদের সুরক্ষিত এলাকার পেছনে অবস্থিত যােগাযােগ ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র চিহ্নিত করে অগ্রসরের জন্য গতিপথ নির্ধারণ। জেনারেল নিয়াজির নিয়ােজিত সুরক্ষিত নগরদুর্গসমূহকে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই । এর অর্থ, পাকিস্তানিদের মূল প্রতিরােধ-ব্যবস্থা এড়িয়ে অগ্রসর হবার গতিপথ নির্ধারণ করতে হয়। কারণ প্রায় সমস্ত প্রধান সড়কেই পাকিস্তানি প্রতিরােধ ছিল। মেইন্টেন্যান্সের জন্য অক্ষরেখা পরবর্তীতে খুলে দেয়া হয়। যুদ্ধের পুরােটা সময় এটাই ছিল আমাদের ধরন। অন্যভাবে বলা যায় যে, অগ্রসর হবার অক্ষরেখা আর মেইন্টেন্যান্সের অক্ষরেখা যে একই হতে হবে, এমন কোনাে বাধাধরা নিয়ম নেই। উপযুক্ত মেইন্টেন্যান্স লাইন উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা দিয়েও অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। হেলি-লিফট হেলিকপ্টার লিফট ছিল আমাদের সচলতার একটি অংশ। দুর্ভাগ্যবশত প্রতিশ্রুত এমআই৮ (Mi8)-গুলাে সময়মতাে না আসায় স্বল্প সংখ্যক এমআই৪ (Mi4)-এর মধ্যেই আমাদের হেলি-লিট সীমাবদ্ধ থাকে। ব্রিজ তৈরি ব্রিজ তৈরির সরঞ্জামাদি ইস্যু করার ব্যাপারে আর্মি হেডকোয়ার্টার্স ছিল ধীর গতিসম্পন্ন, এবং শেষ পর্যন্ত ডিএমও কে কে সিং যখন অগাস্টে তার বিদায়ের আগে এগুলাে ইস্যু করেন, তখন সেগুলাে বিভিন্ন ডিপাে থেকে সংগ্রহ করার পর প্রয়ােজনীয় মেরামতি শেষ করে অকুস্থলে নিয়ে যেতে হয়। প্রকৃতপক্ষে ডিসেম্বরের প্রারম্ভে শেষ ব্রিজটি অকুস্থলে পৌঁছায় এবং যুদ্ধ শেষ হবার পর আমাদের হাতে ব্রিজ তৈরির কোনাে সরঞ্জামই আর অবশিষ্ট ছিল না – প্রতিটি ফুট কাজে লাগানাে হয়েছে।

কাঁচা রাস্তা দিয়ে ব্রিজ তৈরির সরঞ্জাম পরিবহন এবং ব্রিজে ওঠা ও নামার জায়গা নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা দেখা দেয়। নিজেদের ও স্থানীয় সংস্থান ব্যবহার করে ব্যাপক ফেরি পারাপারের ওপরেও আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় । ৪. যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালীন ট্যাকটিক্যাল ও স্ট্র্যাটেজিক্যাল গােয়েন্দাগিরিতে আমাদের বেসামরিক ও সামরিক গােয়েন্দা-ব্যবস্থার কতটুকু প্রবেশ ছিল। অপারেশনের আগে ও অপারেশনের সময় গােয়েন্দাগিরিতে ও প্রকৃত লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা। গােয়েন্দাতথ্যাদি সংগ্রহ ও আমাদের সৈন্যদেরকে তা প্রদানে বেসামরিক জনগােষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছিল কি? আবারও, আমার স্মৃতিশক্তি প্রতারণা না করলে, যুদ্ধের আগের পুরােটা সময়ে আমরা র’-এর তরফ থেকে মাত্র দুটো আধা পৃষ্ঠার গােয়েন্দা-রিপাের্ট পেয়েছি। সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সই আমাদেরকে মূল তথ্যাদি সরবরাহ করে। মুক্তিবাহিনী গেরিলা অপারেশন সংগঠনে যথেষ্ট সময়ের প্রয়ােজন হয়। এ ধরনের অপারেশনের জন্য প্রয়ােজনীয় অবকাঠামাে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব সাবধানতার সাথে ধীরেসুস্থে স্থাপন করতে হয়। গেরিলা সৈন্যদেরকে ট্রেনিংয়ের সময় নেতাদেরকে বিশেষভাবে নির্বাচন করে তাদের জন্য ব্যাপক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। নিবেদিত ও সুশিক্ষিত নেতৃত্ব ছাড়া গেরিলা অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অপারেশন জ্যাকপটে ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে মানের চেয়ে সংখ্যার ওপরে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কার্যকর অধস্তন নেতৃত্বের অভাবে দায়সারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক গেরিলা সৈন্য তাদের সংখ্যার তুলনায় সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। নেতা-নির্বাচন ও তাদের ট্রেনিংয়ের ওপরে আরাে গুরুত্ব দেয়া প্রয়ােজন ছিল। | সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশী বাহিনী ও গেরিলাদের সাফল্য পুরােপুরি আমাদের আশানুরূপ হয়নি। তবে ট্রেনিং ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করার পেছনে তাদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: ক) প্রত্যন্ত এলাকা দখল খ) প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনােবল ভেঙে দেয়া এবং তাদের গতিবিধির স্বাধীনতা হরণ করে তাদের আস্তানায় তাদেরকে আটকে রাখা । ৫. বিমান আক্রমণ ট্যাকটিক্যাল যুদ্ধে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছিল কি না এবং করে থাকলে কীভাবে সেটা সমন্বিত ও সংঘটিত হয়? বিমান আক্রমণ যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে স্থান পরিবর্তন এবং আমাদের বাই-পাসিং ট্যাকটিকসের কারণে আমরা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকার পথে যে নদীগুলাে পড়ে, সেগুলাের তীরবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের গতিবিধি নিষিদ্ধ করার জন্য বিমান ব্যবহার করি। মাটিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুর ওপরে আক্রমণের জন্য আমরা বিমান ব্যবহার করিনি বললেই চলে। পাকিস্তানিদেরকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা অবশ্য খুবই বিশ্বাসযােগ্য হয়েছিল। এই বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় আমাদের প্ররােচনায় ন্যাট (Gnat) বিমান দিয়ে ছােটখাট যে আক্রমণগুলাে চালানাে হয়, সেগুলাে মােটামুটি সাফল্য লাভ করে। অপারেশনের দ্রুত গতির কারণে সটি (আক্রমণের জন্য বিমানের লক্ষস্থলে যাত্রা)-তে যাওয়া যুদ্ধ-বিমানগুলাে কাজে লাগানাে ছিল আমাদের জন্য এক গুরুতর সমস্যা। আমরা অবশ্য এক সেক্টরের অব্যবহৃত সর্টিগুলাে অন্য সেক্টরে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফল লাভ করেছি। ৬. যুদ্ধে সৈন্যদল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জুনিয়র কম্যান্ডার ও এনসিও (NCO)-দের গুরুত্ব আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন? সাধারণভাবে জুনিয়র অফিসার ও এনসিওরা ভাল কাজ করেছেন এবং সাহসিকতা ও উদ্যমের স্বাক্ষর রেখেছেন। জেসিও (JCO)-দেরকে অবশ্য সাবধানী বলে মনে হয়েছে।

সূত্র : সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম – লে জেনারেল জে এফ আর জেকব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!