১৯৯৬ সালে দেয়া জেনারেল স্যাম মানেকশ’র সাক্ষাৎকার
১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়ে অ্যাডমিরাল নন্দ ও অ্যাডমিরাল ডসন (Dai’s())-এর মতাে ব্যক্তিত্ব। ওয়ার রুমে ছিলেন। যুদ্ধের প্রতিপর্বে অথবা যুদ্ধ চলাকালীন তাঁদের এমন কোনাে কর্মকাণ্ডের কথা আপনি স্মরণ করতে পারবেন কি, যা আজও মনে পড়ে অথবা কৌতূহলােদ্দীপক কোনাে বিষয়। হিসেবে আপনার চেতনায় বার বার ফিরে আসে? যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের একটা ঘটনা বলি। তারিখটা আমার সঠিক মনে নেই। এপ্রিলের দিকে কোনাে এক সময়কার ঘটনা। একটা কেবিনেট মিটিঙে আমাকে ডাকা হয়। বন্যার পানির মতাে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় শরণার্থীদের অব্যাহত চাপের কারণে শ্রীমতি গান্ধীকে অস্থির ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। “দেখুন এদিকে—এত শরণার্থী আসছে—আসামের মুখ্যমন্ত্রী টেলিগ্রাম করেছেন, টেলিগ্রাম করেছেন…. এ ব্যাপারে আপনারা কী করছেন?” তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি উত্তর দিলাম, “কিছুই না। এখানে আমার কী করার আছে?” তিনি বললেন, “কিছুই কি আপনার করার নেই? আপনারা এখনাে কিছু একটা করছেন না। “আপনি আমাকে কী করতে বলেন?” “আপনি আপনার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান।” আমি বললাম, “এর অর্থ যুদ্ধ” এবং তিনি বললেন, “তাই যদি হয়, হােক। কিছু এসে যায় এর পরে আমি বসে পড়লাম এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি বাইবেল পড়েছেন?” সর্দার শরণ সিং (Sardar Swaran Singh) জানতে চাইলেন, “এখানে বাইবেলের প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?” “বাইবেলের আদিপুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে আছে, ঈশ্বর বললেন, আলােকিত হােক এবং সবকিছু আলােকিত হয়ে গেল (Let there be light and there was light)’ – আপনিও অনুভব করছেন, যুদ্ধ হােক আর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।’ আপনি কি এজন্য প্রস্তুত? আমি তাে অন্তত প্রস্তুত নই।” এর পর আমি বললাম, “কী ঘটছে, সেটা আমি আপনাকে বলছি।
এখন এপ্রিল শেষ । আর কয়েকদিন অর্থাৎ ১৫-২০ দিন পরেই শুরু হবে বর্ষাকাল। আর পূর্ব পাকিস্তানে বৃষ্টির মৌসুমে নদীগুলাে সমুদ্রের মতাে হয়ে যায় – একদিকের পারে দাঁড়ালে অপর পার দেখা যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা রাস্তায় আটকা পড়ে যাব। বিমানবাহিনীও আমাদেরকে সহায়তা করতে পারবে না। পাকিস্তানিরা তখন আমাদেরকে ধুলােয় মিশিয়ে দেবে —- এটা গেল এক দিক। “দ্বিতীয়ত, আমার আর্মার্ড ডিভিশন এখন বাবিনা (Babina) এলাকায়; অন্য ডিভিশনটি – কোনটি, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না – আছে সেকান্দারাবাদ (Secunderabad) এলাকায়। আমাদের এখন ফসল কাটার মৌসুম। সৈন্য পরিবহনের জন্য প্রতিটি যানবাহন, প্রতিটি ট্রাক, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি রেলপথ আমার প্রয়ােজন পড়বে। সেক্ষেত্রে শস্য পরিবহন সম্ভব হবে না।” একথা বলে আমি কৃষিমন্ত্রী ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ (Fakruddin Ali Ahmed)-এর দিকে ফিরে বললাম, “এবং ভারতে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সবাই দোষ দেবে আমাকে। এই দায়ভার আমি ঘাড়ে নিতে চাই না।” এর পর ঘুরে আমি বললাম, “যে আর্মার্ড ডিভিশন আমার মূল শক্তি, তাদের হাতে কাজ চালানাের উপযােগী মাত্র বারােটি ট্যাঙ্ক আছে।” ওয়াই বি চ্যবন (Y B Chavan) জিজ্ঞাসা করলেন, “মাত্র বারােটি কেন, স্যাম?” আমি বললাম, “কারণ আপনিই অর্থমন্ত্রী, স্যার। মাসের পর মাস আমি এটার পেছনে লেগে আছি, এটা নিয়ে দেন-দরবার করেছি। আপনি বলেছেন, ‘কোনাে টাকা নেই।’ – সেই কারণে।”
এর পরে বললাম, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল থাপারের পরিবর্তে আপনার পিতা যদি আমাকে বলতেন, ‘চীনাদেরকে ঘাড় ধরে বার করে দাও,’ তাহলে আমি ঘুরে দাড়িয়ে তাকে বলতাম, “দেখুন, এগুলাে হল সমস্যা।’ এখন আমি আপনাকে বলছি, সমস্যাগুলাে কী। এর পরেও আপনি যদি বলেন এগিয়ে যেতে, আমি আপনাকে শতকরা ১০০ ভাগ পরাজয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এবারে আপনি আদেশ করুন।” জগজীবন রাম (Jagjeevan Ram) তখন বললেন, “স্যাম, মেনে নাও না ভাই (Sani, maan jao na)” | আমি বললাম, “আমি আমার পেশাগত অবস্থান থেকে যা বলার, বলেছি। এখন সরকারকে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” | প্রধানমন্ত্রী কিছু বললেন না। তাঁর মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, চারটার সময় আবার মন্ত্রিসভার বৈঠক বসবে (Achchha, cabinet clia baje milenge).”
সবাই বেরিয়ে গেলেন। কনিষ্ঠতম হিসেবে আমার সবচেয়ে পরে যাবার কথা। প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম । “চিফ, বসুন।” আমি তখন তাকে বললাম, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কিছু বলার আগে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি চান যে, মানসিক অথবা শারীরিক স্বাস্থ্যগত কোনাে কারণ দেখিয়ে আমি পদত্যাগপত্র দাখিল করি?” তিনি বললেন, “ওহ্ স্যাম, আপনি বসুন। আপনি আমাকে যা যা বলেছেন, সবই কি ঠিক?” “জি। দেখুন, লড়াই করা আমার কাজ। জয়ের জন্য লড়াই করাই আমার কাজ। আপনি কি তৈরি? আমার কিন্তু প্রস্তুতি নেই। অভ্যন্তরীণ সব বিষয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি কি আপনার আছে? আন্তর্জাতিক চাপ সামলানাের প্রস্তুতি কি আপনার আছে? আমার মনে হয় না। আমি জানি, আপনি কী চান। কিন্তু এই কাজ অবশ্যই আমার সময় অনুযায়ী আমাকে করতে হবে। সেটা করতে দেয়া হলে সাফল্যের ব্যাপারে আমি আপনাকে শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় আমি পরিষ্কার করে নিতে চাই। যুদ্ধে একজন মাত্র কম্যান্ডার থাকবে। বিএসএফ, সিআরপিএফ বা আপনি যাকে পছন্দ করেন, কারাে অধীনে কাজ করতেই আমার কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু আমি চাই না, কোনাে সােভিয়েত এসে আমার কর্তব্য নির্ধারণ করে দিক।
আমার একজন রাজনৈতিক অধিকর্তা থাকতে হবে, যার নির্দেশ অনুযায়ী আমি কাজ করব। আমি চাই না, শরণার্থী, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা – সব মন্ত্রণালয় আমাকে নির্দেশ দিক। এবারে আপনি মনস্থির করুন।” তিনি বললেন, “ঠিক আছে, স্যাম । আপনিই অধিনায়ক এবং কেউ আপনার কাজে হস্তক্ষেপ। করবে না।” “ধন্যবাদ। এবারে আমি আপনাকে সাফল্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।” কাজেই ফিল্ড মার্শাল হওয়া ও চাকরিচ্যুত হওয়ার মধ্যে সূক্ষ্ম এক সীমারেখার অস্তিত্ব ছিল! যে কোনােটা ঘটতে পারত! এই একটা ঘটনার কথা আমি বলতে পারি এবং এটা আপনি আপনার ভাষায় বর্ণনা করতে পারেন। অন্য দুই বাহিনীপ্রধান সম্পর্কে কিছু বলুন। তাঁরা কখন এতে সংশ্লিষ্ট হন? প্রাথমিক আলােচনায় তাঁরা ছিলেন না। তাদেরকে পরে আমার ব্রিফ করতে হয়। এ সম্পর্কে। সবকিছু তাদেরকে আমার বলতে হয়।
সূত্র: কোয়ার্টারডেক, ডিরেক্টরেট অভ এক্স-সার্ভিসমেন’স অ্যাফেয়ার্স, নেভাল হেডকোয়ার্টার্স, নয়া। দিল্লী, ১৯৯৬।
সূত্র : সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম – লে জেনারেল জে এফ আর জেকব