দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য ওরা প্রস্তুত
ভবানী ঘােষ
যতদিন যাচ্ছে যুদ্ধের পরিসর ততই বাড়ছে। আর তার জন্য প্রস্তুতিও হচ্ছে ব্যাপক আকারে। তবে নেতা থেকে সৈনিক পর্যন্ত সকলেই তাদের জয় সম্বন্ধে সুনিশ্চিত। সীমানার কাছে কোনাে এক যায়গায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা করবার সুযােগ হয়েছিল, যাদের প্রায় সবাই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন দৃপ্ত কণ্ঠে আমাকে। জানালেন “জয় আমাদের হবেই। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যদের এক ফোঁটা পানি দেবার লােকও এদশে পাওয়া যাবে না”- এই একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম বনগাঁ সীমান্ত থেকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলের অধিবাসীদের কণ্ঠে। অতি সাধারণ চাষিও আজ যুদ্ধের শরিক। যারা অস্ত্র পাচ্ছেন না তারা অন্যভাবে সাহায্য করছেন মুক্তি ফৌজকে। মুক্তি সেনারা ওয়ারলেসের অভাবে সময় মতাে খােজ খবর নিতে ও দিতে পারছেন না। কিন্তু চোখে দেখলাম একদল কৃষক যুবক এই ওয়ারলেসের অভাবকে মেটানাের জন্য কী অসাধ্য সাধন করেছেন। মাত্র কয়েকটি গাড়ি। অতএব বেশিরভাগ সময়ই তাদের কাজ করতে হচ্ছে। পায়ে হেঁটে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা তখন বসে ছিলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে। এমন সময় একটি যুবক এসে সেখানে পৌছল, খবর দিল পাক সৈন্যরা পাকিস্তানের দিকে এগােচ্ছে। অতর্কিত আক্রমণ করে মুক্তি সেনাদের তিনখানি গাড়ি দখল করে নিয়েছে। ওরা দুই একজন প্রাণ হারিয়েছে। কিন্ত প্রান তুচ্ছ করেও সেই যুবকটি খবর পৌছে দিয়ে গেল নেতৃবৃন্দের কাছে। ছেলেটির যেদিন পর্যন্ত পরিচয় ছিল কেবলমাত্র চাষি হিসাবে। আজ কিন্তু সেই চাষিই হয়ে উঠেছে নির্ভিক সৈনিক। অন্য একটি ছেলের সঙ্গে দেখা হলাে, ছেলেটি হিন্দু, সে আত্মনিয়ােগ করেছে স্বাধীন বাঙলার সংগ্রামে। দুদিন আগে গুলি লেগে তার ডান হাতের বুড়াে আঙুলটি উড়ে গেছে। দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জানাল সে আমাদের কাছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানালেন যে আজ এই মুহূর্তে সব দলমতের জনসাধারণ একই সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে। লড়াই করে শত্রু হটানাে তাই বাঙলাদেশের জনগণের সামনে কোনাে সমস্যা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। সমস্যা হচ্ছে খাদ্যের সমস্যা। গােলাবরুদের সমস্যা ক্ষেতে খামারে যে শস্য রয়েছে তাকে বাঁচিয়ে তােলবার। কারণ এই যুদ্ধ চলা থামার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মুক্তিফৌজের এগিয়ে চলার পথে তাদেরকে সব রকম মদত দেবার মধ্যে। একজন ন্যাপ (ওয়ালি গ্রুপ) নেতার সঙ্গে সীমান্তে দেখা হয়েছিল। তারাও যে এই সমস্যাগুলাে গভীরভাবে চিন্তা করছেন, বোেঝা গেল তার কথাবার্তা থেকে। উনি কলেছিলেন যে, বর্তমানে তেলের অভাবে আমাদের পাম্পগুলাে অকেজো হয়ে আছে, এখুনি যদি পম্প চালু না হয় এবং মাঠে জল না দেওয়া যায় তবে সব ধান মরে যাবে। গত বছর ঝড় বন্যার পর থেকে খাদ্যের এমনই অভাব। রেশনের উপর লােকেরা নির্ভর করে আছে।
দীর্ঘ যুদ্ধ চালাতে হলে যে সমস্ত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যেই তা ভাবতে শুরু করেছেন। তবে তাদের ভরসা যে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হবে। এবং এই বর্ষণেই সমস্ত ক্লেদ ও গ্লানির মতাে তারা পাক বাহিনীকেও শেষ করতে পারবেন।
ওপার বাঙলায় এক নতুন নতুনের ছোঁয়া ওদের প্রত্যকের চোখে। বনগাঁর সীমানা পেরিয়ে ওপারে কিছুদুর এগুতেই দেখলাম একদল ছেলে রাস্তার উপর ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে’, বাঁশের লাঠি হয়েছে তাদের মেশিনগান, মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে গুলি ছোঁড়ার। কদিন আগেও কিন্তু এই খেলা ছিল তাদের কাছে অপরিচিত, শুধু মেশিনগানই নয় তারা এ কদিনের মধ্যেই নাম শিখে গেছে মর্টার, টমিগান, এল এম জি, গ্রেনেড, আরাে কত কি।
সীমানা পেরিয়ে কিছুদুর গেলেই ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর অফিস। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সহযােগিতায় কাজ করছেন ই পি আর-এর যােদ্ধারা। ওরা যে এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না সেটা ওরাই স্বীকার করে বললেন যে, এখনও সংগঠন তেমন মজবুত হয়ে পারেনি। তবে যতদিন যাচ্ছে। সংগঠন ততই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এখন রিলিফ বিলি করা, বিভিন্নস্থানে যােগাযােগ রক্ষা, এইসব গরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলাে ক্রমেই সুষ্ঠু হয়ে উঠেছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ৯ এপ্রিল ১৯৭১