You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩ই জুলাই, মঙ্গলবার, ৬ই শ্রাবণ, ১৩৮১

সীমাহীন ধৃষ্টতা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর শেষে পাকিস্তানের প্রত্যাবর্তন করার পর থেকেই সেখানকার কোন কোন পত্রিকা বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় মেতে উঠেছে। জনাব ভুট্টোর সফরের আগেও যে বাংলাদেশে বিরোধী প্রচারণা হয়নি তা নয়। রেডিও পাকিস্তান থেকেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের বিপক্ষে বক্তব্য রাখা হয়েছে। জনাব ভুট্টো বাংলাদেশ সফরের সময়ে তা কিছুটা স্তিমিত হয়–তারপর আবার শুরু হয় কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠানের সময় থেকে।
কোন দেশের কোন বিশেষ পত্রিকার যেকোনো দেশের পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এ সম্পর্কে বলার কিছু নেই। কিন্তু যখন দেখা যায় যে, সেই দেশের সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো কোন দেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তখনই প্রশ্ন জাগে। সন্দিহান হতে হয় সে দেশের সরকারের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও শুভেচ্ছার উপর। কেননা এটা তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিফলিত হয়ে ওঠে যে, পত্রিকাগুলোর মতামতের সঙ্গে সরকারের কোন অমিল বা গড়মিল নেই। সরকারও চান না যে এ ধরনের অপপ্রচার অবাধে চলুক।
পাকিস্তানের সরকার সমর্থক উর্দু দৈনিক নওয়াই-ওয়াক্ত ১লা জুলাই লিখেছেন। গত আড়াই বছরে হিন্দু শেঠ, বেনিয়া ও মাড়োয়ারিদের সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে তাদের চোখ খুলে গিয়েছে এবং এটাই পাকিস্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে।… অতীতকে ভুলে সামনের দিকে তাকাবার জন্য আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলাম কিন্তু বাংলাদেশের নেতারা এই শুভেচ্ছার প্রতিদান দিতে প্রস্তুত নন। তারা কূটনীতিক এবং বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের রাজি হননি।… জাতীয় বিবেকের উপর বোঝাস্বরুপ হলেও পরাজিত দেশকে (সে পরাজয়ের কারণ যাইই হোক) তার পরাজয়ের প্রতিফল ভুগতে হয়েছে। এই কারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় সন্নিকটে এমন এক জায়গায় শহীদ মিনারে ফুলের মালা দিতে হয়েছে যা ছিল হিন্দু এবং ভারতীয় এজেন্টদের বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল। এখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শুরু করে এবং তাতে কিছু সংখ্যক ভারতীয় এজেন্ট এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী নিহত হয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩০ লক্ষ নরনারী প্রাণ দিয়েছে। ইয়াহিয়া সরকারের নরপশু বাহিনী বাংলাদেশের বুকে যে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিল তার ইতিহাস কারো অজানা নয়। বিশ্ব বিবেক এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। একটা রক্তকে সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন বাংলার বুকে বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত। অথচ কোন দেশের সরকার সমর্থক পত্রিকায় যদি এ ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশিত হয় তখন বিক্ষুব্ধ হতে হয় বৈকি! শুধুমাত্র নওয়া-ই ওয়াক্তই নয়। পাকিস্তানের অন্যান্য পত্রিকায় যথা ‘মুসাওয়াত’ ‘মাশরিক’ ইত্যাদিতেও বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
কথায় বলে পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। পাকিস্তানি পত্রিকাসমূহ ভুলে গেছে যে, বাংলাদেশ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিনাবিচারে মুক্তি দিয়েছে। পাকিস্তান এর সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়েছে এবং তারই ফলশ্রুতি হলো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য লাহোর সফর। পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোও বাংলাদেশ সফর করেছেন। সুতরাং এমতাবস্থায় অযথা আপত্তিকর বক্তব্য পেশ করে দু’দেশের জনগণের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। আমরা আশা করব পাকিস্তানের যেসব পত্রিকাগুলো জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় মেতে সীমাহীন ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন সেগুলোর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন এটা পাকিস্তান সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলেই আমরা মনে করি।

রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে–

সাইপ্রাসকে ঘিরে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে এখন গ্রিক সাইপ্রিয়ট এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টদের মধ্যে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। গ্রীকরা সংখ্যালঘু তুর্কি সাইপ্রিয়টদের গ্রামগুলিতে ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে নির্বিচারে অসামরিক তুর্কি সাইপ্রিয়টদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যার অভিযান চালাচ্ছে। তাদের নিধনযজ্ঞের নারী-পুরুষ-শিশু, যুবা বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। গত সোমবার ১৫ জুলাই সাইপ্রাসের নব অভ্যুত্থানের পর থেকেই সেখানে চলছে এই নারকীয় লীলা।
সাইপ্রাসের রাজধানী পরিস্থিতি এখন তীব্র উত্তেজনার মধ্যে আছে। ২১শে জুলাই তুর্কি সাইপ্রাসের উত্তর উপকূলে অবতরণ করেই রাজধানী নিকোসিয়া দখল করে। এবং ২২শে জুলাই ভোরের দিকে কিরেনিয়া শহরটি দখল করে নেয়। এই সব স্থানে তুরকি সৈন্যদের সাথে গ্রিক সৈন্য ও ন্যাশনাল গার্ডদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয় বলে আঙ্কারা বেতার থেকে জানানো হয়।
ইতিমধ্যে সাইপ্রাসের ঘটনাবলীতে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ দেখা দেয়। এবং জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়সের বিরুদ্ধে গ্রীক জান্তাদের সামরিক অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা করে। জাতিসংঘ সেক্রেটারি ডক্টর কুর্ট ওয়াল্ড হেইম সাইপ্রাসের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার প্রশ্নে সাইপ্রাস পরিস্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত গ্ৰীস ও তুরস্কের প্রতি অধিকতর বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি না করার জন্য আহ্বান জানান। এমনকি মার্কিন পরিষদের সদস্য বৃন্দের পক্ষ থেকেও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সাইপ্রাস পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরনের জন্য জরুরী আহ্বান জানানো হয়। এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সাইপ্রাসের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তুরস্ক জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতির আহ্বানকে যখন তুরস্ক জাতীয় পরিষদ বিবেচনা করছে বলেও জানানো হয় তখন গ্রীক সামরিকজান্তা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তুরস্ক আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছে। এই অবস্থা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এবং সাইপ্রাসের সার্বিক অবস্থার যে অবনতি ঘটছে তার প্রমাণ হলো–ব্রিটেনের সাইপ্রাস থেকে তার নাগরিক সরিয়ে নেবার জন্য কমান্ডো সৈন্যদল পাঠিয়েছে। গত রোববার গ্রীনিচ সময় বেলা ১২ টা থেকে সাইপ্রাসের নৌ ও বিমান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঘোরালো পরিস্থিতির অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুদ্ধ নৌবহর বিমানবাহী ‘ফরেস্টাল’ সহ সাইপ্রাসের দিকে এগোচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ব্রেজনেভ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সাইপ্রাসের অবস্থা দেখে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর চোখ বন্ধ করে বসে থাকবে না। অতএব বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন এবং সাইপ্রাসবাসী আতঙ্কিত।
এ কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সাইপ্রাসের ঘটনাবলীতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের প্রত্যক্ষ হাত আছে। ইতিহাসের পাতা আমরা বারবারই দেখেছি–নির্ভরশীল দেশগুলোকে অধিকতর পঙ্গু ও নির্বাচন করে রাখার তৎপরতায় সাম্রাজ্যবাদী চক্র সচেষ্ট থাকে। কখনো সাম্প্রদায়িকতা কখনো অন্তর্ঘাতমূলক ক্রিয়া সৃষ্টি করে দেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নাজুক করে রাখে। ফলশ্রুতিতে কোন দেশ বিভক্ত হয়ে যায়–তার নজিরও আমাদের জানা আছে। এখানে দেখা যাচ্ছে গ্রিস ও তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের তালিকায় থাকা সত্বেও সাইপ্রাসের প্রশ্নে আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
এই সংগ্রামে জনগণের কোন সমর্থন নেই এমনকি তুর্কি বাহিনীর হস্তক্ষেপকেও প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়স সুনজরে দেখছেন না। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন যে, দেশটিকে দুই ভাগ করে দখলের জন্য এথেন্সের সঙ্গে চুক্তিক্রমে তুরস্ক আক্রমণ করেছে। তিনি আরো বলেন যে, ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য তুরস্কই উস্কানি দিয়েছে এবং তারপর এথেন্সেরই প্ররোচনাতে সাইপ্রাসে তুর্কি বাহিনী নেমেছে আর তারই ফলশ্রুতিতে নিরীহ সাইপ্রাস বুকের উপর সৃষ্টি হয়েছে নারকীয় রণাঙ্গন।
একথা সত্য যে, কোন যুদ্ধ বা আগ্রাসী মূলক ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিই আজ আঞ্চলিক সীমার গণ্ডিতে বদ্ধ থাকেনা। তার আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে। সারা বিশ্ব শান্তি, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই প্রেক্ষিতে সাইপ্রাসের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকি বলেই মনে করছি আমরা। সর্বোপরি সাড়ে তিন হাজার মাইল আয়তনের সাত লাখ দ্বীপবাসীর জীবন আজ ভয়ানক ভাবে বিপন্ন। কারণ রাজা রাজা যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ারই প্রাণ যায়। কিন্তু আমরা ওই পুরানো প্রবাদ বাক্যের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাইনা। জাতিসংঘসহ সকল শান্তিকামী দেশের নৈতিক চাপের দ্বারা সাইপ্রাসে শান্তি আসুক এই আমরা ঐকান্তিকভাবে কামনা করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!