You dont have javascript enabled! Please enable it! জনযুদ্ধের যোদ্ধারা - মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ (অব.), বীর বিক্রম - সংগ্রামের নোটবুক

জনযুদ্ধের যোদ্ধারা

জনযুদ্ধের যোদ্ধারা

মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ (অব.), বীর বিক্রম

একাত্তরের জনযুদ্ধের প্রধান চরিত্র। সাধারণ জনগণ। পরিস্থিতিই অনেক স্থানে ন্যাচারাল লিডার সৃষ্টি করেছে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক ও আপামর জনসাধারণ মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষে যে অতুলনীয় শৌৰ্য, দেশপ্ৰেম দেখিয়েছে, যেভাবে হেলায় জীবন উৎসর্গ করেছে, তা প্ৰত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। একাত্তর সালের মার্চ মাসে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নে (দি সিনিয়র টাইগারস) কর্মরত ছিলাম। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সারাদেশ তখন এক উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়। সীমাত্ম এলাকায় ট্রেনিং মহড়ায় নিয়োজিত থাকার কারণে দেশের চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। ২৫ মার্চে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, স্বাধীনতা ঘোষণা ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। ৩০ মার্চ ভোরে সেনাকর্তৃপক্ষ যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করারআমরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধেবিদ্রোহ ঘোষণা করি। ক্যান্টনমেন্টেই আট ঘন্টব্যাপী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধে উভয় পক্ষে বেশ কয়েকজন সৈনিক হতাহত হন। আমাদের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল রেজাউল জলিল বাঙালি ছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তিনি এ বিদ্রোহে যোগদান করেননি। বিকেলের দিকে আমরা দুইশত বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক ক্যান্টনমেন্ট থেকে তুমুল গুলিবৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এসে চৌগাছা বাজারে একত্রিত হই। এ সেনাদলে আমিই ছিলাম একমাত্র অফিসার। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’শ বিদ্রোহী সৈনিকের সঙ্গে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দেয় স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আম্রকাননে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। বাংলাদেশ সশস্ত্ৰ বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ মনোনীত হন কর্নেল এমএজি ওসমানী, গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড। কর্নেল ওসমানীর নির্দেশে আমি পাঁচশ যুবককে আমারবাতালিওনে রিক্রুট করে এটিকে সাতাশ সৈনিকের একটি পূর্ণ শক্তিমান পদাতিক ইউনিটেরূপাত্মরিত করি। এটি ছিল সত্যিকারের গণবাহিনী। সৈনিক ছাড়াও ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ড্রাইভার ও দোকানদার এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত এ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মাত্র দু’মাসের ট্রেনিং নিয়ে এরা দুঃসাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়। সমগ্র সেনাবাহিনীত এরাই সর্বোচ্চসংখ্যক বীরত্ব উপাধি অর্জন করে।

এপ্রিল মাসজুড়ে এ ব্যাটালিয়ন চৌগাছা এবং বেনাপোল সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং শত্রু নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ পল্টনকে মেঘালয়ের তেলঢালা নামক স্থানে নিয়ে আসা হয় রিক্রুটদের ট্রেনিং প্রদানের জন্য। এখানেই প্ৰথম, তৃতীয় এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সমন্বয়ে গঠিত হয় পদাতিক ব্রিগেড জেড ফোর্স, যার কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। জুলাই মাসের প্রথমার্ধে আমি কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব হস্তান্তর করি মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর কাছে।৩১ জুলাই তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানি আমার ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে কামালপুর বিওপি শত্রুঘাট আক্রমণ করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেএটাই ছিলসর্ববৃহৎপ্রথাগত আক্রমণ (Conventional Attach)।পাকবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য এ সুরক্ষিত বাঙ্কারসজ্জিত প্রতিরক্ষা বেষ্টনীতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান গ্ৰহণ করেছিল। তাদের সহায়তায় সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলো। তাদের অবস্থানের সামনে ছিল মাইনফিন্ড এবং কাঁটাতারেরবেড়া। আমাদের সহায়তার জন্য অত্যাবশ্যক ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ, কিন্তু আক্রমণকালে আমরা কোনো ফায়ার সাপোর্ট পাইনি। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কামালপুর আক্রমণ চালাই। শক্ৰ প্ৰথম থেকেই আমাদের ওপর মিডিয়াম কামানের গোলাবর্ষণ করে। মর্টারের গোলাবর্ষণ, মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে, মাইনফিল্ড পেরিয়ে প্ৰমত্ত ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবীন সৈনিকরা যেভাবে শত্রুর কয়েকটি বাঙ্কার দখল করে, সে স্মৃতি রোমন্থন করে আজো বিস্ময়ে আপুত হই। কিন্তু এ আক্রমণে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ত্ৰিশজন শহীদ এবং ছিষট্টিজন আহত হয়। ডেলটা কোম্পানি কমান্ডার জাতির গর্ব ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে শাহাদত বরণ করেন, আমি নিজেও আহত হই। এত অধিকসংখ্যক হতাহত হওয়ার কারণে আমরা শক্ৰঘাটির কিছু অংশ দখল করেও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে কোনো সুশিক্ষিত পেশাদার বাহিনীর পক্ষেও এমন সুরক্ষিত শত্রুঘাঁটি দখল করা সম্ভব নয়। একমাত্র নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজীবিত, মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিসেনার পক্ষেই কামানের সাহায্য ছাড়া এ ধরনের মৃত্যু উপত্যকায় পদচারণা করা সম্ভব।

১০ সেপ্টেম্বর আমাদের ডেলটা কোম্পানি কামালপুরের কাছে ঘাসীপুরে রক্ষণবুহ গড়ে তোলে। পাকবাহিনী তাদের সরবরাহ লাইন নিষ্কন্টক রাখার জন্য বাধ্য হয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ হানে। আক্রমণ ব্যর্থ হয়, তাদের বহু সৈনিক হতাহত হয়। আমাদের পক্ষে দুঃসাহসী যুবক ল্যান্স নায়েক ইউসুফ এবং সুবেদার মোজাম্মেল শহীদ হন।

মোজাম্মেলের ডায়েরির মধ্যে আমার একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিরকুট পাওয়া যায়। তার বাড়ি ভোলার দৌলতখান থানায়। তার শেষ অনুরোধ, যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলে তার বাড়িতে আমি যেন খবরটি পৌঁছে দিই। ২১

সেপ্টেম্বর আমাদের চার্লি কোম্পানি লে. কাইউম চৌধুরীর নেতৃত্বে রৌমারীর কোদালকাটি এলাকায় রক্ষণবুহে অবস্থান নিলে পাকবাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী এ অবস্থানের ওপর মর্টার সাপোর্ট নিয়ে আক্ৰমণ আনে। আক্রমণ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ করা হয়। শত্রুপক্ষে ৪০ জন নিহত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে তারা পশ্চাদপসরণ করে। আমাদের পক্ষে নায়েক আব্দুল হক, হাবিলদার সোবহান, মকবুল ও নায়েক আতাউর রহমানসহ জনাপাচেক আহত হন। হক ও আতাউর এলএমজি নিয়ে শক্রকে আক্রমণের জন্য সংগঠিত হওয়ার আগেই তাদের ওপর আঘাত হানায় তারা মারাতত্ত্বকভাবে বিপর্যন্ত হয়। এ আক্রমণ প্ৰতিহত করায় সৈনিকদের মনোবল দৃঢ়তর হলো।

৫ অক্টোবর কর্নেল ওসমানী আমাদের ব্যাটালিয়ন পরিদর্শনে এলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য আমাদের অভিনন্দন জানালেন। আরো জানালেন, সিলেট এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তেমন তৎপরতা নেই, ফলে পাক সরকার নির্ঝঞ্ঝাটেচা উৎপাদন ও রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা কামাচ্ছে। তাদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এবং বহির্বিশ্বে প্রচার লাভের জন্য আমাদের চা বাগান এলাকায় সামরিক তৎপরতা চালাতে হবে। নির্দেশ মোতাবেক প্ৰায় তিন মাসের আবাসস্থল তেলঢালা ক্যাম্প ছেড়ে ১ম ইস্ট বেঙ্গল যাত্ৰা করে সিলেট সীমান্তের উদ্দেশে। বিদায়ের সময় মনটা উদাস হয়ে গেল। সালাহউদ্দিন মমতাজ, সিরাজ, ইউসুফ, মোজাম্মেলসহ বহু বীর যোদ্ধাকে এখানে হারিয়েছি আমরা, কয়েকজনকে সমাহিতও করেছি পাহাড়ের ঢালে।

পুরো ব্যাটালিয়নের বিরাট কনভয় নিয়ে তিন দিনের পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করেশিলং, জোয়াই হয়ে ১২ অক্টোবর ছোট শহর আমবাসার উপকণ্ঠে পৌঁছলাম। সিলেট জেলার কমলগঞ্জের উল্টোদিকে ভারতীয় সীমান্তের কয়েক মাইল অভ্যন্তরে একটি পাহাড়ি জঙ্গলে স্থাপিত হলো আমাদের ক্যাম্প। সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন চা বাগান এলাকায় গভীর রাতে রেকি করে এলাম আমরা ।কমান্ডার-ইন-চিফ-এর এডিসি ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী আমাদের পল্টনে যোগ দেয়, তাকে চার্লি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের সামরিক অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিহারের মুর্তি নামের একটি স্থানে একটি ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেটদের এখানেই প্ৰশিক্ষণ দেয়া হয়। কমিশন লাভের পর এই ব্যাচের দু’জন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার ও আনিস আমাদের পল্টনে যোগ দেন। ১৪ অক্টোবর চার্লি কোম্পানি খাজুরী চা বাগানে রেইড করে ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে। ১৯ তারিখে দিনের বেলা আমি একটি ছোট গ্রুপ নিয়ে চম্পারায় চা বাগানে প্ৰবেশ করে মেশিন ঘরের ওপর রকেট লঞ্চার দিয়ে ফায়ার করি, কিন্তু গোলা ফাটেনি। বাধ্য হয়ে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে মেশিনের কিছু অংশ উড়িয়ে দিলাম। সিলেট অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল ইতোমধ্যে। জনগণের মনে আতাবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা তৎপরতা আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিই। শ্ৰীমঙ্গল রেলস্টেশনে পাকবাহিনীর ক্যাম্পের ওপর রেইড করার

সিদ্ধান্ত এবং আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি গ্ৰহণ করি। সীমান্ত পেরিয়ে দীর্ঘ কয়েক মাইল পথ চা বাগানের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে আমাদের। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে আগে কখনো আসিনি, চা বাগানও প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম। পাহাড়ি এলাকার চা বাগানের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনোরম, যদিও যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে সে দৃশ্য উপভোগ করার মানসিকতা আমাদের কারুর ছিল না। গেরিলা তৎপরতার জন্য চা বাগান আদর্শ এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের ফলে বহু চা বাগান অব্যবহৃত জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, জনমানবের তেমন সাড়া নেই।

বাগানের চারা গাছের গোড়ার দিকটা যথেষ্ট পরিষ্কার, শুয়ে বিশ্রাম করা কিংবা লুকিয়ে চলাফেরা করার জন্য সুবিধাজনক। এ অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য স্থানীয় গাইড প্রয়োজন হয় এবং বাগানের শ্রমিকরাই এ কাজে পটু ৷ শ্ৰীমঙ্গল যাওয়ার জন্য হরি নামে পাত্রখোলা বাগানের একজন শ্রমিককে জোগাড় করলাম। শীর্ণদেহ, কোঁকড়া চুল, বোকাসোকা চেহারা, মুখে শিশুর মতো মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরই গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে এসে শরনার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শক্ৰকবলিত এলাকায় গাইডের কাজ খুবই বিপজ্জনক। মাত্র কিছুদিন আগেই আমাদের আলফা কোম্পানির সঙ্গে গাইডের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুতনাবের নামে এক শ্রমিক শক্রির গুলিতে নিহত হয়েছে। হরিকে শ্ৰীমঙ্গলে গাইড হিসেবে যাওয়ার কথা বলতেই নির্দ্বিধায়রাজি হয়ে গেল।

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এক বিকেলে শ্ৰীমঙ্গলে রেইডের উদ্দেশে যাত্রা করলাম, সঙ্গে একটি প্লাটুন (৩৫ জন) ও ডাক্তার মুজিব। দু’টি ৩ ইঞ্চি মর্টার নিলাম। সীমান্ত পেরুনোর আগে খবর এল, হরির আসন্নপ্রসবা স্ত্রী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।ডাক্তার মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে হরিকে তার স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার এসে জানাল, হরির স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মারা গেছে, বেচারির ভাগ্যে কিছুদিন ধরে ওষুধপত্র জোটেনি। শুনে দুঃখ পেলাম। অপারেশন সম্পন্ন করার ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন হলাম, কারণ হরির সাহায্য ছাড়া বাগানের ভেতর দিয়ে শ্ৰীমঙ্গল যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার তার মানসিক অবস্থার কারণে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধও করা যাচ্ছে না। আধাঘন্টা পর হরি কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। আমি তাকে সান্তুনা দিলাম এবং শ্ৰীমঙ্গল যাওয়ার জন্য অন্য কোনো গাইড পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাস করলাম ।

চোখ মুছতে মুছতে সে জবাব দিল, ‘সাব, চিন্তা করইন্না যেন। বউ মরছে তো কিতা অইচে। আমি আফনারে লইয়া যাইমু শ্ৰীমঙ্গল।‘

এই অশিক্ষিত শ্রমিকের দৃঢ়তায় অবাক হলাম, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। তার সাহায্যে অন্ধকার রাতে চা বাগানের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা শ্ৰীমঙ্গল রেলস্টেশনে অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিয়ে ফিরে এলাম। ক্যাম্পে ফিরে এসে হরি চলে গেল অজানার উদ্দেশ্যে, আর কোনো পিছুটান নেই তার। তাকে অনুরোধ করলাম আমাদের সঙ্গে থেকে যেতে, কিন্তু কোথায় যেন চলে গেল। আর কখনো দেখা হয়নি চা বাগানের সেই কুলি’র সঙ্গে।‘তুমি কেমন আছ বন্ধু, বেঁচে আছ তো ভাই’?

হরি, চৌগাছার আলী মিয়া ড্রাইভার, বেনাপোলের তোতা এদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ কী? এরা কি জানে দেশ স্বাধীন হলে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না? কিসের নেশায় এই অশিক্ষিত গ্রামীণ কিশোর-যুবকরা জীবন বিপন্ন করে দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের সম্মুখে? মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে তেমন চেতন ছিল না,তারা কোনো তন্ত্রমন্ত্রের ধার ধারতো না। তাদের কাছে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অস্ত্ৰ তুলে নেয়া এবং জীবন উৎসর্গ করা ছিল এক নিতান্ত কর্তব্য, যা তারা হাসিমুখে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে করে গেছে। মা-বোনের আক্ৰ রক্ষার লড়াইকে তারা জ্ঞানপাপী কাপুরুষদের মতো দুই কুকুরের লড়াই বলে ভাবেনি।

এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ধলই বিওপি। এখানে পাক নিয়মিত বাহিনীর প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য দীর্ঘদিন ধরে শক্ত রক্ষণব্যুহ গড়ে তুলেছে। কামালপুরের মতো এখানেও রয়েছে কাটাতার, মাইনফিল্ড এবং কংক্রিট বাঙ্কার। পাকসেনারা জানে, রক্ষণব্যুহছেড়ে বের হলেই বিপদ, বাইরে তাদের কোনো আশ্রয়স্থল নেই, স্থানীয় জনগণ তাদের শত্রু। তাই জীবনপণ করে তাদের আমৃত্যু বাঙ্কারে লড়াই করে যেতে হবে। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুন্দরভাবে ক্যামোফ্রেজ করে গোপন রাখা হত, সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে আমাদের মল্যায়ন প্রায়ই সঠিক হতো না। ভারতীয় ৪ কোর কমান্ডার লে.জেনারেল সগৎসিং আমাদের অনুরোধ করলেন। ধলই বিওপি এলাকায় একটি আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য। তিনি সম্ভবত পাকবাহিনীর বাঙ্কারগুলোর অবস্থান এবং রক্ষণবৃহের ব্যাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন। আমরা পরিকল্পনা করলাম, চার্লি কোম্পানি বিওপির একটি অংশে আক্রমণ চালাবে। আমি ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে সীমান্তের কয়েক মাইল অভ্যন্তরে ধলইয়ের পেছনে পাত্রখোলা চা বাগান এলাকায় অবস্থান নেবো। আমার অবস্থানের উত্তরে ডেল্টা কোম্পানি পাকা সড়কের ওপর অবস্থান নেবে। আমাদের দায়িত্ব ধলই থেকে পশ্চাদপসরণরত পাকসেনাদের অ্যাম্বুশ করা এবং ধলইকে সাহায্যকারী সেনা দল থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা।

২৮ অক্টোবর। পরিকল্পনা মোতাবেক আমি ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে ধলইয়ের দু’মাইল পেছনে পাত্রখোলা চা বাগান এলাকায় প্রতিরক্ষাবৃহ স্থাপন করি। সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহবুব। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ডেল্টা কোম্পানি আমার অবস্থানের এক মাইল উত্তরে পাকা সড়কে ব্লকিং পজিশন স্থাপন করে। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে চার্লি কোম্পানি ক্যাপ্টেন নূরের নেতৃত্বে ধলই বিওপির একটি অংশে আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনী তাদের শক্ত বাঙ্কার থেকে এই আক্রমণ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ করে। এইলড়াইয়ে নায়েব সুবেদার ইব্রাহিম, ইউসুফ, হাবিলদার হবাহানসহ কয়েকজন গুরুতরআহত হন। এক পর্যায়ে শক্ৰপক্ষ চার্লি কোম্পানির ওপর পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করে। সিপাই হামিদুর রহমান একটি মেশিনগান থেকে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে শক্ৰ সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখে এবং এভাবে একটি প্লাটুনকে পিছিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। বেশ কিছু শক্রসেনা নিহত হয় তার গুলিতে, কিন্তু অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক পর্যায়ে এই তরুণ সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সর্বোচ্চ সাহসিকতার পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

পাত্রখোলায় আমরা রুদ্ধশ্বাসে ধলই থেকে বের হয়ে আসা শক্ৰ সৈন্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি,কিন্তু কারো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আমার সঙ্গে বেতার সেটসহ রয়েছেন ভারতীয় গোলন্দাজবাহিনীর ফরওয়ার্ড অবজার্ভেশন অফিসার মেজর চৌধুরী। উড়িষ্যা রাজ্যের অধিবাসী তিনি-শান্তশিষ্ট,অমায়িক ব্যক্তিত্ব। তার দায়িত্ব শক্ৰ সৈন্যের তৎপরতা দেখা গেলেই বেতার সেটে গান পজিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ম্যাপ রেফারেন্স পাঠিয়ে শক্রর ওপর কামানোর গোলা নিক্ষেপ করা। তার সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর জনা পঁচিশেকসৈনিকের একটা“ডিটাচমেন্ট” রয়েছে। আমরা সবাই দুদিন পাত্রখোলা অবস্থানে থাকার জন্য প্ৰস্তুত হয়ে এসেছি, সঙ্গে চিড়া-গুড় ইত্যাদি শুকনো খাবার ।

চার্লি কোম্পানির আক্রমণের পর বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো, আমার রক্ষণব্যুহেরসামনে কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে পাঁচজন সৈনিকসহ পাঠালাম ধলইয়ের দিকে শক্রির গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। আধাঘন্টা পর গুলির শব্দ শোনা গেল। ক্যাপ্টেন মাহবুব এগিয়ে যায় এবং দূরে কালো পোশাকধারী সৈনিক দেখতে পেয়ে একটি ব্রিজের আড়ালে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। জনাদশেক শক্র কাছে আসা মাত্র তার লাইট মেশিনগান গর্জে ওঠে এবং ছ’জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি সবাই উল্টোদিকে পালিয়ে যায়। একজন বয়স্ক সুবেদার আহত হয়ে কাতরাতে থাকে, আমাদের সৈনিকরা তাকে বহন করে পাত্রখোলায় নিয়ে আসে। আহত পাঠানের নামটি সুন্দর, গুল চমন (বাগানের ফুল)।দেখতে রোগাপটকা, মাথার চুল সব শাদা হয়ে গেছে। প্যারা মিলিটারি ইউনিট ফন্ট্রিয়ার কনেস্টবুলারির সুবেদার। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে ফাস্ট এইড দেয়া হলো। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, মাত্র কয়েকদিন আগেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আনা হয়েছে তাদের।

যুদ্ধে এটাই তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। চার্লি কোম্পানির আক্রমণকালে কামানের গোলার শব্দে তারা ভয় পেয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে এই বিপদ ডেকে এনেছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বারবার প্রাণভয়ে উর্দুতে বলছে, “জয় বাংলা, দোয়া করি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।” ঘন্টাচারেক পর তার মৃত্যু হয়। ১২ হাজার মাইল দূরে জন্ম নেওয়া পাহাড়ি ফুল সিলেটের চা বাগানে বেঘোরে ঝরে গেল! বেচারার প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। বিকেলের দিকে ডেল্টা কোম্পানির ওপর শক্রর এক কোম্পানি আক্রমণ চালায় মহাসড়কে সৃষ্ট প্রতিবন্ধক সরাবার উদ্দেশ্যে। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী বেতারে মেজর চৌধুরীর কাছে কামানের গোলা ফেলার অনুরোধ করতেই তিনি মহা উৎসাহে গান পজিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোলা ফেলতে লাগলেন। শক্রির আক্রমণ প্ৰতিহত করা হলেও, তাদের অধিনায়ক একজন ক্যাপ্টেনসহ প্ৰায় ৪০ জন হতাহত হয়। রাতে পাকসেনারা বের হয় না, কাজেই রাতটি নির্ঝঞ্ঝাটকেটে গেল।

২৯ অক্টোবর,আমার জন্মদিন। ট্রেঞ্চে বসে একথা মেজর চৌধুরীকে জানাতেই বললেন, “হ্যাপি বার্থডে ।”

“ধন্যবাদ, দোয়া করবেন জন্মদিন যেন মৃত্যুদিনে পরিণত না হয়।”—আমার জবাব। উভয়ের সম্মিলিত হাসি। দু’মুঠো চিড়া, একটু গুড় আর পাহাড়ি নালার পানি দিয়ে জন্মদিনের ব্রেকফাস্ট সারলাম দু’জনে। এক চিমটি লবণ থাকলেই এটাকে ওরস্যালাইন ব্রেকফাস্ট বলা যেতো!

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাঠ ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানি ধলই বিওপি এলাকায় কামানের সাপোর্ট নিয়ে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে এই আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর একজন মেজর ও দু’জন লেফটেন্যান্টসহ প্ৰায় ৫০ জন নিহত হন। আরো জনাষাটেক আহত হয় মারাতকভাবে ।

আমাদের কোম্পানিগুলো এবং ভারতীয় বাহিনী বেতার সেটে একই ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল। আক্রমণের শুরু থেকেই বেতারযন্ত্রের হ্যান্ডসেটে কান লাগিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কমান্ডারদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। এক পর্যায়ে কথোপকথনহচ্ছিল ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব এবং জাঠ ব্যাটালিয়নের সিও লে. কর্নেল দালালের মধ্যে। ব্রিগেড কমান্ডার রিজার্ভে রাখা দুটি জাঠ কোম্পানি নিয়ে পাক অবস্থানে আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন কমান্ডিং অফিসারকে । কিন্তু সিও এই নির্দেশ অমান্য করলেন। ইংরেজি ভাষায় তাদের বাক্যালাপ এভাবে চলছিল-

‘দালাল, তুমি দুটি কোম্পানি নিয়ে এখনই আক্রমণ চালাও”, বি. ইয়াদব।

“দুঃখিত, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দুটি কোম্পানি ইতোমধ্যেই ধংশ হয়ে গেছে। বাকি দু’কোম্পানি নিয়ে ওদের শক্ত ঘাঁটি দখল করা অসম্ভব’, লে. কর্নেল দালাল।

‘আমি তোমাকে মিলিটারি অর্ডার দিচ্ছি, আক্রমণ চালাও। অবাধ্য হলে তোমাকে কোর্ট মার্শাল করা হবে’, ইয়াদব।

“আমার পক্ষে আমার প্ৰিয় সৈনিকদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। তাদের সাফল্যের নৃত্যুনতম সম্ভাবনাও নেই। আমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত আছি, দালাল।

“তুমি ভয় পেয়েছ চিকেন। জাঠ ব্যাটালিয়নের একশ’ বছরের সাহসিকতা ও গৌরবময় ঐতিহ্য তুমি ধুলায় লুটিয়ে দিও না। ফর গড়স, সেক, আক্রমণ করো’, ইয়াদব।

‘আক্রমণ আমি নিশ্চয় করব, তবে আজ নয়। আমাকে আরো সৈন্য দিতে হবে। আমি দুঃখিত’, দালাল অনড় রইলেন।

উভয়ের কথায় যুক্তি ছিল, একদিকে অমোঘ সামরিক নির্দেশ, অপরদিকে অধীনস্থ শত শত সৈনিকের নিশ্চিত মৃত্যু। মনে দাগ কাটার মতো বিরল কথোপকথন!

দুপুরের দিকে আমার অবস্থানের সামনে বেশ দূরে শত্রু সৈন্যদের তৎপরতা দেখা গেল। আমার আন্ডার কমান্ড মেজর চৌধুরীকে গোলা ফেলার নির্দেশ দিলাম। প্রচন্ড শব্দে কয়েকটি গোলা শক্রর কাছাকাছি পড়তেই তারা রণে ভঙ্গ দিল। কামানের গোলার সাহায্যে শক্রর ওপর মরণআঘাত হানতে পারা আমার মতো পদাতিক সৈনিকের জন্য অত্যন্ত সুখকর অভিজ্ঞতা! সন্ধ্যার পর অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিন নির্দেশ দিলেন আমাদের ফিরে আসার জন্য। ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি চা বাগানের পথ ধরে গভীর রাতে ফিরে এল। আমার লিখিত সুপারিশে মেজর চৌধুরীকে ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ“বীরচক্ৰ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১ নভেম্বর। আজ আমাদের ব্যাটালিয়ন মোহনপুর সীমান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ভোরের আলো ফুটতেই আমাদের অবস্থানের ওপর দিয়ে গিয়ে দুটি ভারতীয় ব্যাটালিয়ন (জাঠ ও রাজপুতনা রাইফেলস) ধলই বিওপি এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর কামানের সহায়তা নিয়ে আক্রমণ করে। কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগৎসিং আমাদের অবস্থানে থেকে নিজে এই আক্রমণ পরিচালনা করেন।

প্রায় আট ঘণ্টা ধরে তুমুল যুদ্ধ হয়। উভয়পক্ষের কামানের গোলার শব্দে চারদিক প্ৰকম্পিত হতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী পাক অবস্থানের অর্ধেক অংশ দখল করে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পেছনে হটা পাকবাহিনী সংগঠিত হয়ে কাউন্টার অ্যাটাক করে আবার হারানো এলাকা কাজ করে নেয়। শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ভারি কামানের সংখ্যাধিক্যতার জোরে ভারতীয় বাহিনী ধলই এলাকা দখল করে এবং পাকিস্তানি বাহিনী নির্মুল হয়। ভারতীয় বাহিনী প্রশংসনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করলেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।দুদিন আগে বেতার সেটে কথোপকথনকালে ব্রিগেডিয়ার ইয়াদব কর্নেল দালালকে একশ বছরের পুরনো জাঠ ব্যাটালিয়নের কলঙ্ক বলে উল্লেখ তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছিল। এ যুদ্ধে দালাল সাহসের সঙ্গে লড়াই করে আহত হন এবং নেতৃত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদবও যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। তুমুল গোলাগুলি উপেক্ষা করে তাকে আমাদের একটি প্লাটুন আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসে। লে. জেনারেল সগৎসিং আমার প্রতিরক্ষা অবস্থানে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালোচনাকালে আমাদের সৈনিকদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ফ্লাক্স হাতে দাঁড়ানো এডিসি তাকে চা ঢেলে দিলে জেনারেল আগে ক্যাপ্টেনকে (অর্থাৎআমাকে) চা অফারকরেবলেন, “Son, you are going to be part of history”.

দুটি ব্যাটালিয়নের আক্রমণে কোর কমান্ডারের আগমনের প্রয়োজন পড়ে না। তবুও এই অভিযানে সব পদমর্যাদার অফিসারই সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভারতীয় বাহিনীর দু’জন কোম্পানি কমান্ডার নিহত এবং দু’জন আহত হন। গোলন্দাজ বাহিনীর একজন মেজরও নিহত হন এই ভয়াবহ সংঘর্ষে। সিও এবং ব্রিগেড কমান্ডারের বেতার কথোপকথনের স্মৃতি বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল। সমরবিদ্যায় একটি প্রচলিত প্ৰবাদ আছে, “সেনাবাহিনী ঐতিহ্যের ওপর ভর করে লড়াই করে।” ধলইয়ের যুদ্ধে এরই বাস্তবায়ন দেখতে পেলাম। ধলইয়ের পতনের পর আবার আমবাসায় ফিরে এলাম কিছুদিন বিশ্রামের জন্য। ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান এলেন আমাদের পল্টনে, তাকে লে. কর্নেল পদে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। তিনি জানালেন, কয়েকদিন আগে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ধামাই চা বাগান এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। তরুণ ক্যাডেট এমদাদ অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন সেখানে। যুদ্ধের প্রথম দিকে সে কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে আরেকজন ক্যাডেট মুদাচ্ছেরকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। শত্রু এলএমজি-র বাস্ট শরীরে বিদ্ধ হওয়ার পরও সে ট্রেঞ্চে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এলএমজি-কে নিস্তব্ধ করে দেয়। এই দুঃসাহসী সদাহাস্যময় যুবকের মৃত্যুতে মন বিষাদে ছেয়ে গেল।          ১১ নভেম্বর। সীমান্তের আট মাইল অভ্যন্তরে নূরজাহান চা ফ্যাক্টরি এলাকার উত্তরে পাকবাহিনীর চলাচলের পথে অ্যাম্বুশ (ফাদ) পাতলাম, সঙ্গে একটি প্লাটুন ফ্লাইং অফিসার লিয়াকত ও ডা. মুজিব। ছয় ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও শক্রির দেখা নেই, সম্ভবত আমাদের অবস্থানের খবর তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়াতেই এমনটা ঘটেছে। ফেরার পথে আমরা নূরজাহান চা ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরিয়ে দিলাম। ওই রাতেই জানলাম আগামীকাল ঈদুল ফিতর। ঈদের দিন সকালে সীমান্ত এলাকায় টিলার ওপর সারিবদ্ধভাবে ঈদের জামাতে দাঁড়ালাম আমরা অর্থাৎপুরো ব্যাটালিয়ন । ঈদগাহ বলতে চারদিকে জঙ্গলবেষ্টিত একটা অসমতল মাঠ। ঈদের পোশাকের পরিবর্তে পরনে ইউনিফরম, পাশে শুয়ে রাখা অস্ত্ৰ-স্টেন, রাইফেল ইত্যাদি। নামাজরত অবস্থায় নীরবে: অশ্রুবর্ষণ করছিল সবাই, মোনাজাতের পর কোলাকুলির সময় শুরু হলো সশব্দ ক্ৰন্দন। পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজনের কথা সবার মনে পড়ছে আজ। ফেলে আসা দিনগুলোতে পারিবারিক পরিবেশে উদযাপিত ঈদের স্মৃতি মনে জেগে উঠার কারণে এদিন কেউ অশ্রুসংবরণ করতে পারেনি। আমরা কোথায়, পরিবার কোথায়, কেউ জানে না। বিপদসংকুল বর্তমান আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সবাই বিহবল হয়ে পড়ি। যুদ্ধেক্ষেত্রে মারণাস্ত্রের ছোবলের মুখে যারা নিঃশঙ্ক নির্বিকার, সেই অসম সাহসী যোদ্ধারা শিশুর মতো কাদছে! জাতি কি এদের কথা মনে রাখবে? স্বাধীন দেশ নাকি জীবিত গেরিলা চায় না। আমরা একে অন্যকে সাস্তুনা দিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখে অপরকে বলছি, কাঁদার কি আছে? কী মুশকিল, কাঁদছিস কেন? সুবেদার ফয়েজ এসে বলল, “স্যার দুদিনের ছুটি চাই। বউ আর ছোট ছেলেটাকে বিলোনিয়াতে রেখে এসেছি অনেকদিন হলো। একটু দেখে আসি, যাব আর আসব” ।“ঠিক আছে, যাও তুমি”, জানালাম।

কৃতজ্ঞতার হাসি উপহার দিয়ে, চোখ-মুখে বিদায় নিল ফয়েজ। ২২শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ দিন মিত্রবাহিনীর ৪/৫ গোর্খা ব্যাটালিয়ন সিলেট জেলার আটগ্রাম শত্ৰুঘাট আক্রমণ করে পাকবাহিনীকে উৎখাত করে। আমার নেতৃত্বে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো কোম্পানি চারগ্রাম আক্রমণ করে দখল করে নেয়। প্রচুর গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয় এবং থাল স্কাউটের (প্যারামিলিটারি ফোর্স) কয়েকজন সৈনিকও আমাদের হাতে বন্দি হয়। ২৮শে অক্টোবর গৌরীপুরে পাকবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি আমাদের আলফা কোম্পানির ওপর আক্রমণ করে।তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। শক্রপক্ষের পঞ্চাশজন নিহত হয় এবং পঁচিশজন পাঞ্জাবি সৈনিক আলফা কোম্পানির হাতে জীবিত অবস্থায় বন্দি হয়। আমাদের আলফা কোম্পানি কমান্ডার মাহবুবুর রহমান শক্রর গোলার আঘাতে শহীদ হন। এরপর থেকে শক্ৰ সিলেট শহরের দিকে পশ্চাদপসারণ শুরু করে এবং আমরা তাদের অবস্থানকে বাইপাস করে চা বাগানের জঙ্গলাকীর্ণ পথ ধরে সিলেট শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি (Infiltration-এর মাধ্যমে)।১৩ই ডিসেম্বর আমরা সিলেট শহরে প্রবেশ করি। সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরেই এমসি কলেজের সন্নিকটে উঁচু টিলায় আমরা অবস্থান নিলে পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য আমাদের ব্রাভো কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয় এবং প্ৰায় চল্লিশজন নিহত হবার পর তারা রণে ভঙ্গ দেয়।

১৫ই ডিসেম্বর বিকেলেই তারা আতসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিনাবাধায় সিলেট শহরে প্রবেশ করে। এভাবেই সাফল্যমন্ডিত হয়। একাত্তরের জনযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায়।

রচনাকাল ১৯৯৭