বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৮শে জানুয়ারী, সোমবার, ১৯৭৪, ১৪ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
এ অবস্থা আর কতদিন চলবে?
এতোদিন ধরে থানা লুট, বাজার লুট, খাদ্য গুদাম লুট অথবা পাটের গুদামে আগুন লাগানো পর্যন্তই ছিল। এবারে দুষ্কৃতিকারীরা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে। শুধু লুটই নয় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার প্রতিও দৃষ্টি দিয়েছে ওরা।
গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে থানা-বাজার লুট। গফরগাঁও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন? শীর্ষক যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্কজনক।
সংবাদে প্রকাশ, গত শনিবার সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীরা গফরগাঁও থানার উপর আক্রমণ চালায়। পূর্বাহ্নে তারা যোগাযোগ কেটে দেয় এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে আওলিয়া নগর এবং ধলার মাঝামাঝি একটি সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। গফরগাঁওকে এভাবে রাজধানী থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে দুর্বৃত্তরা এলোপাথারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে থানার দিকে অগ্রসর হয়। থানা আক্রমণের পর দুষ্কৃতিকারীরা গফরগাঁও বাজার লুট করে। বহু লোক দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেকোনো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে গফরগাঁয়ের সর্বশেষ ঘটনাই তার প্রমাণ। প্রতিদিনই খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, থানা লুট আর বাজার লুটের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত যে সব ঘটনা ঘটেছে তার কোনো লেখাজোখা নেই।
আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। সরকারও বহুবার বলেছেন এদের শক্ত হাতে দমন করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত হয়নি কিছুই। বরং দুষ্কৃতিকারীদের অত্যাচারে গ্রাম-বাংলার মানুষ রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত। কখন যে কার জীবনে মৃত্যুর কালো ছায়া নেমে আসবে তা কেউ বলতে পারেনা। কারো জীবনের নিশ্চয়তা নেই।
গত ২৫শে জানুয়ারী বাংলার বাণীর উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এলাকাতেও কোনো আইন-শৃঙ্খলার অস্তিত্ব নেই’ বলে আলোচনা করা হয়েছে। আজ যে শুধুমাত্র একটি বিশেষ জেলা বা মহকুমা বা থানায় আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে তা নয় সারা দেশের অবস্থায়ই কম বেশী একই রকম।
গত বছরের শেষ ভাগে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্যে দেশের অন্ত প্রত্যন্তে রক্ষী বাহিনী পাঠানো হবে। কিন্তু এই রক্ষী বাহিনী বর্তমানে কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে তা আমরা জানি না। মাঝে মধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, রক্ষী বাহিনী অমুক এলাকা বা অঞ্চলে হামলা চালিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করেছেন অথবা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছেন। এ কথা সত্য যে দুষ্কৃতিকারীরা যদি কারো নামে আতঙ্কিত হয় তাহলে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় রক্ষী বাহিনীর নাম। রক্ষী বাহিনীর উপস্থিতিতে যেন সাপের মাথায় ধূলো পড়ে। আমরা এ কথাও জানি যে, দেশের গ্রামে গ্রামে রক্ষী বাহিনী পাঠানো সম্ভব নয়—এতো রক্ষী বাহিনী আমাদের নেই। তবু বিশেষ বিশেষ চিহ্নিত অঞ্চলে রক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি অবশ্য প্রয়োজন।
গফরগাঁওয়ের সর্বশেষ ঘটনা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুধাবন করা উচিত যে, এবারে দুষ্কৃতিকারীরা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে এগিয়ে এসেছে। এদের দমন করতে না পারলে জনসাধারণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়বে বৈ কমবে না। তাছাড়া সরকারও জনসাধারণের আস্থা হারিয়ে ফেলবেন।
এমতাবস্থায় সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বিধানে আরো তৎপর হওয়া। যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে সেনাবাহিনীকেও পাঠাতে হবে বিভিন্ন অঞ্চলে।
সবকথার শেষকথা হলো দুষ্কৃতিকারীদের সংখ্যা নগণ্য। তবু এদের অশুভ কর্মতৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না তার মূল কারণ হলো দেশের সাধারণ মানুষ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছেনা। এদের সমবেতভাবে দমন করার মতো উৎসাহের অভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করা তখনই সম্ভব হবে যখন দেশের সকল দেশপ্রেমিক দলগুলো সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবেন। সর্বাগ্রে তাই করাও আজ প্রয়োজন। অন্যথায় আজকে গফরগাঁও এলাকার রেলসেতু উড়েছে, থানা ও বাজার লুট হয়েছে কালকে দেখা যাবে যে, অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ পথেও হামলা শুরু হয়েছে। আর একবার যদি এ ধরনের অশুভ তৎপরতা শুরু হয় তাহলে দেশের সর্বত্র নেমে আসবে সমস্যা ও সংকটের কালো মেঘ। আজকের দিনে বাংলার প্রতিটি মানুষের মনেই একটি মাত্র প্রশ্ন ধ্বনিত হচ্ছে। আর তাহলো আমরা কি সুখে শান্তিতে ঘুমুতে পারবো না? রাতের আরাম কি আমাদের জন্যে হারাম হয়ে যাবে?
কালোবাজার কবলিত পাঠ্যপুস্তক
ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক তা-ও কালোবাজারীদের করতলগত। ফলে, রাজধানী ঢাকা শহর ছাড়া দেশের অন্যান্য বিস্তৃত অঞ্চলে বাংলাদেশ স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের প্রকাশিত বইয়ের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। একশ্রেণীর অর্থগৃনধু তথাকথিত ভুয়া পুস্তক ব্যবসায়ীদের কারচুপির বদৌলতে আজ দেশের বিভিন্ন জেলা এবং মহকুমা শহরগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের হাহাকার দেখা দিয়েছে। অথচ নতুন শিক্ষা বছর শুরু হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা এখনো পাঠ্যপুস্তকের মুখ দেখেনি। ক্লাসে গিয়ে মাস্টার মশাইরা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। অভিভাবকরা সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা জীবনের ভবিষ্যত ভাবতে গিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। টেক্সট বুক বোর্ডের নিয়মিত এজেন্টরা বই সংকটের জন্য অভিভাবক এবং ছাত্রদের কাছে অজুহাত দিচ্ছেন, কর্তৃপক্ষ বই সরবরাহ করছেন না, তাই বাজারে বই নেই। মোক্ষম জবাব। প্রতিটি নতুন শিক্ষা বছরে নতুন বইয়ের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অপরিসীম কৌতুল এবং মনে চাঞ্চল্য জাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু বইহীন ছাত্ররা শূন্যহাতে মিছিমিছি ক্লাসে গমন-নির্গমন করে কী করবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাই-বা বই ছাড়া ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষা বিতরণ করবেন কীভাবে। এ নিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিদারুণ নৈরাজ্য দেখা দেয়াটা অস্বাভাবিক নয় নিশ্চয়ই।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেলো, গোটা দেশে প্রায় একজ হাজার এজেন্ট রয়েছেন, যাদের কাজ মূলতঃ বোর্ডের প্রকাশিত বই বিক্রি করা। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছেন, নিয়োজিত এজেন্টদের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহে কোনো ক্রটি নেই। বর্তমান বছরে প্রায় তিন কোটি আশি হাজার পাঠ্যপুস্তক সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হবে। দেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যেনো বইয়ের অভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের ভোগান্তির শিকারে পরিণত হতে না হয়, সেজন্যই এই ব্যাপক ব্যবস্থা। কিন্তু তবুও কেন দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেট জেলা বোর্ড নিযুক্ত এজেন্টদের কাছে বই কিনতে গিয়ে ছাত্র এবং অভিভাবক মহলকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হচ্ছে? সত্যি বিচিত্র এই দেশ! বিচিত্র সব রীতি নীতি! ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য বই তা নিয়েও দুর্নীতি। ঢাকায় অবশ্য বইয়ের কোনো দুর্ভিক্ষ নেই, যাকে বলে বইয়ের বাজার একেবারে সয়লাব।
অভিযোগে প্রকাশ, বোর্ড নিযুক্ত এজেন্টরা তাদের নির্দিষ্ট কোটার বই তুলে, তা নির্দিষ্ট এলাকায় না পৌঁছিয়ে ঢাকার বাংলা বাজারস্থিত বই পাড়ায় তড়িঘড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। বোর্ড নিযুক্ত এজেন্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি প্রকৃত পুস্তক ব্যবসায়ী নন। এদের মধ্যে কতিপয় শিক্ষক এবং থানা পর্যায়ের অফিসাররা রাতারাতি পুস্তক ব্যবসায়ীর লেবেল গায়ে এঁটে বোর্ডের এজেন্ট নিযুক্ত হয়েছেন। তাই, বই নির্দিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া নেয়া নিয়ে তাদের কোনো শিরপীড়া না থাকাটাই যৌক্তিক। স্বাভাবিক নিয়মেই তাই এই সব দুর্নীতিবাজ পুস্তক ব্যবসায়ীরা একেবারে সহজ পন্থা হিসেবে কালোবাজারীর আশ্রয় নেয়াটাই শ্রেয়তর বলে বিবেচনা করছেন। দেশের সার্বিক ব্যবসা ক্ষেত্রে যেখানে চরম দুর্নীতির সাম্রাজ্য জাঁকিয়ে বসেছে, সেখানে পুস্তক ব্যবসায়ীরাও কি হেলায় সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে স্থির ও অচঞ্চল থাকতে পারেন?
আমরা ভাবছি, তা হলে এহেন বণিক বুদ্ধির মারপ্যাঁচে পড়ে আগামী দিনের ভবিষ্যত নাগরিক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা বিতরণের কী হবে? বোর্ড বলছেন, যথানিয়মে এজেন্টদের কাছে বই সরবরাহ করা হচ্ছে। এজেন্টরা বলছেন, না কর্তৃপক্ষ বই সরবরাহ করছেন না। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের নেপথ্যে রহস্যটা কি? রহস্যটি যে কালোবাজারী, তা আমাদের অনুমান করতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার এতোটুকু কারণ নেই।
একজন প্রতিবেদক পত্রিকান্তরে প্রকাশ করেছেন যে, জনৈক এজেন্ট বাংলা বাজারে তার ‘কোটা’র পাঠ্যপুস্তক বিক্রির সময় বোর্ডের দু’জন পরিদর্শক তাকে হাতে-নাতে পাকড়াও করেন। এবং এর ফলে ঐ পরিদর্শক দু’জনের জীবননাশের হুমকিও নাকি এসেছিল। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, এটি সংঘবদ্ধ কালোবাজারী মহল বোর্ডের বই নির্দিষ্ট স্থানে না বিক্রি করে বাংলা বাজারে কম মুনাফায় বিক্রি করে দিচ্ছে। এবং এহেন অবস্থার জন্যেই ঢাকার বাইরে পাঠ্যপুস্তকের মুখ দেখা যাচ্ছেনা। অসৎ এজেন্টদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষীয় বাস্তব ব্যবস্থা যদি জরুরী ভিত্তিতে গৃহীত না হয়, তাহলে এ বছর ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে অন্ধকার ভবিষ্যতই প্রতীক্ষা করছে বলে আমাদের অনুমিত হচ্ছে। এর একটা বিহীত করতে টেক্সট বুক বোর্ড এগিয়ে আসবেন কি?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক