You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা-আন্দোলনে সৈনিক পত্রিকা [১৯৪৮—৫২] | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩
মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ নবেম্বর। পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এবং এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার মুখপত্ররূপেই সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক আবুল কাসেম ও অন্যান্য কয়েকজন বুদ্ধিজীবী উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্ব ঢাকায় ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ নামে এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়। [ দ্রষ্টব্য : ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, অধ্যক্ষ আবুল কাসেম] এ-প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া লিখেছেন,‘….মূল ও প্রধান উদ্যোক্তা অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন।’ [ দ্রষ্টব্য : ভাষা-আন্দোলনের গোড়ার কথা]
তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সম্পাদক দায়িত্বে ছিলেন শাহেদ আলী ও এনামুল হক। পরে সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন শাহেদ আলী। দ্বিতীয় বার্ষিকী সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে মুদ্রিত রয়েছে : ‘মোঃ আবদুল গফুর কর্তৃক আমাদের প্রেস, ১৯ নং আজিমপুর, হইতে প্রকাশিত।’ সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ প্রকাশের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং এই পত্রিকার নীতি ও আদর্শ সম্পর্কে প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধে সুস্পষ্ট ও স্বার্থহীন ভাষায় বলা হয় :
‘সাধারণ মানুষের সামনে পাকিস্তান সম্বন্ধে একদিন এক রঙ্গীন স্বপ্ন তুলিয়া ধরা হইয়াছিল—কিন্তু কোনো মজবুত আদর্শের বুনিয়াদ তাদের মনে খাড়া করা হয় নাই—কারণ, নেতাদের মনেই আদর্শ সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না, এবং আজো নাই।……
ক্ষমতা হাতে পাইয়া নেতারা নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন আর দরিদ্র জনসাধারণ—ছাত্র-শিক্ষক, কিষাণ, শ্রমিক, যাদের ঐতিহাসিক কোরবানীর ফলে পাকিস্তান হাসিল হইয়াছে, নিজেদের ভবিষ্যত ভাবিয়া আজ তারা শংকিত ও সন্ত্রস্ত।–তাদের ভাত-কাপড়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দাবী এতোটুকু মিটে নাই।….ক্ষমতার গদীতে বসিয়া যারা শুধু ক্ষমতার অপব্যবহারই করিতেছেন এবং জনগণের প্রত্যেকটি দাবী দাওয়াকে পায়ের তলায় মাড়াইয়া তাদের মনোবল ভাঙিয়া দিতেছেন, তাদের ভুল শোধরাইবার দায়িত্ব নিয়াছে ‘সৈনিক’।……পাকিস্তানকে জনকয়েকের ভোগের শরাবখানা করিয়া তুলিবার জন্য যে আয়োজন চলিতেছে সৈনিত তাহা বরদাশত করিবে না, বরং জনগণের হুকুমত কায়েম করিবার জন্য অবিরাম লড়াই করিয়া যাইবে।…..চারিদিকে আজ অসহায় জনগণের অসন্তোষের আভাস পাওয়া যাইতেছে, আমাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশার কোনো সীমা নাই, শেষ নাই…..জীবনের কানায় কানায় আমাদের জমা হইয়াছে অনেক চোখের পানি।’
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র হলেও সাপ্তাহিক সৈনিক এই অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে লড়াই করার অঙ্গীকার নিয়েই আত্মপ্রকাশ করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম বাংলার ‘প্রাচীনতম পত্রিকা’ দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক ইত্তেফাদ’ তখনও কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে এবং পাকিস্তানের—বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনগণের অভাব-অভিযোগ সমস্যা-সংকট ও সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরার মতো কোনো নির্ভিক ও বলিষ্ঠ পত্র-পত্রিকা তখনো ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়নি বললেই চলে। বাস্তব কারণেই সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’কে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে জনগণের পক্ষে এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক, অনৈসলামিক ও জনবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রতী হতে হয়েছে। প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধেই ‘সৈনিক’ ঘোষণা করে :

সৈনিক পত্রিকার ডকুমেন্টস কপি :

তার কাজ হইবে : ‘সাধারণ মানুষের মনোবল অটুট রাখা, মজবুত আদর্শের বুনিয়াদ খাড়া করিয়া সেই আদর্শের পিছনে বিপ্লবী জনতাকে সমবেত করা।….সৈনিক জনগণের হইয়া লড়াই করিয়া যাইবে এবং বাঁধা বা আঘাত যে কোন দিক হইতেই আসুক, বীরের মতোন তাহার সামনা-সামনি হইবে।’

ভাষা-আন্দোলনে : আদি-পর্বে
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় ভাষা-আন্দোলন—তথা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামের সূচনা হলেও, এ-সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তা বিভাগ-পূর্বকালেই শুরু হয়। ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাশের পরবর্তী পর্যায়ে অনেক বুদ্ধিজীবী এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান প্রবন্ধও লেখেন। দেশ-বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, এ-নিয়ে রেনেসাঁ-আন্দোলনের নায়করা চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন দেশ বিভাগের বহু আগে, ১৯৪২ সালেই। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুযায়ী, পূর্ব-পাকিস্তান একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, এটা ধরে নিয়েই আমাদের বুদ্ধিজীবীরাই বিভাগ-পূর্বকালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে কলম ধরেছিলেন। পাকিস্তান-পূর্বকালেই মুজীবুর রহমান খাঁ তার ‘পাকিস্তান’ শীর্ষক গ্রন্থে, হবীবুল্লাহ বাহার ও তালেবুর রহমানের পাকিস্তান-সম্পর্কিত বইয়ে এবং ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল হক, ফররুখ আহমেদ, মাহবুব জামাল জাহেদী এবং আরও অনেকের প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা-প্রসঙ্গ আলোচিত হয়।
(দ্রষ্টব্য : ভাষা আন্দোলনের আদি-পর্ব, আবদুল হক, বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষাপ্রীতি, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ)। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে সেকালেই একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ লেখেন আবুল মনসুর আহমদ (দ্রষ্টব্য, পূর্ব পাকিস্তানের জবান, মাসিক মোহাম্মদী, কার্তিক, ১৩৫০)।
কিন্তু ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লী কনভেনশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পরিবর্তনের ফলে এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায়, বিভাগোত্তরকালে, ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সমস্যাটি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষিতেই তমদ্দুন মজলিস এবং সাপ্তাহিক সৈনিক ভাষা আন্দোলননের স্বপক্ষে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার লড়াইয়ে শরীক হয়। ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এর আত্মপ্রকাশের অনেক আগে থেকেই তমদ্দুন মজলিসের ভাষা-বিষয়ক চিন্তা ও সংগ্রামের শুরু। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকা তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এটাই সম্ভবতঃ প্রথম পুস্তিকা। এতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে প্রবন্ধ লেখেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেম। জোরালো যুক্তির অবতারণা করে প্রবন্ধকাররা এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, উর্দুর ন্যায় বাংলাও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। এই পুস্তিকায় আবুল কাসেমের প্রবন্ধে ও তমদ্দুন মজলিসের প্রস্তাবে বলা হয়।
১। বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালত ও অফিসাদির ভাষা হইবে।
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হইবে দু্’টি—বাংলা ও উর্দু।
৩। উর্দু হইবে দ্বিতীয় ভাষা। ইংরেজী হইবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। বিদেশে চাকরি ও উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষার জন্যই ইহার প্রয়োজন হইবে।
৪। শাসনকার্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাততঃ কয়েক বছরের জন্য ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কাজ চলিবে। [ দ্রষ্টব্য : পুস্তিকার প্রথম অধ্যায় ]

‘সৈনিক’-এর ভূমিকা : ৪৮-৫০
উপরোক্ত পুস্তিকায় দেশবাসীর প্রতি ভাষা আন্দোলনকে গণআন্দোলনে পরিণত করার এবং প্রত্যেককে এই আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান জানানো হয়। সে সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকার মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত আবদুল ওয়াহেদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ইনসাফ’ এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত দৈনিক ‘ইত্তেহাদ’ ভাষা আন্দোলনে বিশেষ সমর্থন জোগায়।

পত্রিকার পোস্টার কপি :

‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ পরিণত হয় ভাষা আন্দোলনের অগ্র-সৈনিকে। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিস পালন করে সক্রিয় ও গৌরবময় ভূমিকা। ১৯৪৮ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারীতে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য অধ্যাপক নূরুল হক, (প্রথম সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও তখনকার তমদ্দুন মজলিস কর্মী), অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক রেআত খাঁ, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, আজিজ আহমদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (তখনকার সাপ্তাহিক ‘ইনসাফের’ সম্পাদক), এম আবুল খায়ের, নঈমুদ্দীন, অলি আহাদ এবং আরো অনেকে যে বিবৃতি দেন, তা পরবর্তীকালে সাপ্তাহিক ‘সৈনিকে’ প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি নিম্নরুপ :
‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের নিকট আবেদন জানাইতেছি যে, তাঁহারা যেন বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আগাইয়া আসেন। আমাদের মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করিবার একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলিতেছে—তাহার বিরুদ্ধে আমাদের এখন হইতে তৎপর হওয়া অবশ্য কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখানের সংবাদপত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখনো এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবহিত বলিয়া মনে হয় না। আমরা এইদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। আমাদের মনে রাখা উচিত প্রদেশব্যাপী এক আন্দোলন গড়িয়া তোলা ছাড়া বাংলা ভাষা যথাযোগ্য স্থান পাইবে না।
আরো একটি বিষয়ে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের হিতাকাঙ্ক্ষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। সমস্ত প্রদেশব্যাপী আন্দোলন করিতে আমাদের অনেক অর্থের দরকার। বাংলা ভাষার প্রচার করিতে ইতিপূর্বেই তমদ্দুন মজলিসের অনেক আর্থিক ক্ষতি হইয়াছে। ইহা বিবেচনা করিয়া তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় পরিষদ একটি ‘বাংলা ভাষা প্রচার তহবিল’ খুলিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন।

পত্রিকার পোস্টার কপি :

এই ফান্ডে মুক্তহস্তে দান করিবার জন্য আমরা সকলের নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি। বিভিন্ন পত্রিকায় চাঁদাপ্রাপ্তির হিসাব ও চাঁদাদাতার নাম প্রকাশ করা হইবে। অর্থাদি পাঠাইবার ঠিকানা : অধ্যাপক আবুল কাসেম, ট্রেজারার, বাংলা ভাষা প্রচার তহবিল, ১৯ নং আজিমপুর রোড, ঢাকা।
১৯ নং আজিমপুর রোডই ছিল তমদ্দুন মজলিস ও সাপ্তাহিক সৈনিক-এর অফিস। বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একশ্রেণীর মানুষের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ গোড়াতেই ছিল সচেতন এবং এই পত্রিকা সংবাদ, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কবিতা, কার্টুন ইত্যাদির মধ্যেমে ১৯৪৮-৪৯ সালেই বাংলা ভাষার স্বপক্ষে এবং শাসন কর্তৃপক্ষের শোষণ-বঞ্চনানীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ১৯৪৯ সালে ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হয় ৪৮ নং কাপ্তান বাজার থেকে। ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর সংখ্যায় আবদুল গফুর (পরবর্তীকালে তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও সৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) ‘বাংলা হরফের ওপর কোন শয়তানী হামলা বরদাশত করা হইবে না’ শীর্ষক এক সংবাদ নিবন্ধে বলেন : ‘পূর্ব পাকিস্তানের তমুদ্দুনের গলা টিপিয়া মারিবার জন্য এক শয়তানী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে। বাজারে জোর গুজব, ঢাকাতে আগামী ১৪ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের যে সভা বসিবে তার একটি প্রস্তাবে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। গুজবটি সত্য হইলে, কর্তৃপক্ষকে আমরা হুঁশিয়ার করিয়া দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি। বাংলা ভাষার জন্য আরবী হরফ গ্রহণ যে কতটা অবৈজ্ঞানিক ও জাতীয় জীবনের প্রগতির পক্ষে কতটা মারাত্মক হইবে, তাহা লইয়া দেশের হিতকামী শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিদগণ সৈনিকে ও অন্যান্য পত্রিকায় ঢের আলোচনা করিয়াছে।’
উপরোক্ত সুদীর্ঘ সংবাদ-নিবন্ধ ছাড়াও ‘সংস্কৃতি হত্যার ষড়যন্ত্র’ শিরোনামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ‘সৈনিক’ হরফ বদলানোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে। তাতে বলা হয় :
‘এই সুচতুর ষড়যন্ত্রকে যে সার্থক হইতে দেওয়া হইবে না, পূর্ব বাংলার জাগ্রত জনতার পক্ষ হইতে সে কথা আজ তীব্রস্বরে ঘোষণা করিবার সময় আসিয়াছে। ভাষা আন্দোলনের বন্যায় পূর্ববঙ্গের জাগ্রত-বিক্ষুব্ধ জনমতের কাছে সরকার নতি-স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিল, একথাও স্মরণ করাইয়া দিবার প্রয়োজন আছে। লিপি পরিবর্তনের চোরাপথে সাড়ে চার কোটি লোকের মাতৃভাষাকে কতল করিবার এই পরিকল্পনাকে সহজে সফল হইতে দেওয়া হইবে, একথা মনে করিলে বিরাট ভুলই করা হইবে।’
উর্দু হরফ গ্রহণের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘সৈনিকের’ ভূমিকা এবং তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশের ছাত্র সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলে তা আন্দোলন ও প্রতিবাদের তরঙ্গ সৃষ্টি করে। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কলেজে, ফজলুল হক হল ও অন্যান্য হলে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, এবং তাতে দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলা হয় : ‘উর্দু হরফে বাংলা লিখিতে দেওয়া হইবে না।’ ব্যাপক আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে ‘পূর্ববঙ্গ সরকারের’ এক প্রেসনোটে বলা হয় :
‘ঢাকা, ১৩ই ডিসেম্বর (১৯৪৯)—পূর্ব পাক সরকারের অদ্যকার প্রকাশিত এক প্রেসনোটে বলা হয় : বাংলা ভাষা প্রচলিত বাংলা হরফে লিখা হইবে অথবা আরবী হরফে লিখা হইবে, ইহা এই প্রদেশের জনগণের স্বাধীন মতামতের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করে। প্রেসনোটটিতে আরও প্রকাশ : পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চাপাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইতেছে বলিয়া বাহিরে যে খবর রটিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়।’
কিন্তু এরপরও ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ উর্দু হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে, এবং এ-সংক্রান্ত খবর, প্রতিবেদন ও প্রতিবাদী প্রবন্ধ প্রকাশ করে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘সৈনিকের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘শিক্ষা ও বাণিজ্য সচিব জনাব ফজলুর রহমানের কাছে চট্টগ্রামের ছাত্রদের খোলা চিঠিতে বলা হয় :
‘অর্থাভাবের দোহাই দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যখন প্রাইমারী স্কুলে তালা দেওয়া হচ্ছে, তখন ৩৫,০০০/- টাকা ব্যয় করে আরবী হরফ প্রবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুনিক প্রগতিকে ধ্বংস করা কি জাতিদ্রোহিতা তথা রাষ্ট্রদোহিতা নয়?’
উল্লেখ্য, ফজলুর রহমান তখন ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও বাণিজ্যমন্ত্রী। ‘সৈনিকের’ ৯ ডিসেম্বরের (১৯৪৯) সংখ্যায় ‘ইহা কি সত্য’ শিরোনামের এক খবরে বলা হয় :
‘ইহা কি সত্য যে ভাষা কমিটির রায় প্রকাশের পূর্বেই, উর্দু হরফ চালু করিবার উদ্দেশ্যে ৩৫,০০০/-টাকা ব্যয়ে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কতকগুলো ট্রেনিং সেন্টার খুলিবার আয়োজন হইতেছে? অর্থাভাবের অজুহাত দেখাইয়া যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষালয় তালাবদ্ধ করিয়া দেওয়া হইতেছে, সেখানে এইসব অকারণ অর্থ অপব্যয় কি জঘন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়?’
বাংলার বদলে উর্দু হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালের ১৯ নবেম্বর সংখ্যা সৈনিকে প্রকাশিত হয় ‘দোপেয়াজা’র আঁকা একটি আকর্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ কার্টুন। ‘হরফ খেদা অভিযান’ ক্যাপশনে প্রকাশিত এই কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েকজন পাগড়িপরা ও টুপি মাথায় দেয়া লোক ছুরি হাতে বাংলা বর্ণমালাকে আক্রমণ করছে, এবং সেগুলো বইয়ের খোলা পাতা থেকে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। উল্লেখ্য, ‘দোপেয়াজা’ অর্থাৎ প্রবীণ শিল্পী কাজী আবুল কাসেমের আঁকা বহু সাড়া জাগানো কার্টুনই সাপ্তাহিক সৈনিকে সেকালে প্রকাশিত হয়। সৈনিকের দ্বিতীয় বার্ষিকী সংখ্যায় (১৮শে নবেম্বর, ১৯৫০) ‘হুঁশিয়ারী’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে হাসান ইকবাল (পরবর্তীকালে তিনি সৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করে) বলেন :
‘পূর্ব বাংলাকে কোণঠাসা করার এই ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান কায়েম হবার পর থেকেই করাচীর প্রতিক্রিয়াশীল মহল থেকে একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা মারফত এই ষড়যন্ত্রের শুরু করা হয়েছে। এই সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে পূর্ববঙ্গের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে প্রয়াস পেয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের বীভৎস রূপ আমরা দেখেছি : কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বাজেটে, মূলনীতি প্রস্তাবে, বাংলা হরফকে তাড়ানোর চেষ্টায়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করার বেলায়। পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক ইত্যাদি সকল দিকেই এই ষড়যন্ত্রের সুতীক্ষ্ম ছুরি চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
শুধু বাংলা হরফ বদল এবং উর্দু হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধেই নয়, আরবীকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধেও ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ ‘১৯৪৯-৫০ সালেই আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫০ সালের ২৮ মে সংখ্যায় ‘বাংলা ভাষা ও হরফ হত্যার নতুন ষড়যন্ত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় এক সুদীর্ঘ সংবাদ-প্রতিবেদন। আবদুল গফুরের লেখা এই প্রতিবেদনে বলা হয় :
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় (১৯৪৮ সালের মার্চ) বাংলাকে প্রাদেশিক অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ ও কেন্দ্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে সুপারিশের যে ওয়াদা (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন সাহেব কর্তৃক স্বাক্ষরিত ওয়াদাপত্রে) প্রাদেশিক সরকার করেছিলেন সে ওয়াদাও ভঙ্গ করবার প্রবৃত্তি বর্তমান সরকারের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। শোনা যাচ্ছে—উর্দুকে পূর্ববঙ্গের অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে চালানোর পথ সাফ করার উদ্দেশ্যে, চিঠি-পত্রাদি যথাসম্ভব উর্দুতে আদান-প্রদানের সিদ্ধান্তও নাকি ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে।
…..কিন্তু এই সংস্কৃতি হত্যার চক্রান্তের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের সুস্পষ্ট জনমত ও অন্তর্দাহী বিক্ষোভের খবর কর্তৃপক্ষ রাখেন।’

সৈনিকের ভূমিকা : ’৫০—৫২
১৯৫০—৫১ সালের দিকে ‘সৈনিক’-এর সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন আবদুল গফুর। গোড়া থেকেই যে তিনি তমদ্দুন মজলিস ও সৈনিক-সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন, তা পূর্ববর্তী আলোচনা এবং তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকে স্পষ্ট। পরবর্তী পর্যায়েও সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে আন্দোলনে একাত্ম ও সোচ্চার। ১৯৫২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী সংখ্যা ‘সৈনিকে’ প্রকাশিত ‘উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিবার চক্রান্তকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে : নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতায় প্রদেশব্যাপী বিক্ষোভ’ শিরোনামের খবর বলা হয় :
‘গত ২৭শে জানুয়ারী তারিখে ঢাকা পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন—‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে একমাত্র উর্দু—এবং ‘উর্দু হরফে বাংলা লিখনের চেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হইতেছে’—বলিয়া যে উক্তি করেন, তার বিরুদ্ধে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ শুরু হইয়াছে।’
‘নাজিমুদ্দীনের বিবৃতির প্রতিবাদ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের ঢাকা শহরকেন্দ্রের আহ্বায়ক মিঃ মাহফুজুল হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মরহুম ডক্টর মাহফুজুল হক) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক মিঃ শাহাবুদ্দীন খালেদ সংবাদপত্রে যে যুগ্ম-বিবৃতি দেন তাও ঐ সংখ্যা সৈনিকে প্রকাশিত হয়। নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়, তার বিবরণ দিতে গিয়ে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর উক্ত সংখ্যায় লেখা হয় :
‘২৯শে তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা হয়। ৩০ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ প্রতীক ধর্মঘট পালন করেন এবং বিভিন্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রদের সহযোগে এক বিরাট শোভাযাত্রা বাহির করিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ৩১ তারিখে নাজিমুদ্দীনের ভাষা সম্পর্কিত ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে পূর্ব-পাক মুসলিম ছাত্র লীগের উদ্যোগে বার লাইব্রেরী হলে আহুত এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পূর্ব-পাক ছাত্র লীগ, আওয়ামী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, নিখিল পূর্ব-পাক ছাত্র লীগ, যুব লীগ, ইসলামী ভ্রাতৃ-সংঘ, প্রভৃতি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ জন প্রতিনিধি সমবায়ে একটি ‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। জনাব কাজী গোলাম মাহবুব এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। সর্বদলীয় সভায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা ও কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য খাজা নাজিমুদ্দীন বিগত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় (১৯৪৮ সালের মার্চ) আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন তাহা ভঙ্গ করিবার জন্য তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয় এবং অবিলম্বে তাঁহার ভাষা সম্পর্কিত উক্তি প্রত্যাহার করিয়া বাংলাদেশকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করিয়া লইবার দাবী জানানো হয়। উর্দু হরফে বাংলা লিখিবার চক্রান্তের বিরুদ্ধেও এক প্রস্তাবে সরকারকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হয়। অপর দুই প্রস্তাবে—শেখ মুজিবরের আশু মুক্তির দাবী এবং ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান।’ [ দ্রষ্টব্য, সৈনিক, ৩রা ফেব্রুয়ারী, ’৫২ ]
১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী সংখ্যা ‘সৈনিকে’ সংবাদ-প্রতিবেদনে বলা হয় :
‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-আওয়াজ : ৪ ফেব্রুয়ারী। ধর্মঘট পালন : ঢাকায় দশ সহস্র ছাত্র-ছাত্রীর মিলিত মিছিল।’ আলোচন্য খবরে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলা হয় :
‘উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আরবী অক্ষরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সকল স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীগণ ধর্মঘট পালন করেন। বেলা ১১টা হইতে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রাসহকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়।’
একই সংখ্যায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ বলে :
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে। এই সমস্ত তর্ক-বিতর্ক হতে দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না, এবং পাকিস্তানের বৃহত্তর জনসমষ্টি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে চায়। বিগত ভাষা আন্দোলনের (১৯৪৮ সালের মার্চ) মাধ্যমে যে দুর্জয় জনমত আত্মপ্রকাশ করে আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে থর থর করে কাঁপিয়ে তুলেছিল—তাতে উপরি-উক্ত অভিমত অত্যন্ত স্পষ্ট করে ধরা দিয়েছিল। সে দুর্জয় গণআন্দোলনের জোয়ারে আজকের পাক উজিরে আজম জনাব নাজিমুদ্দীন বাংলাকে কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সুপারিশ করতে জাগত্র জনতাকে ওয়াদা দিয়েছিলেন।
তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী জনাব নাজিমুদ্দীন বর্তমান পাক উজিরে আজম। ১৯৪৮ সালের সেই ওয়াদাকে তিনি আজ হয়তো ইচ্ছে করেই ভুলে গেছেন। তাই যে ঢাকার বুকে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ওয়াদা দিয়েছিলেন সেই ঢাকাতেই তিনি ঘোষণা করেন : একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। ওয়াদা ভঙ্গ করা লীগ নেতাদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। আজ জনাব নাজিমুদ্দীনও নতুন করে ওয়াদা ভঙ্গ করে পূর্ববঙ্গের জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নতুন নজীর স্থাপন করলেন।
কিন্তু জাগ্রত জনতা এই বিশ্বাসঘাতকতার সমুচিত জওয়াব দেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে নতুন করে দিকে দিকে আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে। আমরা এই গণআন্দোলনকে মোবারকবাদ জানাই’ [ রাষ্ট্রভাষা, ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ সংখ্যা দ্রষ্টব্য ]
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে যে আন্দোলন সূচিত হয়, ঢাকায় ধর্মঘট, মিছিল ইত্যাদি চলে, তাতেও তমদ্দুন মজলিস পালন করে অন্যতম অগ্রণীর ভূমিকা।

পত্রিকার ফটো কপি :

এই আন্দোলনের ফলেই, সরকার ভাষা আন্দোলনের দাবী মেনে নিতে রাজি হয় এবং প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে ‘সংগ্রাম পরিষদের’ দু’বার বৈঠক অনুষ্ঠানের পর সংগ্রাম পরিষদ ও সরকারের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এ প্রসঙ্গে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ পুস্তিকায় অধ্যাপক আবুল কাসেম লিখেছেন,
‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের সাথে সংগ্রাম পরিষদের দুইটি বৈঠক হয়। বহু বাদ-প্রতিবাদের পর নাজিমুদ্দীন সরকার ও সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ :
১। বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম ও আদালতের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিতে হইবে।
২। বাংলাকে কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে প্রস্তাব পাশ করিয়া গণপরিষদে পাঠানো হইবে।
৩। ভাষা আন্দোলনের সময় ধৃত সমস্ত ছাত্র ও অন্যান্য নাগরিকদের বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হইবে।
৪। আন্দোলনে জড়িত কোন ছাত্র বা কর্মচারীকে কোন রকম শাস্তি দেওয়া চলিবে না।
৫। ভাষা আন্দোলনের সময় যে যে পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হইয়াছিল তাহা অবিলম্বে উঠাইয়া লওয়া হইবে।
৬। চুক্তির প্রথম ধারাকে কার্যকরী করার জন্য অবিলম্বে আইন পরিষদে প্রস্তাবানুসারে পাশ করাইয়া লইতে হইবে। এবং এজন্য একটি ভাষা কমিটি গঠন করিতে হইবে।
উপরোক্ত চুক্তিতে একপক্ষে স্বাক্ষর করেন খাজা নাজিমুদ্দীন এবং অন্যপক্ষে ‘সংগ্রাম পরিষদ।’ অধ্যাপক আবুল কাসেম, বদরুদ্দীন উমর, এবং অন্যান্যদের লেখা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক যুব লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ এবং ছাত্র ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র সংসদের সমবায়ে। পরবর্তীকালে চুক্তির শর্ত খেলা করে খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের গোড়ায় যে বক্তৃতা দেন, তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সূচিত হয় উপরোক্ত জোরালো সম্পাদকীয় নিবন্ধ। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ‘দৈনিক আজাদ’ ছিল কলকাতায়। উল্লেখ্য, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ বলে যে ঘোষণা দেন, সে সময়ে ‘সৈনিক’ আত্মপ্রকাশ করেনি। তবে, কলকাতায় থাকলেও, ‘দৈনিক আজাদ’ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়েই এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়কে অভিনন্দিত করে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন :
‘জনমতের জয় হইয়াছে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ জাগিয়া উঠিয়াছিল পূর্ববঙ্গ গভর্নমেন্ট তা অকুন্ঠচিত্তে মানিয়া লইয়াছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ প্রভূত শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আন্দোলনের কর্মসূচীতে আমরা বিশেষ করিয়া তাহাদিগকে অভিনন্দন জানাইতেছি।’ [ মোবারকবাদ, দৈনিক আজাদ, ১৭ই মার্চ, ১৯৪৮ ]
কিন্তু জনমতের এই ‘জয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের কারসাজিতে পরবর্তীকালে বানচাল হয়ে যায়। এবং ১৯৫২ সালে পুনরায় ব্যাপক ভাষা আন্দোলন সূচিত হয়। এবং পরিণামে এই আন্দোলন ব্যাপকতা পায়, ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় সংঘটিত হয় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের শোকাবহ ঘটনা।’
১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারীর শোকাবহ ঘটনার সময় পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমীন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় যেমন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ও তেমনি তমদ্দুন মজলিস পালন করে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। ১৯৪৮ সালের ১৪ নবেম্বর আত্মপ্রকাশের সময় থেকে শুরু করে, পরবর্তীকালে তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে কিভাবে লড়াই করেছে, উপরোক্ত আলোচনা থেকেই তা স্পষ্ট হবে। বায়ান্নের ২১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের এবং কয়েকজনের শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর, ২৩ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর ‘শহীদ সংখ্যা।’ লাল কালিতে ও লাল বর্ডার দিয়ে প্রকাশিত এই সংখ্যায় খবরের শিরোনামগুলি ছিল নিম্নরূপ :
১। শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত : মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণ : বৃহস্পতিবারেই ৭ জন নিহত : ৩ শতাধিক আহত : ৬২ জন গ্রেফতার : শুক্রবারেও বহুসংখ্যক লোক হতাহত। রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার শপথ বিঘোষিত।
২। আপনার রক্ত দিন
৩। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিবাদ
৪। ৭ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত
৫। রক্তাক্ত ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূর্ণ বিবরণ
পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদনের শিরোনাম :
১। রক্ত-রাঙা দিন
২। পুলিশের নৃশংস গুলিতে যাঁরা শহীদ হয়েছেন
৩। যারা সংগ্রাম করেছে
৪। শহরে কারফিউ
উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের সচিত্র জীবন-পরিচিতি ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হয়, এবং তা রচনা করেন হেদায়েতুল ইসলাম খান। পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় মুদ্রিত খবর ও প্রতিবেদনের শিরোনাম :
১। রক্তাক্ত ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রতিক্রিয়ায় শহরময় দাবানল
২। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পদত্যাগের সম্ভাবনা
৩। বিক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক মর্নিং নিউজ অফিস ভস্মীভূত
৪। প্রতিবাদে বেতার শিল্পীদের ধর্মঘট
৫। নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালন
৬। কুমিল্লায় ছাত্রদের শোভাযাত্রা
৭। লালবাগ থানায়
৮। চট্টগ্রামে হরতাল ও জনসভা

৪র্থ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত খবর ও প্রতিবেদনের শিরোনাম :
১। গতকল্য ২২শে ফেব্রুয়ারীতে আবার নির্বিচারে গুলিবর্ষণ : ত্রিশ হাজার জনতার মিলিত মিছিল : মেডিক্যাল কলেজে গায়েবী জানাজা
২। শহীদদের আত্মার উদ্দেশ্যে : ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না এলায়হে রাজেউন : সাড়ে চার কোটি মানুষের মাতৃভাষা দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যাঁরা শহীদ হলেন—আল্লাহ তাঁদের রুহের ওপর শান্তিবর্ষণ করুন।
সাপ্তাহিক ‘সৈনিকের’ আলোচ্য ‘শহীদ সংখ্যা’র প্রচার এত বেড়ে যায় যে, সংখ্যাটি ‘প্রথম পর্যায়’, ‘দ্বিতীয় পর্যায়’, ‘তৃতীয় পর্যায়’ হিসাবে তিনবার মুদ্রিত হয় এবং প্রতি পর্যায়েই সংযোজিত হয় নতুন নতুন খবর ও প্রতিবেদন। যেমন :
১। ২৩ ফেব্রুয়ারীতেও লাঠিচার্জ
২। শেষ সংবাদ
‘সৈনিক’-এর আলোচ্য সংখ্যার বিপুল কাটতি ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ঐ সংখ্যার ‘তৃতীয় পর্যায়ে’ সৈনিক সম্বন্ধে বলা হয় :
‘২৩শে ফেব্রুয়ারী সকালে ‘সৈনিকের’ বিশেষ সংখ্যা বাহির হইলে মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যে ঢাকাতেই সৈনিকের হাজার হাজার কপি নিঃশেষ হইয়া যায়। জনতার উপর্যুপরি অনুরোধে আমরা দুপুরে ‘বিশেষ সংখ্যা’র ২য় পর্যায় প্রকাশ করি। কিন্তু তাহাও নিঃশেষ হইয়া যায়। জনতা এবং হকাররা আবারও অফিসে হামলা করিতে শুরু করায় আমরা একইদিনে আবার এই তৃতীয় পর্যায় বাহির করিতে বাধ্য হইলাম।–সম্পাদক।
‘সৈনিকের’ আলোচন্য সংখ্যায় ‘রক্ত-রাঙা দিন’ শিরোনামের সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় :

এ রক্ত-রাঙা দিনে স্মরণ করি
তাদেরে
যারা—
ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামে
শহীদ হইয়াছে!
আর ধ্বংস কামনা করি
সে-সব স্বার্থপর জালিমের
যারা শাসনতন্ত্র হাতে নিয়া—
পাকিস্তানকে ধ্বংসের ও বিশৃংখলার মুখে
ঠেলিয়া নিয়া চলিয়াছে।

‘যারা সংগ্রাম করেছে’ শিরোনামে দ্বিতীয় সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় :
‘বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, ইকবাল হল, মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সলিমুল্লাহ কলেজ, ইডেন কলেজ এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজের ছাত্ররা—যারা এই ন্যায়ের লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের মোবারকবাদ।
মহান পাকিস্তান সংগ্রামে ছাত্ররাই অগ্রফৌজ ছিল। আর আজো জনগণের দাবী—বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে ছাত্ররাই পুরোধায় থেকে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ২য় দিনে জনসাধারণও বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছে।’
বায়ান্নের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারীর শোকাবহ ঘটনার পর থেকেই ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ খবর, প্রতিবেদন, সংবাদ-নিবন্ধ, উপ-সম্পাদকীয়, সম্পাদকীয় এবং কবিতা-গান, কার্টুন ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন ও এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে লড়াই করতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২রা মার্চ ও পরবর্তীকালে প্রকাশিত কয়েকটি খবর ও সংবাদ প্রতিবেদন থেকেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে :
১। এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রাবাস সলিমুল্লাহ হল এবং মেডিক্যাল হোস্টেলে মিলিটারী ও পুলিশের হানা : পুলিশ কর্তৃক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ধূলিস্মাৎ : সরকারই স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবনের প্রতিবন্ধক : চারিদিকে ব্যাপক ধর-পাকড় এবং তল্লাশীতে সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্ত : রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দেশের সর্বত্র শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে দিকে দিকে তুমুল গণআন্দোলন :
২। ঢাকায় নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র এবং জনতার ওপর অমানুষিকভাবে গুলি চালনার প্রতিক্রিয়ায় দিকে দিকে গণ-দাবানল : নুরুল আমীন মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী : রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী : খুনীদের শাস্তি দাবী : ভাষা আন্দোলনে আটক বন্দীদের মুক্তি দাবী।
ভাষা আন্দোলন ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ‘সৈনিকের’ এই ভূমিকা পালন অব্যাহতভাবেই চলে এবং তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র এই পত্রিকা পরিণত হয় লড়াইয়ের অগ্র-সৈনিকে। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগ সরকারের তালবাহানা এবং বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘সৈনিক’ ১৯৪৮ সাল থেকেই সোচ্চার ছিল। বায়ান্নের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন এবং শহীদদের আত্মদানের পরও ‘সৈনিক’ এইই ভূমিকা পালন করে, যে-কোন ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ১৯৫২ সালে ১৩ই এপ্রিল ‘সৈনিক’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ-প্রতিবেদন শিরোনাম :
‘গণ-দাবীর প্রতি লীগ মন্ত্রীসভার জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা : রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত : নুরুল আমীন, ফজলুল হক প্রভৃতি নেতাদের স্বরূপ উদঘাটন।
১৯৫২ সালের ৪ মে ‘সৈনিকে’ প্রকাশিত সংবাদ-প্রতিবেদনের শিরোনাম :
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ওয়াদা গ্রহণ : বার লাইব্রেরী হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সম্মেলনে বিভিন্ন জেলার কর্মিপরিষদের সম্মেলনে বিভিন্ন জেলার কর্মিবৃন্দের সম্মিলিত ঘোষণা।’

আলোচ্য সংবাদ-প্রতিবেদনে বলা হয় :
‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আজ জাগ্রত। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে তারা জগৎকে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমগ্র জাতির ন্যায্য দাবী কোন স্বৈরাচারী সরকারই কোন হিংস্র উপায় অবলম্বনে দাবিয়ে রাখতে পারে না। জীবন দিয়ে যে জাতি তার দাবীর সত্যতা ও পবিত্রতা প্রমাণ করেছে, সে দাবীকে অগ্রাহ্য করবার সাধ্য কারো নেই।’

১৯৫২ সালের ১৮ মে প্রকাশিত সংবাদ-প্রতিবেদনের শিরোনাম : ‘দিকে দিকে আওয়াজ তুলুন : ভাষার লড়াইয়ে আটক বন্দীদের মুক্তি চাই।’
বস্তুতঃ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতিদানের দাবীতে ‘সৈনিক’ সর্বদাই ছিল সোচ্চার এবং সংগ্রামী। ১৯৫১—৫২ সালের দিকে তমদ্দুন মজলিস ও সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ বর্তমান লেখকের ঘটেছিল। অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, হাসান ইকবাল, সানাউল্লাহ নূরী, মফিজউদ্দিন আহমদ (ডক্টর), হাসান জামান (ডক্টর), মাহফুজুল হক, অধ্যাপক আসকার ইবনে শাইখ, হেদায়েতুল ইসলাম খান (ডক্টর), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী, কবিরউদ্দিন আহমদ (ডক্টর), মোজাফফর আহমদ (ডক্টর), আবু হেনা মোস্তফা কামাল, চৌধুরী লুৎফর রহমান এবং আরও অনেকেই তমদ্দুন মজলিস ও ‘সৈনিকের’ সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ প্রসঙ্গে ১৯৫২ সালের ২৫ মে সংখ্যা ‘সৈনিকে’ বদরুদ্দীন উমর লেখেন,
‘পাকিস্তানের বর্তমানের শাসকগোষ্ঠী যেমন একদিকে গণস্বার্থকে পদদলিত করিয়া শ্রেণী স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হইয়া আছে ঠিক সেইভাবেই পাকিস্তানের জনসাধারণও আজ তাহাদের ন্যায্য দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের বিভিন্নমুখী ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়াই সচেতন হইয়া উঠিতেছে। সেই জন্য একদিকে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি যেমন তাহাদের অপরাপর নীতি হইতে কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়, ঠিক অপরদিকে তেমনি এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়া মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহাও জনগণের সাধারণ বিক্ষোভ বিরক্তি হইতে কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়।…..ভাষার আন্দোলন বঙ্গভাষীর মাতৃভাষার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত দরদেরই অকুন্ঠ অভিব্যক্তি। এই আন্দোলন দেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে স্বতঃস্ফূর্থ সমর্থন লাভ করিয়া যে বিরাট বিপ্লবী চেতনার পরিচয় দিয়াছে তাহাই প্রমাণ করে যে পাকিস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর যথার্থ রূপ তাহাদের মনেও দাগ কাটিয়াছে।’
ভাষা সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে অনেক প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, কবিতা, গান ইত্যাদিই সাপ্তাহিক ‘সৈনিকে’ প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিসের যাঁরা সদস্য ছিলেন, তাঁরা তো লিখতেনই যাঁরা সদস্য ছিলেন না, তারাও অনেকেই এই পত্রিকায় লিখেছেন। বস্তুতঃ দল-মতনির্বিশেষ বহু লেখক-সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীই ছিলেন এই পত্রিকার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীকালেও সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, কবিতা, গান, কার্টুন ইত্যাদি সাড়া জাগায়। অনেক ছদ্মনামী রচনা ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফররুখ আহমদ, আবদুর রশীদ খান এবং আরও অনেক কবির বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখা কবিতা ‘সৈনিকে’ প্রকাশিত হয়। প্রজেশ কুমার রায়, আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী প্রমুখের অনেক ব্যাঙ্গাত্মক কবিতাও এই পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময়, মফিজউদ্দিন আহমদ ‘উমর উম্মিয়া’ ছদ্মনামে এবং ‘আজব ভুঁড়ি’ শিরোনাম দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতায় যে প্যারডী লেখেন, তা হয়েছিল, খুবই জনপ্রিয়। ‘দোপেয়াজা’র (শিল্পী আবদুল কাসেম অঙ্কিত) কার্টুনও ছিল ‘সৈনিকের’ জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
এই জনপ্রিয় পত্রিকাটির পুরনো কপিও একালে দুর্লভ ১৯৪৯, ’৫০-৫২, ’৫৩-৫৪ সালের কিছু দুষ্প্রাপ্য কপির ভিত্তিতে বর্তমান নিবন্ধটি রচিত। বাস্তব-কারণেই, তমদ্দুন মজলিস ও ‘সৈনিক’-এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব লেখকের নাম এবং তাঁদের রচনার উল্লেখ সম্ভব হয়নি।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!