You dont have javascript enabled! Please enable it!

দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-’৪৮) | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩
মেসবাহ কামাল/আহমেদ কামাল

তেভাগা কি?
বৃটিশ শাসনের প্রতি অনুগত যে ভূ-স্বামী শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তারা ছিলেন তাদের জমিদারী থেকে বিচ্ছিন্ন—বেশিরভাগই নগরপ্রবাসী তাদের জমি-জমার ব্যবস্থাপনা করতেন তাদের এজেন্টরা। এদের পাশাপাশি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অত্যল্পকালের মধ্যে জোতদার নামের এক নতুন শ্রেণীর ভূ-স্বামীর উদ্ভব হয়। বুকানন-হ্যামিল্টনের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যেই দিনাজপুরের জোতদারী প্রথা বিকশিত হয়েছিল। এরা বসবাস করতেন নিজ নিজ এলাকায় এবং এদের জীবন চলতো আধিয়ারদের খাজনায়। এরা বন্দোবস্ত নেয়া জমি খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত দিতেন প্রজাদের। জমির ওপর চাষীর কোন রকম অধিকার ছিল না এবং চাষের সমস্ত খরচ বহনের পরও ফসলের ৫০ শতাংশ তাকে খাজনা হিসেবে তুলে দিতে হতো ভূ-স্বামীর হাতে; সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্কের অংশ বিশেষ এই প্রথা উত্তরবঙ্গে আধি, পশ্চিমবঙ্গে বর্গা, বীরভূমে কিসানী আর ময়মনসিংহে ‘টঙ্ক’ নামে পরিচিত ছিল। তেভাগা আন্দোলন ছিল ফসলের অর্ধাংশের বদলে দুই-তৃতীয়াংশ লাভের জন্য ভাগ-চাষীদের আন্দোলন। অর্থনীতির পরিভাষায় বলতে গেলে এটা ছিল ভূ-স্বামীকে দেয় খাজনার পরিমাণ অর্ধাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার জন্য ভাগ-চাষীদের সংগ্রাম।

তেভাগার স্বরূপ : যেকোন কৃষক আন্দোলন তাতে অংশগ্রহণকারীদের চেতনার মানকে প্রতিফলিত করে। বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন ধারণ করেছিল এক উন্নত স্তরের চেতনাকে। কোন শোষণ বা অত্যাচারের ঘটনায় কোন ব্যক্তি অসংগঠিত অসহায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করার মাধ্যমে যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ (রবিনহুডের Social Banditry বা রঘু ডাকাতের কাহিনী) ঘটান, তা হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের চেতনা। দ্বিতীয় স্তরের চেতনার প্রতিফলন হিসাবে খাজনা হ্রাস বা বেআইনী অর্থ আদায় বন্ধের জন্য সংগঠিত কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত তা থেকে উৎসারিত উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয় কোন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বা ‘অলৌকিক ক্ষমতার’ অধিকারী কোন নেতার নেতৃত্বে এবং প্রায়শঃই ধর্মীয় আবরণে—যেমন ‘ফকির বিদ্রোহ’ বা ‘ফারায়েজী আন্দোলন।’ তৃতীয় বা সর্বোচ্চ স্তরে এই চেতনা একটি রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে এবং সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের একটি পার্টির নেতৃত্বে সমাজের অপরাপর শোষিত শ্রেণীর (প্রলেতারিয়েত ও শহুরে পেটি-বুর্জোয়া) সহযোগে বিত্তশালী কৃষকসহ সকল শোষকের উচ্ছেদ সাধন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তথা উৎপাদনের উপকরণের ওপর যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়। এই স্তরেও ব্যাপক কৃষককের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অর্থনেতিক অবস্থা উন্নয়নের আশু কর্মসূচী থাকে—কিন্তু এটা কেবল একটি কৌশল হিসাবেই নেয়া হয়—প্রকৃত লক্ষ্য থাকে সুদূরপ্রসারী।
(১) তেভাগা আন্দোলন ধারণ করেছিল এই তৃতীয় তথা সর্বোচ্চ স্তরের চেতনাকে। এ আন্দোলন জমির ওপর কৃষকের মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল না নিঃসন্দেহে, বরং এটা ছিল খাজনা কমানোর একটি অর্থনীতিবাদী আন্দোলন। কিন্তু বিকশিত পর্যায়ে এই আন্দোলন একটি শ্রেণী সংগ্রামের চরিত্র অর্জনের পথে অগ্রসর হয়।
তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ১৯টি জেলায়—দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বগুড়া, চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, বাকুড়া, বীরভূম, মালদহ এবং জলপাইগুড়িতে। কিন্তু দিনাজপুরে এই আন্দোলন ব্যাপ্তি লাভ করেছিল সর্বাধিক—জেলার মোট বত্রিশটি থানার মধ্যে (জলপাইগুড়ির যে চারটি থানা দেশ বিভাগের পর দিনাজপুরে পড়ে এর মধ্যে তাও অন্তর্ভূক্ত) ২৬টিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ‘তেভাগা আন্দোলন চলাকালে মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়েছিল ২২ বার, নারী ধর্ষণ করেছিল চব্বিশ পরগনা, রংপুর, দিনাজপুর, মেদিনীপুর ও ময়মনসিংহ জেলায়। বিভিন্ন জেলায় বিস্তর পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছিল, তার মধ্যে দিনাজপুরেই ৩৫টি।’ ‘মোট ৭০ জনের বেশি কৃষক—হিন্দু, মুসলমান ও আদিবাসী পুরুষ ও নারী—প্রধানতঃ পুলিশের গুলিতে এবং জোতদারের গুলিতেও নিহত হলেন এই আন্দোলনে। এর মধ্যে দিনাজপুরেই শহীদ হলেন ৪০ জন কৃষক।’ (২)

তেভাগা দাবীর জাতীয় প্রেক্ষাপট :
প্রাদেশিক কৃষক সভার পরিকল্পনা অনুযায় তেভাগার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে এবং দিনাজপুর জেলার আটওয়ারী থানার অন্তর্গত রামপুর গ্রামে কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু। তবে এর আগে ত্রিশ দশকের গোড়ার দিকে, যশোরের আধিয়ারদের সংগঠিত করে তেভাগার জন্য দাবী তুলেছিলেন সৈয়দ নওশের আলী। তিনি ছিলেন মুসলমান, অন্যদিকে এলাকার বেশিভাগ জোতদাররা ছিলেন হিন্দু। যার ফলে ‘সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা’ হিসাবে হিসাবে চিহ্নিত করে আন্দোলনটিকে সহজেই দমিয়ে ফেলা হয়।
১৯২৯-এর সর্বগ্রাসী মহামন্দা বাংলার কৃষি ব্যবস্থাকেও আঘাত করেছিল। কৃষক সমাজ এসে পড়েছিলেন ধ্বংসের মুখে। ঋণে আকন্ঠ নিমজ্জিত কৃষকদের পক্ষে খাজনা দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর খাজনার অনাদায়ে জমিদারী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষের মুখে বৃটিশ রাজ ভূমি সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮-এর নবেম্বরে গঠিত হয় ভূমি রাজস্ব কমিশন, যা এর চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নামানুসারে ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভা ১৯৩৯ সালে এই কমিশনের কাজে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদের দাবী জানান হয়।
ভূমি রাজস্ব কমিশন সরকারের নিকট তার রিপোর্ট দাখিল করে ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে কৃষক সভার মূল দাবী মেনে নিয়ে কমিশন এই মর্মে সুপারিশ করে যে—
(১) ‘খাজনাভোগীদের উচ্ছেদ করতে হবে সে জন্য গভর্নমেন্ট কর্তৃক সমস্ত জমিদারী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বত্ব কিনে নিয়ে রাইয়তওয়ারী প্রথা প্রবর্তন করতে হবে। এই স্বত্বের মধ্যে নগদ খাজনায় বিলি করা রাইয়তী বা ফোর্কা স্বত্বও পড়বে।’
(২) ‘….বর্গাদারদের সরাসরি সরকারের প্রজা বলে গণ্য করতে হবে। বর্গাদাররা উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খাজনা দেবে, তার বেশি নয়।’
(৩) ‘ভবিষ্যতে জমি যাতে অকৃষকের হাতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অকৃষকের নিকট জমি হস্তান্তর বা বিলি বন্ধ করতে হবে।’
(৪) ‘বর্তমান খাজনাভোগীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ হবে নিট আয়ের দশগুণ এবং ওয়াকফ, দেবোত্তর ইত্যাদি ট্রাস্ট সম্পত্তির বেলায় ২৫ গুণ।’
ভূমি রাজস্ব কমিশন সরকারের নিকট তার রিপোর্ট পেশের আড়াই মাসের মধ্যে ৮—৯ জুন ১৯৪০ তারিখে যশোরের কেশবপুর থানার পাঁজিয়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। কিষাণ সভার চতুর্থ প্রাদেশিক সম্মেলন। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে কমিশন তাদের রিপোর্টে যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে কৃষক সভার মূল দাবী মেনে নিয়েছে’ এজন্য সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সেই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষতঃ ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সভার মতপার্থক্যের কথাও উল্লেখ করা হয়। তবে এই কমিশনের রিপোর্ট আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা সে ব্যাপারে কিষাণ সভার নেতৃবৃন্দের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কেননা কমিশন রিপোর্ট দাখিলের পর এই রিপোর্টের ওপর সরকারের করণীয় নির্ধারণের জন্য গার্নার নামক আরেকজন সরকারী কর্মচারীকে দিয়ে আরেকটি কমিশন নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাই সাত দফা দফা নির্ধারণের পর তেভাগার জন্য সংগ্রামের ডাক দিয়ে পাঁজিয়া প্রস্তাব শেষ করা হয় এইভাবে—‘….আইন কতদিনে হইবে অথবা আদৌ হইবে কি না তার ঠিক নাই। অথচ বর্গাচাষীরা আজ মারা যাইতেছেন। কাজেই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাইবার দাবী লইয়া চাষীরা আজই সংঘবদ্ধ হইয়া প্রবল সংগ্রাম শুরু করিয়া দিল।’ (৩)
১৯৪০ সালে জারী করা হয় ভারত রক্ষা আইন এবং এই আইনের বলে সর্বত্র ব্যাপক ধরপাকড় চলতে থাকে। সরকারী দমন পীড়ন অব্যাহত থাকার কারণে ১৯৪২-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় দু’বছর আন্দোলন সংগঠনের কাজ প্রকাশ্যে করা যায়নি।

তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের ফটো কপি :

বিশ্বযুদ্ধকে তখন কৃষক সভা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে প্রচার করতো বলে তার ওপর আক্রমণটাও ছিল প্রচন্ডতর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মিত্রশক্তিতে যোগদানের ফলে যুদ্ধের চরিত্র সম্বন্ধে নতুন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নাগপুরে কেন্দ্রীয় কৃষক কাউন্সিল এই যুদ্ধকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী যুদ্ধ ও স্বাধীনতার যুদ্ধ আখ্যা দেয়।
(৪) ১৯৪২ সনেই কৃষক সভা ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে এবং জাপানকে রুখতে হবে বলে আওয়াজ তোলে। ফলে কৃষক সভার ওপর সরকারী দমন ব্যবস্থা অনেকটা শিথিল হয়ে আসে। ‘১৯৪০—৪১ সনে কৃষক সভার প্রায় দু’হাজার কর্মী ও মেম্বর মামলায় জড়িত হয়েছিলেন এবং কয়েকশ’ দন্ডিত হয়েছিলেন।’ এখন গ্রেফতারকৃত বন্দীরা একে একে ছাড়া পেতে শুরু করেন, গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথার ওপর থাকায় যারা গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, পরোয়ানা তুলে নেয়ায় তারাও বেরিয়ে আসতে থাকেন।
এমতাবস্থায় ১৯৪২ সালেরই জুন মাসে রংপুর জেলার ডোমারে এবং পরবর্তী বছর ১০-১২ই মে ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার নালিতাবাড়ি গ্রামে প্রাদেশিক কিষাণ সভার যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সম্মেলন বসে। নালিতাবাড়ি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় অনেক সংগঠিতভাবে—প্রাদেশিক সম্মেলনের পূর্বেই ২৫টি জেলার সবগুলিতেই জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘সমস্ত জেলা সম্মেলনেই প্রধান স্লোগান ছিল : ১৯৪৩ সনে কৃষক সভাকে গড়ে তোল। এই সম্মেলনে সংগঠন তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং কৃষক সমিতিগুলোর প্রতিদিনকার কাজের জন্য…একটি স্থায়ী, নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল কৃষক বাহিনী তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভাগ-চাষীদের অবস্থা পর্যালোচনা করে উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের একভাগ জমির মালিককে দেওয়া হইবে এই ভিত্তিতে সমস্ত ভাগ-চাষীকে সংঘবদ্ধ করার কর্মসূচীও গ্রহণ করা হয়। (৫)
এ সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা জানার জন্য ১৯৪১ সালের আদমশুমারী রিপোর্টটি দেখা যেতে পারে। ঐ রিপোর্ট অনুসারে তখন সম্পূর্ণ বা প্রধানতঃ কৃষি নির্ভর পরিবার ছিল মোট প্রায় ৭৫ লক্ষ। এর মধ্যে ২০ লক্ষের কম পরিবারের জমি ছিল ২ থেকে ৫ একর; মোট পরিবার সংখ্যার অর্ধেকের জমি ছিল ২ একরের কম অথবা তারা জমিহীন ছিল; প্রায় ১০ লক্ষ পরিবার ছিল প্রধানতঃ বা সম্পূর্ণ বর্গাদার; আর প্রায় ২০ লক্ষ পরিবার ছিল যারা প্রধানতঃ বা সম্পূর্ণ নির্ভর করত ক্ষেত-খামারের কাজে যে মজুরী পেত তার ওপর। তাছাড়া ৫ একরের বেশি জমি ছিল ২০ লক্ষের চেয়ে কম পরিবারের, আর তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ছিল ১০ একরের বেশি জমি।
১৯৪৩ সালেই সমগ্র বাংলার জন্য ভয়ংকর বিপদের আকারে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। কৃষক সমাজের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই দুর্ভিক্ষের আঘাতে। জিনিসপত্রের দর বাড়তে থাকে হু হু করে। ৩রা মার্চ ১৯৪৩ তারিখে কলকাতায় মোটা চালের দর ছিল মণপ্রতি ১৫ টাকা, ৫ই এপ্রিলে ২১.১২, ১০ই মে ২৫ টাকা এবং ১৭ই মে ৩০.৬২। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে মণপ্রতি মূল্য তালিকায় কি পরিমাণ পার্থক্য সূচীত হয়েছিল তা বোঝা যায় নিম্নলিখিত তালিকাটি থেকে। (৬)

জেলা জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ মে’র শেষ সপ্তাহ
খুলনা ১০.১২ ৩০.০০
বর্ধমান ১১.৭৫ ২৯.৭৫
রাজশাহী ১৩.২৫ ২৬.৩১
ফরিদপুর ১২.২৫ ৩১.০০
ত্রিপুরা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ৯.৫০ ২৫.০০
দিনাজপুর ১০.০০ ৪০.০০

এই সময়ের অবস্থা সম্পর্কে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের রিপোর্ট থেকে কিছু তথ্য জানা যায়—‘মালদহ ছাড়া অন্য সব জেলাতেই অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে’. ‘বর্ধমানে চাল নাই’, ‘মেদিনীপুরে চালের অভাবে লঙ্গরখানা মাঝে মাঝে বন্ধ থাকছে’, রাজশাহী বিভাগে ‘ব্যবসাদাররা ফটকাবাজীর জন্য কেনার দরুণ চালের দর বেড়ে গেছে’, ‘দিনাজপুর ও রংপুরে ধান লুটের ঘটনা ঘটেছে’, নীলফামারী মহকুমার দারুণ দুরবস্থা’, ‘পাবনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও বগুড়ায় লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে।’ (৭)
দুর্ভিক্ষের কষাঘাতে জমির হস্তান্তর হয় ব্যাপক, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে মানুষ ছুটতে থাকে শহরের দিকে। ১৯৪৩-এর অক্টোবরে কলকাতায় এক লক্ষ নিঃস্ব লোকের সমাগম হয়। নবেম্বরের শেষ নাগাদ ফসল কাটার মওসুম ধরার জন্য এসব নিঃস্ব মানুষ কলকাতা ছেড়ে স্ব-স্ব এলাকায় ফিরে যান। ১৯৪৪ সালে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। কিন্তু তখন আবার শুরু হয় মহামারীর ব্যাপক আক্রমণ। জীবনী শক্তিহীন নিঃস্ব এই সমস্ত মানুষ ম্যালেরিয়া, আমাশয়, উদরাময় ও কলেরার প্রকোপে বেঘোরে মারা পড়ে। সরকারী হিসাবে এই দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর কবলে পড়ে বাংলাদেশে মারা গিয়েছিল ১৫ লক্ষ মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নরবিজ্ঞান বিভাগের সমীক্ষায় ৩৫ লক্ষ লোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়।
পাঁজিয়া ও লালিতাবাড়ি সম্মেলনে আধিয়ারে জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের দাবী নিয়ে ভাগ-চাষীকে সংঘবদ্ধ করার যে কর্মসূচী ঘোষিত হয়েছিল সেই অনুসারে দুর্ভিক্ষ পরবর্তী সময়ে কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচী হাজির করাটাই ছিল যৌক্তিক। কিন্তু ২৯শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২রা মার্চ ১৯৪৪ তারিখে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী বন্দরে প্রাদেশিক কিষাণ সভার সপ্তম সম্মেলন, ১৩—১৪ মার্চ ১৯৪৫ বর্ধমান জেলার হাট গোবিন্দপুরে অষ্টম সম্মেলন এবং ২১শে থেকে ২৪শে মে ১৯৪৬ তারিখে খুলনা জেলার মৌভোগে নবম সম্মেলন হলেও এর কোনটাতেই আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়নি। মৌভোগ সম্মেলনে সমবেত প্রাদেশিক নেতৃত্ব ভাগ-চাষীদের স্বার্থে কোন আন্দোলনের ঘোষণা না দিয়ে কেবল এই মর্মে মন্তব্য প্রকাশ করে যে—‘যত শীঘ্র সম্ভব ভাগ-চাষীদের ফসলের তিন ভাগের দুইভাগের অধিকার দিয়া অথবা সমস্ত রকম খরচ অর্ধেক বহন করিলেই মালিক অর্ধেক ফসলের ভাগ পাইবে এই মর্মে আইন হওয়া প্রয়োজন।’ আবদুল্লাহ রসুলের মতে—‘পরবর্তী দু’মাসের মধ্যে বাংলার বহু জেলায় যে ব্যাপক ও প্রবল তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়ে যায় তার সম্ভাবনা সম্বন্ধে মৌভোগ সম্মেলন চিন্তাও করতে পারেনি।’ অর্থাৎ অন্য কথায় বলতে গেলে তেভাগা আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রাদেশিক নেতৃত্বের কাছ থেকে আসেনি, এসেছিল জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে।

দিনাজপুরের স্থানীয় প্রেক্ষাপট
তেভাগা আন্দোলন ছিল বস্তুতঃ অনেকগুলি আন্দোলনের সমষ্টি এবং দিনাজপুরের ক্ষেত্রে এর দু’টি সুনির্দিষ্ট স্তর বিভাগ ছিল—
প্রথমটি ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ এবং দ্বিতীয়টি ১৯৪৬-১৯৪৭ পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ের আন্দোলনসমূহ যে ভিত্তি নির্মাণ করেছিল সে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনসমূহ গড়ে ওঠে। দৈহিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তোলাবাটি আন্দোলন, সুদ বন্ধ আন্দোলন, জাল যার জলা তার আন্দোলন প্রভৃতি মধ্য দিয়ে কৃষককর্মীরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তা তাদের পরবর্তী পর্যায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে অনুপ্রেরণা জোগায়। (প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন সম্পর্কে আরো তথ্যের জন্য ঈদ-উত্তর বিশেষ সংখ্যা বিচিত্রা ১৯৮০ দ্রষ্টব্য)
১৯৪০ সালে ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্ট’ অনুযায়ী দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির বেশির ভাগ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে যান। এই গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন সুশীল সেন, কালী সরকার, হাজী দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বিভূতি গুহ, জনার্জন ভট্টাচার্য, গনেন ডাক্তার, শচীন্দ্র চক্রবর্তী, অখিল ডাক্তার, রূজ্যেশ্বর রায়, কালাবর্মন, পদ্মলাল, জাল মুহম্মদ, খোকা বাইশ, লাল্টু মুহম্মদ, চান্টু বর্মন প্রমুখ। এরপর কৃষক সমিতি কার্যতঃ আত্মগোপন অবস্থায় চলে যায়। জেলা নেতৃত্বের মধ্যে কেবল অজিৎ রায় গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আত্মগোপন অবস্থায় গ্রামে গ্রামে সাংগঠনিক যোগাযোগ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। কলকাতার ছাত্রনেতা অবনী লাহিড়ী আত্মগোপন অবস্থায় দিনাজপুরে অবস্থান করেন এবং কৃষকের বেশে ঠাকুরগাঁর গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। তিনি দেখেন যে, কৃষক কর্মীরাই আশ্রয় দেন, পত্রবাহকের কাজ করেন, ইস্তাহার বিলি করেন। অন্যান্য জেলার কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ যেমন রংপুরের মহীবাগচী ও জীবন দেব, মালদহের বসন্ত চ্যাটার্জী এবং ঢাকার সুবোধ সেন, আত্মগোপন অবস্থায় দিনাজপুরের গ্রামে গ্রামে অবস্থান করে স্থানীয় কৃষক সংগঠনের কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। জলপাইগুড়ির ছাত্রনেতা নরেশ চক্রবর্তী আত্মগোপন করে দেবীগঞ্জ এলাকায় কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন (৮)। ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগের পর এই অঞ্চল দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়।
সোভিয়েত রাশিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কিষাণ সভা বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন অন্যান্য জেলার মতো দিনাজপুরের নেতৃবৃন্দও মুক্তি পেতে শুরু করেন। তবে এদের কারো কারো ওপর রেসট্রিকশন অর্ডার জারী করে তাদের গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করা হয়।
দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতি এই সময় কর্মীদেরকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার জন্য রাজনৈতিক ক্লাসের ব্যবস্থা করে কর্মীদেরকে লেখাপড়া শেখানোর কর্মসূচীও হতে নেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপান বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইন্দোচীন, মালয়, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মা একে একে তার অধিকারে আসে। তাদের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ হয়ে ওঠে ভারত। কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট পার্টি জাপানের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে বিশেষতঃ কৃষক সভা ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে জাপান বিরোধী আওয়াজ তোলে। দিনাজপুর কৃষক সমিতিও জাপান বিরোধী প্রচারণায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফুলবাড়ী কৃষক সমিতির সদস্য আনন্দ মোহন রায় জাপান-বিরোধী প্রচারণায় অংশ হিসাবে রচনা করেন গান—

হৈ হৈ হৈ
জাপান ঐ
আসছে তেড়ে
ভারতেই
চলরে নওজোয়ান
রুখতে জাপান

প্রস্তুতি পর্বে সংগঠিত আন্দোলনসমূহের মধ্য দিয়ে কৃষক সমিতি অর্জন করেছিল ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সমিতির প্রতি জনগণের এই আস্থা আরো ব্যাপকতা লাভ করে দুর্ভিক্ষর সময়ে। ১৯৪৩ সালে ফসলহানি ও যুদ্ধের ফলে ধান-চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম অত্যাধিক বৃদ্ধি পায়। দিনাজপুর জেলা সংলগ্ন রংপুরের নীলফামারী মহকুমায় দুর্ভিক্ষের প্রকোপ ছিল ব্যাপক। সেখান থেকে শত শত লোক খাদ্যের সন্ধানে দিনাজপুরে আসতে শুরু করেন। এইভাবে আগত লোকজন বিশেষভাবে মহিলারা বিভিন্ন এলাকার জোতদার ও ধনী কৃষকদের বাড়িতে ‘থাকতি দিতি হবি’ বলে জোর আশ্রয় গ্রহণ করতেন। দিনাজপুরের স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই গ্রামে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর শহর, বালুরঘাট বা বিভিন্ন থানা শহরে আসতে শুরু করেন। পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ইউনিয়নে ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খোলার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এর ফলে খোলা হয় লঙ্গরখানা। জেলা কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষক সমিতি সংগঠিতভাবে দুর্ভিক্ষকে প্রতিরোধের ডাক দেয় এবং স্থানীয় জোতদার-মহাজনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য বা চাঁদা সংগ্রহ করে। লঙ্গরখানাগুলিতে দু’বেলা খিচুড়ীর ব্যবস্থা করা হয়। জোতদার মহাজনদের মধ্য থেকে কেউ কেউ মানবিক কারণে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেও সাধারণতঃ তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি। তবে প্রত্যক্ষভাবে এই ত্রাণ তৎপরতাকে বিরোধিতা করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা এ সময় দিনরাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। ফলে এদের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে। এবং সমিতি একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দুর্ভিক্ষ যখন কেবল শুরু হয়েছে, ধানের দর মণপ্রতি ১৪ টাকায় উঠেছে—সে সময় ফুলবাড়ী এলাকার বড় জোতদার সহারুদ্দীন ‘হাতীর দৌড়’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন—কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে তখন ব্যাপক প্রচারকার্য চালানো হয়।
‘এই দ্যাখোরে, মানুষ মরলো, ধানের দাম বাড়লো আর জোতদারদের হাতীর দৌড় শুরু হলো’—এই বক্তব্যকে তুলে ধরে তাদের গণবিরোধী চরিত্রকে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতাকে বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ না নেয়া হলেও কেবলমাত্র প্রচার অভিযানের ফলেই এতে অংশগ্রহণের সংখ্যা অনেক হ্রাস পায়, মাত্র দুটো হাতী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
দুর্ভিক্ষের সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় গঠন করা হয় ফুড কমিটি। পাবলিক মিটিং করে এই কমিটির চেয়ারম্যান, সেক্রেটারী ও সদস্য মনোনীত করা হতো। দিনাজপুরের কৃষক সমিতি এই সমস্ত ফুড কমিটিগুলিতে নিজ কর্মীদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে ত্রাণকার্য সংগঠনের নেতৃত্বের ভূমিকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঠাকুরগাঁ মহারগাঁ মহকুমার প্রায় সমস্ত গ্রাম-ফুড কমিটিতে কৃষক সমিতির প্রতিনিধিরাই মনোনীত হন। ঠাকুরগাঁ মহকুমা ফুড কমিটির সেক্রেটারী মনোনীত হন হাজী দানেশ। তিনি ঠাকুরগাঁ শহর ফুড কমিটিরও সেক্রেটারী হন। যে সব এলাকায় কোন জোতদার ফুড কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হতেন, বন্টনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতো যে সব এলাকাতেই বেশি। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এসব এলাকায় নতুন করে কমিটি গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
দিনাজপুরের লঙ্গরখানাগুলো থেকে জেলার অভাবগ্রস্ত লোকেরা সহযোগিতা পেয়েছিলেন ঠিকই, তবে তাদের তুলনায় রংপুর থেকে আগত লোকেরাই সাহায্য পেয়েছিলেন বেশি। প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই লঙ্গরখানা খোলা হলেও প্রায় দু’ থেকে আড়াই হাজার লোক এ জেলায় অনাহারে মারা যান, আর এদের অধিকাংশই ছিলেন রংপুর থেকে আগত। মৃতদেহের সৎকারের জন্যও কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, গঠন করা হয়েছিল একটি সৎকার সংস্থা। মৃত মুসলমান ব্যক্তিদেরকে মুসলমান কর্মীরা কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। হিন্দুদের সৎকার যথেষ্ট ব্যয়বহুল বিধায় সঠিকভাবে তা করা সম্ভবপর ছিল না। হিন্দু কর্মীরা সেসব লাশ মাটি দিয়ে চাপা দিতেন। কৃষক সমিতি এ সময় মজুতদারী ও চোরাচালানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে সুদ বন্ধ আন্দোলনে অর্জিত সাফল্যের কারণে জোতদাররূপী মহাজনরা ২০ ধামা ধানের বদলে ২৩ ধামা পেয়ে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হয়। আন্দোলন পূর্ববর্তীকালে তারা পেত ২০ ধামার বদলে ৪০ ধামা। তাছাড়া ঋণ সালিশী বোর্ড ও মহাজনী আইন প্রবর্তিত হওয়ায় সুদের হার ও মহাজনী অত্যাচার খানিকটা কমেছিল। মহাজনী ব্যবসার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হতো এবং সুদের হার বাঁধা ছিল ১২%। দুর্ভিক্ষের সময়ে সুযোগ বুঝে অনেকের লাইসেন্স ছাড়া মহাজনী শুরু করে, সুদের হারও বেড়ে যায় সেই সঙ্গে—সাধারণভাবে এক মণ ধান ধার নিলে পরবর্তী ফসল ওঠার সময় ফেরত দিতে হতো দু’মণ। কৃষকের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে জোতদাররা কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের শোষণের পরিমাণকে আরো বাড়িয়ে দেয় নতুন এক পদ্ধতিতে। দুর্ভিক্ষাবস্থায় ধানের মণ যখন ৩০ টাকা তখন ধান ধার নিলে শর্তটা এ রকমভাবে করা হতো যে ফেরত দে’য়ার সময় (যখন দর স্বাভাবিকভাবেই অনেক কম থাকবে) এক মণ ধান ছাড়াও ত্রিশ টাকা বা ত্রিশ টাকায় ঐ সময় বাজারে যে পরিমাণ ধান কিনতে পাওয়া যায় তার সমপরিমাণ ফেরত দিতে হবে। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় ধারগ্রহীতাকে ফেরত দিতে হতো সাড়ে ৩ থেকে ৪ গুণ ধান।
তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব যখন শুরু হয় তখন কৃষকরা ছিলেন অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত—একটা লাল পাগড়ী দেখলে ভয়ে কাঁপতেন; জমিদার জোতদারকে, জমিদারের নায়েবকে, এমনকি বরকন্দাজকে যমের মতো ভয় করতেন। সর্বোপরি তারা ছিলেন অদৃষ্টবাদী—‘বর্তমান দুরাবস্তা আল্লাহ বা ভগবানের দেয়া, তাদের আর কিছু হবে না’ এটা ছিল তাদের বিশ্বাস। কিন্তু দুর্ভিক্ষ পরবর্তী এই সময়ে কৃষকদের মনোভাব ছিল ভিন্ন। প্রস্তুতিপর্বের আন্দোলনসমূহের অভিজ্ঞতা এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার দিকে আকর্ষণ করেছিল, সংগঠিত শক্তির ওপর জন্মেছিল তাদের অবস্থা। কৃষক সমিতির প্রচারিত রাজনীতি থেকে শিক্ষা লাভ করে অগ্রসর কৃষক কর্মীরা এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অপরাপর মেহনতী মানুষের সঙ্গে একজোট হয়ে দাঁড়াতে পারলে তারা পাল্টে দিতে পারেন গোটা ব্যবস্থাকে, আর যে জমির মালিক জোতদার-জমিদার, সে জমির মালিক তারা নিজেরাই হতে পারেন। সর্বোপরি তাদের বিপদের দিনে পাশাপাশি কৃষক সমিতিকে পেয়ে তারা এই সংগঠনের প্রতি আস্থা স্থাপন করেন, কৃষক সমিতি তাদের জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়।

ফুলবাড়ী কৃষক সম্মেলন
২৯ ফেব্রুয়ারী থেকে ২ মার্চ ১৯৪৪ সনে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক কিষাণ সভার সপ্তম সম্মেলন। সম্মেলনে রক্তবর্ণ পতাকা উত্তোলন করেন ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা কমরেড মুজাফফর আহমেদ। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবদুল্লাহ রসুল, গোপাল হালদার, মনি সিংহ, মনসুর হাবিব, বগলা গুহ, শ্যামাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, বঙ্কিম মুখার্জী, ননী ভৌমিক, আবদুর রাজ্জাক খান, কৃষ্ণবিনোদ রায়, রণধীর দাশগুপ্ত, শচীন্দ্র ঘোষ, সুধীর মুখার্জী প্রমুখ। এছাড়া বিভূতি গুহ, সুশীল সেন, হাজী দানেশ, কালী সরকারসহ জেলার সকল নেতা উপস্থিত ছিলেন। রংপুরের দীনেশ লাহিড়ী, ইলা মিত্র, বদরগঞ্জের মনিকৃষ্ণ সেনসহ গনেশ দে, অম্বিকা চক্রবর্তী, কমরেড ইসমাইল প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন এই সম্মেলনে। এছাড়া আসাম প্রাদেশিক কিষাণ সভা, কম্যুনিস্ট পার্টি, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির পক্ষ থেকে অনেক মিত্র প্রতিনিধিও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
প্রাদেশিক কৃষক কমিটির ৬৫ জন মেম্বরসহ চব্বিশটি জেলা থেকে মোট ৪০০-এর অধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। দিনাজপুরের বিভিন্ন থানা এবং রংপুরের নিকটবর্তী এলাকাসমূহ থেকে কর্মীরা মিছিল সহযোগে ফুলবাড়ীতে এসে পৌঁছান। এই মিছিলগুলির মধ্যে বিশেষতঃ পেলিয়া রমনীদের মিছিলগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। ইটাহার, কশমুন্ডী, বালিয়াডাঙ্গি, রাণীসংকল, গঙ্গারামপুর, তপন প্রভৃতি এলাকা থেকে রওনা হয়ে পঁচিশ, ত্রিশ, পয়ত্রিশ বা চল্লিশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে এঁরা সম্মেলন স্থলে এসে পৌঁছান। পিঠের সঙ্গে বাঁধা কাপড়ে কোলের ছোট্ট বাচ্চাকে ঝুলিয়ে নিয়ে, পথের খাবার হিসাবে মুড়ি-মুড়কী বা চিড়া-গুড় সম্বল করে, এক বা একাধিক দিন মিছিল করে এসে এরা সম্মেলনে যোগদান করেন। এই উপলক্ষে যে কৃষক সমাবেশ হয় তাতে দু’হাজার নারীসহ প্রায় ত্রিশ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। ৪৫০ জন কৃষকের একটি দল প্রায় ৮০ মাইল হেঁটে এসে সম্মেলনে যোগদান করেন।
তখন জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি ছিলেন ফুলবাড়ীর ডাঃ গণেন্দ্রনাথ সরকার। তার বাসা ছিল যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র। প্রতিটি জেলার জন্য আলাদা আলাদা ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফুলবাড়ীর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা এগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং দক্ষ বিধায় গুরুদাস তালুকদারের ওপর ছিল রান্নার সামগ্রিক দায়িত্ব। সম্মেলনে উপস্থিতির সংখ্যা ও আয়োজনের ব্যাপকতা এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল যে স্থানীয় মাড়োয়ারী, বড় ব্যবসায়ী বা জোতদারের ছেলেরাও লাল টুপী মাথায় দিয়ে লাঠি খেলায় অংশগ্রহণ করে। ফুলবাড়ী ও আশপাশের থানাগুলোর মানুষ এর আগে কখনো কোনো ব্যারিস্টারকে সামনাসামনি দেখেননি। এই প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগদান করতে কলকাতা থেকে এসেছিলেন ৭/৮ জন ব্যারিস্টার। এই ব্যারিস্টারদের দেখার জন্য দূর দূরাঞ্চল থেকে বহু মানুষ সমাগত হয়েছিলেন সম্মেলন স্থলে।
সম্মেলন শেষে আয়োজন করা হয়েছিল গণসঙ্গীত ও গণনাট্য অভিনয়ের। গণসঙ্গীতের আসরে ময়মনসিংহ-এর নিবারণ পন্ডিত এক হাজার দুর্ভিক্ষের ওপর নিজের লেখা নিম্নলিখিত গানটি গেয়ে শোনায়—

ঘোর কলিকাল
আইলো আকাল
সোনারই বাঙলায়
শ্মশান ঘাটে ডাকে শকুনী
হা অন্ন হা অন্ন ধ্বনী
চারদিকে শুনি।
আপন মা’য়ে নিজ সন্তান
বিক্রি করে খায়
ঘোর কলিকাল
আইলো আকাল
সোনারই বাঙলায়।

সম্মেলনে সেদিন বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান উঠেছিল। তবে সর্বাধিক গুরুত্ব পায় ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’ শ্লোগানটি। অপরাপর শ্লোগানের মধ্যে ছিল ‘লাঙল যার জমি তার’, ‘বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ চাই’, ‘আবওয়ার বন্ধ কর’, ‘তোলাবাটি চলবে না’, ইত্যাদি। কিন্তু এই সম্মেলন কোন কর্মসূচী দিতে ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় পাঁজিয়া সম্মেলনে গৃহীত তেভাগার দাবী পুনরুচ্চারণ করতে। সম্মেলন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, সরকারকে ৫ কোটি মণ চাল কিনতে হবে এবং সমস্ত শহরে রেশনিং চালু করতে হবে, কুইনিনের চোরাকারবার বন্ধ করতে হবে (তখন দুর্ভিক্ষ পরবর্তীকালে মহামারী অবস্থা চলছিল) এবং ৫ লক্ষ পাউন্ড কুইনিন বন্টন করতে হবে। দুঃস্থদের জন্য কর্মক্ষেত্র স্থাপন করতে হবে, নিত্যপ্রয়োজনী জিনিসপত্রের রেশনিং ব্যব্স্থা করে ফুড কমিটি মারফত বন্টন করতে হবে, দুর্ভিক্ষের বছরে কৃষকদের যেসব জমি হস্তান্তরিত হয়েছিল তা ফেরত দেওয়াতে হবে। তাছাড়া পূর্ববঙ্গে যে কচুরিপানার উপদ্রব বিস্তর জমির ফসল নষ্ট হচ্ছিল অথচ বাঁশ ও নৌকার অভাবে তা রক্ষা করা যাচ্ছিল না, সেই উপদ্রব থেকে ফসল রক্ষায় আবেদন জানান হয়। (৯)
আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণে ফুলবাড়ী সম্মেলন সাফল্যের ছাপ রাখতে না পারলেও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ব্যাপারে এই সম্মেলন উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কৃষক বাহিনী গঠন সম্পর্কে এই সভাতেই নীতি নির্ধারিত হয়। ঠিক করা হয় যে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স্ক ও সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন কাজ করতে ইচ্ছুক যে কোন সদস্য বাহিনীতে যোগদান করতে পারবে। প্রত্যেক গ্রামে অন্ততঃ দশজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠিত হবে। প্রত্যেক ইউনিয়নে অন্ততঃ ত্রিশ, মহকুমায় কমপক্ষে ২১০ এবং জেলায় ৫০০ জনকে নিয়ে বাহিনী গঠিত হবে। প্রাদেশিক অফিস থেকে প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবককে কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্নিত ও কৃষক বাহিনী লিখিত ব্যাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্ততঃ একজন কৃষককে কৃষক বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
কৃষক আন্দোলনের অপরিহার্য অংশ হিসাবে কৃষকদের মধ্য থেকে শিল্পী সংগ্রহ করে কৃষি বাহিনী গঠন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঠিক হয় যে গ্রামে প্রচলিত নাচ, গান পরিবর্ধিত ও সংশোধিত করে বা নতুনভাবে রচনা করে কৃষক সভার চিন্তার প্রতিফলন তার মাধ্যমে ঘটাতে হবে।
এই সম্মেলনে কৃষক সভার সভ্যদের জন্য একটি ফরমের নমুনা গৃহীত হয়। ইউনিয়ন সমিতির নাম, থানা ও মহকুমা সমেত পূর্ণ ঠিকানার সঙ্গে ফরমে সভ্যের নাম, ইউনিয়নের ক্রমিক নম্বর, রসিদ নম্বর, গ্রামের নাম, স্ত্রী/পুরুষ, হিন্দু/মুসলিম, জমিহীন ভাগ-চাষী, জমিহীন কৃষি মজুর, গরীব চাষী, মধ্যম চাষী, ধনী চাষী, অকৃষক (হস্তশিল্পী/অন্যান্য শ্রেণী) বয়স, নতুন না পুরাতন সদস্য, তারিখ প্রভৃতি লেখার জন্য আলাদা আলাদা ঘর রাখা হয়েছিল। প্রাদেশিক অফিসের জন্য এই ফরমে সভ্য তালিকা পাঠাবার নিয়ম চালু করা হয় এবং তা কয়েক বছর চালু ছিল। (১০)
ফুলবাড়ী সম্মেলন থেকে কোন আন্দোলনের ডাক না দেয়া হলেও এই উপলক্ষে দিনাজপুরে সংগঠিত কৃষকের যে ব্যাপক সমাগম হয় তা জেলার কৃষক কর্মীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ২৪টি জেলার প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ তাদের মনোবলকে বৃদ্ধি করে অনেক গুণ বেশি। তারা সংগঠনের কাজে আরো বেশি মনোযোগী এবং সংগঠনের প্রতি আরো বেশি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহকে সাধারণ দাবীগুলির পাশাপাশি শ্লোগান আকারে সামনে নিয়ে এসে সেগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য জেলা কৃষক সমিতি ব্যাপক প্রচার অভিযান শুরু করে।

বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি : সমাজতন্ত্রের জয়
ফ্যাসীবাদী জার্মানী ও ইটালীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৪৫ সালের মে মাসে। মিত্রশক্তির পক্ষভুক্ত প্রধান শক্তি হিসাবে সোভিয়েত রাশিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করে। পূর্ব ফ্রন্টে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয় আরো চার মাস পরে, সেপ্টেম্বর মাসে। উত্তর কোরিয়া মুক্ত হয়। মাও সেতুঙের নেতৃত্বাধীন গণমুক্তিফৌজ তখন চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহ বাংলার অপরাপর জেলার মত দিনাজপুরের রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝেও সঞ্চার করে নতুন প্রাণ। ফুলবাড়ী অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক, স্বল্প লেখাপড়া জানা খবীর শেখ এ সময় লেখেন একটি উল্লেখযোগ্য গান। ক্রমবর্ধমান কমিউনিস্ট চাপের মুখোমুখি পড়ে চীনা রাষ্ট্রপ্রধান চিয়াং কাই শেক মার্কিন রাষ্ট্রের কর্ণধার ট্রুম্যানের সঙ্গে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করলে তাকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের কৃষক নেতা শেখ খবীর রচনা করেন নিম্নলিখিত গানটি—(১১)

ব্যাঙ বলে মোর ঠ্যাঙ্গের ল্যাঙ্গে
পাহাড় পর্বত রইবে না
শুনবে ব্যাট চিয়াং চাষা
একবারে তোর বুদ্ধিনাশা
তোর মাও সেতুঙ দাদা শুনলে পরে
জীবনটা তোর রাখবে না
ব্যাঙ বলে মোর ঠ্যাঙ্গের ল্যাঙ্গে
পাহাড় পর্বত রইবে না

তার লেখা আরেকটি গান তখন ফিরতো কৃষক কর্মীদের মুখে মুখে—

আমি দেখে শুনে তালকানা রে ট্রুম্যান নানা
চীনের কথা শুনে
ভাবি মনে মনে
সেই লড়াই আর বোধহয় আর আসবে না এখানে
কোরিয়ার দিকে চেয়ে নানা হে
ভয়েতে প্রাণ বাঁচে নাহে ট্রুম্যান নানা
আমি দেখে শুনে তাককামারে ট্রুম্যান নানা

প্রশিক্ষণ শিবির : রংপুর
ময়মনসিংহের হাজং এলাকার বহেরতলী গ্রামে মিলিটারীর সঙ্গে সংঘর্ষে রাসমণি ও সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুবরণ (জানুয়ারী ১৯৪৬), কলকাতায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি দিবস (নবেম্বর, ১৯৪৫) ও রশীদ আলী দিবস (ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬) উপলক্ষে ব্যাপক জনসমাবেশ, বোম্বাইয়ে নৌবিদ্রোহ ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে দেশের মধ্যে সংগ্রামমুখী পরিস্থিতির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সে সম্পর্কে দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ সজাগ ছিলেন। ১৯৪৫ সনের ১৩ ও ১৪ মার্চ বর্ধমান জেলার হাটগোবিন্দপুরে প্রাদেশিক কিষাণ সভার যে সম্মেলন হয় তাতে সংগ্রামের কোন দিক নির্দেশিকা হাজির না করে সাংগঠনিক পরিকল্পনার দিকে অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করা হলেও বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে দিনাজপুর জেলা ইউনিটসহ রংপুর, জলপাইগুড়ি ও অন্যান্য দু’একটি ইউনিট নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আন্দোলনে প্রবৃত্ত হন। দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ির জেলা কমিটি পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী ফসল ওঠার মওসুম অর্থাৎ ১৯৪৬-এর শেষভাগে তেভাগা আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। উত্তরবঙ্গেই এই তিনটি জেলায় ভাগ-চাষীর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক এবং জোতদারদের শোষণ নির্যাতনের মাত্রা ছিল অপরিসীম। ঠিক করা হয় যে আন্দোলনের প্রথম ধাপ হতে জোতদার-জমিদারের খোলনে ধান তোলার পরিবর্তে আধিয়ারের নিজ খোলনে ধান তুলে উৎপাদিত শস্যের তিনভাগের দুই ভাগ আদায় করা। সেই অনুযায়ী ‘আধি নয় তেভাগা চাই’ বক্তব্যকে তুলে ধরে ‘নিজ খোলনে ধান তোল’ শ্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচার অভিযান শুরু করা হয়।
তেভাগা আদায়ের মত ব্যাপক একটি আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল পরিকল্পনার, ‘কিভাবে আন্দোলনটি পরিচালনা করতে হবে’ সেই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন ছিল। তাই দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ির নেতৃস্থানীয় কর্মীদের কয়েকজন সমবেত হন রংপুরে—উদ্দেশ্যে সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশগ্রহণ করা। (১২) এই শিবিরে অংশগ্রহণ তথা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এসেছিলেন প্রাদেশিক কিষাণ সভার নেতা ভবানী সেন। মনিকৃষ্ণ সেন, হাজী দানেশ ও মহী বাগচীসহ বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণ করেন এই প্রশিক্ষণ শিবিরে। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় মহিলাও এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রথমতঃ চেতনা বিকাশের চেষ্টা করা হয়। ‘তেভাগা কেন প্রয়োজন’ সে ব্যাপারে করা হয় বিস্তারিত আলোচনা। ঋণে আকন্ঠ নিমজ্জমান কৃষকদের যতটুকু যাও ছিল তা নিয়ে গেছে সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ, কাজেই ক্রমাগতভাবে অবনত অবস্থার দিকে ধাবমান কৃষক শ্রেণীকে উৎপাদিত ফসলের বেশির ভাগ অংশ না দিলে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিন হবে—ইত্যাদি আলোচিত হয় বিস্তৃতভাবে। এরপর নির্ধারিত হয় কর্মপন্থা :-
প্রথমতঃ জোর দেয়া হয় ব্যাপক প্রচারের ওপর। ‘তেভাগা কেন চাই’ তা কৃষকদেরকে বোঝানো’ ও ‘তেভাগার যৌক্তিকতা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সমাজের মধ্যবিত্ত অংশকে আন্দোলনের স্বপক্ষে টানার চেষ্টা করা’ প্রাথমিক কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়।
ব্যাপক সংখ্যায় মিছিল ও মিটিং করে সংগঠনকে আরো জোরদার করার কথা বলা হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে তাদেরকে তেভাগার মন্ত্রে উদ্বুব্ধ করার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি কৃষক পরিবার থেকে ‘এক ভাই, এক লাঠি, এক টাকা’ চাওয়া হয়।
যে সমস্ত এলাকায় কৃষক সমিতির শক্ত ঘাঁটি আছে সেগুলোতে আগে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আন্দোলনের পথে যদি পুলিশী নির্যাতন আসে তাহলে ‘প্রথম থেকেই তাকে প্রতিরোধ করতে হবে।’ তবে এই প্রতিরোধের ধরন কি হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। পুলিশী নির্যাতন হলে ‘সংগঠিতভাবে তার প্রতিবাদ করার কথা আলোচিত হয়। বস্তুতঃ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আক্রমণ যে সর্বাত্মক রূপ নিতে পারে এবং তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নিরীহ কৃষকরা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবতে পারেন—এতদূর পর্যন্ত তখন চিন্তা করা হয়নি।
রংপুরের প্রশিক্ষণ শিবিরে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মহিলাদের করণীয় প্রসঙ্গেও আলোকপাত করা হয়। কৃষকরা সাংগঠনিকভাবে ধান কাটার সময় তাদের ওপর পুলিশী আক্রমণ হলে মহিলা ধান ভানার গাইন, ঝাড়ু অথবা যে যা পারেন তাই নিয়ে পুলিশের মুখোমুখী হবেন—এই মর্মে তাদেরকে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বালতি ভর্তি পানিতে মরিচ ভিজিয়ে সেই ভেজা পানি পিচকিরি দিয়ে আক্রমনোদ্যত পুলিশের চোখে-মুখে মেরে তাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেবার প্রচেষ্টা নেয়ার জন্যও মহিলাদের উপদেশ দেয়া হয়।

স্থানীয় প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা
রংপুর থেকে ফিরে এসে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ সর্বপ্রথম জেলা কমিটির স্তরে যে নেতৃবর্গের অবস্থান তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। তারপর এই নেতৃবর্গের মধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব বন্টন করা হয়, এরা স্ব স্ব এলাকার নেতৃস্থানীয় কৃষক কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। দিনাজপুরে দায়িত্বের বিভাজনটা হয়েছিল নিম্নলিখিতভাবে :-
কোতোয়ালী—বিভূতি গুহ, অজিত রায়, বরদাভূষণ চক্রবর্তী
বীরগঞ্জ ঠাকুগাঁ (পূর্ব)—হাজী মোঃ দানেশ
ঠাকুরগাঁ (পশ্চিম)—সুনীল সেন
ফুলবাড়ী নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর—কালা সরকার, খবীর শেখ
বালুরঘাট-পতিরাম—কৃষ্ণ দাস মোহান্ত, ননীদাস মোহান্ত
আটওয়ারী ও বালিয়াডাঙ্গী—গুরুদাস তালুকদার
কাহারোল—শচীন্দু চক্রবর্তী ও জাল মোহাম্মদ
খানসামা ও বোচগঞ্জ ইটাহার-রায়গঞ্জ—বসন্ত চট্টোপাধ্যায়
চিরিরবন্দর—সুধীর সমাজপতি
সেতাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জ—জনার্দন ভট্টাচার্য
রানীসংকোল-পস্টরাম
তখন দিনাজপুর জেলা কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী ছিলেন সুশীল সেন। তিনি বিশেষ কোন এলাকার দায়িত্বে না থেকে সারা জেলার তত্ত্বাবধান করতেন। হাজী দানেশ, বরদা ভূষণ চক্রবর্তী, ভূজেন পালিত, ডাঃ গনেন্দ্রনাথ সরকার, রূপনারায়ন রায় প্রমুখ আন্ডারগ্রাউন্ড হননি—তারা প্রকাশ্যভাবেই চলাফেরা করতেন। সুশীল সেন, অজিত রায়, জনার্দন ভট্টাচার্য, বিভূতি গুহ, কালী সরকার, শেখ খবীরউদ্দিন, বসন্ত চ্যাটার্জি, শচীন্দু চক্রবর্তী, সুধীর সমাজপতি প্রমুখ ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড। তারা গোপন অবস্থান থেকেই স্ব স্ব এলাকায় সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করতেন। সুনীল সেন ছিলেন আধা-গোপন অবস্থায়। তিনজন নেত্রী রানী মিত্র, বীনা রায় ও জয়মণি বর্মনী এ সময় মহিলাদের মধ্যে সংগঠন গড়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

নির্বাচন ১৯৪৬ : রূপনারায়নের জয়
১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা প্রাদেশিক এ্যাসেম্বলীর নির্বাচন। দিনাজপুর জেলার সর্বত্র কম্যুনিস্ট পার্টি তথা কৃষক সমিতির সংগঠন তখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি—২৮টি থানার মধ্যে ৬টি তখনো সংগঠন গড়া বাকি। পুরো দিনাজপুর জেলা নিয়ে তখন ছিল একটা হিন্দু নির্বাচনী এলাকা কিন্তু সদর, বালুরঘাট ও ঠাকুরগাঁ ছিল আলাদা আলাদা মুসলিম-নির্বাচনী এলাকা। সংগঠিত ২২টি থানার কৃষক সমিতিতে আবার মুসলমান কৃষকের অংশগ্রহণ ততটা ব্যাপক ছিল না। তাই জেলা কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে নির্বাচনে কেবলমাত্র হিন্দু-নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে। মনোনয়ন পান নেতৃস্থানীয় রাজবংশী কৃষক রূপনারায়ন রায়। কৃষক সমিতির কর্মীরা এই নির্বাচনের প্রচার-কার্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। জাতিভিত্তিক সংগঠন ক্ষত্রীয় সমিতির জনৈক নেতা, যিনি ছিলেন একজন জোতদার—তার সঙ্গে মূলতঃ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। রূপনারায়ন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ক্ষত্রীয় সমিতির কার্যক্রম এরপর কার্যতঃ স্তব্ধ হয়ে যায়।
রূপনারায়নের জয় ছিল দিনাজপুর জেলার তথা বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রাদেশিক এ্যাসেম্বলীতে তিনি ছিলেন একমাত্র সদস্য যিনি ছিলেন পেশায় কৃষক। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে সারা বাংলায় এই নির্বাচনে মোট তিনজন নির্বাচিত হন। রূপনারায়ন ছাড়া অপর দু’জন ছিলেন জ্যোতি বসু ও রতন লাল ব্রাহ্মণ। রতন লাল ছিলেন দার্জিলিং চা-শ্রমিকদের প্রিয় নেতা। ট্রেড-ইউনিয়ন নেতা জ্যোতি বসু হুমায়ুন কবীরকে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন। তেভাগা আন্দোলন চলাকালে প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত দমনমূলক ব্যবস্থাবলীর বিরুদ্ধে এ্যাসেম্বলীতে এরা ছিলেন সোচ্চার।

নিজ খোলনে ধান তোলা
তেভাগার জন্য আন্দোলনের প্রথম স্তর ছিল ‘নিজ খোলনে ধান তোলা’ আন্দোলন। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী জমিদার বা জোতদার খোলনে ধান জমা হয়ে গেলে তারপর তারা তেভাগার দাবী মানবে এরকম সম্ভাবনা ছিল কম। তাই কৃষক সমিতি নিজ খোলনে ধান তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েক মাস ধরে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন চালানোর মাধ্যমে তেভাগার দাবীকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা হলেও সারা জেলার সমস্ত এলাকায় ‘নিজ খোলনে ধান তোলার’ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়া কৃষক সমিতির পক্ষে সম্ভব ছিল না। যে সমস্ত এলাকার সংগঠন ছিল মজবুত অথবা যে সব এলাকার জোতদাররা ছিলেন অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল কেবলমাত্র সেসব এলাকাতেই আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রতাপশালী জোতদারের অধীনস্ত আধিয়াররা কৃষক সমিতি আহুত এই আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী হাতে পারেননি বলে এর সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে অযথা জোতদারের বিরাগভাজন হতে চাননি। দিনাজপুরের যে সমস্ত থানায় এ আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে সেগুলো হচ্ছে আটওয়ারী, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁ, বীরগঞ্জ, কাহারুল, ফুলবাড়ী, চিরিরবন্দর, বালুরঘাট, ইটাহার, সেতাবগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও রানীসংকোল।
দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়মকে অস্বীকার করে জোতদারের খোলনের পরিবর্তে আধিয়ারের নিজস্ব খোলনে ধান তোলা এক এক আধিয়ারের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া নিজ খোলনে ধান তোলার চেষ্টা করলে জোতদার বরকন্দাজ বা পুলিশের সাহায্যে তাতে বাঁধা দেবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই কৃষক সমিতি সিদ্ধান্ত য়ে যে সংগঠিত কৃষকরা দলবদ্ধভাবে এক একদিন একেক জন আধিয়ারের ধান কাটবেন। সেই অনুযায়ী শুরু হয় তেভাগার ধান কাটা। জোতদাররা পুলিশ সহযোগে আসে বাঁধা দিতে, ফলে বাঁধে কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষ। এরকম প্রথম সংঘর্ষটি অনুষ্ঠিত হয় দিনাজপুর জেলার আটওয়ারী থানার রামপুর গ্রামে।

আটওয়ারীর ঘটনা
আটওয়ারী থানার রামপুর গ্রামটি ছিল ৩ নং পাটাপাড়া থানার অন্তর্ভূক্ত। কালী বাবু ছিলেন এই ইউনিয়নের বড় জোতদার। তার খাস জমির পরিমাণ ছিল ৫০০ বিঘা, আর প্রজাপত্তন মিলিয়ে ছিল মোট ১৪০০ বিঘা জমি। ইউনিয়নের অপর উল্লেখযোগ্য জোতদার বিদ্যানাথ ঠাকুরের ছিল ৩০০ বিঘা জমি। অপরাপর জোতদারের মধ্যে ছিলেন বাচাবাবু, পাচুবাবু, বীনাবাবু ও স্বণকুমার পন্ডিত।
আধিয়াররা নিজ খোলনে ধান তোলার কথা চিন্তা করছে এই সংবাদ পেয়েই কালী বাবু স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পুলিশ আনিয়ে নিজ বাড়িতে রাখেন। যেদিন কৃষকরা সংগঠিতভাবে ধান কাটতে যাবেন সেদিন পুলিশ যে কোন সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। কৃষক সমিতির নেতৃত্বে সাধারণ কৃষকরা এই নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করেই মাঠে যেয়ে হাজির হন এবং ধান কাটতে শুরু করেন। মেয়েরা ধান ভানার গাইন, ঝাটা প্রভৃতি হাতে পাহারায় থাকেন।
পুলিশ কৃষকদের গ্রেফতার করতে মাঠে এলে মেয়েরাই প্রথম তাদের বাঁধা দেন। এই এলাকার মেয়েদের, বিশেষতঃ পোলিয়া রমণীদের, মনে যেমন ছিল সাহস বাহুতে ছিল তেমন বল। এঁরা পুলিশকে তো ঠেকিয়ে রাখেনই, উপরন্তু তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন পুলিশের দাঁত ভেঙে যায়। একজন পোলিয়া রমণী পুলিশের হাত থেকে একটি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে নিজ হাঁটুর ওপর বাড়ি মেরে তাকে দু’টুকরো করে ফেলেন। লেদী, বর্মনী, জয়নালের মা প্রমুখ লড়েন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে। এরপর পুরুষরা এসে মেয়েদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় পুলিশ বাধ্য হয়ে পিছু হটে।
মাঠে সুবিধা করতে না পেরে এরপর পুলিশ বাড়ি বাড়ি যেয়ে আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠকদের গ্রেফতার করতে শুরু করেন। বর্ষীয়ান অথচ নেতা মঙ্গলু মোহাম্মদ, জঙ্গী নেতা অভরন, পোহালু বর্মন, চিত্তমোহন, সিরাজ মিয়া, চুনী ও রজনীসহ মোট ১৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে ঠাকুরগাঁয়ে চালান দেয়।
আসামীরা আড়াই দিন হাজত বাসের পর ঠাকুরগাঁয়ে তৎকালীন এস, ডি, ও ফনী মুখার্জী কৃষকদের বক্তব্য শোনার জন্য মঙ্গলু মোহাম্মদকে খাস কামরায় ডেকে পাঠান। ‘তারা কেন এই সমস্ত করছেন’ এই প্রশ্নের উত্তরে বর্ষীয়ান কৃষক নেতা জানান যে তারা আন্দোলনে নেমেছেন পেটের দায়ে—এক বিঘা জমি আবাদ করতে অন্তত পাঁচটা চাষ দিতে হয়, হালের খরচ আছে, আছে গরুর খরচ। তারপর আছে ধান কাটা, ধান মাড়া। এতকিছু ছাড়াও আছে জোতদারের খোলনে ধান তোলা যারা সুযোগ নিয়ে সে ভালো ধানগুলো রেখে দিয়ে খারাপ ধানগুলো দেয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই প্রয়োজন নিজ খোলনে ধান তোলা, প্রয়োজন তেভাগা। এস, ডি, ও তখন আধিয়ারদের দাবীগুলোকে লিখিতভাবে দেবার জন্য বলেন। জোতদারদের বক্তব্যেও তিনি আহ্বান করেন লিখিতভাবে। এরপর গ্রেফতারকৃত ১৩ জন বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
প্রথম ঘটনার দু’দিন পরেই আটওয়ারীতে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষ। রামপুরের কৃষকরা অপর আরেকজন আধিয়ারের ধান কাটার জন্য মাঠে যান, আশেপাশের অন্যান্য অনেক গ্রাম থেকেও কৃষকরা এসে তাদের সঙ্গে ধান কাটায় শরীক হন। ফলে কটিয়ের সংখ্যা পৌঁছে যায় কয়েক শ’তে। পুলিশ কৃষকদের গ্রেফতার করতে এলে কৃষকরা হয়ে ওঠেন মারমুখী। পুলিশের কাছ থেকে তিনটা রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে কৃষকরা তা আছড়িয়ে ভেঙে ফেলেন। এরপর পুলিশ গ্রেফতার করা শুরু করে এবং ফিচক, শীতলবর্মন, কনাই ও পঞ্চাননসহ মোট ২৬ জন বন্দী অবস্থায় ঠাকুরগাঁয়ে পাঠায়।
আধিয়াররা এস, ডি, ও-র কাছে তাদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হিসাবে দেখান যে প্রতি বিঘা জমি চাষ করতে খরচ হয় ৩৫ টাকা, আর তাতে ধান উৎপন্ন হয় গড়ে ৮ মণ। ভাগাভাগির পর আধিয়ার পান ৪ মণ—যার মূল্য দাঁড়ায় সর্বাধিক ২০ টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত ৩৫ টাকার বদলে একজন কৃষক পান মাত্র ২০ টাকা, এতে তাদের পোষায় না। তাই আধির বদলে যদি তেভাগা হয়, কেবল তাহলেই তাদের পোষাতে পারে। জোতদারদের পক্ষ থেকেও বক্তব্য লিখিতভাবে দেয়া হয়। এস, ডি, ও এরপর আলোচনার জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দেন।
নির্দিষ্ট দিনে আটওয়ারী অঞ্চলের কৃষক কর্মী ও জোতদাররা হাজির হন আলোচনাস্থলে। আলোচনায় কি হয় দেখার জন্য অনেক কৃষক সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কৃষক সমিতির জেলা নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এই আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজী মোঃ দানেশ। এস, ডি, ও উভয়পক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনার পর এই মর্মে রায় দেন যে এখন থেকে ঐ অঞ্চলের কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগই পাবেন। তখন উপস্থিত দর্শকদের মধ্য থেকে অত্যুৎসাহী কৃষক কর্মী কুথা বর্মন ‘তেভাগা চাই না, জোতদারের নাই ভাগ’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ চিন্তাটি দাবী আকারে না এলেও শ্লোগান ও বক্তব্য আকারে এসেছিল এবং ঐ অত্যুৎসাহী কৃষক কর্মী সম্ভবতঃ ঐ চিন্তা থেকে উদ্দীপিত হয়ে ‘জোতদারের ভাগ না থাকার কথা ‘ সরবে ঘোষণা করেন। এস, ডি, ও বুঝতে পারেন যে তেভাগার দাবীই কৃষকদের শেষ দাবী নয় বরং একে একে আরো অধিকতর আন্দোলনের দিকে কৃষক সমাজ এগিয়ে যাবে এবং তিনি সাথে সাথে মিটিং ভেঙে দেন। গৃহীত হবার মুখে এসেও সিদ্ধান্তবিহীনভাবে মিটিং সমাপ্ত হয়।
প্রতিটি মাঠেই এরপর থেকে ধান কাটার জন্য আধিয়াররা যেতে সংঘবদ্ধভাবে, সব জায়গাতেই আসতো পুলিশ। ফলশ্রুতিতে ঘটতো কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষ। কৃষক কর্মীরা গ্রেফতার হতেন। কৃষক সমিতির প্রতি সহানুভূতিশীল ঠাকুরগাঁর মতিবাবু মোক্তার, কেরামত আলী মোক্তার, আজিজ মোক্তার প্রমুখ এদের জামিনের ব্যবস্থা করতেন। (১৪)

বোদা, পঁচাগড় ও দেবীগঞ্জ
তিস্তা নদী জলপাইগুড়ি জেলাকে ভাগ করেছে দু’ভাগে। নদীর পূর্ব পাড়ে ভুয়াস, পশ্চিমে জলপাইগুড়ি শহর। শহরের সংলগ্ন গ্রামগুলি ছিল কৃষক সমিতির এলাকা, তবে জেলায় কৃষক সমিতির সবচেয়ে ভাল সংগঠন ছিল বোদা, পঁচাগড়, দেবীগঞ্জ প্রভৃতি থানায়—এসবগুলিই দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে পড়ে দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ছেড়ে মার্কসবাদে দীক্ষা গ্রহণকারী মাধব দত্ত ছিলেন ভোলা কৃষক সমিতির সম্পাদক।–বোদা, পঁচাগড় আর দেবীগঞ্জের প্রায় প্রতিটি কৃষকের ঘরে তিনি ছিলেন পরিচিত। তিনি তাদের সাথে এত আপন হয়ে মিশে গেছিলেন, যে অনেক সময় ‘কোন কৃষকের বাড়ির পাশ দিয়ে তিনি হেঁটে গেলে চলার শব্দ শুনে ঘরের লোক বুঝতে পারতেন যে মাধব বাবু যাচ্ছেন।’ (১৫)
মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা অপরাপর যেসব কম্যুনিস্ট কর্মী তখন এসব থানায় কাজ করতেন তাদের মধ্যে ছিলেন চারু মজুমদার (পরবর্তীকালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের নেতা), গুরুদাস রায়, শচীন দাসগুপ্ত, হরো ঘোষ, সমর গাঙ্গুলি, ধীরে পাল, বীরেন নিয়োগী ও নরেশ চক্রবর্তী।
এই অঞ্চলে কৃষকদের মধ্য থেকে নেতা হিসাবে বেরিয়ে এসেছিলেন বাচ্চামুন্সী। বেটে খাটো, রোগা দাঁড়িওয়ালা এই মানুষটিকে রাজবংশী কৃষকরা দেখতেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে। বাচ্চা মুনশী মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারতেন অক্লান্তভাবে, নিপুন বাগ্মীতায় জনসভায় উপস্থিত প্রতিটি কৃষকের মনকে করে তুলতে পারতেন আলোড়িত। বড় জোতদারের ছেলে দীপেন রায় কৃষক সমিতিতে যোগ দিযে দেবীগঞ্জ এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী কৃষক সংগঠন।
কৃষক সমিতির সংগঠিত এলাকা হিসাবে এই তিনটি থানার অধিকাংশ আধিয়ারই জোতদারদের তোয়াক্কা না করে নিজ খোলনে ধান তোলেন। গ্রামে গ্রামে ভলান্টিয়ার বাহিনী গঠন করে সভা, মিছিল, মিটিং মারফত তেভাগার দাবীকে এর পূর্বেই জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল।
১৯৪৭-এর জানুয়ারীর প্রথম ভাগ আসতে দেখা যায় যে কৃষকদের সংগঠিত শক্তিকে জোতদাররা ভয় পেতে শুরু করেছেন। তাদের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। নিজ খোলনে ধান তোলার পর বর্গাদাররা মাড়াইয়ের কাজ শুরু করেন এবং জোতদারদের কাছে এই মর্মে খবর পাঠান যেন তারা শীঘ্র এসে তাদের প্রাপ্য এক-তৃতীয়ংশ ধান নিয়ে যান। দু’চারজন জোতদার এলেও অধিকাংশ জোতদারই ধান নিতে আসেননি।

শ্রমিক কৃষক মৈত্রী
দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়িসহ ভারতের ১৯টি জেলায় বর্গাচাষীরা তেভাগার দাবীতে পূর্ণোদ্যমে সংগ্রাম পরিচালনা করছেন তখন, ১৯৪৬ সালে, কতকগুলি দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে রেল শ্রমিকেরাও ঐক্যবদ্ধ হন এবং রংপুরের লালমনিরহাটে রেল শ্রমিকদের এক আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক সমিতির কর্মীরা এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। শ্রমিক-কৃষকের মিলিত কন্ঠে আওয়াজ ওঠে ‘রেল-শ্রমিকদের দাবী মানতে হবে’, ‘তেভাগার দাবী মানতে হবে’, দুনিয়ার মজুর-চাষী এক হও’। (১৬)
শ্রমিক কৃষকের এই ঐক্য পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুরেও যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাংবাদিক গোলাম কুদ্দুসের লেখা থেকে—
‘….দিনাজপুরে এসে ফুলবাড়ীর মাঠে প্রথম তেভাগার ধান কাটা দেখলাম। একটা লাল নিশাল পুঁতে রেল-লাইনের ধারে ধানকাটা হচ্ছিল। মাঝে মাঝে গানও গাওয়া হচ্ছে। একজন তামাক সাজছে সারাক্ষণ। কয়েকজন লোক ভাত-রাধার আয়োজন করছে। আজ মাঠেই বনভোজনের ব্যবস্থা।
এই সময় দার্জিলিং জেলা পাস করে। হঠাৎ সেই দূরন্ত গাড়িটা মাঠের মধ্যে আমাদের কাছাকাছি এসে থেমে গেল। ড্রাইভার এবং ফায়ারম্যানেরা হাসছে, আর হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলতে বলতে কাস্তে হাতে একদল কৃষক ইঞ্জিনের দিকে দৌড়ে গেল। ওদিকে ওরাও গাড়ি থেকে পাল্টা ধ্বনি দিচ্ছে। গাড়ির যাত্রীরা হতবাক হয়ে এই কান্ড দেখছে। হঠাৎ শুনলাম ধ্বনির ভাষাটা বদলে দিয়ে কে যেন বলে উঠলে—কৃষক মজুর এক হও।…..
ওদিকে গাড়ির পেছন থেকে গার্ড ক্রমাগত তার ফ্লাগ নেড়ে আর বাঁশি বাজিয়ে ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু গাড়িটার নড়ার লক্ষণ নেই। কারণ তখন কৃষকদের হাত থেকে একটা লাল নিশান নিয়ে ইঞ্জিনের মাথায় বাঁধা হচ্ছিলো। তখন মনে হচ্ছিল দার্জিলিং মেলের মতোই আন্দোলন বাঁধা লাইন দিয়ে দ্রুত সম্মুখে ধাবিত হবে।’ (১৭)

চিরিরবন্দর : প্রথম গুলি চললো
তখন স্থানীয় কৃষক নেতাদের দায়িত্ব ছিল কৃষক সমাবেশ করা, কার ধান কবে কাটা হবে সেই কর্মসূচী ঠিক করা কৃষকরা লাল ঝান্ডা ও লাঠি সমভিহারে মার্চ করে যেতেন ধান কাটতে। অনেক সময় কৃষকরা নিজেরাই কার ধান কবে কাটা হবে তা নির্ধারণ করতেন। পুলিশ যেখানেই গ্রেফতার করতে যেতো, সেখানেই বাঁধতো সংঘর্ষ। এরকম একটি সংঘর্ষের ঘটনা থেকেই চিরিরবন্দরে পুলিশ গুলি চালায়।
মফিজ চৌধুরী ছিলেন চিরিরবন্দরের বড় জোতদার। অপরাপর জোতদারদের মধ্যে ছিলেন মনাবাবু, নির্মল চৌধুরী, রাজন চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী, নসীর চৌধুরী, বিনোদ মেকার, দুর্গাবাবু, হরমোহন ঠাকুর, রামলাল চৌধুরী, মতিলাল চৌধুরী, মহেন্দ্রলাল চৌধুরী প্রমুখ। কৃষকরা নিজ খোলনে ধান তুলতে শুরু করলে এরা কৃষকদের আসামী করে মামলা দায়ের করে। লাল মোহাম্মদ মুন্সী ছিলেন দল্লা গ্রামের একজন গরীব চাষী এবং স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসেন। জোতদাররা তাকে সহ সমিরুদ্দিন, কান্দু, কংস, প্রসূন সাহা প্রমুখকে আসামী করে।
মামলা দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারী শেষ রাতের দিকে পুলিশ দল্লা গ্রামে আসে এবং লাল মোহাম্মদ মুন্সীর বাড়ি ঘেরাও করে তাকে গ্রেফতার করে। বাজিতপুর গ্রামে সমিরুদ্দিনের বাড়িতেও পুলিশ যেয়ে ঢোকে। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে চাইলে তার বোন প্রতিবাদ করেন। তখন পুলিশ তার পায়ে সঙ্গীনের খোঁচা মেরে তাকে আহত করে এবং জোর করে সমিরুদ্দিনকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। এরপর অপরাপর ছ/সাতজন আসামীকেও গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যেই রাতের আধাঁর কেটে সকাল হয়ে আসে এবং পুলিশ বাহিনী আসামীদের নিয়ে চিরিরবন্দর রেল স্টেশনের দিকে অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে সমস্ত এলাকায় খবর পৌঁছে যায় যে কৃষক কর্মীদের গ্রেফতার করে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে শ’য়ে শ’য়ে কৃষক কর্মী লাঠি হাতে স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ তখন সবে তালপুকুর মোজা অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ধাবমান জনতা তাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাদেরকে ঘিরে ফেলে। উত্তেজিত জনতা বন্দী কৃষকদের তাৎক্ষণিক মুক্তি দাবী করে। পুলিশও থাকে সিদ্ধান্তে অটল। ফলে কথাবার্তা বচসার রূপ নেয় এবং ক্রমে তা পরিণত হয় হাতাহাতিতে। হাতাহাতির এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠি দিয়ে সম্মুখবর্তী শিবরামকে প্রচন্ড প্রহার শুরু করে। তখন অপরাপর কৃষকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন পুলিশের ওপর। পুলিশ তৎক্ষণাৎ শুরু করে গুলিবর্ষণ। প্রথমে দু’এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করলেও পরবর্তীতে তারা সমবেত কৃষকদের ওপর সরাসরি গুলি চালায়। ফলে সম্মুখভাগে অবস্থানকারী জঙ্গী কৃষক নেতা সমীর দাই গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথে মারা যান। সাথীর মৃত্যুদর্শনে কৃষকরা হয়ে ওঠেন আরো বেপরোয়া। সাঁওতাল কর্মী শিবরাম তৎক্ষণাৎ হাতে তীরধনুক তুলে নিয়ে হত্যাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়েন। শীতের ভোরে পড়ে থাকা মোটা ওভারকোটে ভেদ করে সেই তীর ঐ পুলিশের হৎপিন্ডে গেঁথে যায় এবং সে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। তারপরই অন্য একজন পুলিশের গুলিতে শিবরাম নিহত হন। এরপর শুরু হয় ঝাঁকে ঝাঁকে তীব্র বর্ষণ। কিন্তু পুলিশ যেহেতু মোটা ওভারকোট পরেছিল সেহেতু বেশিরভাগ তীরই তাদের গায়ে বিধছিল না। তখন আট-দশজন সাঁওতাল একজন পুলিশকে ধরে ফেলেন এবং প্রধান মাঝি নামে একজন সাঁওতাল কর্মী তার পেটে তীর ঢুকিয়ে দেন। আহত অবস্থায় পুলিশটিকে দিনাজপুর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে বিকেল তিনটার দিকে সে মৃত্যুবরণ করে।
সমিরুদ্দিনের বাড়ি ছিল বাজিপুর গ্রামে। তিনি নিজে ছিলেন একজন ক্ষেত মজুর। তেভাগা অর্জিত হলে তার ব্যক্তিগত কোন লাভ ছিল না, তথাপি তিনি আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন এবং আন্দোলনরত অবস্থাতেই মৃত্যুকে বরণ করে নেন। তখন তার বয়স ছিল ত্রিশ। স্বামী, স্ত্রী ও চার অথবা পাঁচটি সন্তান সমবায়ে গঠিত তার পরিবারের তিনি ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ২৩/২৪ বছর বয়স্ক শিবরামের বাড়ি ছিল তালপুকুর গ্রামে। জীবিকায় তিনি ছিলেন একজন আধিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবনে সদ্য বিবাহিত।
এরপর আসে চরম নির্যাতনের পালা। ৮০০ থেকে হাজারখানেক ফোর্স তালপুকুর থেকে কাউগাঁ স্টেশন পর্যন্ত পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেলে। তারপর শুরু করে একদিক থেকে পেটানো—যাকে সামনে পায় তাকেই পেটায়। শ’তিনেক কৃষককে পুলিশ গ্রেফতার করে। ‘পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র—এই ৩/৪ মাস মানুষ বাড়িতে থাকতে পারেনি। ভোরবেলা থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে, তাও মন উচাটন—কোথাও পুলিশ আসছে নাকি। সন্ধ্যে হলে ভাত খেয়ে সব খালে আশ্রয় নিতো—শিয়ালের খালেও মানুষ থাকতো।’
চিরিরবন্দরে জঙ্গী কৃষক কর্মীদের অন্যতম ছিলেন কান্দু। তিনি ও তার আরেক ভাই কৃষক সমিতি করতেন। তার মাও ছিলেন জঙ্গী প্রকৃতির। পুলিশ তার দুই ছেলেকে গ্রেফতার করতে এলে তিনি লাঠি হাতে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এলাকার মহিলাদেরকে সংগঠিত করার ব্যাপারেও তার উদ্যোগী ভূমিকা ছিল।
চিরিরবন্দরে উল্লেখযোগ্য কৃষককর্মীদের মধ্যে লাল মোহাম্মদ মুন্সী ছাড়াও ছিলেন—সমিরউদ্দিন, দর্প, বেনীম ধব, মধু, কৃষ্টমোহন, গজীন, চন্দ্রকান্ত, সিদ্ধি, নয়ান, হরিপদ মাস্টার প্রমুখ। সাঁওতালদের মধ্যে ছটকা হাজদা, মুন্সী সরেন, বৈরাগী কিসকু, শিবরাম, খিলু, হাজদা, প্রধান মাঝি, চোকা মাঝি, বুধু হাজদা প্রমুখ ছিলেন নেতৃস্থানীয়। মধু ছিলেন খুব ভাল বক্তা। কিছু লেখাপড়া জানা সাঁওতাল কর্মী ছটকা ছিলেন খু্ব উদ্যোগী পুরুষ। কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুশীল সেন, গুরুদাস তালুকদার, কালী সরকার, হাজী দানেশ, বরদা ভূষণ চক্রবর্তী প্রমুখ এই এলাকায় মাঝে মাঝে আসতেন। তবে এলাকায় সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন সুধী সমাজপতি।
চিরিরবন্দরের বেশিরভাগ মিটিং হতো দুর্গাডঙ্গায়। কৃষক সমিতির সাঁওতাল কর্মী বৈরাগী কিসকু ও খিলু হাজদা সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে জানান যে—চিরিরবন্দর এলাকায় তখন এক কম্যুনিস্ট পার্টি ছাড়া আর অন্য কোন পার্টি ছিল না। কেবল জোতদাররা ‘কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ’ পার্টি করতেন। আন্দোলনের মুখে জোতদাররাও সমিতিতে ঐক্যবদ্ধ হন। ঐ জোতদার সমিতির নেতা ছিলেন রামলাল চৌধুরী, মতিলাল চৌধুরী, মনাবাবু ও রজিন চৌধুরী।
পুলিশ কর্তৃক ব্যাপক অত্যাচারের পরে পরেই জোতদাররা আধিয়ারদের খোলনে ভেঙে নিজ নিজ খোলনে ধান তোলেন। এদের কেউ কেউ আধিয়ারদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ভাগ দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ পুরা ধানটাই আত্মসাৎ করেন। মনা জোতদার স্বপক্ষভূক্ত কিছুসংখ্যক কৃষককে নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘বাহিনী’। এবং পুলিশকে সাথে করে নিজে ঘোড়ায় চড়ে কৃষকদের পিটিয়েছেন।
কিন্তু পুলিশের এই গুলিবর্ষণ ও ব্যাপক অত্যাচারের ঘটনাতেও এলাকার কৃষক কর্মীরা সংগঠনের প্রতি আস্থা হারাননি। তারা গোপনে সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। (১৮)

বর্গাদার বিল
চিরিরবন্দরে যেদি গুলি বর্ষিত হয় তার পরদিন সিরাজগঞ্জের এক জনসভায় ভাষণদানকালে তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান ঘোষণা করেন যে বর্গাদার উচ্ছেদ রোধ করার জন্য এবং তারা যেন দুই-তৃতীয়াংশ পায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য তার সরকার শীঘ্রই একটি বিল আনবেন। কলকাতা গেজেটে ১৯৪৭ সালের ২২শে জানুয়ারী ক্যালকাটা গেজেটে এই বিলটি ‘বেঙ্গল বর্গাদার্স টেম্পোরারী রেগুলেশন বিল’ নামে নিয়ে প্রকাশিত হয়।
বিলটিতে বলা হয় যে যেখানে জোতদার ‘চাষের বলদ, লাঙল ও অন্য কোন কৃষি যন্ত্রপাতি ও সার’ দেবেন, সেখানে বর্গাদার পাবেন উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক অংশ। কিন্তু জোতদার এসব জিনিস না দিলে পাবেন দুই-তৃতীয়াংশ। বীজ জোতদার দিলে জোতদার তা ফেরত পাবেন এবং বীজ বর্গাদার দিলে তা বর্গাদার পাবেন। বীজ জোতদার বর্গাদার দু’জনেই দিয়ে থাকলে দেয়া বীজের আনুপাতিক হারে তা তাদের মধ্যে ভাগ হবে। বিলের ঘোষিত লক্ষ্যে উচ্ছেদ বন্ধের কথা থাকলেও বস্তুতঃ জোতদারদেরকে বর্গাদার উচ্ছেদের যথেষ্ট সুযোগ ছেড়ে দেয়া হয়। বিলে উল্লেখ ছিল যে যদি জোতদার ‘নিজে কিংবা তার পরিবারের লোকজনের সাহায্যে জমি চাষ করতে চান’ তাহলে বর্গাদার উচ্ছেদ করতে পারেন। যদি ‘জমির কোন অপব্যবহার হয়ে থাকে’ বা বর্গাদার যদি ‘উপযুক্তভাবে জমি চাষ করতে ব্যর্থ হয়’ অথবা সে যদি ‘এই আইনের ব্যবস্থা অনুযায়ী মালিককে ফসলের এমন কোন অংশ দিতে অপারগ হয়ে থাকে যেটা মালিকের সঙ্গে কোন ঘোষিত বা উহ্য চুক্তি অনুযায়ী তাকে সে দিতে বাধ্য’ তাহলেও জোতদার তাকে উচ্ছেদ করতে পারেন।
কি উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী বর্গাদার বিল এনেছিলেন তা পরিষ্কার নয়। সম্ভবতঃ আন্দোলনকে মাঝ পথে স্তিমিত করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই বিলটি আনা হয়েছিল। যাইহোক বিলটি ধামা-চাপা দেয়া হয় এবং আইন সভায় মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভাকে কম্যুনিস্ট গ্রুপের নেতা জ্যোতি বসু এভাবে অভিযুক্ত করেন যে, বিলটির খসড়া তৈরির সময় তাঁরা আসলে ‘লোক দেখানো খেলা খেলেছেন।’ বিলটি পাশ করাতো দূরে থাক, আসলে আইন সভাতেও পেশ করা হয়নি।
তবুও বিলটির কিছু ইতিবাচক দিক ছিল এবং এ বিল তেভাগা আন্দোলনে যথেষ্ট উৎসাহ যুগিয়েছিল। ‘তেভাগার দাবী বেআইনী’—একথা জোতদাররাও আর সরাসরি বলতে পারতেন না। বর্গাদারদের জন্য দুই-তৃতীয়াংশের দাবী সরকার মেনে নিয়েছেন—এ খবর ছড়িয়ে পড়লো দিকে দিকে। ফলে নিরপেক্ষ, নিষ্ক্রিয়, দ্বিধান্বিত ব্যাপক সংখ্যাক বর্গাদারও আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। বিশেষতঃ মুসলমান কৃষকরা এরপর থেকে ব্যাপক সংখ্যায় আন্দোলনে যোগদান করে। ফলে অনেক নতুন নতুন এলাকায় কৃষক সমিতি গড়ে ওঠে এবং আন্দোলন আরো এগিয়ে যায়।

পুঁজ ভাঙা আন্দোলন
যেসব এলাকায় কৃষক সমিতির সংগঠন খুব শক্তিশালী ছিল না অথবা যেসব জোতদার খুব পরাক্রমশালী ছিলেন সেখানকার আধিয়াররা কৃষক সমিতির নিজ খোলনে ধান তোলার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে জোতদারের খোলনেই ধান তুলেছিলেন। বর্গাদার বিলের কথা প্রচারিত হতেই এরা ভাবলেন যে যেহেতু তারা জোতদারের খোলনে এর মধ্যেই ধান তুলে ফেলেছেন অর্থাৎ জোতদাররা হাতের মুঠোর মধ্যে ধান পেয়ে গেছে সেহেতু তারা নিশ্চয়ই এ বছর ফসলের দু্ই-তৃতীয়াংশ দিতে অস্বীকার করবে। তাই তারা সংগঠিত হওয়া শুরু করেন এবং কখনো কখনো কৃষক সমিতির অনুমোদন ছাড়াই জোতদারের পুঁজ (ধান কাটার পর মাড়াইয়ের জন্য সমবেত করে রাখা ধান) ভেঙে আসতে শুরু করেন। আন্দোলনটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র অর্জন করেন।
এতদিন পর্যন্ত কৃষক সমিতির আন্দোলন কেবলমাত্র বড় জোতদারদের বিপক্ষেই পরিকল্পিত হতো। কিন্তু বর্গাদার বিল অনুযায়ী যেহেতু ছোট বড় সমস্ত জোতদারই উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ আধিয়ারকে দেয়ার কথা, সেহেতু পুঁজ ভাঙা আন্দোলনও ছোট-বড় সমস্ত জোতদারের বিপক্ষেই পরিচালিত হতে শুরু করে। ফলে ছোট ভূ-স্বামী ও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিপক্ষে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। এই সময় প্রাদেশিক কিষাণ সভার পক্ষ থেকে দাবী করা হয় যে ‘এই বছরের ফসল সম্পর্কেই যাহাতে আধির বদলে তেভাগা ব্যবস্থা হয় তজ্জন্য তেভাগা অর্ডিন্যান্স জারী করা হউক।’ (১৯)

রাণী সংকোল
পুঁজভাঙা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় রাণী সংকোলে। সেখানে সংগঠনের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল পস্টরাম সিং ও তার স্ত্রী জয়মণির উপর। পস্টরাম সিং ছিলেন বালিয়াডাঙ্গী থানার পরিয়া গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষক, প্রায় ৪ বিঘা জমির মালিক। আয় বাড়ানোর জন্য তিনি ‘মোহান্ত’ (গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার) হিসাবেও কাজ করতেন। তার স্ত্রী জয়মণি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং লিখতে পড়তে শিখেছিলেন। কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পস্টরাম নিজের গ্রামের বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীসহ কিষাণ সভার নতুন ঘাঁটি রাণী সংকোলে কাজ করতে আসেন। রাণী সংকোলের অপর একজন রাজবংশী তরুণী কর্মী ভান্ডারী ছিলেন খুবই জঙ্গী ধরনের। জয়মণি এবং ভান্ডারী এক সাথে স্থানীয় মেয়েদের মধ্যে, বিশেষ করে রাজবংশী মেয়েদের মধ্যে, কাজ চালিয়ে যান এবং কৃষক সমিতিকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। পস্টরাম এবং জয়মণি উভয়েই ছিলেন খুব নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। রাণী সংকেলে অপর একজন জঙ্গী কর্মী ছিলেন রাজেন সিং। এছাড়াও অনিল চক্রবর্তী নামের একজন মধ্যবিত্ত কর্মী রাণী সংকোলে এসেছিলেন পস্টরামকে সাহায্য করার জন্য।
কৃষক সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে কৃষকরা সংগঠিতভাবে হয়ে স্থানীয় এক জোতদারের পুঁজ আক্রমণ করবেন এবং তা ভেঙে দিয়ে এসে আধিয়ারদের খোলনে তুলবেন। সফলভাবে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নও করা হয়। জোতদাররা তখন কৃষকদের বিরুদ্ধে ‘ধান লুটের’ মামলা দায়ের করেন। ফলশ্রুতিতে ২ ফেব্রুয়ারীতে পুলিশ রাণী সংকোলে আসে কিছু কৃষক কর্মীকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্য। পুলিশ আসতেই কৃষক সমিতির মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের একবাহিনী ভান্ডারীর নেতৃত্বে তাদেরকে ঘেরাও করে। তারা দারোগার হাত থেকে রিভলভার এবং পুলিশদের কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয় এবং পর্যুদস্ত দারোগাকে একটি বাড়ির মধ্যে আটকে রাখে। এই দারোগা, আওলাদ হোসেন ছিলেন হাজী দানেশের আত্মীয় এবং কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন। হাজী সাহেবের বাড়িতে পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীদের আসা যাওয়ার কথা জেনেও তিনি কখনো উচ্চবাচ্য করেননি বা এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেননি।
ঘটনার দিন কৃষ্ণবিনোদ রায়, সুশীল সেন, গুরুদাস তালুকদার, হাজী দানেশ প্রমুখ নেতৃবর্গ অবস্থান করছিলেন আটওয়ারী থানায়। রাজেন সিং দ্রুত সেখানে এসে পৌঁছান এবং ঘটনা বিবৃত করে করণীয় বিষয়ক পরামর্শ চান। কৃষ্ণবিনোদ রায়ের মত ছিল দারোগাকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার, কিন্তু সুশীল সেন, গুরুদাস তালুকদার, হাজী দানেশসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় কৃষক কর্মীরা পার্টির প্রতি ‘সহানুভূতিসম্পন্ন’ বলে দারোগাকে ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সুতরাং দারোগাকে পরদিন রাইফেলগুলিসহ ছেড়ে দেয়া হয়। তিনদিন পর দারোগা এক বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালান এবং বেশ কিছু কৃষককে গ্রেফতার করেন। এই দ্বিতীয়বারের ঘটনায় কোন প্রতিরোধ করা হয়নি। পুলিশ পস্টরাম, জয়মণি এবং ভান্ডারীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। (২০)।

পতিরাম
বালুরঘাটে ছিল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি এবং প্রথমদিকে কৃষক সমিতি এই মহকুমায় তেমন এগোতে পারেনি স্থানীয় কংগ্রেস কমিটির বিরোধিতার ফলে। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যখন কৃষকরা জোরদারের পুঁজ ভেঙে নিজেদের খামারে ধান তুলতে শুরু করলেন। আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে পতিরাম থানায় এবং আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন পতিরামের মোহান্ত পরিবার। কৃষ্ণদাস মোহান্ত, তার ছেলে ননীদাস ও নগেন্দ্রনাথ মোহান্ত, কৃষ্ণদাস মোহান্তের স্ত্রী, তার ছেলের স্ত্রী, নাতি—সবাই পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে পুলিশী তৎপরতার মুখে এদের পুরো পরিবারটিকে একই সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়। প্রায় ৩০ একরের মতো জমি ছিল। ননীদাস যুগান্তর দলের বিপ্লবী থাকা অবস্থায় আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হন। সেখানে তিনি মার্কসবাদকে গ্রহণ করেন কম্যুনিস্টদের সংস্পর্শে এসে। ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন ভেঙে যাবার পর মোহান্ত পরিবার কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে ননীদাস পার্টিতে যোগ দেন। তাদের প্রচেষ্টায় ক্রমে ক্রমে আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে পতিরামের আশপাশের গ্রামগুলিতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংঘটিত হয় ‘সিংহ কচরীতে।’ সেখানে পুঁজ ভেঙে ধান নিয়ে যাবার জন্য সমবেত কৃষকদের উপর গুলি চালান গোবিন্দ সিংহ নামক একজন ধনী জোতদার। কৃষকরা আহত হলেও ছত্রভঙ্গ হননি, বরং যথারীতি পুঁজ ভেঙে ধান নিয়ে তোলেন নিজ খামারে। (২১)

নবাবগঞ্জ
নবাবগঞ্জ থানায় পুঁজ ভাঙা আন্দোলনে কৃষক সমিতি একদিকে যেমন আংশিকভাবে সফল হয়, অন্যদিকে ব্যর্থও হয় আংশিকভাবে। সাফল্যের মধ্যে ছিল খামারপাড়ার বড় জোতদার সর্বানন্দ রায়ের পুঁজ ভেঙে নিয়ে আসা, আর ব্যর্থতার মধ্যে ছিল চিলেপাড়ার ঘটনা।
চিলেপাড়ার চৌধুরী পরিবারের অন্যতম শরীক আবুল হোসেন চৌধুরী ও ইসাহাক চৌধুরী ছিলেন বিরাট জোতের অধিকারী প্রতাপশালী জোতদার। তাদের এলাকায় কৃষক সমিতির সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়ার পরও আধিয়ারদের একটা অংশকে তারা নিজেদের পক্ষে রাখতে সমর্থ হন, বিশেষতঃ মুসলমান কৃষকদের একটা অংশ তাদের পক্ষে কাজ করে। কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই হিন্দু হওয়ায় তারা তেভাগা আন্দোলনকে ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র’ হিসাবে আখ্যায়িত করে মুসলমান আধিয়ারদের অন্ততঃ সিকি অংশকে স্বপক্ষে টেনে নেন। এই আধিয়াররা লাঠি হাতে জোতদার চৌধুরীদের বাড়ি পাহারা দিতেন। ফলে কৃষক সমিতির নেতৃত্বে সংগঠিত কৃষকরা চৌধুরীদের পুঁজ ভেঙে আনতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। (২২)

পার্বতীপুর
পার্বতীপুর থানার শিবনগর গ্রামের তমিজ গোমস্তা ছিলেন একজন বড় জোতদার। কালিকাপুর গ্রামের খড়কু রায় ও শেখরপুরের বর্মন পরিবারের কয়েক ভাই ছিলেন থানার অপরাপর উল্লেখযোগ্য জোতদার। কৃষক সমিতি স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করে শিবনগর, কালিকাপুর ও শেখরপুরের জোতদারদের পুঁজ ভাঙার কর্মসূচী ও দিনক্ষণ ঠিক করে। প্রথমদিন তমিজ গোমস্তার পুঁজ ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়।
নির্দিষ্ট দিনে সমবেত কৃষকরা পরিকল্পনা মাফিক তমিজ গোমস্তার বাড়িতে যেয়ে হাজির হন। কৃষকরা আক্রমণ করতে আসবে—এই সংবাদ পেয়ে গোমস্তা সাহেব আগে থেকেই বাড়িতে সশস্ত্র পুলিশ আনিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সমবেত কৃষকরা সংখ্যায় এত ব্যাপক ছিলেন যে উপস্থিত স্বল্প ক’জন পুলিশ জনস্রোতকে বাঁধা দেয়া নিরাপদ নয় মনে করে চুপচাপ থেকে চান। কৃষকদের আগমনে মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। কালী সরকার তখন আগ বাড়িয়ে তাদেরকে এই মর্মে আশ্বস্থ করেন যে তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অশালীন আচরণ করা হবে না, ‘আমরা আমাদের কাজ করেই চলে যাব’—তিনি জানান। এরপর দু’একদিনের মধ্যে একের পর এক তিন জোতদারেরই পুঁজ ভেঙে ফেলে হয়। কালী সরকারের সাথে খবীর শেখ এসব আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। (২৩)

বীরগঞ্জ
বীরগঞ্জের বড় জোতদার ছিলেন মিতলাইয়ের তফির চৌধুরী, মরিচা ইউনিয়নের নূরুদ্দিন চৌধুরী, নিজ পাড়া গ্রামে গঙ্গাধর মন্ডল, দেবীপুরের আজিমউদ্দিন চৌধুরী, চৌপেখেরিয়ার হালিম মিয়া ও গফার পন্ডিত প্রমুখ। ব্রাহ্মণভিটার পিয়ার আলী, নিজামউদ্দিন, মাহতাবুদ্দিন, খতীবউদ্দিন প্রমুখ ছিলেন এতদঞ্চলের কৃষক সমিতির নেতা। স্থানীয় জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন সাঁওতাল। এরা কৃষক সমিতিতে যোগ দেন এবং মনু সাঁওতাল এলাকার অন্যতম নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এখানকার কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে করা হয়েছিল যে সমিতির রসিদ না দেখালে কারো কাছে কোন বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করবেন না। এটা কার্যকরী হবার ফলে স্থানীয় জোতদাররা খুব বিপদগ্রস্ত অবস্থায় পড়েন। ফলে ঘটনা এরকমও ঘটেছে যে জোতদাররা কৃষক সমিতিতে চাঁদা দিয়ে রসিদ নিয়ে বাজারে জিনিসপত্র কেনার সুযোগ লাভ করেন।
বীরগঞ্জের দেবীপুর গ্রামের জোতদার আজিমউদ্দিন উকিলের বাড়ির পুঁজ সংগঠিত কৃষকরা এসে ভেঙে নিয়ে যায়। আজিমউদ্দিন চৌধুরী তার একজন আধিয়ার পোহাতু মোহম্মদকে ‘ধর্ম ছেলে’ বানিয়েছিলেন। এই ‘ধর্ম ছেলে’ কৃষক সমিতির সংস্পর্শে এসে সংগঠিত হন এবং তেভাগা দাবী করেন। কিন্তু ‘ধর্ম বাপ’ আজিমউদ্দিন চৌধুরী তার দাবী মানতে রাজী হননি, ফলে আধিয়ার ধর্মছেলে সংগঠিত কৃষক বাহিনীসহ এসে পুঁজ ভেঙে নিয়ে যেয়ে নিজ খোলনে তোলেন। আজিমউদ্দিন সাহেব এক সাক্ষাৎকারে অবশ্য ভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ তার ধর্ম ছেলের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে পুঁজ ভাঙার জন্য আসতে বাধ্য করে। তার মতে ‘কৃষকরা’ এসব আন্দোলনের মধ্যে আসতে চাননি, কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ জোর করে তাদেরকে দিয়ে এসব করিয়েছে। কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দ যে কৃষকদের ওপর জোর করে এসব করিয়েছেন তা তিনি কৃষকদের মুখ থেকেই শুনেছেন—তেভাগার আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পর আধিয়াররা নিজ মুখে তার কাছে একথা স্বীকার করেছেন। অবশ্য আজিমউদ্দিন সাহেব তার সাক্ষাৎকারের অন্য একটি জায়গায় কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু সংগঠিত চরিত্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা তার উপরোক্ত বক্তব্যের ভিন্ন চিত্রকেই বহন করে। তার ভাষায়—‘কৃষকরা ছিল যথেষ্ট সংগঠিত। তারা ইনকিলাব ধ্বনিটাকে সংকেত হিসাবে ব্যবহার করতো। পুলিশ আসছে দেখে একজন হয়তো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করে উঠতেন, সেটা শুনে পার্শ্ববর্তী অন্য কোন স্থান থেকে আরেকজন ইনকিলাব ধ্বনি দিতেন—এভাবে এপাড়া ওপাড়া থেকে ওপাড়া হয়ে এলাকার সবগুলি পাড়াতেই তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়তো সেই সংকেত।’ তার কথায়-‘৫/৭ হাজার সমবেত কৃষক যখন একসাথে লাঠি দিয়ে মাটির উপর ঠকঠক শব্দ করতেন, তখন মনে হতো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।’
এলাকার প্রায় সমস্ত জোতদারের পুঁজই সংগঠিত কৃষকরা ভেঙে নিয়ে গেছিলেন। বিরাট জোতের অধিপতি নুরুদ্দিন চৌধুরীর বিপক্ষে জনমনে ক্ষোভ এতই ব্যাপক ছিল যে তার এলাকার মিছিল মিটিংয়ে শ্লোগান উঠেছিল—‘নুরুদ্দিন চৌধুরীর কল্লা চাই।’ আতঙ্কগ্রস্ত এই জোতদার নিজ বাড়িতে থাকা নিরাপদ মনে করেননি বলে জলপাইগুড়িতে পলায়ন করেন। জলপাইগুড়ির জমিদাররা ছিলেন তার শ্বশুরকূলের আত্মীয়। তাদের সাহায্যে তিনি জলপাইগুড়ি থেকে গোর্খা রেজিমেন্টের কিছু সৈনিককে গ্রামে নিয়ে আসেন, তাঁবু ফেলে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং এইভাবে কৃষক সংগঠনকে মোকাবিলা করেন। (২৪)

আপোষ প্রচেষ্টা
কৃষকদের ক্রম শক্তি সঞ্চয়কারী আন্দোলনের মুখে জোতদাররা কৃষকদের সাথে আপোষে আসার চিন্তা করতে থাকেন। তখন দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তোরাব আলী হাজী দানেশ ও সুশীল সেনের কাছে পত্র পাঠান আপোষ আলোচনায় বসার প্রস্তাব জানিয়ে। তাঁরা আলোচনায় বসতে রাজী হন এবং ঠাকুরগাঁ কোর্টের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এখানে অংশগ্রহণ করেন তোরাব আলী ছাড়াও বালুরঘাট, সদর ও ঠাকুরগাঁ মহকুমার এস, ডি, ওরা, জোতদারদের পক্ষে ছিলেন কেরামত আলী, আজিমউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। কৃষক সমিতির তরফ থেকে ছিলেন হাজী দানেশ, সুশীল সেন ও জানু সিংহ। আপোষ আলোচনা উপলক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১১—১২ হাজার কৃষক ঠাকুরগাঁ মাঠে সমবেত হলেন যাদের ভেতর প্রচুর সংখ্যক মহিলাও ছিলেন। কৃষক সমাবেশ থেকে রামলাল, কালা বর্মন, বিনোদ, যুগল প্রমুখকে কৃষক প্রতিনিধি হিসাবে আলোচনায় আহ্বান করা হয়।
জোতদার পক্ষের প্রস্তাব ছিল যে ফসলের ভাগাভাগি হবে ন’আনা, সাত আনা। আধিয়ার পাবেন ন’আনা এবং জোতদার সাত আনা। স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা এ প্রস্তাবে রাজী হননি এবং তারা প্রস্তাব রাখেন দশ আনা—ছ’আনার। অর্থাৎ আধিয়ার পাবেন দশ আনা এবং জোতদার পাবেন ছ’আনা। ফলে আপোষের আলোচনায় স্থবিররতা আসে এবং কৃষক কর্মীরা আলোচনা সভা ত্যাগ করে কৃষক সমাবেশে চলে যান। সুশীল সেন তখন তেভাগার দাবীতে অটল থাকার আহ্বান জানিয়ে কৃষক সমাবেশে বক্তৃতা দেন। তোরাব আলীও সে বক্তৃতা শানেন। সুশীল সেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকলেও লাঠিসোটাসহ বিপুল কৃষক জনতাকে দেখে পুলিশ সেদিন তাকে গ্রেফতার করতে সাহস পায়নি। আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সমাপ্ত হয়। (২৫)

বালিয়াডাঙ্গী
বালিয়াডাঙ্গীর দায়িত্বে ছিলেন গুরুদাস তালুকদার। তিনি থাকতেন ঠুমনিয়ায় ডোমা সিং-এর বাড়িতে। ঠাকুরগাঁর পুলিশ ইন্সপেক্টর ২০/২৫ জন সশস্ত্র পুলিশসহ খুব সকালে ডোমা সিং-এর বাড়ি ঘেরাও করেন ডোমা সিং এবং গুরুদাস তালুকদারকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে। ডোমা সিং-এর বাড়ির একদিকে জঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকায় পুলিশ সেদিক ঘেরাও করতে পারেনি। পুলিশ বাড়িতে ঢোকার মুখে ৪/৫ জন কমরেড শুধুমাত্র লাঠি দিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করেন এবং এর ফলে পুলিশ বাড়ির ভেতরে তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যে ডোমা সিং ও গুরুদাস তালুকদার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এরপর পুলিশ পিছিয়ে রাস্তায় চলে আসে এবং সেখান থেকে গুলি চালায়। গুলিতে ঘটনাস্থলে একজন মহিলাসহ মোট দু’জন নিহত হন এবং অপর তিনজন মারাত্মকভাবে আহত হন। আহতদের ঠাকুরগাঁ নিয়ে যাওয়ার পথে এদের দু’জন মৃত্যুবরণ করেন। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে মৃতদেহ সৎকারের ব্যব্স্থা নেয়া হয়। ঠুমনিয়ার এই ঘটনায় নিহতরা হলেন মুকুর চাঁদ ও তার স্ত্রী, মাকটু সিং এবং নেন্দেলী সিং।
বালিয়াডাঙ্গীর কৃষক কর্মীদের মধ্যে থেকে এমন কয়েকজন বেরিয়ে এসেছিলেন যারা একদিকে ছিলেন যেমন জঙ্গী, অন্যদিকে রাজনীতি বোঝা ও বোঝানোর ক্ষেত্রে অগ্রসর। এদের মধ্যে কম্পরাম সিং ও ডোমারাম সিং-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—এদের যোগ্যতা এদেরকে কম্যুনিস্ট পার্টির জেলা কমিটির সদস্য পদে উন্নীত করে। কম্পরাম ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। হেলেকিতু ও তিলক বর্মন ছিলেন এখানকার জঙ্গী কর্মীদের অন্যতম। (২৬)

খাঁপুর
কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে খাঁপুরে। ফুলবাড়ীর গনেন্দ্রনাথ সরকার তার ‘আমি’ গ্রন্থে গ্রামটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—‘খাঁপুর বালুরঘাট মহকুমা শহর থেকে ৬/৭ মাইল দূরে ছোট একটা গাঁ। এখানে সেখানে উঁচু ভিটামাটি। তার চারপাশে ফণিমনসার বেড়া, আর সরু সরু বাঁশের খোপ। চার ধারে চার হাত উঁচু মাটির কোঠা তার উপর পোয়াল খড়ের চালা। সে-সব ঘরের নেই কোন জানালা, দরজা। বাঁশের তৈরি একটা দরজার ঝাঁপ দরজার আব্রু রাখে। ঘরের সামনে লম্বা পিঠ, বারান্দার মত ব্যবহৃত হয়। তারই একপাশে চুলা রান্নার ব্যবস্থা।’ এই অতি সাধারণ গাঁয়ের সাধারণ কৃষকরা নীলকন্ঠ, নগেন বর্ম্মন, চেয়ার সাঁই প্রমুখের নেতৃত্বে সংগঠিত হন কৃষক সমিতির পতাকাতলে। এলাকার দায়িত্বে ছিলেন কালী সরকার।
১৯৪৭ সালে ২০শে ফেব্রুয়ারী খাঁপুরে স্থানীয় কৃষকদের এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কালী সরকার তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। সমাবেশের আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি খবীর শেখকে সাথে নিয়ে খাঁপুরে আসেন। কিন্তু গ্রামের ঢোকার মুখে জনৈক চেয়ারম্যান তাদেরকে দেখে ফেলেন এবং বালুরঘাট থানায় খবর দেন। ফলে শেষ রাতের দিকে গ্রামে পুলিশ আসে। জেলার অন্যত্র পুলিশী তৎপরতার ধরন দেখে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ আগেই অনুমান করেছিলেন যে সমাবেশকে ভেঙে দেবার প্রয়োজনে খাঁপুরে পুলিশ আসতে পারে। তাই তার বালুরঘাট থেকে খাঁপুর আসার মাটির সড়কে গর্ত কেটে লরী যাবার পথটা রাতে বন্ধ করে দেন। বালুরঘাটের দিকে না পেয়ে যশোদাকে (তার স্ত্রী) ধরে টেনে হিঁচড়ে বস্ত্রবিহীন করে দারোগার সামনে এনে হাজির করে। যশোদার কাছ থেকে নীলকন্ঠের খবর না পেয়ে সঙ্গিনের খোঁচায় খোঁচায় তাকে মেরে ফেলে আর্মড পুলিশেরা। হতভাগিনীর আর্তচিৎকারে সমস্ত স্থান কেঁপে ওঠে। মুহূর্তে জ্বলে ওঠে আগুন। সাঁওতালদের তীর ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলে—কারুর মাথায়, কারুর ঘাড়ে, কারুর বা উরু ভেদ করে। তখন ফায়ারিং-এর হুকুম পেয়ে গর্জে ওঠে রাইফেলের গুলি। বীর সাঁওতাল কৃষক ধনুক হাতে চিৎকার করে মরেছে—‘জান দেবো তো ধান দেবো না।’ (২৮) সেদিনকার গুলিতে নিহত হয়েছিলেন নিম্নলিখিত কৃষকবৃন্দ—
চিয়ার সাঁই শেখ, যশোর রাণী সরকার, কৌশল্য কামারনী, গুরুচরণ বর্মন, হপন মার্তি, মাঝি সরেন, দুখনা কোলকামার, পুরনা কোলকমার, ফাগুয়া কোকামার, ভোলানাথ কোলকামার, কৈলাস ভুঁইমালী, থোতো বর্মন, চাদু বর্মন, আলু বর্মন, মঙ্গল বর্মন, শ্যামচরণ বর্মন, নগেন বর্মন, ভূবন বর্মন, ভযানী বর্মন, জ্ঞান বর্মন, নারায়ণ মুর্ম ও গহনুয়া মাহাতো। (২৯)
খাঁপুরে পুলিশ কর্তৃক নির্বিকার গুলিবর্ষণের ফলে স্থানীয় পার্টি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশ যে পথে এসেছিল সেই পথের দু’পাশে ‘লাখো লাখো’ তীরসহ সাঁওতালদের সমবেত করে, উদ্দেশ্য—ফিরতি পথে পুলিশদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালানো। কিন্তু পুলিশ পুর্বোক্ত পথ অর্থাৎ পতিরাম হয়ে বালুরঘাটে না গিয়ে হিলির পথ পাহারা দেবার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল আটজন কর্মীকে। পুলিশরা ব্যবহার করছিল শব্দবিহীন পাঁচখানা গাড়ি। শব্দবিহীন হওয়ায় পাহারারত কর্মীরা প্রথমে টের পাননি, টের যখন পেলেন তখন গাড়ি পাশাপাশি অবস্থানে এসে গেছে। সেখান থেকে গাড়ি গ্রামের দিকে এগিয়ে চলে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে মাঠ দিয়ে দৌড়াতে থাকেন পাহারারত কর্মীরা। এই দৌড়ঝাঁপের শব্দে পার্শ্ববর্তী এক বাড়ির কৃষকরা জেগে ওঠে বাজিয়ে দেন মাদন। শব্দ শুনে নিকটবর্তী অপরাপর বাড়ি থেকেও মাদল বাজানো শুরু হয়, এভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে মাদলের শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে সারা এলাকায় জানিয়ে দেয় শত্রু আগমনের সংবাদ। প্রত্যেক বাড়ি থেকে তীরধনুক ও লাঠি সজ্জিত কৃষকরা বের হয়ে মেঠো সড়কে গর্ত খুঁড়ে রাখা স্থানটির দিকে ছুটতে থাকেন। (২৭)
পুলিশের গাড়ি সড়ক বরাবর এগিয়ে যায় এবং চালক খেয়াল করতে না পারায় প্রথম গাড়িটি সোজাসুজি গিয়ে কেটে রাখা গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এতে জনাকয়েক পুলিশ সামান্য আহত হয়। পিছনের গাড়িগুলি দাঁড়িয়ে পড়ে। পুলিশদের বড় অংশটি এরপর ঐ গর্তের মধ্যে যা আশপাশে পজিশন নেয় এবং চারজন আর্মড পুলিশ স্থানীয় নেতা নীলকন্ঠকে ধরে আনতে তার বাড়িত যায়। পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা পাওয়া ডাঃ গনেন্দ্রনাথের পুস্তিকায়—‘এদিকে নীলকন্ঠ নগেন বর্মন, চেয়ার সাঁই খবর দিয়ে ফিরছে তল্লাটের কৃষক ভাইদের। তারা তীর ধনুক নিয়ে চারদিক থেকে এসে জড়ো হয়েছে খাঁপুড়ের ঝাড় জঙ্গলে।….আর্মড পুলিশেরা নীলকন্ঠকে তার বাড়িতে পথ ঘুরে বালুরঘাট ফিরে যায়। ফলে তাদেরকে আর আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি।
এরপর খাঁপুরকে পরিণত করা হয় এক অবরুদ্ধ জনপদে। ২৩শে ফেব্রুয়ারী প্রাদেশিক কিষাণ সভার পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ রসুল, ডাক্তার বিজয় বসু, ও জনযুদ্ধের একজন সাংবাদিককে খাঁপুরে পাঠানো হয়, কিন্তু পুলিশ তাদের সেখানে ঢুকতে দেয়নি। ব্যাপক নির্যাতনের মুখে এলাকার সমস্ত পুরুষরা পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন। কলকাতার আরেকজন সাংবাদিক গোলাম কুদ্দুস ঘোরাপথে ফুলবাড়ী হয়ে পিছন দিক দিয়ে খাঁপুরে প্রবেশ করেন। খাঁপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে নয় বছরের একটি উৎসাহী বালক তার সঙ্গী হয়। তিনি লিখেছেন–(৩০)
‘আমাদের এই খাঁপুর যাত্রার সময় সব আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে এসেছে। এখন আর সেই সভা শোভাযাত্রা নেই। লাল নিশানের ক্ষীণতম ইশারাও লুপ্ত। চারদিকে সব চাঞ্চল্য থেকে গেছে। সব আওয়াজ বন্ধ হয়েছে। শুধু একটা বীভৎস ভয় বিরাজ করছে গ্রাম-গ্রামান্তরে।….মাঠের ওপর থেকে গান ভেসে এল। তুমি আমার বিস্ময় লক্ষ্য করে বললে, পুলিশরা রেকর্ড বাজাচ্ছে। মাইল দুই দূরে লাউড স্পীকারের ধ্বনি তরঙ্গ এমনভাবে এসে কানে ধাক্কা দিতে পারে আমার ধারণাই ছিল না। আমি প্রশ্ন করলাম, ওরা কি রোজই বাজায়?
হ্যাঁ, প্রায় সব সময়। খাসি মেরে মেরে খায় আর রেকর্ড বাজায়, আর তাস খেলে।
–খাসি পায় কোথায়?
–সব গ্রাম থেকে ধরে ধরে নিয়ে যায়। আর জেলে এনে পুকুর থেকে মাছ ধরে।
গ্রামের কাছে এসে দেখি এপাশটা কাঁটা তার দিয়ে ঘিরেছে। বহু কষ্টে সেটা পার হয়ে তুমি আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম।
….অনেকগুলি বাড়ির ভেতর ঢোকা গেল, বেশিরভাগ বাড়িতেই লোকজন নেই। শুধু দু’একটা বাড়িতে বদ্ধ ঘরের মধ্য থেকে স্ত্রীকন্ঠে ভয়ার্ত আওয়াজ শুনলাম—কে? কে?
তুমি আমার হাত টিপে দিলে, অর্থাৎ যেন শব্দ না করি। অবশেষে তুমি আমাকে একটা বাড়ির উঠানে এনে দাঁড় করিয়ে চাটাই এর দরজা ঠেলে ভেতরে গেলে। খানিক পরে তোমার সঙ্গে এক বুড়ি বেরিয়ে এল। বুড়ি হাত নেড়ে আমাকে কাছে ডাকলো। কাছে যেতেই ফিসফিস করে বলল, তুমি কার ঘরের ছেলে বাবা! কেন এই রাক্ষসপুরীতে এসেছ, পালাও শীগগীর! নইলে এরা মেরে ফেলবে। এতোক্ষণে আমার পা শিউরে উঠল।
….হঠাৎ মনে হলো রূপকথার গল্পকারেরাও বোধহয় এমনি করে অবরুদ্ধ জনপদের অভিজ্ঞতাই কল্পনার রঙ চড়িয়ে প্রকাশ করেছিল। তাতে থাকতে রাজকন্যা রাজকুমার তেপান্তরে মাঠ জীয়নকাঠি মরণকাঠি। বুড়ি উঁচু দাওয়ার উপর বসে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমাদের তুমি দেখতে এসেছ! আহা মায়ের বুকে ফিরে যাও বাবা, নইলে এরা তোমাকে খুন করবে বাবা।
….আমি ভেবে পেলাম না এই গ্রাম থেকে আর কি খবর সংগ্রহ করার আছে। আরো কিছু শূন্য বাড়ি আর ঝরাপাতা দেখব শুধু। এর জন্যই এতো পথ আসা।’

জোতদারদের ভীতি এবং সোহরাওয়ার্দীর কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ
কৃষকদের ক্রমবর্ধমান সংগঠন ও সংগঠিত শক্তি দেখে ভীত জোতদাররা নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই অনুযায়ী সমস্ত এলাকায় গঠিত হয় জোতদার সমিতি। কোতোয়ালী থানায় তেভাগা আন্দোলন তেমন দানা বেঁধে উঠতে পারেনি বলে সেখানকার জোতদারদের দুশ্চিন্তাও ছিল কম। জোতদার সমিতির গঠন ও কর্মকান্ড পরিচালনায় উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন ঠাকুরগাঁ মহকুমার জোতদাররা। রশিয়ার আমিরউদ্দিন চৌধুরী, সিতলাইয়ের তফির চৌধুরী, দেবীপুরের আজিমউদ্দিন চৌধুরী এবং ঠাকুরগাঁর হরিপদ দাস ছিলেন এই সমিতির নেতা।
সংগঠিত কৃষকদের আন্দোলন যে সে সময় জোতদারদের মধ্যে রীতিমত ভীতির সঞ্চার করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নলিখিত ঘটনাটি থেকে। কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে আধিয়ারের নিজ খোলনে ধান মাড়ানোর পর যদি কোন জোতদার ‘সন্তুষ্টচিত্তে’ এক-তৃতীয়াংশ ধান গ্রহণ করে সেই মর্মে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বা ‘রসিদ’ লিখে দিতে রাজী হন তাহলে তাকে তার প্রাপ্য ধান দিয়ে দেয়া হবে। পতিরাম থানার চাঁদপাড়ায় দেবেন্দ্রনাথ সরকার নামে একজন জোতদার ছিলেন। তিনি ধান নেয়ার জন্য এক ঘাটোয়াল (সাঁওতালদের মধ্যেকার একটি সম্প্রদায়) আধিয়ারের বাসায় যেয়ে হাজির হন। নিরক্ষর আধিয়ারটি তাকে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে রসিদ লিখে দিতে বললে নিরুপায় জোতদার রসিদ লিখে দিতে বাধ্য হন, তবে তিনি লেখেন একটু ভিন্নভাবে—‘সন্তুষ্টর’ জায়গায় ‘সন্ত্রস্ত’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি লেখেন-‘সন্ত্রস্ত হইয়া রসিদ লিখিয়া দিলাম।’ (৩১)
ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান ঘোষিত বিলের পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুরের জোতদার সমিতি জোতদারদের একটি সাধারণ সভার আয়োজন করে। এই উপলক্ষে তফিরউদ্দিন চৌধুরী, আজিমউদ্দিন চৌধুরী ও হরিপদ দাসের নামে একটি ‘প্যামপ্লেট’ ছাপানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে ‘বর্গাদার বিষয়ে অচিরেই একটি আইন পাশ হইবে এবং সেইটি যেন জোতদারদের পক্ষে বেশি ক্ষতির কারণ না হয় তদ্বিষয়ে আলোচনার জন্যই এই সভার আয়োজন।
সে সময় গ্রামে বন্দুকের সংখ্যা ছিল খুব কম, তবে প্রতাপশালী জোতদারদের বাড়িতে একটা বা দুটো বন্দুক থাকতো। কিন্তু সংগঠিত কৃষকরা যখন এসব জোতদারের পুঁজ ভেঙে নিয়ে যান তখন এরা বন্দুক ব্যবহার করতে সাহস পাননি। জোতদার আজিমউদ্দিন উকিল তার সাথে সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেছেন যে কৃষকদের সংখ্যা ছিল হাজারে হাজার, কাজেই একটা দুটো বন্দুক দিয়ে তাদের ঠেকানো যেতো না, বন্দুক ব্যবহার করলে বরং ভয় ছিল যে তারা ক্ষেপে গিয়ে হয়তো ঘর-বাড়ি সবকিছু জ্বালিয়ে দিতে পারে।
কৃষকদের আন্দোলন যখন ব্যাপকতা লাভ করে এবং জোতদারদের পক্ষে এলাকায় টিকতে পারা মুশকিল হয়ে ওঠে, তখন দিনাজপুর জোতদার সমিতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নিকট একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী তফিরউদ্দিন চৌধুরী, আজিমউদ্দিন চৌধুরী, যোগেশ গুপ্ত ও হরিপদ রায় কলকাতায় যেয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সোহরাওয়ার্দী তাদেরকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নাই এবং আধিয়ারদের ব্যাপারে ‘যথাবিহীত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করা হবে। সোহরাওয়ার্দী তার কথা রেখেছিলেন, তাই প্রতিনিধি দল দিনাজপুরে প্রত্যাবর্তনের দু’তিনদিনের মধ্যেই ঘটে ঠাকুরগাঁর ঘটনা। (২৩)

ঠাকুরগাঁ
চিরিরবন্দর, বালিয়াডাঙ্গী, খাঁপুর প্রভৃতি এলাকায় পুলিশের গুলি চালানো এবং অত্যাচারের প্রতিবাদ করার লক্ষ্যে কৃষক সমিতি ঠাকুরগাঁয়ে একটি বড় ধরনের কৃষক সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যথারীতি কৃষক সমাবেশের স্থান, দিন-তারিখ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা নির্ধারিত হয়। বীরগঞ্জ, পীরগঞ্জ, কাহারুল, রাণী সংকোল, ঠাকুরগাঁ পূর্ব ও পশ্চিম এলাকা, বালিয়াডাঙ্গী, আটওয়ারী প্রভৃতি এলাকা থেকে কৃষকরা মিছিল সহযোগে সমাবেশে যোগদানের পরিকল্পনা নেন। আটওয়ারী, বালিয়াডাঙ্গী প্রভৃতি এলাকার কৃষকরা ছোট ছোট মিছিলের মাধ্যমে ট্রাঙ্গন নদীর এপারে গোবিন্দনগরে জমায়েত হচ্ছিলেন পরবর্তীতে বড় মিছিল সহযোগে ঠাকুরগাঁ শহরে প্রবেশের উদ্দেশ্যে। আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রামলাল, পস্টরাম, মঙ্গলু মোহাম্মদ, সতীশ ঠাকুর, ডোমারাম, ডমন প্রমুখ।
অপরদিকে বীরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁ থেকে আগত মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা অজিত রায় ও বিভূতি গুহ। স্থানীয় নেতা অখিল ডাক্তার, বালা বর্মন, নিমসর বর্মন, আবদুল গনি, নলিনী বাবু, বিনোদ রায়, নিয়ামত, নাসিরুদ্দিন, যুগল বালা, চান্টু বর্মন, লাল্টু মোহাম্মদ প্রমুখের নেতৃত্বে নেতৃস্থানীয় কৃষক কর্মীদের মধ্যে যারা গ্রেফতার এড়াতে পেরেছিলেন তারা বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্যাতন শুরু হয়েছে তার বিপক্ষে কোন কোন এলাকায় জনসভা করারও চেষ্টা নেয়া হয়। কিন্তু তাতে করে ভাটার টানকে প্রতিরোধ করা যায়নি।
এমতাবস্থায় আসে দেশ বিভাগ। কেসগুলি প্রত্যাহার করেই ১৪ই আগস্ট সন্ধ্যায় বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। দিনাজপুরে স্বাধীনতার উৎসব কিভাবে উদযাপিত হয়েছিল সে সম্পর্কে চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন সুনীল সেন—১৫ আগস্ট তারিখে জনগণ ময়দানে সমবেত হন। এখানে প্রধান নায়ক ছিলেন তোরাব আলী (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট)। তাকে ঘিরে রেখেছিল গদী পাওয়ার জন্য অপেক্ষারত নতুন লোকেরা। টুপি আন্দোলিত করে তিনি জয়ধ্বনি মুখর জনতার উদ্দেশ্যে অভিনন্দন জানান। কিষাণ সভা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছিল চিরিরবন্দর গ্রামে, যেখানে শিবরাম আর সমীরুদ্দিন মারা গিয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। কিষাণ সভার দপ্তর যে বাড়িতে ছিল সেই বাড়ির সামনে প্রায় শ’খানেক রাজবংশী কৃষক জড়ো হন। লাল ঝান্ডা তোলা হয় এবং পোহাতু বর্মন (এর একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল) আওয়াজ তোলেন—‘ইনকিলাব’, আর কৃষকেরা সাড়া দিয়ে বলেন—‘জিন্দাবাদ’।
তেভাগা আন্দোলনে বিপর্যয় দেখা দেওয়ার পরও দিনাজপুরের যে একটি থানায় কৃষক সমিতির ঘাঁটি ছিল মজবুত সেটি হচ্ছে রাণী সংকোল। বালিয়াডাঙ্গী কৃষক নেতা পস্টরাম ও তার স্ত্রী জয়মণি এখানে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতেন। পুলিশী নির্যাতনের মুখে এরা আত্মগোপন করেন। দেশ বিভাগের পর, ১৯৪৯ সালে, তেভাগার দাবীতে ও নির্যাতনের প্রতিবাদে সংগঠিত কৃষকরা রুহিয়া ও আখানগর রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে দেড় মাইল রেল-লাইন তুলে ফেলেন। একটি থানায় সীমাবদ্ধ এবারের আন্দোলন দমন করতে প্রশাসনকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। ভবেন সিংসহ এলাকার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের অনেকেই গ্রেফতার হয়ে যান। গ্রামের পর গ্রামে হানা দিয়েও পুলিশ পস্টরাম বা জয়মণিকে গ্রেফতার করতে না পারলেও আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে।
দিনাজপুর জেলায় মোট কৃষকের তিন-চতুথাংশেরও অধিক যোগদান করেছিলেন তেভাগা আন্দোলনে। ১৯টি জেলা মিলিয়ে এই সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ। তথাপি এই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ‘কেন এই ব্যর্থতা’—এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্নভাবে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কম্যুনিস্ট পার্টি বা কিষাণ সভার প্রাদেশিক কমিটি বা জেলা স্তরে যে নেতৃত্ব ছিল—তাদের অধিকাংশিই ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে এই নেতৃত্ব শ্রেণীচ্যূত হতে পারেননি বলেই মধ্যবিত্ত চরিত্রের দোদুল্যমানতা নিয়ে তার আন্দোলনে যখন এগিয়ে যেতে চেয়েছে তখন পিছন থেকে টেনে ধরেছেন। কৃষক সভা কৃষক পরিবারগুলোর কাছে চেয়েছিলেন ‘এক ভাই এক লাঠি, এক টাকা’—কৃষকরা তা দিয়েছিলেন, কিন্তু লাঠি যে পুলিশের রাইফেলকে প্রতিহত করতে অপারগ তা যখন প্রমাণিত হলো তখন কৃষকরা সশস্ত্র হতে চাইলেন, কিন্তু মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব সেদিন যে অনুমতি দিলেন না—ফলে ঘটনা এমনও ঘটেছে যে রঘুনাথপুরের ফুটবল মাঠে পঞ্চাশ জন সশস্ত্র পুলিশকে ছয় ঘন্টা ঘেরাও করে রাখার পরও তাদেরকে অস্ত্রসহ নড়াইলে ফেরত দেওয়া হয়।
কিন্তু তেভাগা আন্দোলন ছিল বস্তুতঃ একটি আংশিক সংগ্রাম—কেবলমাত্র আধিয়ারদের কতিপয় দাবী ভিত্তিক একটি আন্দোলন। আন্দোলনের পথ চলায় অনেক দিনমজুর এদের সঙ্গী হয়েছেন এবং এদের কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছেন-আধিয়ারদের অর্থনৈতিক দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিত এই আন্দোলন কতখানি রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করেছে তা নেতৃবৃন্দ নির্ধারণ করতে পারেননি। কিন্তু তা যদি তারা করতেও পারতেন তাহলেও তেভাগার মতো একটি আংশিক সংগ্রামকে সে সময় কৃষি বিপ্লবে রূপান্তর করা সম্ভবপর ছিল কিনা তা ভেবে দেখা প্রয়োজন—তখন সময়টা ছিল ভারত বর্ষের স্বাধীনতার। কম্যুনিস্ট পার্টি তথা কিষাণ সভার পক্ষ থেকে ১৯৪২ এর পূর্বে বা ১৯৪৫-এর পরে (রাশিয়ার মিত্র শক্তিতে যোগদান ও যুদ্ধের সমাপ্তি) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিরোধিতার কথা সিদ্ধান্ত হিসাবে কাগজে কলমে এলেও বা মিছিল মিটিং-এ ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ বলা হলেও বস্তুতঃ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাতের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কোন কর্মপন্থা বা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়নি। বরং ভারত বর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ যখন প্রচারণা চালাচ্ছে তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী পি. সি. যোশী `Forward to Freedom’ থিসিস এনে ‘Imperialism is a Prisoner in Peoples Camp’ বক্তব্য তুলে ধরে ভারতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার লাইনকে তুলে ধরলেন।
লেনিন বা মাও সেতুংয়ের শিক্ষা অনুযায়ী ‘কৃষকদের সমস্যা হলো জাতীয় আন্দোলনেরই একটি অংশ। অথচ ভারতে অপরাপর সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি যখন জাতীয় আন্দোলনের কথা বলছে, তখন কম্যুনিস্টরা প্রধান করণীয় হিসাবে ধরলেন কৃষক সমস্যা কেন্দ্রীক আন্দোলনকে। ফলে জাতীয় আন্দোলনের ধারা থেকে তারা হলে গেলেন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। দিনাজপুরের যত কৃষক কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তারা সবাই বলেছেন যে ১৯৪৬-৪৭-এর এই সংগ্রামে তারা ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ এই শ্লোগানটি একটি অপ্রধান শ্লোগান হিসাবে দেওয়া ছাড়া জাতীয় স্বাধীনতার স্বপক্ষে কোন বক্তব্য বলেননি বা কোন কর্ম করেননি। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস আর রুটির জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি’—এই ধরনের কথা প্রচলিত হয়। কাজেই জাতীয় আন্দোলনের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত, তা যত শক্তিশালীই হয়ে উঠুক না কেন, যতবড় শ্রেণীচ্যূত নেতাই তাতে নেতৃত্বের ভূমিকাই থাকুন না কেন—আন্দোলনটি ছিল ব্যর্থ হতে বাধ্য।

তথ্যপুঞ্জী
১। Siddiki, kamaluddin & et, al—Tebhaga Movement in Bengal, P—1-2
২। আবদুল্লাহ রসুল, কৃষক সভার ইতিহাস, পৃ—১৫৬
৩। পাঁজিয়া রিপোর্ট, উল্লেখ করেছেন আবদুল্লাহ রসুল পুর্বে উল্লেখিত গ্রন্থ, পৃ—৪, ৫, ৬ ও ৭/আবদুল্লাহ রসুল; পূ; উ; গ্র—পৃ যথাক্রমে ১১০, ১২১, ১২৩ (দিনাজপুরের দর হাজী দানেশের কাছ থেকে জানা)
৮। সুনীল সেন, বাংলার কৃষক সংগ্রাম, বিচিন্তা চৈত্র ১৩৮০ পৃ—৪৪৫
৯ ও ১০। আবদুল্লাহ রসুল, পূ; উ; পৃ—১৩২-১৪৫
১১। সমস্ত গান সংগ্রহ করা হয়েছে শেখ খবীরউদ্দিনের কাছ থেকে।
১২। হাজী দানেশের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
১৩। হাজী দানেশ ও খবীর সেখের সাক্ষাৎকার
১৪। মঙ্গলু মোহম্মদের সাথে সাক্ষাৎকার
১৫। বিমল দাসগুপ্ত, ডুয়ার্সের তেভাগা আন্দোলন প্রসঙ্গে বিচিন্তা সাক্ষাৎকার।
০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1983.02.25-bichitra.pdf” title=”1983.02.25 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!