You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২০শে জানুয়ারী, রবিবার, ১৯৭৪, ৬ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান

অসংখ্য ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ডের সুরম্যতা, কর্মীদের গগন-বিদারী শ্লোগান, ছিমছাম আকাশে রূপালী রোদের ঝলক আর অগণিত দেশী ও বিদেশী অভ্যাগতের উপস্থিতিতে গত ১৮ই জানুয়ারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও কর্মী তথা সমগ্র জাতির উদ্দেশে যে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ জ্ঞানালোক দান করেন, তাকে স্মরণে রেখে আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের নানান কর্তব্য সম্পর্কেই আমরা আজ আলোচনা করতে প্রয়াসী হবো।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধুমাত্র একটি বিস্তৃত, জ্ঞানগর্ভ সমস্যা সমাধানের পর্যালোচনাই নয়, এটা সমগ্র বাংলা ও বাঙালীর সমগ্র অতীত ও ভবিষ্যতের এক দ্ব্যর্থহীন ইতিহাস।
সুতরাং, বলা যায়, তাঁর ভাষণে প্রদত্ত-নানান কথা ও ইঙ্গিতের গূঢ় তাৎপর্য সত্যিকারের অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় পন্থায় দেশ গঠনের নিশ্চিত অকন্টক পথে এগিয়ে চলার জন্যে সমগ্র জাতির সামনে আজ এক নতুন তাগিদ এসেছে।
আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কতটুকু সজাগ বা অবহিত তা তাঁর ভাষণ শুনলে বা পড়লেই বোঝা যায়। এর মাঝে তাঁর বিচার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞান, দেশপ্রেম, প্রয়োজনে কঠোরতা, দুরদর্শিতা, দৃপ্ততা ও আন্তরিকতা সবই অপূর্ব স্পষ্টতা ও দ্ব্যর্থহীনতার সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়।
তিনি জানেন যে, ঐকান্তিক ও সমবেত চেষ্টা না হলে কখনোই কোনো সমস্যা জর্জরিত দেশ গঠন করা যায় না। তাই তিনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষকলীগ, ছাত্রলীগ সহ দেশের অন্যান্য সমস্ত রাজনৈতিক দলকেই আহ্বান জানিয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গঠন কাজে শরীক হতে। এক্ষেত্রে তাঁর ঔদার্য কম লক্ষণীয় নয়।
জনতার মাঝে ভয়, আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কখনোই জনতার মন পাওয়া যায় না কিম্বা সরকার উৎখাত বা দেশ গঠনও করা যায় না। কারণ, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বা অভিধানেই সন্ত্রাস ও গুপ্ত গণহত্যার অনুমোদন নেই।
সত্যিকারভাবে দেশগঠন করতে হলে প্রথমেই ব্যক্তি থেকেই আত্মসমালোচনা, আত্ম-শুদ্ধি ও আত্ম-সংযম সহ অন্যান্য সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানবিক গুণপনা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। অন্যে কি করে কিম্বা করবে কিনা তা না ভেবে প্রত্যেক নাগরিককেই আগে নিজের দুর্বলতা সংশোধনের ব্যস্ত হয়ে সৎ নাগরিকভাবেই দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। যে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি অসৎ বা দুর্নীতিপরায়ণ, সে দেশ কখনোই সামগ্রিকভাবে সততার জয়টিকার দাবীদার হ’তে পারে না।
তাই, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বিশেষ জোর দিয়েছেন ব্যক্তির আত্ম-সমালোচনা, আত্মশুদ্ধি ও আত্ম-সংযমের উপর। তিনি ঠিকই বলেছেন, তীব্র জনমত তৈরী না হলে কিম্বা জনতার নিজস্ব আগ্রহ বা সততা না থাকলে কখনোই শুধুমাত্র আইন তৈরী করে বা তা প্রয়োগ করে কালোবাজারী, মওজুতদার, ঘুষখোর, পাচারকারী বা অন্যান্য দুষ্কৃতিকারী বা সমাজবিরোধীদের বিষদাঁত ভেঙে মানুষের জন্যে নিশ্চিত সুখ ও শান্তি আনা সম্ভব হয়না। তাই তিনি আওয়ামী লীগ কর্মী সহ দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে সব রকমের দুর্নীতি বন্ধের তীব্র জনমত তৈরী করার এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। এখানেও মূলে সেই ব্যক্তিমতের স্পষ্ট ভূমিকা আছে।
বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বলেছেন, হাতে গোনা দু’একজন অসৎ ব্যক্তির জন্যে কখনোই কোনো পুরো সংগঠন দুষিত হতে পারেনা। যদি কোনো অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বা কর্মী আওয়ামী লীগে ঢুকে থাকে, তবে তাদের অচিরেই পার্টি থেকে উৎখাত করা হবে। এ জন্যে তিনি অন্যান্য কর্মীদের সজাগও হতে বলেছেন।
কিছু সংখ্যক স্বার্থপ্রণোদিত ব্যক্তি ও সংস্থা জনসাধারণের সামনে নানান কুৎসা ও অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটা হিংসাত্মক জ্বালা সৃষ্টি করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে। কিন্তু তারা জানেনা, আজকে বাংলাদেশের জনতা কতো সজাগ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে আওয়ামী লীগ বাংলা ও বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জন্যে কিভাবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শক্তির কুটিল চক্রের সঙ্গে নিরলস লড়ে এসেছে এবং এখনো লড়ছে, তা বাংলার জাগ্রত জনতা নিজের চোখেই দেখেছে এবং দেখছে। তাই তারা যে কখনো আওয়ামী লীগের যথার্থ যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অপপ্রচারের ফলে বিভ্রান্ত হবে, তা একমাত্র অলীক স্বপ্নেবিভোর ও অসম্ভব উচ্চাভিলাষীরাই ভাবতে পারেন।
বাংলার মানুষ খুব ভালো করেই জানে যে, আওয়ামী লীগের মতো একটি সুদৃঢ় সংগঠনের পরিকল্পনা বা নেতৃত্বে না হলে আরো পঞ্চাশ বছরেও বাংলার স্বাধীনতা আসতো কিনা তা’ ভাবনার বিষয়। আবার, দেশের বর্তমান নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মতো একটি জন-সমর্থনপুষ্ট সংগঠন না থাকলে কখনোই দেশ ঠেকানো সম্ভব নয়। জনতার এ রায় বিগত সত্তরের মতো তেয়াত্তরেও স্বর্ণোজ্জ্বল অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বাংলার মানুষ যাতে আওয়ামী লীগের উপর আস্থা না হারায় সে জন্যে তিনি কর্মীদের কঠোর নির্দেশও দিয়েছেন।
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি মূল আদর্শের উপরই বাংলাদেশের ভবিষ্যত ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং এগুলো যাতে প্রতি অক্ষরে অক্ষরে ও সর্বার্থে দেশে স্থাপিত বা সার্থক হয় সেজন্যে দৃষ্টি রাখা আমাদের সবারই এক জাতীয় কর্তব্য।
তিনি বলেছেন, আমরা আমাদের দ্বি-মুখী সংগ্রামের প্রথম মুখ উত্তীর্ণ হয়েছি, অর্থাৎ সোনার সাধের দেশকে বিদেশী শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে পেরেছি, এবার আমাদের দ্বিতীয় মুখ উত্তীর্ণ হবার পালা। অর্থাৎ, আমাদের সমস্ত মানুষকে অর্থনৈতিক জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিয়ে দেশ গঠনের পালা। আর এ দেশ গঠন ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ আমরা সহনশীলতা, আত্মত্যাগ ও উপচিকীর্ষার মতো কয়েকটি গুণের অধিকারী না হবো। দেশকে প্রকৃতই শোষণহীন ও অর্থ জ্বালামুক্ত সমাজ দিতে হলে আমাদের ঘরকোণা হলে চলবেনা। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে, খেতে খামারে, কলে-কারখানায়, অফিস আদালতে, সমাজ অনুষ্ঠানে বর্ধিতভাবে উৎপাদন বাড়ানোর এক স্থায়ী উৎস রচনায় ব্যাপৃত হতে হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, অস্ত্রের মুখে হাট-বাজার বা দোকান-পাট বন্ধ করে, জাতীয় সম্পদ উৎখাত করে বা মিল কল-কারখানার চাকা বন্ধ রেখে কখনোই দেশ গঠন করা যায়না। এসব নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী যে সব বিপ্লবীরা আছে, তারা বিপ্লবী নয়, সন্ত্রাসবাদী, মাওবাদী নয়, ফাওবাদী। তাই বঙ্গবন্ধু কঠোরভাবে এদের প্রতিরোধ করতে উপদেশ দিয়েছেন।
কর্মীদের উৎসাহ দান কালে বঙ্গবন্ধু আশা পোষণ করেন যে, যেহেতু আওয়ামী লীগের জন্ম সংগ্রামের মাধ্যমে এসেছে, সেহেতু এর কোনো মৃত্যু এলেও সংগ্রামের মাধ্যমে আসা উচিত হবে এবং এ ঐতিহ্য স্থাপন করতে সবাইকেই সজাগ থাকতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উপদেশ আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে দেশের শত্রু ও সমাজবিরোধীদের নানান নাশকতামূলক কাজের প্রধান হাতিয়ারই হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো। সুতরাং তারা যাতে তাদের কুটিল পরিকল্পনায় আমাদের বিভ্রান্ত না করতে পারে সেদিকেও যথেষ্ট লক্ষ্য রাখতে হবে।
পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আবার উল্লেখ করে বলেছেন, আমাদের প্রধান আদর্শই স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষতা। কারো সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নয় ও সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব চাই। এমন কি চীনের সঙ্গেও। কিন্তু আত্মমর্যাদা বা সার্বভৌম সমতা বিক্রি করে নয়। তেমনি বৈদেশিক সাহায্যও আমরা নেবো, কিন্তু সে সাহায্যের পেছনে কোনো অসম্মানের আঘাত নিয়ে নয়।
তিনি দুঃখ করে বলেন যে, চীনের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির জন্যে বাংলার মানুষ আজীবন বিশ্বের বৃহৎ শক্তির বিপক্ষে রায় দিয়েছে। সেই চীনই তার দোসর পাকিস্তানের মন্ত্রণানুসারে বিবেক-বিচারবিহীনভাবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে ভেটো দিয়েছে। এটা নিতান্তই পরিতাপের বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এটা শুধু কোনো সম্মেলনে দিতে হবে বা না দিলেই নয় তেমন কোনো নিছক তাগিদে রচিত কোনো ভাষণ নয়, এ মূলতঃ সমগ্র বাংলা ও বাঙালীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা, সমস্যা ও তার সমাধানের এক অমোঘ ইতিহাস, সুতরাং ভুললে চলবে না, সত্যিকারভাবে দেশ গড়তে এবার আমাদের এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এর সার্থকতার উপরই আমাদের ভবিষ্যত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!