You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ও জামাত - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ও জামাত

পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন দাবির ছদ্মাবরণে মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাত ক্ষমতাসীন সরকার, এমনকি কর্মচারীদের আনুগত্য প্রদর্শন, সেনাবাহিনীতে যােগদান প্রভৃতির ঘাের বিরােধিতা করেন। পরবর্তীকালে তাঁরা দেশের অধিকাংশ আলেমদেরও এক প্লাটফরমে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য কাদিয়ানী দাঙ্গার পর আলেমদের সে ফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। ১৯৫৩ সালের ১১ জানুয়ারী থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাচীতে সর্বদলীয় আলেমদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মওলানা মওদুদীও অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সম্মেলন সুপারিশ করে, পাকিস্তানের ভাবী শাসনতন্ত্রে কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করতে হবে। শাসনতন্ত্র জারি করার তারিখ থেকে অনধিক তিন বছরের ভেতর আইনের মাধ্যমে সমাজদেহ থেকে মদ, জুয়া ও ব্যভিচার সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে। প্রচলিত আইন-কানুন পাঁচ বছরের মধ্যে কোরআন ও সুন্নাহ মােতাবেক পরিবর্তন করতে হবে। নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহিতার প্রচারপ্রসার এবং কোরআন-সুন্নাহর অবমাননা ও উপহাস করা আইন করে বন্ধ করতে হবে। মুসলমান চাকরিপ্রার্থী ও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ ও পদোন্নতির বেলায় ধর্মপরায়ণতা ও ইসলামী রীতি-নীতি অবলম্বনের শর্তারােপ করতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহকে দেশের আইন-কানুনের মূল উৎস হিসাবে মেনে নিতে হবে। ফরজ বিধানের অনুসারী না হওয়া। ও অশ্লীলতা পরিহার না করা পরিষদগুলােয় মুসলিম সদস্যদের অযােগ্যতার শর্ত আরােপ করতে হবে। আইন পরিষদে কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে যদি কোনাে আপত্তি উথাপিত হয় তবে অবশ্যই তা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ (ওলামায়ে পাকিস্তান)  বাের্ডের নিকট পাঠাতে হবে। বাের্ডের ফয়সাল আইন পরিষদ মেনে দিতে বাধ্য থাকবে। ১৯৫৬ সালের ১০ জানুয়ারি আইন পরিষদে শাসনতন্ত্রের খসড়া পেশ করা হয়। কিন্তু দেখা গেলাে, মওলানা মওদুদীসহ অন্যান্য আলেমদের উল্লিখিত সুপারিশগুলাের কোনােটিই। তাতে রক্ষা করা হয়নি। আরাে মজার ব্যাপার হলাে, শাসনতন্ত্রের খসড়া পরিষদে পেশ। করার পর ১৬ জানুয়ারি জামাতে ইসলামীর ‘মজলিসে শূরার তরফ থেকে এ সম্পর্কে একটি সমালােচনা প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু আলেমদের দাবীগুলাে কেন শাসনতন্ত্রের খসড়ায় শামিল করা হলাে না, এ বিষয়ে কোনাে প্রতিবাদ করা হয়নি। অথচ এগুলাে ছিলাে সর্বদলীয়  আলেমদের মৌলিক দাবি। সর্বদলীয় আলেমদের আর একটি দাবি ছিলাে, আইন পরিষদে প্রণীত আইন-কানুনের বিরুদ্ধে যেসব শাসনতান্ত্রিক আপত্তি কিংবা ব্যাখ্যাগত সমস্যা সৃষ্টি হবে সেগুলাে মীমাংসার জন্য সুপ্রীমকোর্টে পাঁচজন আলেম নিয়ােগ করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান ধর্মপরায়ণ ও ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ একজন বিচারপতি মনােনীত করবেন। উক্ত পাঁচজন আলেম ও বিচারপতি মিলে ফয়সালা করবেন সংশ্লিষ্ট আইন কোরআন ও সুন্নাহ মােতাবেক কিনা। এ দাবিটিও খসড়া শাসনতন্ত্রে শামিল করা হয়নি। অবশ্য এ বিষয়টি সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরা তাদের সমালােচনায় উল্লেখ করেছিলেন। ” এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলাে, “এখন প্রশ্ন থেকে যায় কোনাে আইন ইসলামের অনুশাসন মােতাবেক কিনা তার শেষ মীমাংসা কে করবে ? সুপ্রীমকোর্ট, না খােদ আইন পরিষদ ? এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলাে, সঠিক পন্থা তা-ই যা ১৯৫৩ সালে ওলামা কনফারেন্স সুপারিশ করেছিলাে। যদি তা আইন পরিষদের সদস্যদের পক্ষে কোন অবস্থায়ই গ্রহণযােগ্য না হয় তবে অন্য আর একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আইন পরিষদই এর মীমাংসা করবেন, কিন্তু এ ব্যবস্থা আমরা শুধু এরূপ শর্তে গ্রহণ করতে পারি, আইন পরিষদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তা মীমাংসা করবেন।’ জামাতে ইসলামী তাদের মূল দাবী থেকে অনেক দূর সরে গিয়ে বিকল্প প্রস্তাবটি পেশ করে। কিন্তু তাদের এ সুপারিশটিও বিবেচনা করা ছাড়াই শাসনতন্ত্র অনুমােদন করা হয়। তাছাড়া মওলানা মওদুদী ইসলামী শাসনতন্ত্রের বুনিয়াদ হিসাবে যেসব দাবী পেশ করেছিলেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এসবের পক্ষে ঝড়-ঝঝার বেগে যে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় কেউই এসব দাবীর গুরুত্ব দেয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মওলানা অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন তার একটিও শাসনতন্ত্রে স্থান লাভ করেনি। তাতে ধর্ম, সম্প্রদায় ও গােত্র নির্বিশেষে সবাইকে সমান নাগরিক অধিকার দেয়া হয়েছিলাে। শুধু তাই নয়, এ অধিকার আদায়ের জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সুপ্রীমকোর্টের আশ্রয় নেয়ারও বিধান রাখা হয়েছিলাে।

পাকিস্তানের একজন অমুসলিম নাগরিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছাড়া আর সকল পদের যােগ্য বলে মেনে নেয়া  হয়েছিলাে। একজন অমুসলিম নাগরিককে সাধারণ পদ থেকে আরম্ভ করে প্রধানমন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি এমনকি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ারও অধিকার দেয়া হয়েছিলো। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে অমুসলিমদের তাদের নিজস্ব ধর্মকর্ম পালন ও প্রচারপ্রসারের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলাে। প্রতিটি নাগরিককে যেকোন ধর্ম গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়। কিন্তু মওলানা মওদুদী সুপারিশ করেছিলেন, যারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ‘মােরতাদ হয়ে যাবে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। শাসনতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা আরােপ করা হয়নি। রাষ্ট্রের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে পুরুষের ন্যায় নারীদের নিয়ােগ করার বিধান রাখা হয়েছিলাে। এ ব্যাপারে কোনাে প্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ মওলানা তাঁর শাসনতান্ত্রিক সুপারিশে বলেছিলেন, “আইন পরিষদগুলােতে একাধিক দল গঠন করা আইনের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ হতে  হবে। … আইন পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্যা হওয়ার অধিকার দেয়া পাশ্চাত্য জাতিগুলাের অন্ধ অনুকরণ বই কিছু নয়। ইসলামের নীতি কিছুতেই এর অনুমতি দেয় ।”

মওলানা মওদুদী ও অন্যান্য কয়েকজন আলেম দাবি করেছিলেন, যেহেতু পাকিস্তান একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, সুতরাং শাসনতন্ত্রে এমন একটা ধারা রাখা হােক যাতে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ও লক্ষ্য সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রতিটি নাগরিককে সমভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলাে। এমনকি আদর্শ বলতে তাতে কিছুই স্বীকার করা হয়নি। প্রতিটি ব্যাপারে জনমতকেই শেষ কথা হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিলাে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মওলানা মওদুদী কতকগুলাে বিষয় ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বলে প্রচার করে আসছিলেন। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে এগুলাে সন্নিবেশ করানাের জন্য তিনি রাতদিন নিরলস অভিযান চালান। এ ব্যাপারে প্রতিবাদকারীদের এমন কোন ভদ্র গালি নেই যা তিনি দেননি। কিন্তু এতাে কিছু করার পরও শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়ার পর দেখা গেলাে, মওলানার সুপারিশগুলাে কোনটিই তাতে নেই। এমতাবস্থায় স্বভাবতই মনে করা হয়েছিলাে তিনি শাসনতন্ত্রের বিরূপ সমালােচনা করবেন। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হলাে। মওলানা সীমাহীন সহানুভূতি ও প্রশংসচিত্তে শাসনতন্ত্রকে অভিনন্দন জানালেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাখা হয়েছিলাে। এও শর্তারােপ করা হয়েছিলাে, মুসলমানই রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। আমরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম এজন্য যে, মওলানা তাতেই অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং এটা তাঁদের সবচাইতে কামিয়াবী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পক্ষান্তরে ১৯৩৩ সাল থেকে মওলানা উপমহাদেশের মুসলমানদের একথা শুনিয়ে আসছিলেন, ‘ইসলাম’ শব্দে কোন বৈশিষ্ট্য নিহিত নেই। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা বংশগত ও নামের মুসলমান। আরাে কত কিছুই না তিনি বলেছেন। 

কিন্তু সময়ের কি নির্মম পরিহাস, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানের শাব্দিক । ইসলামী নামেই তিনি আনন্দে আটখানা হয়ে পড়েছিলেন। মওলানা ও তাঁর অনুসারীরা এটাকে তাঁদের বিরাট কামিয়াবী বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি এতটুকু তলিয়ে দেখার ফুরসত পেলেন না-রাষ্ট্রপ্রধান যে মুসলমান হবেন তিনি কি বংশগত ও নামের মুসলমানই হবেন, না তাঁর বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকৃত ‘সত্যিকার ও ন্যায়নিষ্ঠ মুসলমান’ হবেন। এবারে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নে আসা যাক। সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নটা যেকোন দেশের। শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। এ অধিকার কাকে দেয়া হয়েছে তা দেখলেই উক্ত শাসনতন্ত্রের ধরন নির্ণয় করা যায়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছিলাে, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদই দেশের সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী। আর এর সদস্য হবেন জনসাধারণ। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ পরিষদের সদস্য হতে পারবেন। ধর্মগত কারণে তাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা হবে না। কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান হবেন। কোনাে অমুসলিম এ পদের প্রার্থী হতে পারবে না। এছাড়া আর সব বিষয়ে মুসলিম-অমুসলিম পরিষদ সদস্যদের সম-অধিকার থাকবে। তাদের সবার ভােটে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন। সবার ভােটে তাঁকে পদচ্যুতও করা যাবে। একজন মুসলমান যেমন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন অনুরূপ একজন অমুসলমানও হতে পারবেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের মধ্য হতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। তাঁদের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা দেয়া হবে। তাঁরা জাতীয় পরিষদের সামনে জবাবদিহি হবেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের উপর আর কেউ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নেই। শুধু জনসাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের পরিবর্তন করতে পারবে। জাতীয় পরিষদের এই মর্যাদার প্রেক্ষিতে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনসাধারণের সার্বভৌমত্বকেই ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলাে।  ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি ধারায় একথা বলা হয়েছিলাে, জাতীয় পরিষদ কোরআন ও সুন্নাহর খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। বাহ্যত এ ধারাটি জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্বকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিলাে। এদিক থেকে যদি বলা হয়, জাতীয় পরিষদের উপরেও একটি শক্তি রয়েছে যার সামনে পরিষদকে মাথানত করতে হবে, তাহলে অযথা কিছু বলা হবে না। বস্তুত জাতীয় পরিষদের আইন তৈরি করার শক্তি ছিলাে না।

কিন্তু শাসনতন্ত্রে বিষয়টির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এরপর স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, কোন্ আইনটি ইসলামানুগ আর কোন্‌টি নয়, এর ফয়সালাও জাতীয় পরিষদই করবে। সে-ই এ ব্যাপারে সর্বেসর্বা। তার ফয়সালার বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্ট, ওলামা বাের্ড কিংবা অন্য কোনাে সংস্থার নিকট অভিযােগ করা চলবে না। তবে হ্যাঁ, একটি শক্তি এ ব্যাপারে জাতীয় পরিষদকে বিরত রাখতে পারে, আর তা হলাে জনশক্তি। তারা নতুন নির্বাচনকালে এরূপ আইন প্রণয়নকারী জাতীয় পরিষদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। এক্ষেত্রেও পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনসাধারণের সার্বভৌম ক্ষমতাকেই মেনে নেয়া হয়েছিলাে। এ বিষয়টি এতাে স্পষ্ট ভাষায় বিবৃত হয়েছিলাে যে, শাসনতন্ত্রের খসড়া  প্রকাশিত হওয়ার পর খােদ জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরাকেও তার রিপাের্টে স্বীকার করতে হয়েছিলাে। মজলিসে শূরা খসড়াটি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছিলাে, “তাতে অনৈসলামিক প্রবণতা রয়ে গেছে।৩

তা দূর করার জন্য মজলিসে শূরা কতকগুলাে সুপারিশ করেছিলাে, কিন্তু কেউই সেদিকে নজর দেয়নি। এমনিই খসড়াটি অনুমােদন করা হয়। তাতে করে শাসনতন্ত্র প্রণেতা পরিষদ জনগণের সার্বভৌমত্বকেই বহাল রাখে। জাতীয় পরিষদের উপর কোনাে শক্তির কর্তৃত্বকে মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়। বস্তুত জাতীয় পরিষদের অর্থই হলাে জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধি। অন্যভাবে বলতে গেলে স্বয়ং জনসাধারণ । অবশ্য শাসনতন্ত্রের ভূমিকায় উল্লিখিত আদর্শ প্রস্তাবের একটি ধারায় বলা হয়েছিলাে, ‘আল্লাহ তায়ালাই সমগ্র বিশ্বের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে জনসাধারণকে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার সুনির্দিষ্ট অধিকার প্রদান করেছেন। আর এ অধিকার একটা পবিত্র আমানত।’ কিন্তু মূল শাসনতন্ত্রের অন্যান্য ধারায়  সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলাের প্রেক্ষিতে ভূমিকায় উল্লিখিত মন্তব্য যে অর্থহীন, তা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা, মূল শাসনতন্ত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে, জাতীয় পরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এসব কারণে সম্ভবত শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরাও ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে এর বিরুদ্ধে সমালােচনা করে এবং এ ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে। তাছাড়া মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে যেসব মৌলিক দাবীদাওয়া ও সুপারিশ পেশ করেছিলেন, শাসনতন্ত্র প্রণেতারা তার তেমন কিছুই গ্রহণ করেননি। এত কিছু সত্ত্বেও শাসনতন্ত্র অনুমােদিত হওয়ার পর জামাত নেতা ও তাঁর দলবল এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। তাঁরা শাসনতন্ত্রে বিভিন্ন ধারার মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজেদের পরাজয়কে লােকচক্ষুর আড়াল রাখার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করায় মেতে ওঠেন। এ সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরার একটি ঘােষণা উর্দু দৈনিক তসনিমের ১৯৫৬ সালের ২০ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, “দেড়শ’ দু’শ’ বছর কুফরীর প্রভাব থাকার পর এই প্রথমবার আমাদের শাসনতন্ত্র ও আইনে। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর ধর্মের আইনানুগ প্রাধান্য স্বীকৃত হলাে।’

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ মওলানা মওদুদী এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি শাসনতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “শাসনতন্ত্র দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন থেকে আমরা এরূপ একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জীবনারম্ভ করছি, যে আইনগতভাবে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, ক্ষমতা তাঁর তরফ থেকে পবিত্র আমানতস্বরূপ মেনে নিয়ে তা প্রয়ােগের জন্য তাঁর নির্ধারিত বিধিবিধান অনুসরণ করার ব্রত গ্রহণ করেছে। আর বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি, যে নিজের শাসনতন্ত্রের ভূমিকায় এ ঘােষণা সংযােজিত করেছে—আমরা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, ইনসাফ ও সামাজিক ন্যায়নীতির সে পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করবাে যা ইসলাম আমাদের দিয়েছে।” মওলানার এই বিবৃতি পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্রগুলােতে প্রকাশ। করা হয়। অসংখ্য পােস্টারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তাতে করে জনসাধারণকে বুঝানাে হয়, সত্যি সত্যি শাসনতন্ত্রে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অথচ মূল শাসনতন্ত্রে তার কোনাে উল্লেখ নেই। তাতে জনসাধারণের সার্বভৌমত্বই স্পষ্টরূপে স্বীকৃত হয়েছে। পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, যে বাক্যটি থেকে মওলানা মওদুদী ও তার অনুসারীরা এ ধরনের অর্থ নিয়েছেন তা শাসনতন্ত্রের মূল ধারার নয়। এটা আদর্শ প্রস্তাব ও শাসনতন্ত্রের ভূমিকার অংশবিশেষ। এ বাক্যটিকে নিজেদের স্বার্থের সহায়ক হিসেবে । যতই টানাহেঁচড়া করে থাকুন না কেন, কিন্তু এটা যে শাসনতন্ত্রের মূল ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত তা মওদুদী সাহেবদের পক্ষেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে জামাতে ইসলামীর দাবীদাওয়া সংযােজিত হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা একে স্বাগত জানিয়েছিলেন? প্রথমে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিরূপ সমালােচনা করে এবং অনুমােদিত হওয়ার পর কেন তারা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন? মওদুদী সাহেব জেনেশুনে কেন এর অপব্যাখ্যা করেছিলেন? ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানী দাঙ্গা, লাহােরে সামরিক আইন জারি ও তার পরবর্তীকালে মওলানার ভূমিকা থেকেই এর পরিষ্কার জবাব পাওয়া যায়। এ সময়ের পর থেকে মওলানা যেকোন বিষয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেন। ফলে ১৯৫৩ সালের পূর্বেকার দীর্ঘ কর্মজীবনের তথাকথিত অনেক ইসলামী ব্যাখ্যা-বিবৃতিই তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়।

দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, এককালে তিনি গণতন্ত্রকে ইসলামের শত্র, অভিশপ্ত-আরাে কত কি বলতেন! কিন্তু ১৯৫৩ সালের পর এই মওলানা মওদুদীই ‘গণতন্ত্র ইসলামের সারকথা’ ইত্যাদি বলতে আরম্ভ করেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বেলায়ও মওলানা ও তাঁর জামাত হুবহু এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। শাসনতন্ত্রের খসড়া পর্যায় পর্যন্ত এর কড়া সমালােচনা করেন। কিন্তু অনুমােদিত হওয়ার পর তিনি এ ব্যাপারে সকল প্রকার মতবিরােধ ধামাচাপা দিয়ে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে যান। শাসনতন্ত্রকে সানন্দে গ্রহণ করেন। জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শাসনতন্ত্রের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন।  আপনারা হয়তাে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে পাকিস্তানের মৃত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনার প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। আমিও আপনাদের সাথে এ ব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করি না। তারপরও এই আলােচনার লক্ষ্য হচ্ছে, ইসলামের মুখােশধারী জামাতের আসল চেহারার একটা দিক তুলে ধরা। ক্ষমতাসীনদের সাথে বৈরিতা এড়ানাের জন্য জামাত কিভাবে ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা করে, এই সংক্ষিপ্ত আলােচনায় তার কিছুটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। গত ক’বছর থেকে জামাতের যে সরকার-বিরােধী ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন, এটা তার অভিনয় ছাড়া কিছু নয়। নিজেদের কালাে অতীতকে ধামাচাপা দেয়াই হাচ্ছ, তাদের এই অভিনয়ের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নতুবা অতীতে যেমন ক্ষমতাসীনদের সাথে তাদের যােগসাজশ ছিলাে, আজো রয়েছে। আমাদের এই বক্তব্যের  বাস্তব প্রমাণ হছে, গত ক’বছরের আন্দোলনে এতাে রক্ত ঝরা সত্ত্বেও জামাতীদের একজন কর্মীরও কিছু হয়নি। মির্টিং-মিছিলে তাদের কেউ নিহত কিংবা আহত হয়নি। হরতাল ও মিটিং-মিছিলের যেখানে সংঘর্ষ হয়েছে, জামাতীদের সেখানে দেখা যায়নি। মওলানা মওদুদী ও তার জামাত সেই সুদূর অতীত থেকে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে কায়েমী। স্বার্থের লেজুড়বৃত্তি করার যে ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে আসছিলেন, বাংলাদেশেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের চোখে ধূলা দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা পাতানাে বিরােধিতার ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আমাদের এই অভিমতের বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে তৃতীয় জাতীয় সংসদ থেকে দশজন জামাতী সদস্যের একযােগে পদত্যাগ। জনশ্রুতি আছে, একটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে তারা সেবার জাতীয় সংসদ থেকে একযােগে পদত্যাগ করে। নতুবা এ সময়ে পদত্যাগের কোন যৌক্তিকতা ছিলাে না।

 

Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল