You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.20 | মতিউরের জঙ্গি বিমান হাইজ্যাক প্রচেষ্টা  - সংগ্রামের নোটবুক

২০ আগস্ট ১৯৭১ঃ মতিউরের জঙ্গি বিমান হাইজ্যাক প্রচেষ্টা 

পূর্ব পাকিস্তানে ২ বেঙ্গলের সাথে কিছু দিন প্রতিরোধ যুদ্ধ করে ২ বেঙ্গল ভারতের দিকে চলে যাওয়ার পর মতিউর অন্য পরিকল্পনা নিয়ে ৬ মে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যান। জুলাইয়ে পিআইএ বিমান হাইজ্যাক করার একটি পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার ফলে হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বাঙ্গালী পাইলটকে গ্রাউন্ডেড করে দেয়া হয়। করাচি মশরুর বিমান ঘাঁটিতে বেস কমান্ডার সব বাঙ্গালী বৈমানিককে একত্রিত করে সতর্ক করে দেন যে কোনো অপারেশন্যাল এলাকায় তারা যেতে পারবে না এবং তাদের জন্য বিমান চালনা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। মতিউর এতে ক্ষুব্দ হন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবারো মরিয়া হয়ে উঠেন। সংকল্প নিলেন বিমান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করার। তিনি কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন হয়ে মশরুর বিমান ঘাঁটিতে বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব লাভ করেন।

এই সময় তিনি পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজকে জেট বিমান উড্ডয়ন শিক্ষা দিতেন। ছুটিতে দেশে যাওয়ার সময় ছিল আসন্ন। তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করলেন মিনহাজ যখন বিমান চড়ে উড়তে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে তিনিও ওই বিমানে চড়ে মিনহাজ সহই বিমানটি হাইজ্যাক করবেন এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আকাশে প্রবেশ করবেন।  ২০ আগস্ট শুক্রবার বেলা সোয়া ১০-১৭ টায় মতিউর রহমানের ছাত্র পাইলট অফিসার মিনহাজ ‘টি-৩৩’ বিমান নিয়ে একবার উড়ে এলেন মতিউর তার কাছে গিয়ে তার এই উড়াও সম্পর্কে ব্রিফিং দিয়ে বললেন আবারো আরেকবার উড়াও। আরও কয়েক প্রশিক্ষণার্থী উড়াল প্রশিক্ষনে ছিলেন ফলে পরবর্তী উড়ানের জন্য মিনহাজের ২৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। মিনহাজ পরবর্তী উড়ানের জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি চায়। কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন ডিউটিতে ছিলেন বাঙ্গালী পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান এবং পাকিস্তান বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম। অনুমতি দেয়ার পর মতিউর তার জীপ গাড়ী স্টার্ট দিয়ে রাখে। এর মধ্যেই মিনহাজ তার বিমান স্টার্ট দেয়। মতিউর সাথে সাথে গাড়ী চালায় বিমানের সাথেই এবং ইঙ্গিত দেয় পিছনে কিছু সমস্যা হচ্ছে। মিনহাজ প্লেন থামিয়ে দেয়। মতিউর তার গাড়ী রানওয়েতে আড়াআড়ি রাখে যাতে পরবর্তী উড়ান বিঘ্নিত হয়। মতিউর বিমানের পিছনে চড়েন। বিমানে চড়েই মতিউর মিনহাজের অক্সিজেন বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালান এবং মিনহাজ আবার তা পুনঃস্থাপন করেন। মতিউর এ সময়ে মিনহাজকে কিছুটা ক্লরোফর্ম করেছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যেই মিনহাজ টাওয়ারে বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হন তার বিমান হাইজ্যাক হচ্ছে। তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রন নিয়ে মিনিট দুয়েক ধস্তাধস্তি চলার পর মুল রানওয়েতে বিমান পৌঁছে।

ককপিটে শুরু হলো মতিউর-মিনহাজ অর্থাৎ গুরু-শিষ্যের তুমুল লড়াই। ধস্তাধস্তির মধ্যে বিমানটি হঠাৎ দ্রুত রানওয়ের মাত্র কয়েক ফুট ওপর দিয়ে বিপজ্জনকভাবে ভাবে উড়ে যায়। মিনহাজের বার্তার প্রেক্ষিতে থামার আদেশ সত্ত্বেও নিষেধ না মেনে বিমানটি বহু কষ্টে উপরে উঠে যায়। বিমানটি এমনভাবে একাত-ওকাত হয়ে উড়তে থাকে যাতে বোঝা যায় বিমানটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ককপিটের ভেতর ভীষণ হাতাহাতি চলছে। রাডারে যাতে বিমানের অবস্থান ধরা না যায় তার জন্য টি-৩৩ খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমানটি দিগন্তে মিলিয়ে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন হুলস্থূল পড়ে গেছে। 

পাকিস্তানী ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম সঙ্গে সঙ্গে বেস কমান্ডারকে টি-৩৩ ছিনতাইয়ের খবর জানালেন। খবর শোনামাত্র বেস কমান্ডারও দ্রুত কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে এলেন। অল্প ক্ষণের মধ্যেই দুটি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান টি-৩৩ এর খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও টি-৩৩ এর কোনো হদিস করা গেল না। বিকালের দিকে খবর পাওয়া গেল থাট্টা জেলার দক্ষিনে তালাহারে বিমানটি টি-৩৩ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং দুজন বৈমানিকই নিহত হয়েছেন। ভূগোলের দৃষ্টিকোণে এ জেলা বাংলাদেশের খুলনার অনুরুপ। পার্থক্য শুধু খুলনার সুন্দরবন আর সেখানে জলা জঙ্গল এবং প্রায় জনবসতিহীন। ভারত সীমান্ত যেতে এ পথ ছিল অর্ধেক আর চার মিনিট সময় পেলেই ভারতের যে কোন ঘাটিতে পৌঁছে যেতেন মতিউর। কিন্তু মিনহাজের ক্লরোফর্ম মাত্রা কমে আসলে সে ধস্তাধস্তি শুরু করায় দুর্ঘটনা ঘটে। আরেকটি মত আছে যে ধাওয়াকারী বিমান থেকে বেতার মারফত ফিরে যাওয়ার নির্দেশ উপেক্ষা করে বিমান ভারতের দিকে ধাবমান হওয়ায় বিমানটিকে গুলি করে ভুপাতিত করা হয়। মতিউরের দেহ সম্পূর্ণ অবস্থায় মুল ক্রাশ এলাকা থেকে আধা কিমি দূরে পাওয়া যায়। এর কারন হিসেবে বলা হয় মতিউর আগে বেল আউট করে ছিলেন বা কেনোপি খুলে গিয়ে ধ্বস্তাধস্তিতে পরে যেয়ে থাকতে পারেন। মিনহাজের দেহ খণ্ডিত অবস্থায় ক্রাশ পয়েন্ট এর কাছেই পাওয়া যায়।