You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ২৯শে শ্রাবণ, ১৩৮১

পরগাছাদের উচ্ছেদ করতে হবে

স্মরণাতীতকাল এর ভয়াবহ বন্যায় আজ দীর্ঘদিন ধরে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার প্রায় তিন কোটি মানুষ বিপর্যস্ত এবং বন্যা কবলিত এলাকায় এমন কোন লোক আছে কিনা সন্দেহ, সে কোন না কোন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক’দিন ধরে আমরা লক্ষ্য করে আসছি বহির্বিশ্ব থেকে ত্রাণসামগ্রী এসেছে, দুর্গতদের জন্য তা পর্যাপ্ত নয় এবং এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সরকারকে তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ কার্য পরিচালনা করতে হচ্ছে। গতকাল দেশের জাতীয় সংবাদপত্র গুলোর খবর অনুযায়ী কোন কোন জায়গায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পেলেও সামগ্রিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি গত দুদিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে অতিশীঘ্র পানি হ্রাস পেতে শুরু করবে।
অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তাই আমরা আশঙ্কা করছে করেছিলাম অন্যান্য বছরের ন্যায় বন্যার পানি এবারও হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে দুর্গত অঞ্চলগুলোতে সংকট তীব্রতর হবে সংক্রামক ব্যাধি বিস্তারের মধ্য দিয়ে। জনস্বাস্থ্য দপ্তর ইতিমধ্যে দুর্গত অঞ্চলসহ দেশের অপরাপর এলাকায় মহামারী প্রতিরোধক টিকা ও ইনজেকশন ব্যাপকহারে দেয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা হাতে নিয়েছেন এবং খবরের কাগজে এ খবর পড়ার সাথে সাথে তাই আমরা পুলকিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম।
কিন্তু গতকাল একটি দৈনিকে উপদ্রুত অঞ্চলে উচ্চমূল্যে স্যালাইন বিক্রিসহ সংক্রামক ব্যাধি কবলিত এলাকার একটি দীর্ঘ রিপোর্ট পরিবেশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নোয়াখালী সদর মহাকুমায় কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা সঠিকভাবে গণনা করা হলে সহস্রের কোটা অতিক্রম করে যাবে। রিপোর্টার বিভিন্ন গ্রামে হেঁটে হেঁটে লোকজনের সাথে সরাসরি আলাপ আলোচনা করেছেন এবং পরে লিখেছেন, ‘ওষুধ যে নেই তা নয়, প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকলেও ওষুধ আছে। অন্ততঃ জরুরী ভিত্তিতে আক্রান্তদের দেয়ার মত। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিরা সে ওষুধ পাচ্ছেন না । জন-স্বাস্থ্য বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মচারী সে ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করে পয়সা কামানোর উৎসবে মেতেছে। রিপোর্টার লিখেছেন, ‘বেগমগঞ্জ থানার ১৬ নম্বর রাজগঞ্জ ইউনিয়ন এর এমন কোন বাড়ী নেই সেখানে কলেরা ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়নি বা মারা যায়নি।’ দুলা মিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, কলেরায় আক্রান্ত দুলামিয়া তার নিজের ও মেয়ের জন্য স্যালাইনের দুটি বোতল কিনেছেন যথাক্রমে ৬০ টাকা ও ৬৫ টাকা দিয়ে। অথচ প্রতি বোতল তৈরি করতে হয় মাত্র ৮৭ পয়সা এবং এই সমস্ত স্যালাইন সরকার বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে সরবরাহ করেছেন।
গতকাল অপর একটি জাতীয় দৈনিকে আরেকটি খবর পরিবেশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আদমজীনগর এর রিলিফ ক্যাম্পে আত্মঘাতী সংঘর্ষে তিন ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, যে আই,সি,আর,সি’র জনৈক সদস্য উক্ত রিলিফ ক্যাম্পের অবস্থা পরিদর্শনে গেলে ক্যাম্পের লোকজন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রিলিফ দ্রব্য চুরি, বন্টনে অব্যবস্থা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলেন। বিদেশি ত্রাণ সংস্থার উক্ত সদস্য প্রস্থান করলে রিলিফ ক্যাম্প এর চেয়ারম্যানের লোকজন অভিযোগকারীদের কয়েকজনকে প্রহার ও ডেগার দ্বারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে।
দুটি খবরেই পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত বলে আমরা পাশাপাশি তা পরিবেশন করলাম। রিলিফ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শুরুতেই আরম্ভ হয়েছে তা আর বিশদভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদমজী নগরের ঘটনাই তো শেষ ঘটনা নয়। রিলিফ নিয়ে কারচুপির বহু খবর আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি এবং এই স্বজনপ্রীতি ও চুরির বিরুদ্ধে সরকারিভাবে কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এই হুঁশিয়ারি বাস্তবায়নে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না? মহামারীর খবর তো ব্যাপকভাবে সবেমাত্র মাইজদী হতেই পাওয়া গেল। বন্যার পানি হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ শুরু হবে ব্যাপকহারে। তাহলে জনসাস্থ্য দপ্তরের যে কর্মীদের কাছে স্যালাইনসহ টিকা-ইঞ্জেকশন বিনা মূল্যে জনগণের মাঝে বিতরণের জন্য দেওয়া হয়েছে, তারা যদি নোয়াখালী সদর মহকুমার স্বাস্থ্যকর্মীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জনগণের মাঝে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে তাহলে বন্যায় সর্বহারা লোকদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? বঙ্গবন্ধুর কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও যে সমস্ত পরগাছা রিলিফ সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে নিরীহ জনগণের সাথে ছিনিমিনি খেলছে অবিলম্বে তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং নোয়াখালীর ঘটনা যদি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হয় স্বাস্থ্য বিভাগের উক্ত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা

হাইড্রোজেন বোমার জনক বলে অভিহিত মিস্টার এডওয়ার্ড টেলর সম্প্রতি বলেছেন, দশ বছর আগের চেয়ে এখন পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা অনেক গুণ বেড়েছে। তিনি আরো বলেন, যারা শান্তিকামী তাদের হাতে ক্ষমতা থাকার উপর শান্তি নির্ভর করে। এবং বিশ্বের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য পরমাণুশক্তিকে সরাসরিভাবে ব্যবহার করাকে তিনি অপত্তিকর বলে মন্তব্য রাখেন। মিস্টার টেলরের অভিমত বিস্তারিত দেখার অপেক্ষা রাখে না।
একথা অনস্বীকার্য যে, পারমাণবিক শক্তির দ্বারা একদিকে যেমন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে অন্যদিকে আবার মানবসভ্যতা আরও তুঙ্গে আরোহন করতে পারে। মানবজাতির ইতিহাসকে নতুন খাতে বইয়ে দিতে পারে। পাহাড় কেটে খাল, সমুদ্রের মাঝে পাহাড়, মরুভূমির বালুরাশি মাঝে মরুদ্দ্যান গড়ে তুলতে পারে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ববাসীর খাদ্য সমস্যা ও নানাবিধ সমস্যার সমাধানে অতি দ্রুত এবং নিখুঁত কারিগরী সহায়তা নিয়ে সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে এগিয়ে আসতে পারে। পৃথিবী থেকে দারিদ্রের অভিশাপ, পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা, মানবতার লাঞ্ছনা এবং অগ্রগতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির চিরশত্রুকে নির্মূল করতে পারে। কিন্তু সেদিকে যথার্থ চিন্তার বিন্যাস কই?
মুখে শান্তির বাণী ও দলিলপত্রের শান্তির সনদপত্র প্রদান করার পরেও যখন বৃহৎ শক্তিবর্গের নির্বিকারে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে ক্ষান্ত দেয় না-সেখানে আশঙ্কাও বৃহৎ জিজ্ঞাসা দেয় বৈকি! চকিতে ভাবতে হয়-পারমাণবিক শক্তির চর্চা কি তাহলে শান্তি আন্দোলনকে দানা বেঁধে উঠতেই দেবেনা? মানবসভ্যতার এতদিনের সৃষ্টি ঐতিহ্যের তিল তিল সঞ্চয় কী পারমাণবিক শক্তির আগুনে ছাই হয়ে যাবে?
শক্তি চর্চার এই আত্মহনন প্রয়াস কোন পথে মানবজাতির কল্যাণের অমৃত সাগরে অবগাহনের সুযোগ দিবে সে জিজ্ঞাসার অনন্ত উৎসব থেকে মানব সভ্যতা কবে মুক্তি পাবে-তা আমরা জানিনা। তবে আজকের বিষয় সহ অবস্থান ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য মন্ডিত সম্বন্ধে ছাড়া যে একক অস্তিত্বের অহংকার নিয়ে টিকে থাকা যায় না-এই সততার মূল্য দিতে গিয়েই শান্তি আন্দোলন আরো জোরদার হবে বলে আমরা ভরসা রাখি। সর্বোপরি বিশ্বমানবতার চেতনায় বিশ্ববিবেক আজ শান্তির সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে।
আমরা জানি বিশ্বব্যাপী শান্তি আন্দোলন এখন জোরদার হয়েছে। এবং ক্রমশঃ এই আন্দোলন আরও প্রসারিত হবে। শুধু যে নির্ভরশীল দেশগুলো নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই আজ শান্তি আন্দোলনের তাঁবুতে আশ্রয় নিয়ে নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তা নয়। শক্তিশালী দেশগুলোর জনসাধারণ ও গভীরভাবে শান্তির স্বপক্ষে আজ রায় দিচ্ছে। কারণ সেই সনাতন শক্তির চর্চার সংঘর্ষ ঘটে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চাই শান্তি পেলব প্রলেপ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিশ্লিষ্ট জ্ঞান এই ধারণাকেই প্রচার করছে সবচেয়ে বেশি।
শান্তিকামী বিশ্ববাসীর এই নৈতিক চেতনার ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি আলোচনা চলেছে বহু বার। এবং সাম্প্রতিককালের রুশ-মার্কিন চুক্তিকে পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষাকে আংশিকভাবে সীমিত করার প্রচেষ্টা ও শান্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সহায়ক শর্ত তা বলাই বাহুল্য। তাই মানবতাবাদকে সামনে রেখে তারই বন্দনায় পারমাণবিক শক্তির চর্চাকে যুদ্ধোপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার মানসিকতা আজ উৎসর্গ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ শক্তির তপস্যা করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এতে বিশ্বের স্থিতিশীলতা চির হুমকির মুখেই থাকবে। যার ফলে পৃথিবীর বুক থেকে মানব জাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত একদিন বিলুপ্ত হতে পারে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!