বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৫শে জুলাই, বৃহস্পতিবার, ৮ই শ্রাবন, ১৩৮১
ট্রেন ডাকাতির হিড়িক
স্বাধীনতার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির অঙ্গীভূত হয়ে ট্রেন ডাকাতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার বলতে গেলে রাজধানীর বুকের উপর গেন্ডারিয়ায় এক ভয়াবহ ট্রেন ডাকাতি সংঘটিত হয়। ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা গামী ট্রেনটি গেন্ডারিয়া ঢাকা দলটি যাত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ডাকাতেরা যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, হাতঘড়ি ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
যাত্রীদের মধ্যে একজন মারা যায় এবং একজন মহিলা সহ চার ব্যক্তি আহত হয়।
ওই রাতেই অপর একটি ট্রেন ডাকাতি হয় জগন্নাথগঞ্জ-ময়মনসিংহ লাইনে নুরুন্দি-পিয়ারপুর স্টেশন এর মাঝ পথে। ভুক্তভোগী যাত্রী সূত্রে খবর পাওয়া যায় এবং পত্রিকান্তরের এক প্রতিবেদনে তা প্রকাশ করা হয়। ভোর রাতের দিকে ধারালো ছোরা হাতে ডাকাতেরা ট্রেনে ডাকাতি শুরু করে। এরা ট্রেনের দুটি কামরার যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা-পয়সা ও হাতঘড়ি সহ প্রায় ৩৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। যাত্রীরা প্রাণ ভয়ে চিৎকার শুরু করলে ডাকাতেরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাত্র ক’দিন আগেই সিলেট সুরমা মেল ট্রেনের সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে ডাকাতেরা ১৪ হাজার টাকা লুট করে এবং ৫ ব্যক্তি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। ঘটনার বিবরণ প্রায় একই রকম। মাঝরাতের দিকে ট্রেনের ছাদের উপর থেকে খোলা জানালা দিয়ে ডাকাতেরা চলন্ত গাড়িতে ডাকাতি করে। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তবু ডাকাতি তৎপরতা একই পর্যায়ে চলে।
বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই ট্রেনযোগে যাতায়াত করে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ট্রেন পরিবহন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বহু যত্নে এবং তৎপরতার মাধ্যমে স্বাধীনতার পর থেকে ট্রেন ব্যবস্থা উন্নত করার আপ্রান চেষ্টা চালান ক্ষমতাসীন সরকার। তার ফলে লাইনের উপর দিয়ে গাড়ি চললেও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা খুব একটা দূর হয়েছিল না। তবু ট্রেনে যাত্রী তো ছিলই না বরঞ্চ ছাদ পর্যন্ত লোকে পূর্ণ থাকতো। এই অবস্থায় যদি ডাকাতের তৎপরতা চলতে থাকে এবং জান ও মালের নিরাপত্তা চূড়ান্ত অভাব দেখা দেয়–তাহলে জনসাধারণ কোন পথে যাবে? আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ট্রেন ডাকাতি ঘটে যাবার পরও রেলপুলিশের গোচরে আসে না সেই সংবাদ। হয় পুলিশের সংখ্যা কম নয় তাদের পুলিশেরা কর্মে অবহেলা করে থাকেন। তবে যেটাই হোক–কোনটাই প্রশংসার কথা নয়। জাতীয় সাধারণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব। অতএব প্রয়োজনবোধে ব্যবস্থা নিলেই সব নাশকতামূলক কাজ রোধ করা যায় বা দূর করা যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা জানি চোর–ডাকাত শ্রেণীর দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দেবার জন্য বহুবিধ দন্ডবিধি আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দণ্ড দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো অপরাধীকে হাতেনাতে ধরা। তাই এমন ভাবে সতর্কতামূলক নিরাপত্তা জাল বিছাতে হবে যারা দুষ্কৃতিকারী কোন পথেই পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে না পারে। এব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষ এর অধিক সচেতন এবং প্রতিটি স্টেশনের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর করতে হবে। এবং ট্রেন ডাকাতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী প্রমাণসাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে, যাতে ঐ পথে যেতে অন্যেরা ভয় পায়। মোটকথা পরিবহনের মধ্যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পেলে যাত্রীসাধারণ যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও ভোগান্তিতে পীড়িত হয়–তার অবসান চাই আমরা।
বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা
বাড়িভাড়া সংকট ঢাকা শহরে আজ একটা নিদারুণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুদিন ধরে এই সমস্যার সমাধানের জন্য ভাড়াটেরা দাবি উত্থাপন করে আসছে। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম যে, কর্তৃপক্ষ ভাড়াটেদের এই নিদারুণ সমস্যার সমাধানের জন্য এগিয়ে আসবেন। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি জনিত সমস্যা যে কত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তা আর কারও অজানা নেই। বিশেষ করে ঢাকা শহরে এই সমস্যা আজ সবচেয়ে মর্মান্তিক। স্বাধীনতার পর থেকেই বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে প্রথম অবস্থায় মালিকরা হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে তারা অনেকটা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তৎপর হয়ে ওঠে। বর্তমানে ভালো বাড়ানো বা ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ করে একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির মালিকরা এখন তাদের খেয়ালখুশিমতো ভাড়া বাড়িয়ে চলেছে। যারা বাড়ির মালিক তারাও দাবি তুলেছেন–জিনিসপত্রের অধিক মূল্যের দরুন ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে, অন্যদিকে ভাড়াটে যারা তারাও জিনিসপত্র অত্যধিক মূল্যের জন্য বাড়ি ভাড়া দিতে অপারগ। এহেন অবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা বহুবার কতৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির দৌড় বন্ধের জন্য হস্তক্ষেপ করতে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা করেননি। অথচ ঢাকা শহরের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো অন্যান্য জিনিসপত্রের দামের আগুনে তেমন পুড়ে মরছে তেমনি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি জনিত কারণে ওষ্ঠাগত প্রাণ হয়ে উঠেছে। গত পরশু দিনের এক সংবাদে প্রকাশ ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেটে বাড়ির মালিকদের ওপর ভাড়া অনুপাতে ট্যাক্স ধরা হয়েছে তাতে করে আরও ভাড়া বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে ২০-৩০ কোন ক্ষেত্রে ৫০ ভাগও। বাড়িওয়ালার উপর ট্যাক্স ধার্য করার দরুন ট্যাক্সের বোঝা ভাড়াটিয়দের উপর এসে বর্তেছে। এদিকে গত কয়েকদিন পূর্বে সংসদ অধিবেশনে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য শ্রী ফণীভুষণ মজুমদারের নেতৃত্বে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও এতদসংক্রান্ত একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কয়েকজন সংসদ সদস্য এ কমিটির সভ্য রয়েছেন। সরকারের এই কমিটি গঠন একটি শুভ পদক্ষেপ বলে আমরা বিবেচনা করেছি। তবে কমিটি যত দ্রুত বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করবেন ততই মঙ্গল। আমরা আশা করছি–কর্তৃপক্ষ ও উল্লেখিত কমিটি এ ব্যাপারে একটা জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য রোধ করা আজ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। জীবনব্যবস্থা এমনিতেই মর্মান্তিক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে সে ক্ষেত্রে যদি বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে তাদের অহর্নিশি ভুগতে হয় তাহলে তাদের সংসার জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট আয়রে এই বিশেষ শ্রেণীটি একদিন সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়বে।
গত পরশুদিন অন্য একটি খবরে প্রকাশ, বাড়িওয়ালারা আজকাল নাকি বিদেশিদের নিকট বাড়ি ভাড়া দেবার ব্যাপারে অত্যাধিক উৎসাহী হয়ে উঠেছে। গত ২০ দিনের একটি পরিসংখ্যান থেকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রতি ৪৫টি বাড়ির মধ্যে ১৭ বাড়ি বিদেশীদের কাছে ভাড়া দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ফলে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাড়িওয়ালাদের কাছে বাঙালিরা কৃপার পাত্র বিশেষ। আমরা আশা করব, কতৃপক্ষ অনতিবিলম্বে ভাড়াটেদের জীবনের এই বিরাট সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগী হবেন। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলোর দুর্বিষহ জীবনের দিকে স্বহৃদয় দৃষ্টি দেবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক