বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২২শে জুলাই, সোমবার, ৫ই শ্রাবণ, ১৩৮১
আমদানি নীতি
জুলাই-ডিসেম্বর বাণিজ্য মৌসুমের আমদানি নীতি ঘোষণা করা হয়েছে গত শনিবার ২০শে জুলাই। এটা বাংলাদেশের ষষ্ঠ আমদানি নীতি। এবারের মৌসুমে নির্বাহের জন্য ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আমদানি নীতি ঘোষণাকালে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী অর্থের হিসেব দিতে গিয়ে বলেছেন যে, আমদানির নীতির বরাদ্দকৃত অর্থের অর্ধেক আসবে নিজস্ব রপ্তানি থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে। প্রত্যাশিত বৈদেশিক ঋণের বেশিরভাগ ইতিমধ্যেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং বাকি অংশের জন্য অল্প দিনের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করা হবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন যে, প্রয়োজনের তুলনায় যদিও উপরোক্ত বরাদ্দ অনেক কম তবু এই স্বল্প বরাদ্দের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ সংকট দেখা দেবে না। তদুপরি বর্তমান আমদানি নীতিতে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ প্রয়োজন সহ জ্বালানি তেল, নারকেল তেল, কাপড় কাঁচা সাবান ও সোডা, সিগারেট, টায়ার ও টিউব, মোটরগাড়ি, অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেলের পার্টিস ইত্যাদির জন্যও উপযুক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
প্রবাসী বাঙ্গালীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আমদানির স্কিমের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মৌসুমে তার পরিধি আরো বৃদ্ধি এবং নিয়মকানুন সহজতর করা হয়েছে। এদের আমদানিকৃত পণ্যের সংখ্যাও ২৮-৪০ প্রকারে উন্নীত করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লেড, টয়লেট সরঞ্জামাদি, ফিল্টার, টিপ সিগারেট, গ্রামোফোন রেকর্ড, ড্রাইসেল ব্যাটারি, টর্চ লাইট, জিরা আমদানি করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। স্কিমের আওতায় আমদানিকৃত দ্রব্যের আমদানির পরিমাণ, মূল্য ও বিতরণ এর উপরে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাছাড়া এই আমদানির ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আদেশের বিধিনিষেধ প্রয়োজন হবে না। এই পরিবর্তিত স্কীম চলতি সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবত থাকবে। এই নয়া আমদানি নীতিতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সহজতর করার উদ্দেশ্যে ভারী সোডা অ্যাশ এবং সাবান শিল্পের কাঁচামাল যথা কস্টিক সোডা ও তাল্লু টি,সি,বি,র আমদানি তালিকা থেকে অপসারণ করে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কে সরাসরি আমদানি লাইসেন্স দেয়ার কথা বলা হয়।
আমদানি নীতিতে বরাদ্দকৃত অর্থের উৎস হিসেবে পাট, চামড়া, কাগজ, চা ও জমানো মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে চলতি আমদানি মৌসুমের দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য রপ্তানিকারকদের তিনটি অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। যেমন- (ক) কয়েকটি রপ্তানি দ্রব্যের এক্স,পি,এল এর হার শতকরা ১০% ভাগ থেকে ১৫% ভাগ থেকে ২০% করা হয়। (খ) কোন পণ্য টি,সি,ব ‘র একান্ত তালিকা থাকা সত্ত্বেও এক্স পি এল এর অধীনে রপ্তানিকারকরা সরাসরি আমদানী করতে পারবেন। (গ) এক্স,পি,এল এর অধীনে আধুনিকীকরণ যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি দেয়া হবে।
আমদানি নীতি ঘোষণা করার সময় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর চলতি মৌসুমে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলেছেন। এ ব্যাপারে আমরাও একমত। তার উপরে বরাদ্দকৃত আমদানির যদি দেখা দেয় কম লাভজনক অথচ অথচ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আনার চেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প প্রয়োজনীয় এবং অধিক লাভজনক ব্যবসার সুযোগ রাখা হয়েছে–তাহলে দুঃখের আর অবধি থাকেনা। কারণ যতটুকুই হোক কোনো অবস্থাতেই কোন খাতে আর অপচয় রন্ধ্রকে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারিনা।
খুচরা যন্ত্রাংশ ও সরাসরি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানি করার লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসার্হ। কারণ এতে অনেক সময় ও অযথা নানা ক্রিয়া প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক বিলম্বের হাত থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো রেহাই পাবে। এবং রপ্তানি বাণিজ্যে লাভের অংক বাড়ানোর উদ্যোগকেও আমরা প্রশংসা করছি। কিন্তু সেইসঙ্গে কাপড় কাচা সাবান ও সোডা, ব্লেড, ড্রাইসেল ব্যাটারি, তালা ও জিরাসহ মসলা আমদানির ব্যাপারে আমরা উৎসাহ বোধ করছিনা।
স্বাধীনতার পরেও দেশে কয়টি ব্যাটারির কারখানা স্থাপিত হয়েছে। যতদূর জানা যায়, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে তারা পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি ড্রাইসেল ব্যাটারি আমদানি না করে কারখানাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামাল সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। এতে একদিকে কম বৈদেশিক মুদ্রা বা অধিক উৎপাদনের পথকে সুগম করা হতো এবং দেশে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হতো। এরকম জিরাসহ মসলার কথাও বলা যায়। স্বাধীনতার আগে জিরা ছিল পাঁচ টাকা থেকে ছয় টাকা। আর বর্তমান বাজারের প্রতি কাঁচা জিরা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার টাকা থেকে ৫ টাকা অর্থাৎ ছটাক হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর প্রতি সেরের দাম দাঁড়ায় ২৮৮ থেকে ৩২০ টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত দামের জিরা আমদানি না করলেও রন্ধনশালা শিকেয় উঠার প্রশ্ন আসে না। অতএব সেই পদ্ধতি ও আমরা আমদানি বরাদ্দ থেকে অনায়াসে বাদ দিতে পারি। একটু বাস্তব দৃষ্টি সম্পন্ন হলেই এসব চোখে পড়ার কথা।
অন্যদিকে আমদানির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের উৎস এখনো হাতের মধ্যে নেই। সবেই সম্ভাবনা, আসবে, পাওয়া যাবে এবং অর্জন করব। অর্থাৎ পুরোপুরি অনিশ্চিতের ভিত্তিভূমি থেকে এবারের আমদানি নীতি নির্ধারিত হয়েছে- একথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এবং এরই সূত্র ধরে অনুমান করা যায় যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞয় কত! অতএব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যাদি ছাড়া অন্য কোন দ্রব্য আনার পরিকল্পনা আজ কিছুতেই রাখা যায় না।
তার উপরেও প্রশ্ন আছে প্রায় সমগ্র বিশ্ব আজ মুদ্রাস্ফীতির তরঙ্গ আন্দোলিত। মুদ্রাস্ফীতির দোলায়মান পরিস্থিতির অবস্থায় আমদানি নীতি কার্যকর হতে হতে কোথায় গিয়ে শেষ হবে এবং নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে কি পাব না, সে বিষয়েও ঘোরতর সন্দেহ জাগে। তার ওপর আছে দুর্নীতি তেলেসমাতি খেল। সুতরাং সবদিক সামলে চলতে হবে এবং যত সত্বর সম্ভব আমদানীর সম্ভাবনা গুলিকে সর্বোচ্চ পরিমাণে সফল করে তোলার প্রয়াসে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসহ কাজের নিদর্শন আজ রাখতে হবে। আমাদের যা আছে তার মধ্যেও যেন আবার ঘাপলা না ঢোকে। নাই-এর বাস্তবতা সহ্য হয়, আছে-এর বঞ্চনা অসহ্য। কেন অল্প আয়েও তো গরীবের সংসার চলে। কেবল সেখানে বাবুয়ানা আর অপরিণামদর্শিতা বাদ দিতে হয়। এই সহজ কথাটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ সমানভাবে প্রযোজ্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক