You dont have javascript enabled! Please enable it!

Dr Geofrey Davis, Interviewee William Davis (Son of Dr Geofrey Davis) (ভিডিও)

ডা. জিওফ্রে ডেভিস ও মুক্তিযােদ্ধা বীরাঙ্গনারা

ডা. জিওফ্রে ডেভিস অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বটে কিন্তু যুদ্ধের পরপরই যুক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের আরেক ধরনের যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বাঙালি নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। যাদের বাংলাদেশ সরকার বীরাঙ্গনা অভিধায় ভূষিত করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর বড় সমস্যা ছিল নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা প্রদান। যুদ্ধ শিশুদের পুনর্বাসন, বীরাঙ্গনাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ করে সমাজে ফিরিয়ে আনা। এক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন লন্ডনের পপুলেশন সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কতজন ধর্ষিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপর আমরা নানা হিসাব পেয়েছি। এখন হিসাবটা চার লক্ষে দাঁড়িয়েছে। ডা. ডেভিসও এই সংখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যক ধর্ষিতার কথা বাইরে পৃথিবীতে জানাজানি হলে তখন বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার ডা. জিওফ্রে ডেভিসকে বাংলাদেশে পাঠায়। তিনি বাংলাদেশের আনাচেকানাচে ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন।

এক সাক্ষাৎকারে তখন তিনি জানিয়েছিলেন

“প্রশ্ন : তারা নারী ধর্ষণের ব্যাপারটা কীভাবে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে?

জেফ্রি : ওরে বাপস! তাদের ওপর টিক্কা খানের এক প্রকার আদেশ বা নির্দেশই ছিল যে, একজন সাচ্চা মুসলমান তার বাবা ছাড়া আর সবার সঙ্গেই লড়াই করবে। কাজেই তাদের যা করতে হবে তা হলাে যতটা পারা যায় বেশি সংখ্যক বাঙালি নারীকে গর্ভবর্তী করা! এটাই ছিল তাদের কাজের পেছনের তৎকালীন সরকারি কর্মচারীরা যে হিসাব দিয়েছেন, ডা. ডেভিস জানিয়েছিলেন তা ঠিক নয়। তিনি বলেছেন, “সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশের জেলাওয়ারি হিসাব করেছেন। সারা দেশের ৪৮০টি থানা ২৭০

দিন পাক সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে দুজন করে নিখোঁজ মহিলার সংখ্যা অনুসারে লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ। এই সংখ্যাকে চূড়ান্তভাবে নির্ভুল অঙ্করূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।” ডা. ডেভিস মনে করেন এই সংখ্যা ৪ লাখ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতাে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, ধর্ষিতা ও নির্যাতিতদের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। নিউজ উইকের একটি প্রতিবেদনের কথা ধরা যাক উদাহরণ হিসেবে। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর পত্রিকাটি লিখেছিল, মুক্তিবাহিনীকে দমন। করার নামে কিছুদিন আগে পাক সেনারা ডেমরা নামে এক গ্রামে অভিযান চালায় (যেখানে মুক্তিবাহিনী আদৌ ছিল না)। তারা ১২ থেকে ৩৫ বছরের সমস্ত মহিলাদের ধর্ষণ করে এবং গুলি করে মারে ১২ বছরের বেশি বয়সের সমস্ত পুরুষদের।

ডা. ডেভিস এ পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন- 

“প্রশ্ন : পাকিস্তানের অসংখ্য নথিপত্রে এখনও বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অত্যন্ত বাড়িয়ে বলা হচ্ছে আপনি কি তাদের এ দাবি সত্য মনে করেন?

জেফ্রি : না, না…তারা ধর্ষণ করেছে। সম্ভবত তারা প্রকৃতই যা করেছে, তার তুলনায় অনেকগুণ কম সংখ্যা দাবি করা হয়। তারা যে পদ্ধতিতে শহর দখল করতাে তার বিবরণ খুব কৌতূহলােদ্দীপক। তারা তাদের পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গােলন্দাজ বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসতাে। তারপর হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ গােলা ছুঁড়ে গুঁড়িয়ে দিতাে। এর ফলে শহরে নেমে আসতাে চরম বিশৃঙ্খলা। আর তারপর পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে মেয়েদের বেছে বেছে আলাদা করতাে। শিশুরা ছাড়া যৌনভাবে ম্যাচিওরড সকল মেয়েকে তারা একত্রে জড়াে করতাে। আর শহরের বাকি লােকজনকে বন্দি করে ফেলতাে পদাতিক বাহিনীর অন্যরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হতাে। আর তারপর মেয়েদের পাহারা দিয়ে কম্পাউন্ডে নিয়ে এসে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হতাে। অত্যন্ত জঘন্য একটা ব্যাপার ছিল এটা। বিশ্বের কোথাও কখনও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায় না। তবুও, এমনটাই ঘটেছিল।” 

হঁ্যা, যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রামে তাে পাকিস্তানি সৈন্যরা যায়নি। কথাটা ঠিক, ৬৪ হাজার গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা যায়নি, কিন্তু যেসব গ্রামে গেছে সেখানেই মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। এখানে যে একটি প্যাটার্ন ফুটে, তাহলাে গ্রামে গ্রামে তারা সুনির্দিষ্টভাবে। মেয়েদের জন্য হানা দিচ্ছে, শহরাঞ্চল থেকে মেয়েদের উঠিয়ে নিচ্ছে, সে এক ভয়াবহ অবস্থা। অনেক জায়গায় রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়েছে। ধর্ষিতা নারীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করেছে, মেরে ফেলা হয়েছে। একটি অংশের পরিবার পরিজন ধর্ষণের কথা কখনও স্বীকার করে নি সামাজিক কারণে। ফলে, সঠিক সংখ্যা কখনও জানা যাবে না। সরকারি কর্মচারীরা তখন নানাবিধ কারণে ধর্ষিতার সংখ্যা কম করে দেখাতে চেয়েছে। এর পেছনে যে মানসিকতা কাজ করেছে তাহল এক ধরনের অপরাধবােধ। কারণ, এই মেয়েদের রক্ষার দায়িত্ব আমরা যে কোনাে কারণেই হােক পালন করতে পারিনি। অনেকের কাছে এটি লজ্জার বিষয় মনে হয়েছে। এই মানসিকতার সমাজতান্ত্রিক কারণ কী তা আমি জানি না। যে কারণে, এখন নারী ধর্ষণের বিষয়টি পারতপক্ষে কেউ আলােচনায় আনতে চান না

ও ডা. ডেভিস আরও উল্লেখ করেছিলেন, “হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেওয়ার সময় যে সব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব রক্ষণে সরকারি রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনি অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিতা তরুণীদের অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রােগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে নয়তাে হত্যা করা হয়েছে।”

সামগ্রিকভাবে কিন্তু সমাজ ধর্ষিতাদের সানন্দে গ্রহণ করেনি। অধিকাংশ নারী সূচিকিৎসা পাননি। যারা পরিত্যাজ্য হয়েছেন তাদের বেঁচে বর্তে থাকা ছিল মুশকিল। কাউন্সেলিং হয়নি। অধিকাংশই রােগাক্রান্ত অবস্থায় ভুগেছেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। স্বাধীনতার পর পর ডাক্তারদের উচিত ছিল ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের স্বেচ্ছায় সুচিকিৎসা দেওয়া। কিন্তু তারা তা দেননি, দিতে চাননি আইনের অজুহাত দেখিয়ে। ডা. ডেভিস তখন প্রায় ১০০০ ডাক্তারের এক সম্মেলনে তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন- “এই সব অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভপাত আইনসম্মত করার জন্য সরকার বিশেষ আইন প্রবর্তন করেছেন বলে অধিকাংশ বাঙালি ডাক্তারই বিশ্বাস করেননি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস কর্তৃক বারবার আশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের দ্রুত অবনতিশীল সমস্যার সমাধানে সাহায্য করার চাইতে বাঙালি ডাক্তাররা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন।”

ডা. ডেভিস বলেন, “একটি সেমিনারে তাকে ৯০ ভাগ প্রশ্ন করা হয়েছিল কর্মসূচিতে বৈধতা সম্পর্কে, বাকি ১০ ভাগ প্রশ্ন আমি যে টেকনিক সম্বন্ধে বক্তৃতা করি সে সম্পর্কে।”

অনেক নির্যাতিতা/ধর্ষিত মহিলা আত্মহত্যা করেন যার নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ডা. ডেভিস জানিয়েছিলেন, জানুয়ারি-১৯৭২ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে সব মহিলা আত্মহত্যা করেন তাদের আত্মীয়স্বজন তা জানাননি। কারণ যদি তদন্ত হয়। 

ডা. ডেভিস সেই সব দুঃখজনক ঘটনার কিছু উল্লেখ করেছেন। যেমন-ক্যাম্পে যে সব মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের নগ্ন রাখা হতাে। “হতভাগা বন্দি নারীদের যখনই শাড়ি পরতে দেওয়া হয়েছে তখনই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বুকে পাথর বেঁধে পুলের ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন তেমন হাজার হাজার মহিলা তাদের পরিবার কর্তৃক পরিত্যাক্ত হয়েছেন।…বর্তমানে দেখতে ‘অপরিচ্ছন্ন। এ ধরনের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক।”

তবে এ বিষয়ে সংগঠিতভাবে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের লন্ডন অফিস। যেসব বিদেশি সংস্থা এক্ষেত্রে সহায়তা দিতে চেয়েছিল তাদের সহায়তা সংহত করে কর্মসূচি গ্রহণ করে প্ল্যানড প্যারেন্টহুড। তারা নির্যাতিতাদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাঠায় বাংলাদেশ। এ রকমই একজন হলেন ডা. জিওফ্রে ডেভিস। তিনি শুধু ডাক্তারের নৈর্ব্যক্তিক মন দিয়েই বিষয়টিকে দেখেননি, মানবিকতার দিক থেকে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনা করেছিলেন। একা সেই সময় তিনি যে কাজ করেছেন তা তুলনাহীন। বাংলাদেশের মানুষ এখনও তাকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

বাংলাদেশের বিজয়ের পরই গণহারে ধর্ষণের বিষয়টি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। শুধু মানবিক নয়, সামাজিক-রাজনৈতিকও। যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল বেঁচে থাকা। যে কোনাে গণহত্যা, ব্যক্তি হত্যা, বন্ধু পরিচিতজনের হত্যার খবর শােনার পর মনে হতাে, আরে আমি তা বেঁচে আছি। তখন, ধর্ষণের ঘটনা শুনছি, মনে হয়েছে হত্যা থেকে। সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি সবারই কম বেশি মনে হয়েছে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন থেকেই দেখা গেল, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চার লক্ষও যদি ধর্ষিত হয়ে থাকে তাহলে চার লক্ষ পরিবার সরাসরি বিপর্যন্ত। কিন্তু এ দেশে একটি পরিবার মানে তাে শুধু পিতামাতা আর সন্তানই নয়, চাচা, ফুফু, মামা এবং জ্ঞাতি ভাইবােন সবাই। পরােক্ষভাবে বিপর্যস্ত। তাহলে সংখ্যাটি কী দাঁড়ায়?

সমাজ, রাষ্ট্র এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সমাজে এক দিকে ছিল ঐতিহ্য ও ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন, যুদ্ধও যা ধ্বংশ করতে পারেনি। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রায় অনুপস্থিত। সরকার কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে তাও বুঝতে পারছে না । কিন্তু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর যে বিষয়টি গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে তা সবাই বুঝতে পারছিল। ডা. ডেভিসের সংবাদ সম্মেলন-যার ওপর ভিত্তি করে বাংলার বাণী একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল যা এক্ষেত্রে প্রণিধানযােগ্য

“দখলদার আমলে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ধর্ষিত বাংলাদেশের মহিলাদের একটা বিরাট অংশ বন্ধ্যাত্ব ও পৌনঃপুনিক রােগের সম্মুখীন হয়েছে বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক মতপ্রকাশ করেছেন।

সিডনির শল্য চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস সম্প্রতি লন্ডনে বলেন যে, ৯ মাসে পাক বাহিনীদের দ্বারা ধর্ষিতা চার লাখ মহিলার বেশির ভাগই সিফিলিস অথবা গনােরিয়া কিংবা উভয় ধরনের রােগের শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশ ইতিমধ্যেই ভ্রুণ হত্যাজনিত অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তিনি বলেন, এরা বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারেন কিংবা বাকি জীবনভর বারবার রােগে ভুগতে পারেন। ১. ড. ডেভিস বলেন, বাংলাদেশে কোনাে সাহায্য এসে পৌছাবার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের ফলে দুই লাখ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাগরিষ্ঠাংশ স্থানীয় গ্রামীণ ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল দিক থেকে গর্ভপাত কর্মসূচি সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু মহিলাদের কঠিন সমস্যা এখনাে রয়ে গেছে। 

ডা. ডেভিস বলেন, আমরা বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কে অবগত হবার আগেই অনিবার্য ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির চাপে দুই লাখ ধর্ষিতার মধ্যে দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মহিলা গর্ভপাত করেছেন। ডা. ডেভিসের মতে দীর্ঘ মেয়াদী জটিলতা খুবই গুরুতর । বেশ কিছু সংখ্যক তরুণী যৌন মিলনের উপযােগী না হওয়ায় সমস্যা বেশি জটিল হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্ভাগা মহিলারা যদি রােগের চিকিৎসা লাভে সক্ষমও হন তবুও তাদের বিয়ে করার মতাে কোনাে একজনকে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর।”

সামাজিক সমস্যা প্রকট করে তুলেছিল যা বিস্তারিতভাবে ডেভিস উল্লেখ করেছেন যৌন রােগ এবং অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি। পুনর্বাসন কেন্দ্রের ক্লিনিকে যারা গেছেন তাদের কিছু গর্ভপাত করতে পেয়েছিলেন অধিকাংশই পারেননি দেখে ক্লিনিকে এসেছিলেন গর্ভপাত করাতে। একজন মাত্র গর্ভজাত সন্তানকে রাখতে চেয়েছিলেন। সবার গর্ভপাত সম্ভব হয়নি। তাদের সন্তান যুদ্ধশিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু ছয় লক্ষের মধ্যে কয়জন ক্লিনিকে আসতে পেরেছিলেন? সুসান ব্রাউনমিলার জানাচ্ছেন, এ সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি হবে না।

কলকাতার মাদার তেরেসা যুদ্ধশিশু গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন । পুনর্বাসনের জন্য অনেক মহিলাকেও গ্রহণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তেমন সাড়া পাননি। যুদ্ধশিশুদের যারা বিভিন্ন কেন্দ্রে স্থান পেয়েছিল তাদের পাশ্চাত্যের অনেক পরিবার দত্তক নিয়েছিলেন। তাদের অনেকে আবার এখন বাবা-মার খোঁজে এ দেশে এসেছেন। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র সহায়তা পেয়েছিল প্যারেন্ট হুডের। তারা ঢাকা শহর ও অন্যান্য জায়গায় ১৭টি ক্লিনিক খুলেছিলেন। খােলার পর প্রথম মাসেই ঢাকা ক্লিনিকে ১০০ জনের গর্ভপাত ঘটানাে হয়েছিল।”

কিন্তু কতজন আর ক্লিনিকে আসতে পেরেছেন। অধিকাংশই ছিলেন গ্রামীণ কিশােরী। কখনও বাবা-মা, কখনও মুক্তিযােদ্ধা, কখনও গ্রামের সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি যারা ক্লিনিকের কথা শুনেছিলেন তারা নিয়ে এসেছিলেন। ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, অনেক নবজাতককে হত্যা করা হয়েছে ইঁদুর মারা বিষ খাইয়ে বা পানিতে ডুবিয়ে। অসংখ্য আত্মহত্যা করেছেন। হাজার পাঁচেকের মতাে বিভিন্ন উপায়ে গর্ভপাত করাতে পেরেছিলেন মাত্র। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ডা. জিওফ্রে ডেভিসকে মরণােত্তর মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করে।

Reference: ভিনদেশিদের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসির মামুন, pp. 54-60

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!