বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই ডিসেম্বর, বুধবার, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনসাধারণের সহযোগিতা
গত সোমবার ফরিদপুর বার লাইব্রেরী হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনজীবীদের এক সমাবেশে ভাষণদানকালে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন যে, সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই জনগণের জন্য স্থায়ী সুখ নিশ্চিত করা যাবে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বিশেষ জোর দিয়ে বলেন যে, দেশ আইনের দ্বারাই শাসিত হবে এবং আইন ও বিচার সংক্রান্ত ব্যাপারে কাউকেই ব্যক্তিগত প্রভাব খাটাতে দেওয়া হবেনা। আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা এমন হবে আইন তৈরি করুন যাতে তার অপব্যবহারের কোন সুযোগ না থাকে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের সহযোগিতা ও আইনের অপব্যবহার করা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি যে বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। আইনের ব্যবহার প্রয়োগ এ দু’টো বিশেষভাবেই জনগণের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা ভিন্ন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভব নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপও নেওয়া যায় না। তবে এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি আইন প্রণেতাদের যে কথা বলেছেন সে সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করে দেখতে হবে। পাকিস্তানী শাসনামলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো এবং তা যেভাবে প্রয়োগ করা হোত তাতে দেশের শতকরা নব্বুই ভাগ মানুষের পক্ষেই সুবিচার পাওয়া ছিলো সুদূর পরাহত।
আইনের জটিলতা, বিচার বিভাগের জটিলতা সব মিলিয়ে তখন বিচারের বাণী নিভৃতেই কাঁদতো। কিন্তু এখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে৷ স্বাধীন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাতে আইনের আশ্রয় লাভ করে নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় দিন কাটাতে পারে।
রাষ্ট্রপতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের যে সহযোগিতার কথা বলেছেন সেই সহযোগিতা করতে জনগণ সব সময়ই যে, প্রস্তুত রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে সবার সেই প্রশ্নই উত্থাপিত হবে, যে আইন বর্তমানে পরিচালিত সে আইনের রদবদল না করলে জনগণের পক্ষে সুবিচার পাবার সম্ভাবনা কম। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, পুলিশ আর আদালতের নাম শুনলে জনগণকে ভয় পায়। ইচ্ছা থাকা সত্বেও সহজে কেউ আদালতের দুয়ারে ধর্ণা দিতে চায় না। আর একই কারণে চোখের সামনে কোন অন্যায় ও অসঙ্গত ঘটনার জন্ম হতে দেখেও সহজে সাধারন মানুষ তার প্রতিবিধানের জন্য পুলিশকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন না। সুতরাং এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েই বলবো, এমন ভাবে আইন তৈরী করতে হবে যাতে তার অপব্যবহারের সুযোগ না থাকে।
গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হচ্ছেটা কি!
গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর একটি সপ্তাহও নির্বিঘ্নে গেল না। গত ৩রা ডিসেম্বর সন্ধ্যে ৬টা থেকে বিদ্যুৎ স্টেশনের সাত মেগাওযয়াটের পানির পাম্পে বেয়ারিং জলে পাঁচটি জেলার শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে শিল্পোৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। এই ঘটনা দুঃখজনক ও আকস্মিক হলেও এর পেছনে বক্তব্য আছে। জানা গেছে, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ স্টেশনে ৬০ মেগাওয়াটের যে ইউনিট রয়েছে, তাতে গোলযোগ দেখা দেবার পর ছোট ছোট পুরানো ইউনিটের মাধ্যমে ২৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিছুদিন আগে এই ২৫ মেগাওয়াটের একটা ছোট ইউনিট নষ্ট হয়ে যায়। তারপর লোডিং-এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ মেগাওয়াট। এর ফলেই ৭ মেগাওয়াটের পানির পাম্পের বেয়ারিং জ্বলে যায়। এই ২৫ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রটি মাত্র এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয়েছিল। এখন একটি মাত্র গ্যাস ইউনিট দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এটি যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদি এটিও ভেঙ্গে যায়, তাহলে সারা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।
যে পুরানো ইউনিট দিয়ে কোন মতে কাজ চালানো হচ্ছিল তাতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ পাওয়া যেত ৩৩ মেগাওয়াট। তার চেয়ে বেশী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলেই ইউনিটটিতে গোলমাল দেখা দিত।
বিশেষজ্ঞমহলের মতে যথাযথ সময়ে ইউনিটটি যদি মেরামত করা হ’ত তাহলে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করলেই চলতো। কিন্তু এখন এর মেরামতের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ৫০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
তথ্য সূত্রে যা জানা গেছে তাতে মনে হয়, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট মহলের যথেষ্ট গাফিলতি ও উদাসীনতা আছে। খুলনাসহ পাঁচটি জেলার (যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী) দৈনন্দিন জীবন যাত্রা এবং শিল্প উৎপাদনের ক্ষয়-ক্ষতিতে যেন উক্ত মহলের কিছু এসে যায় না। পরিতাপের বিষয়! লক্ষ্য করা গেছে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সবচেয়ে অবহেলিত দিকগুলির একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রসমূহ। পত্রিকান্তরের খবরে প্রায়ই এ নিয়ে অভিযোগ, অনুযোগ এবং প্রতিবিধানের আবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফল কি হয় তা সবাই জানেন।
অপরদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের গোলযোগের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে স্থায়ী তা একটা স্থায়ী ক্ষত রেখে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে দেশের অগ্রগতি ও উন্নতির পথে তা একটা বিরাট অন্তরায়। যাইহোক, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থা এখন এত শোচনীয় যে, এর একটা বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে উক্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। জনজীবন এবং জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকিয়েই এখন ঐ প্রকল্পটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহলের শুভচেতনা জাগ্রত হোক, এই আমরা চাই।
সোনার বাংলা গড়ার আদর্শ
সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে জোড়পুষ্করিণী গ্রামের লোকদের কোন অভাব নেই। তারা অন্যান্যদের মত কোন প্রকার রিলিফ বা সাহায্য চায় না। তারা চায় ফসল ফলানোর জন্য সার, কীটনাশক দ্রব্য ও নলকূপ। কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর তত্ত্বাবধানে জোড়পুষ্করিণী এলাকার জনগণ সমবায় সমিতি গড়ে তুলে উন্নত প্রথার চাষ বাস শুরু করেছে। ফলে পূর্বে এই এলাকার জনগণকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাস করে যেখানে ‘জাউ’ খেয়ে জীবন ধারণ করতে হতো সেখানে প্রতিটি কৃষকই সচ্ছল হয়ে উঠেছে। এখন আর তাদের কোন অভাব নেই।
গত সোমবার স্থানীয় একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায়, সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত প্রথায় চাষের ব্যবস্থা হওয়ার দরুন ১৯৬৫ সনে এই এলাকায় যেখানে মাত্র ৬৭ একর জমি চাষ হতো সে স্থলে বর্তমানে চাষ হচ্ছে ২৪০ একর। ক্রমান্বয়ে চাষাবাদের জমির পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদনের হারও পূর্বের চাইতে বেড়ে গেছে। ১৯৬৮ সনে প্রতি একরে উৎপাদিত ১৫ মণ আউশ ও ৩০ মণ বোরো ধানের স্থলে বর্তমানে একর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে আউশ ৩২ মণ এবং বোরো ৬০ মণ। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে তারা যে ঋণের অর্থ দিয়ে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেছিলো- নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়েও বর্তমানে তারা সে ঋণের সিংহভাগ পরিশোধ করতে সমর্থ হয়েছে।
সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ আধুনিক চাষাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। সমবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সুতরাং বাংলাদেশের আবহাওয়া জলবায়ু, নির্ভর যে সমাজতন্ত্র সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার আহ্বান এসেছে সেই সবুজ বিপ্লবকে সফল করে তুলতে হলে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য। এই উন্নত পদ্ধতিতে প্রতি কৃষকের পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে চাষাবাদ করা নানা দিক থেকে অসুবিধাজনক। স্বতন্ত্রভাবে যেটা অসুবিধাজনক সমবায়ের ভিত্তিতে তা একেবারেই সহজসাধ্য। জোড়পুষ্করিণী গ্রামের জনগণ সেই কথাটাই পুনরায় সত্য বলে প্রমাণ করেছে নিজেদের শ্রম এবং বাস্তব কর্মসূচির মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে, ঠাকুরগাঁয়ের একটি গ্রামের একটি সমবায় সংস্থাও নিজেদের প্রচেষ্টায় তাদের গ্রাম থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষি কাজের জন্য গ্রামে গ্রামে নলকূপ এবং অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণের কর্মসূচী অনুসারে বহু সংখ্যক কৃষক নলকূপের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে দরখাস্ত করেছে। গ্রাম গ্রামান্তরে থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, তারা সে নলকূপ ও সার ইত্যাদি ঠিকমতো পাচ্ছেনা। সংশ্লিষ্ট বিভাগও পর্যাপ্ত সংখ্যক নলকূপের অভাবে তা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু প্রতি গ্রামে যদি সমবায় সমিতি গঠন মাধ্যমে সেই সব নলকূপসহ উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় বীজ, সার ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়, তাহলে সবুজ বিপ্লব সাধনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ ত্বরান্বিত হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক