বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১০ই ডিসেম্বর, সোমবার, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
বিশ্ব মানবাধিকার দিবস
আজ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার পঁচিশতম বর্ষপূর্তি দিবস। সত্য, ন্যায় নীতি ও মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং প্রতিষ্ঠার জন্য আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে জাতিসংঘ এগিয়ে এসেছিলেন। মানবাধিকার ঘোষণার পঁচিশতম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশ্বশান্তি সংসদ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্যে মোজাম্বিক, এঙ্গেলো ও গিনি বিসাউ-এ পর্তুগীজ উপনিবেশবাদীদের সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে এবং চিলিতে প্রগতিশীলদের পাইকারিভাবে নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল প্রগতিশীল ও শান্তিপ্রিয় জনগণকে সংগ্রাম জোরদার করার আবেদন জানিয়েছে।
বিশ্বশান্তি সংসদ সায়গনের কারাগারে নির্যাতিত দু’লাখ রাজবন্দির মুক্তি এবং গ্রীস, স্পেন ও পর্তুগাল এবং অন্যান্য ধনবাদী দেশে মানবাধিকার ঘোষণা লংঘনের দাবি করেছে। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বিশ্বশান্তি সংসদ যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়েই আমরা বলবো- বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বিশেষ করে ধনবাদী দেশগুলোতে মানবাধিকার পদে পদে পদদলিত হচ্ছে। কাগজপত্রে মানবাধিকারের কথা বলা হলেও বর্ণবৈষম্য, শোষণ ও শাসনের ষ্টিম রোলার চালিয়ে সমাজের বৃহত্তর সংখ্যক মানুষকে নির্যাতন, নিপীড়ন ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়াতে নীল রক্তধারী ব্যক্তিরা সাদা চামড়ার আড়ালে থেকে কালো চামড়ার মানুষগুলোকে ঠেলে দিয়েছে একেবারে নীচুতলায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের জন্য কোন সুবিচার নেই, নেই কোন ন্যায় নীতি বা অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাগিজে কলমে অধিকার দেওয়া হলেও কৃষ্ণাঙ্গদের গুলী করে অথবা প্রকাশ্য স্থানে গলায় দড়ি বেঁধে মারা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন হানাদার বাহিনীর হাতে অশেষ নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেছে। হানাদার বাহিনী ‘মানুষ চাই না মাটি চাই’ বলে যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে ছিলো তাতে প্রাণ দিয়েছে ৩০ লক্ষ নর-নারী। ৪ লক্ষেরও বেশি মা-বোন হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন। এতদ্বসত্ত্বেও জাতিসংঘ এগিয়ে আসেননি। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেওয়া হয়নি যে, বাংলাদেশের গণহত্যা চলছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। এ অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা বলবো, বিশ্ব মানবাধিকারের ঘোষণা যাতে শুধুমাত্র কাগুজে ঘোষণায় পরিনত না হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে জাতিসংঘকে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাস্তবায়িত করার জন্য নিতে হবে বাস্তবসম্মত ও সুদুরপ্রসারী পদক্ষেপ।
গ্রাম-বাংলার কলেরা-বসন্ত নিরোধ প্রসংগে
সম্প্রতি গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহ থেকে মারাত্মক কলেরা ও বসন্তের প্রাদুর্ভাব ও প্রাণহানির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে, শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা এ রোগে শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারানোর ঘটনাই বেশি। ফলে, গ্রাম-বাংলার বর্তমান গ্রামীণ জীবন অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যার মাঝে এখন মারাত্মক এক হতাশা ও জীবন অনিশ্চিতের ধুম্রজালে সমাচ্ছাদিত। গ্রাম-বাংলার এ কলেরা বসন্তের সমস্যা আজকের নতুন নয়। সেই এক বিস্মৃত অতীত থেকেই বহু লক্ষ লক্ষ লোক এই মারাত্মক রোগ-দানবের শিকার হয়ে অকালে বহু আগেই ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে।
কলেরা-বসন্ত নিরোধের জন্য কয়েকটি পূর্ব সাবধানতা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। এ ব্যবস্থা গ্রহণ বা এ বিধি পালনে যে কোনো কার্পণ্য হলেই কলেরা-বসন্ত বিস্তৃতি পেতে বাধ্য। সুতরাং যখনি সংবাদ আসে যে, কোন বিশেষ অঞ্চলে কলেরা-বসন্ত দেখা দিয়েছে তখনি বুঝতে হয় সেখানে এ রোগ প্রতিরোধে কতিপয় পূর্ব ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বা রোগ বিস্তারকালীন সময়ে কতিপয় স্বাস্থ্যবিধিও প্রতিপালিত হয়নি। প্রথমেই আলোচনা করা যাক কলেরা সম্পর্কে। সাধারণতঃ দূষিত আহার বা পানি গ্রহণ করলেই কলেরার জীবাণু সংক্রমিত হয়।
আমাদের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ঠিক প্রয়োজন অনুসারে চাপকল নেই বা শহরের মতো বিশুদ্ধ পাইপ-জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেই বলে প্রায়ই লোকেরা খোলা ইন্দিরার পানি, দূষিত খাল পুকুরের পানি বা নদীর পানি খেয়ে জীবন ধারণ করে। এর ওপর আছে তাদের নিজস্ব ও আঞ্চলিক স্বাস্থ্যপালন সম্পর্কে চরম কুসংস্কার, কু-অভ্যাস ও অনভিজ্ঞতা। যখন তখন অরক্ষিত বাসি খাবার খাওয়া, নোঙরাভাবে চলা ইত্যাদি বিভন্ন কারনে সহজেই কলেরা তাদের পেয়ে বসে। আবার, কলেরা হলে তার ওষুধপত্র গ্রহণ, সাবধানতা অবলম্বন ইত্যাদি সম্পর্কেও অধিকাংশেরই নানারকম কুসংস্কার, ভীতি ও নীতি-ধারণা আছে। যার ফলে, কলেরা হলেও সাধারণ গ্রামীন মরবে তবু পথ্য করবেনা।
স্বীকার করতেই হয়, এরই সঙ্গে আরো আছে তাদের শ্বাশত চরম দারিদ্র্যের অভিশাপ, গ্রামাঞ্চলে ভালো ডাক্তার বা প্রয়োজনীয় ওষুধ বা ডাক্তারখানার অভাব ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এক দারুণ হতাশা-চিত্র ও মৃত্যুর নিশ্চিত পদাঘাত। এভাবে বসন্ত রোগও আমাদের গ্রামীণ জীবনের ক্ষেত্রে সহজে নিরোধযোগ্য হলেও এক দারুণ সমস্যাসংকুল রোগ হিসেবে হিসেবে এক জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বসন্ত রোগ সাধারণতঃ একটি বিশেষ মৌসুমে বিস্তৃতি পায় এবং বাতাসই এর জীবাণু বহন করে চলে। ফলে, কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির বসন্ত দেখা দিলে প্রায়ই তা অসাবধানতার দরুণ মারাত্মক ও মহামারী হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। টিকা গ্রহণই এ রোগের নিরোধে প্রথম পূর্ব ব্যবস্থাস্বরূপ। অবশ্য টিকা নিলে এ রোগ খুব একটা সহজভাবে বিস্তৃতি পেতে পারেনা।
এর ওপর আছে, বসন্ত রোগ হবার পর কয়েকটি সাবধানতা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন। এ সব ঠিক মতো পালন না করলে বসন্ত সহজেই মারত্মক হিসেবে দেখা দেয়।
যাহোক, রাতারাতি আমাদের গ্রাম-বাংলার সমস্ত অভাব-অভিযোগ দূর করা সম্ভব হবেনা বা তাদের সর্বাধুনিক করে গড়ে তোলাও সম্ভব হবে না তা’ আমরাও স্বীকার করি। তবুও, আমাদের গ্রাম-বাংলার এই বর্তমান রোগ প্রবল অবস্থায় সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকা বা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা আমাদের কখনোই উচিত হবেনা।
তাই সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য দপ্তর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা কয়েকটি প্রস্তাব রাখতে চাই। ‘বিশেষ জরুরী ভিত্তিতে’ ও এসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আমাদের হতভাগা গ্রামীণ জীবনের এই মহারোগ-দূর্যোগে সত্যিকারে সাহায্য ও সহযোগিতার প্রাণ- আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে এসে লক্ষ লক্ষ গ্রামীণের প্রাণ রক্ষায় সচেষ্ট হবেন বলেই আমরা আশা রাখি।
নির্ধারিত রিক্সাভাড়া চালু হোক
রাজধানী ঢাকা শহরের রিক্সাভাড়া সাধারণ নাগরিকদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই রাজধানীর রিক্সাওয়ালারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে চড়া ভাড়া আদায় করে আসছে। চড়া ভাড়া নিয়েই যদি রিক্সাচালকরা তৃপ্ত থাকতো, তাহলে হয়তো রিকশাচালকরা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় সবরকম সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারতো। কিন্তু না, তা হয়নি। রিক্সাচালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে গলাকাটা ভাড়া নিচ্ছিলো একদিকে, অপরদিকে তাদের দুর্ব্যবহার ক্রমাগত ঔদ্ধত্যের সীমা লংঘন করে যাচ্ছিলো। গতকাল প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেল যে, ঢাকা পৌরসভা, জেলা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, রিক্সামালিক ও ড্রাইভার ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে আবার রিক্সাভাড়া তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা অবশ্য প্রশ্ন তুলতে পারি যে, এই নিয়ে বারবার কতোবার রিক্সাভাড়া বেঁধে দেয়া হলো। কিন্তু আমরা সে প্রশ্ন করব না। আমরা শুধু এইটুকুই দেখতে চাই যে, রিক্সাচালকরা এখন থেকে আর যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে মনগড়া চড়া ভাড়া আদায়ের জন্য কোন ওজর আপত্তি কিংবা চাপ প্রয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে এবং রিক্সা আইন অনুযায়ী প্রতিটি রিক্সাচালকের কাছেই জনসাধারণের সুবিধার্থে ভাড়ার তালিকা বইটি সংরক্ষিত থাকবে। এই নির্দেশ অমান্যকারী রিক্সা চালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাবলম্বন করা হবে এবং তাই প্রতিটি রিকশাচালককে সাত দিনের মধ্যে পৌরসভা থেকে ভাড়ার তালিকা বই সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া কোন রিক্সাচালক যদি নির্ধারিত ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তাকে আইন মোতাবেক দোষী সাব্যস্ত হতে হবে এবং রিক্সাচালনার লাইসেন্স বাতিল কিংবা একশত টাকা জরিমানা বা একসাথে দুটো শাস্তিই প্রযোজ্য হতে পারে বলে নির্দেশ প্রচার করা হয়েছে।
রিক্সার মালিকরা নতুন ও পুরাতন রিক্সার জমা হিসেবে রিক্সাচালকদের কাছ থেকে যথাক্রমে দশ টাকা এবং আট টাকা নেয়ার বৈধ অধিকারী বলে গণ্য করা হয়েছে। এই নির্দেশ কোন মালিক না মানলে আইনানুযায়ী তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশগুলো খুবই ভালো। এই সব নির্দেশ কার্যকর হবে কি হবে না, এখন এটাই আমাদের একটি প্রধান প্রশ্ন। এর আগেও রিক্সা ভাড়া বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কিছুই করা হয়নি। রিক্সা চালকরা তাদের খেয়াল খুশিমতোই যাত্রীদের হয়রানি করেছে, অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম হয়েছে।
এবার যদি এই নির্দেশ রিক্সাচালক ও রিক্সামালিকরা অমান্য করে তাহলে এই নির্দেশ নামার অর্থ খুবই খেলো হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের আশা, পৌরসভার সিদ্ধান্ত যেনো এবার থেকে নড়চড় না হয় এবং রিক্সাচালকরা এই আইন ভঙ্গ করলে যেন যথাযথ শাস্তি পায়। এর অন্যথা হলে, যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ লাঘব হবে, এ আশা এক দুরাশায় পরিণত হতে বাধ্য। জেলা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের শিথিলতা যেনো এবারের নির্দেশটিও ভেস্তে না যায়, সেদিকেই আমরা তাকিয়ে রইলাম। রিক্সাভাড়া সমস্যার একটা চূড়ান্ত বাস্তবায়নই আমরা মনেপ্রাণে কামনা করি।
এবার যদি এ সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে তা কোনদিন হবে বলে বিশ্বাস করতেও আমাদের কষ্ট হয়। অতএব, নির্ধারিত হারে রিক্সাভাড়া চালু হোক, জনসাধারণ দূর্ভোগের হাত থেকে মুক্তি পাক, এটাই আমরা দেখতে চাই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক