পাক বেতার বেশ সংবাদ বানিয়ে চলেছে
নিজস্ব প্রতিনিধি
রামতারণ থােবা নাকি ফিরে এসেছে, পাকিস্তান রেডিও বলছে। রামতারণ হিন্দু। অতএব, সংখ্যালঘুদের ফিরে আসা সম্পর্কে জেনাঃ ইয়াহিয়া খানের আশ্বাসে যে সাড়া পাওয়া গেছে রামতরণ তারই এক দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার ভূমিকা নেপথ্যেই থেকে গেল। ছােট্ট একটি নাটিকা হল পাকিস্তান রেডিওতে রােববার (২৭৬-৭১)। কোন এক পরিবারে-এক নটী, এক নট, একটি কিশাের ও আর একটি তরুণ নটকেই মঞ্চে দেখা গেল বা রেডিও মারফৎ শােনা গেল।
একটি নাটিকা
নট খুব গম্ভীর গলায় হিন্দুস্থানের কারসাজির কথা বলছিল নটীকে : হিন্দুস্থান চিরকাল পূর্ববাঙলাকে কলকাতার হিন্টারল্যান্ড রাখতে চেয়েছে, আজও রাখতে চায়; তাই এবারও গােলমাল বাধিয়ে পূর্ব বাঙলাকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। এখনাে তাই ওরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আন্তরিকতায় বিশ্বাস করে না। উদ্বাস্তুদের বিভ্রান্ত করে চলেছে। ওদের উদ্দেশ্য, উদ্বাস্তুদের উপলক্ষ্য করে পূর্ব বাঙলাকে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা; তাই তাে উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এমন সময় কিশাের নট এসে বলল, সে ধােবাকে কাপড় জামা দেবে। নটী বলল, দাও যেগুলাে নােংরা আছে। তরুণ নট এসে বলল, এগুলাে কাচা। কিশাের বলল, তােমার কাচায় বড় মামার হবে না। রামতারণ ধােবা এসেছে, তাকে দিতে হবে। সবাই চমকে উঠল। রামতারণ এসেছে? হ্যা, এসেছে, এসে বলছে, একি? ঘরবাড়ী দেখি যেমনটি ছিল তেমনটি আছে। এতক্ষণে নট, বলল, থাকবে না? তবু হিন্দুস্থানের আকাশবাণী প্রচার করে চলেছে, হিন্দুদের বিষয় সম্পত্তির দলিলপত্র নাকি সব পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। অথচ প্রেসিডেন্ট যে প্রেস নােট দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট আশ্বাস আছে।
নটী জানতে চাইল, প্রেস নােটটা কি। নট পড়ে শােনালাে।এমন সময় কিশাের নট আবার প্রবেশ করে বলল, জানাে, রামতারণ বলছে, সেখানে নাকি খুব কষ্টে ছিল। তরুণ নট ফোড়ন কেটে বলল, ওদের নামে যে রেশন নেওয়া হত, তা স্বেচ্ছাসেবকরাই লুটে নিত; কিছু বললে, মারপিট করত, বলত, যা পাচ্ছি তাই ঢের। বলল, পালিয়ে এসেছে, বেচেছে। এসে দেখে সব ঠিক। | নট বলল, থাকবেই তাে; ওদের মিথ্যা প্রচারে তাে বেঠিক হবে না? তা, তোমরা দুটিতে যাচ্ছ কোথায়? ওরা বলল, রামতারণ ওর বাড়ীর পেয়ারা খেতে ডেকেছে। অর্থাৎ রামতারণের বাড়ী তাে বটেই, পেয়ারা গাছে একটা অবধি পেয়ারা খােয়া যায়নি। এমন সময় নটী ডুকরে কেঁদে উঠল, তার ‘ইয়ে এখনও ফিরল না, নট খনিকটা ফ্যাচফ্যাচানির মধ্যে আশ্বাস দিল, আসবে। সবাই আসবে। তারপর সেই গান :-ফেরার সময় হল এবার-ফিরে এস আপন ঘরে-এমন করে পরের ঘরে থেকো নাআর অনাদরে। আম পেকেছে জাম পেকেছে ইত্যাদি। মঞ্চে রামতারণে আবির্ভাব ঘটেনি, তার একটা নকল গলাও শােনা যায়নি। তার আগের দিন (শনিবার, ২৬-৬-৭১), মঞ্চস্থল ঐ পরিবারই। তাতে এই সংলাপ ছিল। ওরা সব দলে দলে ফিরে আসছে। কারা?
যারা সব শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছল। এল কি করে? কেন ট্রেণে, লঞ্চে। তবে যে ওসব শুনছি নেই? ওসব আকাশবাণীর মিথ্যে প্রচারণা। তাই বল। এখানে ওখানে যে দুটো একটা সাঁকো ভেঙে গেছল তা মেরামত হয়ে গেছে। তা ওরা গায়ের অবস্থা কেমন বলল? কেন, স্বাভাবিক। গায়ের মধ্যে দুষ্কৃতকারীরা যাতে কিছু করতে না পারে, হিন্দুস্থানী অনুপ্রবেশকারীরা আসতে না পারে এজন্য শান্তি কমিটি চেষ্টা করছে; সবাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে। বহু লােক ফিরে আসছে।এমন সময় কিশাের নটটি এসে বলল, দেখ, কি সুন্দর ম্যাপ এঁকেছি। কিসের ম্যাপ? পূর্ব পাকিস্তানের। বাঃ, কি সুন্দর! নট বলল, এবার পশ্চিম পাকিস্তানেরটাও এঁকে ফেল। মামাকে বলল, ভুচিত্রাবলী থেকে তাকে গােটা পাকিস্তানের ম্যাপ আঁকা শেখাতে। নট বলল, আঁকলে একটা চমৎকার প্রাইজ দেবে।
নট আরও খবর দিল, ই-পি আর । বি আর ওরা সব আত্মসমর্পণ করছে। নটী বলল, তা একটা ভুলের জন্য তারা দলত্যাগ করে থাকবেই বা কেন? নট বলল, প্রথম হাজার দুই আত্মসমর্পণ করেছিল। বুঝতে পেরেছে ভুলের পেছনে ঘুরে মরার কোন সার্থকতা নেই। গােলমালের সময় চলে যাওয়া ৯০০ গৃহত্যাগী সাতক্ষীরায় এসেছে। কুমিল্লায়ও এসেছে অনেক। সংলাপ চলতে লাগল। নানা ছল-ছুতােয় ওরা এদেশের মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে, ওদের দেখিয়ে কাড়ি কাড়ি সাহায্য কুড়াচ্ছে, তার ১০০ ভাগের এক ভাগও উদ্ধাস্তুদের ভােগে লাগছে না। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এসে পড়ছে ভারতে এবং তা যাচ্ছে অফিসারদের ট্যাকে, যাদের জন্য তারা কিছু পাচ্ছে না। এরপর শরণার্থী শিবিরগুলােতে অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনার জন্ম হ’লওদের বন্দী করে রাখা হয়েছে, এক শিবির থেকে আর এক শিবিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। খাওয়া দাওয়ার মধ্যে এক বেলা খিচুরী। ট্রেনিং নিতে না চাইলে নির্যাতন চালাচ্ছে।নটী বলল, অথচ এখানে ওদের জন্য কীনা করা হচ্ছে।
কূটনীতিক বিনিময়
কূটনীতিক বিনিময় নিয়ে রেডিও তাদের কথা অনবরত মিথ্যা প্রচারনা চলেছে এবং সব দোষ হিন্দুস্থানের ওপর চাপাচ্ছে। অন্য কোন দেশ বাধা দিচ্ছে না বলে হিন্দুস্থান ধরাকে সরাজ্ঞান করছে এবং রাষ্ট্রসঙ্গের প্রস্তাব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করছে। তবে জাতিসঙ্রে প্রতি ভারতের অবজ্ঞা কিছু নতুন নয়। কাশ্মীরে গণভােট সম্পর্কে নেহরু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়েছেন, তাঁর তনয়াও তাই করছেন। কূটনীতিক বিনিময় যদি কোন পরিণতির দিকে যায় তবে তার দায়িত্ব ভারতের। বিভিন্ন আসরের মধ্য দিয়ে ভারত বিদ্বেষের একটা অবিচ্ছিন্ন সুর ধ্বনিত হচ্ছে পাকিস্তান রেডিওতে প্রতিদিন। পল্লী আসরে কথা হল : গত সাধারণ নির্বাচনে আমরা আশা করছিলাম যে, অর্থনৈতিক অবস্থার এক সুরাহা হবে।
কিন্তু ভারত ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দের পরাজয়ে পাল্টা নেবার পথ খুঁজছিল; এবার তারা তাই বিচ্ছিন্নতাকামীদের সঙ্গে মিলে গােলযােগ সৃষ্টি করে। ফলে বহুলােক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। আজ যখন সব সামলানাে গেছে, কাজকর্ম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, ওরা ফিরে আসছে। যােগযােগ ব্যবস্থা পূর্বের মতই অক্ষুন্ন আছে। হাজার হাজার লােক যাতায়াত করছে। ১৮ই জুন পাক সরকার অত্যান্ত সহানুভূতির সঙ্গে মিলমজুরদের কাজে যােগ দিতে বলেছেন, যারা পারেনি তারা ৩০ এ জুন অবধি যােগ দিতে পারবে। ঘােষক। বলল, অবিলম্বে সকলকে কাজে যােগ দানের জন্য আহ্বান জানাই। আসুন আমরা ১৯৬৫ সালের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতীয় হানদারদের সমুচিত শিক্ষা দিই।
কৌতুকের শেষ নেই
ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট বরাবর যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তারও ইতিবৃত্ত বলা হয় এবং গােলমালের জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতের প্ররােচনাকে দায়ী করা হয়। দৈনিক পত্রিকা থেকে যেসব উদ্ধৃতি দেওয়া হয় তাতেও বলা হয়, ভারতের জঙ্গীনীতি এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত করছে। ভারতে নাকি দেড় লক্ষ মুসলমান নিহত হয়েছে। যাই হােক, পাকিস্তান তার সার্বভৌম অধিকারে হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। সাম্রাজ্যবাদী ভারতবর্ষের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি।
Reference:
১ জুলাই ১৯৭১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা