You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে জুলাই, বুধবার, ৭ই শ্রাবণ, ১৩৮১

বিশেষ ক্ষমতা আইন সংশোধনী বিল

বিশেষ ক্ষমতা আইন সংশোধন করে একটি বিল পাস হয়েছে সংসদে। নতুন বিলে নাশকতামুলক কাজ, মুদ্রা ও সরকারি চোরাচালান, মজুতদারী, কালোবাজারি এবং খাদ্য-পানীয়, ঔষধে ভেজাল দেয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এইসব অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করবে। সেই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি যোগ্যতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত আপিল ট্রাইব্যুনালেই আপিল করা যাবে।
বিলটিকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন সংশোধনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। গত ত্রিশ মাসে যাদের লাগামহীন অশুভ তৎপরতার ফলে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক এটা আপামর দেশবাসীর দাবি। পুরনো উপনিবেশিক আইনে এদের চরম শাস্তি দানের কোন বিধান ছিল না। তাই সে আইন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সকলেই উপলব্ধি করে আসছিলেন। সংসদের পূর্ববর্তী অধিবেশনে তাই প্রণীত হয়েছিল বিশেষ ক্ষমতা আইন। আজ সেই আইন পাস হওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই দেখা দিয়েছে সে আইনের সংশোধন করে আরো কঠোর বিধান সংযোজনের। আইনমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রবর্তিত হবার পর সমাজদ্রোহীরা আরো শক্তিশালী হয়েছে, তাই প্রয়োজন অনুসারে আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। তিনি অবশ্য বলেছেন যেদিন এই আইনের প্রয়োজন থাকবে না তখনই তা প্রত্যাহার করা হবে।
এই আইনের প্রয়োজনীয়তা কতদিন থাকবে আর কতদিন থাকবে না সে বিতর্কে না গিয়ে ও বলা চলে গত ৩০ মাসেই মন্ত্রীমহোদয়ের শাসনামলে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে আইনের বাধন শক্তের পর শক্ত করার পরও সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা অধিকতর সংঘটিত হয়ে উঠেছে, সমস্ত অর্থনীতিটই তারা গ্রাস করে ফেলেছে। অথচ এতদিন সেই ঘৃণ্যতম ‘ক্লিক’ -এর বিরুদ্ধে সরকার তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
সংসদে বিরোধীমনা সদস্যরা এই আইনের অপপ্রয়োগ হবার আশঙ্কা প্রকাশ করে ‘ওয়াক আউট’ করেছেন। তাদের অভিযোগ ‘স্বাধীনতার পর থেকে সমাজ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়া হলেও এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যারা এইসব সমাজবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তাদের সবাই চেনে, কিন্তু কোনো শাস্তি তাদের দেওয়া হয়নি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এগুলো রোধের জন্য দেশের প্রচলিত আইন থাকা সত্বেও তা কোনদিন প্রয়োগ করা হয়নি।’
বিরোধী সদস্যদের এই আশঙ্কা এবং অভিযোগ স্বয়ং আইনমন্ত্রীও উড়িয়ে দিতে পারেননি। তিনি ও স্বীকার করেছেন পূর্ববর্তী আইন সমূহ ‘ভালোভাবে’ প্রয়োগ করা হয়নি। করা হলে অবস্থার উন্নতি হতো বলে তিনি নিজেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
স্বয়ং আইনমন্ত্রী যখন বিগত দিনসমূহে প্রচলিত আইন ‘ভালোভাবে’ প্রয়োগ হয়নি বলে স্বীকারোক্তি করেছেন তখন ভবিষ্যতেও কোনো আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ হবে কিনা সে নিয়ে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হবে বৈকি! এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে চিহ্নিত সমাজদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আইন কার্যকরী করে জনগণের প্রাথমিক আস্থা অর্জনের। বিগত ৩০ মাসে আইন সঠিকভাবে প্রয়োগের অভাবে জনগণের যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। জনসাধারণ যখন নিশ্চিত হবে যে তাদের স্বার্থে সরকার গণদুশমনদের নির্মূল করার ব্যাপারে আন্তরিকতার নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তখনই কেবল তাদের সন্দেহ সংশয়ের অবসান ঘটবে। বর্তমান নৈরাজ্য এবং হতাশাজনক অবস্থা অতিক্রমের জন্যই এর প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের আস্থা সম্বল করে জনস্বার্থবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তীব্রতর অভিযান পরিচালনা করার। অতীত ব্যর্থতাকে কবর দিয়ে সরকার সেই পথেই অগ্রসর হোন–এটাই দেশবাসীর আশা।

লবণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা

নোনাপানির উপকূলবর্তী বাংলাদেশে লবণের সঙ্কট–কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু তবুও বাস্তব সংবাদ হচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকেই লবণের বাজার গরম। দেড় টাকা থেকে তিন টাকা সের দরে দেশের বিভিন্ন স্থানে লবণ বিক্রি হচ্ছে এবং পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জামালপুরে ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা মণ দরে লবণ বিক্রি হচ্ছে এবং নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে ৯৫ টাকা মণ দরে লবণ বিক্রি করে মেমোতে লিখে দিচ্ছে ৫৫ টাকা। ঢাকার খোলাবাজারেও লবণের দাম ন্যায্য নয়। কয়েক সপ্তাহ থেকে কিছু কিছু রেশনের দোকানে কার্ডে লবণ সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানা যায়।
উল্লিখিত বিবরণের দ্বারা লবণ সংকটের বাস্তবতাই স্বীকৃত হচ্ছে। কিন্তু তা কতটা সত্য সেটিও বিচার্য বৈকি। একথা অনস্বীকার্য যে, লবণ এমনই দ্রব্য যাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি সংশ্লিষ্ট মহলসূত্রে রেশনে লবণ সরবরাহ করার কথা ফলাও করে বলা হয়–তাতেও সমস্যা দূর হবে না। কারণ রেশন দেশের শতকরা কতজন লোকে পায়? গ্রাম অঞ্চলসহ মফস্বল শহরে যেখানে পূর্ণ রেশন সরবরাহ করা সম্ভব হয় না, সে ক্ষেত্রে কার্ডের লবণ পাবার আশা তারা স্বাভাবিকভাবেই করতে পারেনা। খোলাবাজারের তিন টাকা সের বা তদূর্ধ্ব হলেও তাদের লবণ না কিনে উপায় থাকবে না। অথচ বিশেষজ্ঞ মহলের স্পষ্ট ধারণা বর্তমানের লবণ সংকট একান্তভাবেই কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট। অসাধু ব্যবসায়ী এবং কতিপয় স্বার্থান্ধ ব্যক্তিরাই এজন্য দায়ী।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগে পত্রিকান্তরে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল এ বছর বাংলাদেশের লবণ উৎপাদনের ঘাটতি দেখা দেবে। এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, বহু কাল থেকেই বাংলাদেশ লবণ শিল্পে স্বয়ম্ভর ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে তো ছিলই এমনকি ব্রিটিশ শাসনের আমলেও বাংলাদেশের লবণ উৎপাদন পর্যাপ্ত ছিল। উপকূলীয় দেশ হিসেবে এদেশের কিছু সংখ্যক উপকূল অঞ্চল বাসি শুধুমাত্র লবণ উৎপাদনের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। জীবন যাত্রার মান বজায় রাখার তাগিদেও তাই লবণ উৎপাদনে ঢিলেমি করার কোনো যৌক্তিকতা ওদের পক্ষ থেকে থাকার কথা নয়।
অগত্যা লবণ সংকট এর একটি কারণ দর্শানো যায়। তাহলো পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃংখলা। তবে একথা নিশ্চিত যে এই অজুহাতে দিয়ে লবণ সংকটকে সমর্থন করা বাতুলতা। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বেশ কয়েক দফায় লবণ নিয়ে তেলেসমাতি কারবার করার প্রয়াস পেয়েছে স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী মহল। লবণ মজুদ করে অপপ্রচার করে এবং অকস্মাৎ লবণের দাম বাড়িয়ে দিয়ে তারা অসদুপায় মুনাফা লুটবার সুযোগ সন্ধান করেছে। কিন্তু অচিরেই মুনাফাখোরদের সেই দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রয়াসকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তৈরি তৎপরতায় রোধ করাও সম্ভব হয়েছিল। লবণ সরকার যে কৃত্রিম এবং লবণের স্বল্পতার সংবাদ যে ভিত্তিহীন লবণ পরিস্থিতি স্বাভাবিককরণেই তার প্রমাণ দিয়েছে। তবুও দেখা যাচ্ছে বারবার মজুতদার ও মুনাফাখোরের দল লবণের মত সাধারন অপরিহার্য একটি দ্রব্যকে কেন্দ্র করে মুনাফা খাওয়ার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারছে না। আপাতদৃষ্টিতে লবণের অভাবকে ক্ষুদ্র ভাবলেও বোঝার উপর শাকের আঁটির মতোই বিপর্যস্ত জনজীবন লবণের কৃত্রিম সঙ্কটকে ক্ষুন্ন ও বিপর্যস্ত বোধ করছে।
দেশে আজ সমাজবিরোধীদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশের আইন পাস হয়েছে। পাপের ছোট বড় ভেদ থাকলেও পাপকে পাপই বলা হয়। তাই লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কারীদের আমরা সমাজবিরোধী বলেই চিহ্নিত করছি। লবণ সংকটের কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে যদি উৎপাদন ঘাটতির কারণ পাওয়া যায় তবে অবিলম্বে তার ব্যবস্থা নেয়া হোক। আর যদি মানুষী অপক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়, তবে নয়া আইনের দণ্ড তাদের মাথায় প্রথম নেমে আসুক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!