বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২১শে জুলাই, রোববার, ৪ঠা শ্রাবণ, ১৩৮১
সাইপ্রাসের বিপন্ন স্বাধীনতা
ভূমধ্য সাগরের ছোট দ্বীপ সাইপ্রাসকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র জট পাকিয়ে উঠছে। সেখানকার আইনানুগ সরকারের প্রধান আর্চবিশপ ম্যাকারিয়াস এখন নিউইয়র্কে। যাবার পথে তিনি লন্ডনে থেমেছিলেন। সেখানে কথা হয়েছে ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের সাথে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী সাইপ্রাসের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখানে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। সিষ্কো ইতিমধ্যেই গোপন বৈঠক করেছেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহানের সাথে কথা হয়েছে।
স্বস্তি পরিষদের বৈঠকে ম্যাকারিয়াসের ভাষণ দেওয়ার কথা। ঐ একই বৈঠকে সাইপ্রাসের সামরিক জান্তার প্রতিনিধি ও যোগদান করবেন। তার কাছ থেকে তথ্যাদি পাওয়া যাবে বলে জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সুযোগও দিয়েছে। এদিকে সাইপ্রাসের ম্যাকারিয়াসের সমর্থক এবং প্রগতিশীল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে অকথ্য নির্যাতন চালানোর সংবাদ পাওয়া গেছে। নয়া সামরিক জান্তা চাইছে সাইপ্রাস এর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে। এ কারণে বিরোধী সকল শক্তিকে নির্মূল করার পরিকল্পনা তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে বৈঠক করে চলেছে।
সবাই বলছে সাইপ্রাসের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেয়া চলবে না। অথচ কেউ কেউ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সেখানকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র সাইপ্রাসের স্বাধীনতা রয়েছে এবং সেখানে কোন বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ করেনি।
সাইপ্রাসের ঘটনাবলী অত্যন্ত পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ। সেখানে অবস্থানরত গ্রিক সামরিক অফিসারদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল গার্ড সরকারের নির্দেশক্রমেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়াসকে উৎখাত করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য সাইপ্রাসের অন্তর্ভুক্ত করা অথবা তার উপনিবেশে পরিণত করা। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই অভ্যুত্থানের নায়করা একজন নৈতিকতা বর্জিত সাইপ্রিয়টকে ক্ষমতায় বসিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এসব কিছু জানে না তা নয়। তার গরজ বড় বালাই। গ্রিসে রয়েছে তার শক্ত সামরিক ঘাঁটি আর ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সামরিক দিক থেকে গ্রিস এর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই দেশের সামরিক জান্তা বিব্রতবোধ করেন অথবা বিক্ষুব্ধ হন এমন কোন কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সিস্কো তাই লন্ডন থেকে ফেরার পথে আঙ্কারা এবং এথেন্স একবার ঘুরে যাবেন। তার লক্ষ্য থাকবে যাতে সাইপ্রাসকে কেন্দ্র করে তুরস্ক এবং গ্রিস কোন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। এমনি তালবাহানা করে যদি কিছুটা সময় কাটানো যায় তবে হয়তো সাইপ্রাসের নয়া সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত টিকে যাবে, আর দুনিয়ার লোক একদিন ম্যাকারিয়াসকে ভুলে যাবে।
গত পরশু বাংলাদেশ সরকার সাইপ্রিয়টদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র রক্ষায় প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়াসের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ম্যাকারিয়াস জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তাছাড়া সাইপ্রাসে গ্রিক এবং তুর্কি বংশোদ্ভূতদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় ও তাঁর অবদান রয়েছে যথেষ্ট। এমতাবস্থায় সাইপ্রাসের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র অক্ষুন্ন রাখতে ম্যাকারিয়াসের প্রয়োজনেই এখন সবচেয়ে বেশি। আমরা দুনিয়ার গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আহ্বান জানাব তারা যেন সাইপ্রাসের নয়া সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। আজ হোক কাল হোক সাইপ্রাস থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত গুটাতেই হবে।
খাদ্যশস্য চুরি!
মুখের আহার চুরি করে এক শ্রেণীর চোর দিব্যি মুনাফা লুটছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশের কয়েকটি গুদাম থেকে ৬ হাজার ৯ শত ৭৬ মণ ২৭ সের খাদ্য শস্য চুরি হয়েছে। এসব খাদ্যশস্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁও, হালিশহর, দেওয়ান হাট, খুলনা সি,এসে,ডি গোডাউন; খুলনা পোর্ট ও নারায়ণগঞ্জ ঘাট এবং চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও আশুগঞ্জ সাইলো গোডাউন থেকে চুরি হয়েছে। এবং উল্লেখিত স্থান থেকে খাদ্যশস্য চুরির দায়ে দোষী কর্মচারীদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
নিঃসন্দেহে এসব দুঃখজনক এবং লজ্জার খবর। খাদ্য চুরির কথা আজ নয়–বেশ কিছুদিন আগেই ফাঁস হয়েছিল। তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু তার আর পর জানা যায়নি । শুধু তাই নয়–বিভিন্ন উপায়ে অথচ সংঘবদ্ধভাবে সুপরিকল্পনা চালিত ভাবে খাদ্যশস্য চুরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনগুলোতে তথ্য দেয়া হতো। কখনো গোডাউন ভেঙে, কখনো বা ওয়াগনের সিল করা দরজার মধ্য থেকে, কখনো বন্দর থেকেই চুরির মাধ্যমে ব্যাপক খাদ্যের অপচয় করা হয়েছে। আবার কখনোবা হাজার হাজার মণ খাদ্যশস্যের হিসেব মেলাতে না পেরে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ইঁদুরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে। অপরদিকে প্রকৃত ঘটনা চাপা পড়ে গেছে। দোষী ব্যক্তিরা সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছে (মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী) এবং নামকাওয়াস্তে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার পরের খবর আর আমরা জানতে পারিনি।
বলাবাহুল্য, কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় সবটুকু আমরা খাদ্য আমদানি করে থাকি। বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংস্থান করতে বাংলাদেশকে সারাবছর বহু অর্থ ও শ্রম ব্যয় তো করতেই হয়, তদুপরি কোটি কোটি মানুষের মুখের আহার জোটানোর দাবিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে প্রয়োজনবোধে উন্নয়ন পরিকল্পনা গুলিকেও সংক্ষিপ্ত করতে হয়। তার উপর আছে পেটের ধান্দা জনিত নিদারুণ অস্থিরতা ও অশান্তি। তাই এত কষ্ট সংগ্রহ করা খাদ্যশস্য চুরি করাকে আমরা গর্হিত অপরাধ বলেই আমরা গণ্য করি। আমাদের মতে জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির হননকারী বলে তাদেরকে চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। আমরা জানি, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি থাকে দুর্বল। তারই প্রেক্ষিতে চোরাচালানী, মজুতদারী ও ভেজালকারীরা পাষণ্ডের মত আত্মস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অগণিত জনগণের দুর্দশাকে বর্ধিত করছে। এদেরই দোসর হলো খাদ্যশস্যের চোরেরা। সবাই মিলে যদি দেশের সার্বিক অবস্থাকে ফুটো কলসির মত করে ফেলে তাহলে একা সরকারের পক্ষে যুগ যুগ ধরে ফুটে কলসিতে অমৃতের জোগান দেওয়া কোন মতেই সম্ভব নয়। তা সে যে দেশের এবং যত শক্তিশালী সরকারি হোক না কেন। অতএব দেশের সর্বনাশা শত্রুদের আজ সমূলে উৎপাটন করতে হবে। নির্মম সত্য বিচারের গুরুদন্ডে এদেরকে দণ্ডিত করতে হবে। যা দেখে পাপো প্রবন ব্যক্তিদের মনে ত্রাসের সঞ্চার হবে। কথায় বলে–‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’ তাদের জন্য চাই লাঠ্যেষি ধর্ম। এবং দেশের সর্বত্র কল্যাণের সাথে আজ পাপীদের উপর যদি রোজকেয়ামত নেমে আসে–তাতে সৎলোকের তো ভয় পাবার কোন নেই। ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা স্মরণে রেখে অতএব দেশের শত্রু যারা নানাপ্রকার দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের দেশকে ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করেছে তারা এইবেলা সতর্কতা হবে বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক