You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩শে জুন, সোমবার, ৯ই আষাঢ়, ১৩৮১

মহিলা সমবায় সমিতি

মহিলা সমবায় সমিতির প্রথম জাতীয় মহাসম্মেলন গত পরশুদিন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনী ভাষণে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন-‘দেশের সার্বিক অগ্রগতি নির্ভর করে গোটা জনশক্তি সমষ্টিগত কর্মপ্রচেষ্টার উপর। পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজকে উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত থেকে বিপুল জনশক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন-‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে কি করে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল করা যায় সমবায় তা আমাদের শিখিয়েছে। সমবায় কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা এই যুগে বিশেষ করে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন-‘সমবায় ব্যবস্থার সাফল্যজনক প্রয়োগে জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে ও প্রগতিশীল অর্থনীতির দ্বার উন্মোচন করতে সহায়ক হবে।’ মহিলারা আলাদা কোন সমাজ জীব নয়। তারাও দেশের সম-অধিকারের দাবিদার। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দ্বারা পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করে মহিলা সমাজকে সমবায় মাধ্যমে জাতীয় জীবনে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দান করতে হবে। তাহলেই মহিলারা সমাজে স্বীয় মর্যাদাবোধের অধিষ্ঠিত হতে পারবেন। সমবায়ের মাধ্যমে কুটির শিল্প স্থাপন করে মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার যে প্রস্তাব মহিলা সমবায় সমিতির রেখেছে তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার যথাযথ সহায়তা প্রদান করবেন বলে শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। মহিলা সমবায় সমিতি গঠন হবার বেশ কিছুদিন পরে এই মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। দেশি-বিদেশী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কর্মসূচি একটি অত্যন্ত প্রগতিশীল আন্দোলন বলে সমাজে বিবেচিত। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সমবায় আন্দোলন গড়ে তোলা অত্যন্ত আবশ্যক। শুধু তাই নয় মেহনতী মানুষের ঐক্যবদ্ধ শ্রমদান যদি সমবায়ের মাধ্যমে দেশের প্রগতির জন্য কাজে লাগানো যায় তাহলে উন্নয়ন অনেক বেশি ত্বরান্বিত হবে বলে সবার ধারণা। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ কারণে সমবায় মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার বেশ উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হাতে নিয়েছেন। কিন্তু সমবায় বিভাগটিকে পুরোপুরি জনগণের আদৃত বিভাগ বলে প্রতিপন্ন করাতে কর্তৃপক্ষ শৈথিল্য প্রদর্শন করেছেন। সেকারণে সমবায়ের মাধ্যমে সুতা বন্টনের প্রশ্নটিই দেশের মানুষের সামনে নানা প্রশ্নের কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সমবায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বন্টন ও উৎপাদন কাজ করার মূল লক্ষ্যটি ছিল অত্যন্ত সাধু। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তা রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বস্তুতঃ মহিলা সমবায় সমিতি একটি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে বলে মনে করি। মহিলাদের একত্রিত করে কিছু উপাদান মূলক কাজ অংশগ্রহণের একটা সদিচ্ছা এই সমিতির রয়েছে। বিভিন্ন কুটির শিল্প হস্ত তৈরি জিনিসের কারখানা প্রভৃতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের মত কিছু আবশ্যকীয় কাজ সমবায়ের মাধ্যমে করার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা কার্যকরী হলে দেশের উপকার হতে পারে। মহিলা সমবায় সমিতি একটি আদর্শ বা জনগণের সম্মান অর্জনের উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক এটাই আমাদের কামনা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক শ্রমজীবী মহিলাদের সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠান জনগণের আদৃত হোক এটাই আমরা আশা করি।

নাম ঠিকানা বিহীন শিশুরা

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। এটা প্রচলিত প্রবাদ। বাবা-মার আদরে স্নেহে তারা বড় হয়ে ওঠে। এই রীতি সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা বেয়ে এই রীতি প্রতিপালিত হয়ে আসছে। অথচ এর অন্যথা যে হয় না তা নয়। শহরে বন্দরে এমন বহু শিশুসন্তানকে নিত্যান্ত অবহেলা আর অনাদরে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। বাবা-মার হদিস মেলে না, সমাজের কোনো দায়-দায়িত্বও এদের ওপর আছে বলে মনে হয় না। অথচ আজকের এই অভিভাবকহীন শিশুরাই কাল সমাজের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দারিদ্র সন্তানকে পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এমন উদাহরণ আমাদেরই শুধু নয়, বিভিন্ন দেশেও রয়েছে। স্নেহ আর মমতাবোধ এ বিচ্ছিন্নতা অথবা দূরত্বকে আটকে রাখতে পারে না। ক্ষুদে ক্ষুদে শিশুরা তাই পৃথিবীকে জানে একাকিত্বের নির্বিকারতা নিয়ে, সামাজিক প্রয়োজনে নয় বরং নিজের বেঁচে থাকার মুখ্য চিন্তাকে সামনে রেখে তারা জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ হলো অভিভাবক থেকেও না থাকা অনাদর আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা এক শ্রেণীর শিশু।
আরো আছে যাদের সেই অভিভাবকত্বের স্বীকৃতিটুকুও নেই। তারা জানেনা কে তাদের বাবা কে তাদের মা। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদের সংখ্যা বেড়েছে। যুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণতিতে বহু সন্তান এবং তাদের জননী সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। জননী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক সন্তান খোলা আকাশের নিচে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের সামনে কোন আলোর সন্ধান নেই, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো ধারণা পোষণ করে না।
বিদেশী সৈন্যের অবস্থান যেখানে রয়েছে অথবা যেসকল মুক্তিকামী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদার বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত সে সকল স্থানে বহু নিষ্পাপ রমণীকে লালসার শিকারে পরিণত হয়ে অবাঞ্ছিত সন্তান ধারণ করতে হয়েছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে এমন হাজারো সন্তান পুত্র পরিচয়হীন অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহবরে কাল কাটাচ্ছে, থাইল্যান্ডের এদের সংখ্যার কমতি নেই। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে নতুন সামাজিক পরিবেশে অভিভাবকহীন এই শিশু সন্তানদের পূর্নবাসনে সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ পরবর্তীকালে বহু সমস্যার অগ্রিম সমাধান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে এই সকল শিশু সন্তানদের পূর্নবাসনে কিছু কিছু ব্যবস্থা গৃহীত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। আসলে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে এ দিকটা ভেবে দেখা হয়নি। নতুন দেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ব্যবস্থার ভালো ও মন্দ দুটোই হাত ধরে এগুচ্ছে। সামাজিক ব্যভিচার হ্রাস পেয়েছে এমন কথা কেউ বলবেন না। এই ব্যভিচার এবং পাপাচারের ফলশ্রুতিতে যে নিষ্পাপ শিশুকে অনাদরে পথের পাশে লেকের ধারে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় তাদের নিয়েই বা কে ভাবছে। সামাজিক স্বীকৃতি না থাকলেই তাদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব কিছু হ্রাস পায়না। মনে রাখা দরকার অভিভাবকহীন অথবা সামাজিক স্বীকৃতিহীন এই শিশুরাও সমাজের একটা অংশ। যে অংশটা আমাদেরই অবহেলায় সকল মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে বেড়ে উঠছে তারা সামাজিক কল্যাণে কতটুকু সহায়ক হবে সেদিকটা এখন থেকেই ভেবে চিন্তে দেখা দরকার।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ অথবা দু’একটি প্রতিষ্ঠানের নেক নজরে এই সমস্যার গুরুত্ব এতটুকু লাঘব করা যাবে না। এর জন্য সার্বিক একটা পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকার কি সে প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দেবেন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!