বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১০ই জুলাই, বুধবার, ২৬শে আষাঢ়, ১৩৮১
সীমান্তে চোরাচালান
গত সোমবার জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্তে চোরাচালান সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন যে, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রংপুর জেলার বিভিন্ন সীমান্তে ২৮ চোরাচালানীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ২হাজার ১৪২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এবং এর মধ্যে ১৮২ জন কে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মাল উদ্ধার করা হয়েছে ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৭শ’ ৭৮ টাকার।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান যে, ১৯৮৩-৭৪ সালে মোট ১৩ হাজার ৩শ’ ৩৯ জন চোরাচালানকারী ও মজুতদার ধরা হয়েছে। এরমধ্যে ৬ হাজার ৮শ’ ৪৮ জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে পর্যন্ত যশোর, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর ও কুমিল্লা সেক্টরে সীমান্ত চোরাচালানের সময় মোট ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫শ’ ৫৮ টাকা ৫৭ পয়সা মূল্যের মালামাল উদ্ধার করা হয়। এসব চোরাচালানির সাথে জড়িত থাকায় এ পর্যন্ত খুলনা সেক্টরে ১২৩০ জন, যশোর ১২৭০, রাজশাহী ১৫৩১, সিলেট ২০৬৮, রংপুর ১৪১৪, দিনাজপুর ১৮৭৩ এবং কুমিল্লা সেক্টরে ১২৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে যে চিত্রটি উদ্ভাসিত হয়েছে তাতে বোঝা যায় সীমান্তে চোরাচালান দমনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্ততঃ এটা ঠিক যে, স্বাধীনতার পরপর সীমান্তে চোরাচালান এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল তার তুলনামূলকভাবে এখন কম। কিন্তু তবুও এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, সীমান্তে চোরাচালানির তৎপরতা এখনো পুরো মাত্রায় বন্ধ হয়নি। অথচ চোরাচালান রোধ এর উপর আজকের বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। বিভিন্ন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় সীমান্তে চোরাচালানির সেনাবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টিতে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে যাচ্ছে।
গতকালেই স্থানীয় দুটি পত্রিকা সংবাদ বেরিয়েছে যে, “বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার মণ চাউল, চিনি,আটা, মাছ পাচার হয়ে যাচ্ছে।” “লাখ লাখ টাকার মাল পাচার” শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে যে, ঝিকরগাছার অন্তর্গত কলাগাছি নামক স্থানে একটি ছৈ দেওয়া গরুর গাড়ি তল্লাশি করে মানুষের পরিবর্তে ১২ বস্তা ইউরিয়া সার উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে ঝিকরগাছার বিভিন্ন এলাকায় চোরাচালানীরা নতুন পদ্ধতিতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মালপত্র সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইউরিয়া সার বাংলাদেশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৫০ টাকা আর সীমান্তের ওপারে প্রতি মণ ৭০ টাকা অর্থাৎ বাংলাদেশের টাকায় ১৪০ টাকা।
অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, গত চৌঠা জুলাই হইতে বেনাপোল বাজারের চাউল, আটা সম্পূর্ণ উধাও হইয়া গিয়াছে। ফলে বেনাপোল-বাহাদুরপুর ও পুটখালী -এই তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার অধিবাসী বিরাট দুর্ভোগের সম্মুখীন হইয়াছে।
উল্লেখিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, সীমান্তে চোরাচালানির তৎপরতা এখনো আশানুরূপভাবে হ্রাস পায় নি। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চোরাচালানিরা সাধারণতঃ ধান, চাল, পাট ও ইউরিয়া সার সীমান্তের ওপারে পাচার করতে আগ্রহী। অথচ এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ সম্পদ। বেসরকারি হিসাব মতে এ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ বেল পাট পাচার হয়ে গেছে । ধান ও চাল গেছে। ইউরিয়া সার ও যাচ্ছে। অনুমান করতে আর কষ্ট হয় না যে চোরাচালানিরা অর্থের বিনিময়ে দেশের কি সর্বনাশ ডেকে আনছে।
আলোচ্য অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, চোরাকারবারীরা সহজে বাগে আসবেনা। হুমকি-ধামকি বা কয়েকজনকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সমাজ বিরোধীদের দমন করা যাবে না। সুতরাং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হলো, কতিপয়–সমাজবিরোধী ব্যক্তির অসাধু তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এমন তো হতে পারে না। এদের দমন করতে হবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল ও কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দুর্বৃত্তদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য ফায়ারিং স্কোয়াডের বিধান প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ সুপারিশ অনুসারে সরকার যথাযথ আইন প্রণয়ন করবেন বলেই আমরা আশা করি। এবং সে আইনের আওতায় এনে সমাজবিরোধীদের ও চোরাচালান কারবারীদের নির্মূল করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই।
খাদ্য নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জন স্কেলি গত ৪ঠা জুলাই জেনেভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি খাদ্য সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য শস্যের গুদামজাতকরন ও বর্ধিত হারে খাদ্য উৎপাদনের ভিত্তিতে একটি বিশ্ব খাদ্য নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে এই নীতি প্রণীত হলেই আন্তর্জাতিক বিশ্বের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মিঃ স্কেলী উল্লেখ করেছেন যে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উন্নয়নকামী ও অনুন্নত দেশের জন্য বিশেষ উন্নয়ন তহবিল গঠনের জন্য যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা জাতিসংঘের কাঠামোর অনুরূপ আরো অনেক তহবিল রয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি মিঃ স্কেলীর এই অভিমত বিশ্বের উন্নয়নগামী দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেননা প্রস্তাবে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত রয়েছে। বিশ্বের সকল খাদ্য সমস্যায় জর্জরিত দেশগুলোর জন্য ইতোপূর্বে যে তহবিল গঠনের কথা উঠেছিল উল্লেখিত প্রস্তাবটি তার প্রতিবাদ নয় বরং সম্পূরক। উন্নয়নগামী দেশ সমূহের জন্য বিশেষ তহবিল এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে জাতিসংঘের মার্কিন প্রতিনিধি মিঃ স্কেলী খাদ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোর জন্য খাদ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রস্তাব একটি কার্যকরী প্রস্তাব বলে উল্লেখ করা যায়। বস্তুতঃপক্ষে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা আজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যকীয় ব্যাপার। এ ব্যাপারে যদি জাতিসংঘ পর্যায় কোন তহবিল বা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তাহলে তা একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। আমাদের মত উন্নয়নগামী দেশ যারা তারা এ প্রস্তাবকে অবশ্যই স্বাগত জানাবে। তবে অর্থনীতিতে তহবিল গঠনের যে প্রস্তাব ইতিপূর্বে বিবেচিত হয়েছিল তাও উন্নয়নশীল দেশের জন্য আবশ্যক। আমরা অর্থনীতি তহবিল গঠনের প্রশ্নটির সঙ্গে খাদ্য সহযোগিতা গুদামজাত ও খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্য নীতি প্রণয়ন ইত্যাদি ব্যাপারে সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানাই। এ ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমর্থন থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক