You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৯ই জুলাই, মঙ্গলবার, ২৪শে আষাঢ়, ১৩৮১

বিদেশ গমনের ওপর বিধিনিষেধ

ইচ্ছে হলেই দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না–সরকারের এটা কড়া নির্দেশ। গত পরশু বার্তা সংস্থা বিপিআই এই খবর দিয়েছে। এই নির্দেশ গতকাল থেকে কার্যকর হবার কথা। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারি এই ঘোষণা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভীষণ সংকটাপন্ন। কি দেশের অভ্যন্তরে, কি দেশের বাইরে আমাদের অর্থের যোগান অত্যন্ত স্বল্প। এই সীমিত সম্পদের মধ্যে আমাদের প্রয়োজন মেটাতে হবে । বাইরে থেকে আনতে হবে খাদ্য থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কল কারখানার কাঁচামাল স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি। এর বিকল্প কোন পথ নেই। স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সীমিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকেই জরুরি এই সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।
বিদেশ গমনের উপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রশ্নে এই কথাগুলো আসতো না যদি গত ৩০ মাসে বৈদেশিক মুদ্রা অপচয়ের নানা খবর না ছড়াতো। যারা গত ৩০ মাসে দেশের বাইরে গেছেন তারা সবাই যে অফুরন্ত বৈদেশিক মুদ্রা উড়িয়ে এসেছেন এমন কথা কেউ বলে না ঠিকই কিন্তু বেআইনি পথে মুদ্রা পাচার এবং অপচয়ের অভিযোগ কারও কারও বিরুদ্ধে করা হয়ে থাকে।
বিদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রয়োজনে এদেশ সে দেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে আমরা অস্বীকার করিনা। সরকারি কাজে দেশের স্বার্থে ও প্রয়োজন রয়েছে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। কিন্তু বিদেশে গেলেই তার বাড়িতে নতুন গাড়ি আসবে, নতুন ফ্রিজ উঠবে এমন সামর্থ কি এই পোড়া দেশের রয়েছে? সবাই বলবেন নাই, অথচ গত ৩০ মাসে নানা প্রয়োজনে তালবাহানা করে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ফিরেছেন সঙ্গে করে হরেক রকম জিনিস।
এছাড়া অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এই বিদেশ যাত্রীদের অনেকে মুদ্রা পাচার করায় নিয়োজিত থেকেছেন। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় রকমের কালোবাজার গড়ে উঠেছে। রয়েছে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশটির প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নানা শক্তির অশুভ তৎপরতা। এরা দেশীয় নানা গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের অশুভ লক্ষ্য হাসিলের জন্য তাদের ব্যবহার করছে। বাইরে থেকে তারা আসছে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যের নাম করে। এদেশীয় এজেন্টরাও বিদেশে গিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করছে।
আমরা বলি না অশুভ এসকল তৎপরতা বন্ধ করার জন্য সরকারের নির্দেশে যথেষ্ট। নানা ফোকর গলিয়ে যে এর পরও কেউ কেউ বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে না তা নয়। দেশ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গণবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুব শীঘ্রই কঠোরতম ব্যবস্থা গৃহীত হতে যাচ্ছে। এ সম্পর্কিত সুপারিশ আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ সভায় গৃহীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তা বাস্তবায়নে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে চলেছেন। এসব কিছুর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশ গমনের উপর বাধানিষেধ আরোপ করে বঙ্গবন্ধু নিজে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার গুরুত্ব দেশবাসীর সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আমরা আহবান জানাবো দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই নির্দেশ বাস্তবায়নে যত্নবান হোন।

বন্যা দুর্গতদের সাহায্য

সর্বগ্রাসী বন্যার নির্মম জনজীবনে নেমে এসেছে অকথিত ভোগান্তি। তাদের সাহায্যের জন্য গতকাল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ভগবতী জেলা পর্যায়ে প্রশাসক কর্তৃপক্ষকে দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্বেও বন্যা ক্লিষ্ট জনগণের যাতে কোন কষ্ট না হয়, সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেন। তিনি বন্যা ক্লিষ্ট জনগণকে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের নিশ্চিত আশ্বাস দেন।
নদ-নদীর দেশ আমাদের বঙ্গভূমি। বলতে গেলে নদী-নালা এদেশকে বেষ্টন করে আছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, প্লাবনে দেশের উপকূলীয় জীবনের নিত্য সঙ্গী। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বরূপ শুধুমাত্র বন্যাতেই এদেশের জনসাধারণের জীবনসহ কোটি টাকার ফসল ও মালামাল ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর আদিমতম অসহায় প্রাণীর মতোই উপকূল অঞ্চলের অগণিত মানুষ ততোধিক অসহায় ভাবে বন্যা পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে আজো। মানবতার সেই করুন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ত্রাণ মূলক কাজ করার জন্য আবেদন নয়–নির্দেশ দিয়েছেন।
আমরা জানি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামনে বহুতর সমস্যা আছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এমনি একটি সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রতিবছরই বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ গুলো আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ।
আমাদের বর্তমান অবস্থায় বন্যার ছোবল খেতেই হবে। অতএব সেই বিপদকে সামনে রেখেই সর্তকতা এবং ত্রাণকার্য এই দুটোর দিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। দলীয় বা নির্দলীয় অথবা সরকারি-বেসরকারি বলে কোন কথা নয়–এ আমাদের জাতীয় সমস্যা। অতএব সমাধানের দায়িত্ব আমাদের পরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ন্যস্ত। যদিও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ সরকারি পর্যায়ে সীমাবদ্ধতা, তথাপি মনে রাখতে হবে মানবতার স্বার্থে ঘোষিত এই নির্দেশ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সবার উপরে বর্তেছে।
পত্রিকান্তরে মাধ্যমেই দেখেছি–গত কয়েকদিনের বন্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি কত দ্রুত অবনতির দিকে গেছে। সিলেটের বনাম সিলেট সদর মহকুমা, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এর অধিকাংশ অংশ প্লাবিত হয়েছে। ব্যাপক ফসলহানি এবং শতকরা ৮০টি ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। কোথাও কোথাও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ১৫টি থানার ১৫ লক্ষ লক্ষ লোক আশ্রয়হীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রংপুরের বন্যার ১৫টি থানার ১০ লক্ষ লোক আশ্রয়হীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও শতকরা ৮০ টি ঘর বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। পাবনায় পাঁচটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া ময়মনসিংহ, বগুড়া ও নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সমগ্র বন্যা দুর্গত এলাকায় প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এবং দুর্ঘটনার ইতিমধ্যে মহামারীর প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আর্তমানবতার সেবায় যখন সবারই ঝাপিয়ে পড়া উচিত, তখনও আমরা দেখি বিরোধী দলের নেতাদের স্লোগান–সর্বস্ব আন্দোলন সমানতালে চলছে। শহরের নিরাপদ এলাকায় বসে তারা ধর্মঘট, আন্দোলন, আইন অমান্যকরণ ইত্যাদি তৎপরতা চালান। আমরা বিশ্বাস করি মানবতার স্বার্থ উপেক্ষা করে যে দল যত কথাই বলুক–তার দ্বারা সুদুরপ্রসারী কোন স্থায়ী কল্যাণ অর্জিত হয় না। দেশের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাই বিরোধী দলের ভূমিকায় আমরা হতাশ হয়েছি।
আমরা জানি বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ‘এই আওয়ামী লীগ’ ও বিরোধী দলীয় রাজনীতি করতো। দেশবাসী এ কথা স্মরণ করতে পারে যে, সেদিন দুর্গত মানবতার সেবায় তারা যথেষ্ট সক্রিয় ও উদ্যোগী ছিল। সরকারি আদেশ, নির্দেশ বা অনুরোধ-উপরোধ মূলক আবেদনের তোয়াক্কা না করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা গঠন করে দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে তারা দাঁড়াত। এবং সার্বিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা যথেষ্ট অবদানও রাখত।
সেদিন যেমন একথা সত্য ছিল আজও তেমনি সত্য যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার দায়িত্ব সকলেরই। সেই কোন আদি যুগে প্রকৃতিকে মানুষ বশ করেছিল মানবতার বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেই। আজও সেই কথা স্মরণ করে প্রকৃতির নির্মমতাকে রুখতে হবে। এখানে দল মতের কথা গৌণ–মানবতার প্রশ্নটি মূখ্য। একথা বুঝিয়ে বলাটাও তো দুর্ভাগ্যের কথা!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!